অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ২৫

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ২৫
ইফা আমহৃদ

নিজের ডান হাতটা বক্ষের বাম পাশে অবস্থান করছে। অন্য হাতটা শূন্যতায়। দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম। চোখের পাতা দুটো স্থির খাদের দিকে। চোখের অশ্রু টলটল করছে। কিয়ৎক্ষণ নীরব দৃষ্টিতে অনুভূতি হীন চেয়ে করলো। অপূর্বের কাঁধে হাত রেখে অন্য হাতে অপূর্বের হাত ধরলো। মৃদু শব্দে বলল,

-” আমার বোনটাকে দেখিস অপু।”
অপূর্বের মুখ কদাচিৎ ফাঁক হয়ে এলো। কিন্তু শব্দটি উচ্চারণ করার আগে অরিশ ঝাঁপ দিলো খাদে। বোধশক্তি হারিয়ে ফেলেছে সে। অনুভূতি শূন্য হয়ে ধপাস করে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো অপূর্ব। তার বোনটাকে রক্ষা করতে এসে, ব্যর্থ হলো সে। অরিশের শেষ উক্তিটি ভেবে নিজেকে সংযত করে রাখল। আরশির কথা মস্তিষ্কে সচল হতেই খুঁজতে উদ্বেগ হলো।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

রেসকিউ টিম আরশিকে জ্ঞানহীন অবস্থায় উপরে তুলে নিয়ে এলো। পাহাড়ের উপরে শুইয়ে রাখল তাকে। ভীত হয়ে হিতাহত জ্ঞান হারিয়েছে সে। অপূর্বের ফট করে উঠে বসলো। আরশির মাথাটা নিজের কোলের উপর রাখল। গালের উপর মৃদু শব্দে চপল মেরে বলল,

-” আরু, এই আরু! কিছু হয়নি তোর, এই তো আমি দেখ।” রেসকিউ টিমের মেন লোকটির দিকে চেয়ে বললো,
“কি হয়েছে ওর। খুকি, আমার খুকি কোথায়? ওকে পাননি?”
-” স্যরি স্যার, আমাদের পৌঁছানোর পূর্বেই তিনি রশি ছিঁড়ে পড়ে গেছেন। আমরা তাদের খোঁজার চেষ্টা করব। তবে এতো উঁচু পাহাড় থেকে পড়ে গেলে কেউ বাঁচতে পারে না। কিন্তু..

“বাঁচতে পারে না” কথাটা তীরের ন্যায় বুকে আঘাত হানলো অপূর্বের। নিজের সামলে আহত স্বরে বলে,
-” কিন্তু, কিন্তু কিসের অফিসার?”
-“পাহাড়ের ঐ পাশের দিকটায় ঘন বন জঙ্গল। পাহাড়ের পাদদেশে পলি সঞ্চিত হয়ে সমতল ভূমির সৃষ্টি হয়েছে। সেখানে অসংখ্য গাছ গাছালি রয়েছে। সেখান থেকে পাহাড়ের উচ্চতা বেশি নয়। তাই বেঁচে থাকার সম্ভাবনা অনেকটাই বেশি।”

অপূর্ব চোখ জোড়া গ্ৰথণ করে শান্তির তৃপ্তিকর শ্বাস ত্যাগ করলো। অরিশ তার ছোট্ট বোনটাকে নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসে। তার কোনো ক্ষতি সে হতে দিবে না। অপূর্বেরও একটা দায়িত্ব রয়েছে। অরিশ তার বোনটা রক্ষাকবচ। তাকেও আরশির রক্ষাকবচ হতে হবে।
কাঁধ ব্যাগ পানির বোতল বের করলো। ছিপি খুলে হাতের করতলে নিয়ে বিন্দু বিন্দু করে ছিটিয়ে দিলো মুখশ্রীতে।

রাত্রি গাঢ় হয়ে উঠেছে। মেঘের উপস্থিতি নেই আকাশে। চাঁদও অনুপস্থিত। তবুও শিশির ঝরে পড়ছে। গাছ গাছালির ফাঁক দিয়ে দিয়ে মাটি স্পর্শ করতে ব্যর্থ হয়েছে। পাতার ফাঁকে আঁটকে অতঃপর পাতা থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে মাটিকে পড়ছে। হিম শীতল পানি চোখের উপর পড়তেই নড়েচড়ে উঠলাম আমি। নিভু নিভু চোখ মেলে তাকাতেই গাছ গাছালির ফাঁক দিয়ে আকাশ দৃষ্টিগোচর হলো। ধীরে ধীরে উঠে বসলাম।

নিজেকে গাছের ডালের উপর অনুভব করলাম। চারিদিক নিস্তব্ধ, নির্জন, জনশূন্য হীন। ভীত হয়ে শীতল হয়ে এলো শরীর। গাছের ডাল আঁকড়ে ধরলাম। শরীরে ব্যাথা অনুভব করলাম। মাথা চেপে মিনিট কয়েক ভাবতে স্মৃতিনন্দন হলো সবকিছু। পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়া অবধি সবকিছু। বুঝতে বাকি রইল না আমি মরে ভূত হয়ে গেছি। আর যাই হোক এতোটা উচ্চতা থেকে পড়ে বাঁচা সম্ভব নয়। হঠাৎ মনের অদ্ভুত এক আকাঙ্ক্ষা জায়গা করে নিল। নিজের গ্ৰামে ফিরে দিদাকে ভয় দেখানো। দুপাশের ডাল দৃঢ় করে ধরে পা দুলিয়ে গান ধরলাম।

আহা! কী আনন্দ আকাশে বাতাসে,,
আহা! কী আনন্দ আকাশে বাতাসে।
পরবর্তী লাইন ধরার আগে দৃষ্টি গেল নিচের দিকে। জোনাকির নিভু নিভু আলোয় দেখা মিললো আবছা একজন মানবের। গাছ থেকে ঝাঁপ দিতে গিয়েও দিলাম না। যদি ভূত দেখে পৃথিবী ত্যাগ করে। আমার শত্রুতা তো দিদার সাথে, অন্য কারো সাথে নয়।

আমার কাঁধে ব্যাগ। তবে খাবারের ব্যাগ আরশির কাছে। গাছের উঁচু ডাল ধরে দোলালাম। টপ টপ করে পানি নিচে পড়তে লাগলো। সেই মানুষটির চোখ মুখেও পানি পড়ছে। একসময় জ্ঞান ফিরে পেল সে। উঠে বসলো। কিয়ৎক্ষণ জিম মেরে বসে রইল। অতঃপর এদিক ওদিক কিছু একটা খুঁজতে লাগলো। উঠে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক খুঁজলো। বলতে শুরু করল,

-” তরী, এই তরী! কোথায় তুই?”
চির পরিচিত কষ্ঠস্বর শুনে কম্পিত হলাম আমি। অরিশ ভাইয়া আমার জন্য পাহাড় থেকে ঝাঁপ দিয়েছে। কিন্তু আমি যে ভূত হয়ে গেছি। ঠোঁট উল্টে বললাম,
-” ভাইয়া।”
অরিশ ভাইয়া উপরের দিকে চাইলো। আঁধারের মাঝে চেয়ে রইলো আমার পানে। তার চোখ মুখ দেখা যাচ্ছে না। ক্লান্তিমাখা গলায় বলল,

-” তরী, কি হয়েছে তোর? ঠিক আছিস তো? গাছে উঠেছিস কেন? নেমে আয় বলছি? পড়ে গেলে হাত পা ভেঙে যাবে।
আমাকে যদি উপরে উঠতে হয়, তাহলে তোর হাড়গোড় সব ভাঙবো। গেট ডাউন কুইকলি।”
প্রথম কথাগুলো করুন শুনালো। অন্তরন কথাগুলোতে ক্ষোভ ছিলো। শেষে কি-না ভূত হয়ে মানুষের ঝাড়ি শুনছি। ইচ্ছে তো করছে, তার ঘাড় মটকে দেই। বিরবির করে বললাম,

-” হি হি হি! আমি তো মরে গেছি। ভালোই হয়েছে, বেঁচে থাকতে অরিশ ভাইয়া আমাকে প্রচুর জ্বালিয়েছে। এবার ভূত হয়ে তাকে জ্বালাবো।”?‍♀️
বলেই উপর থেকে অরিশ ভাইয়ার উপরে ঝাপঁ দিলাম। আর যাই হোক, ভূত ব্যথা পায় না। অরিশ ভাইয়া দুহাতে পেঁচিয়ে নিলেন আমায়। চেয়ে রইলেন আমার চোখে। বিলাই চোখের মাঝে শত বছরের তৃষ্ণা লুকিয়ে আছে। দম মেরে বললেন,

-” তোকে আমি যেই কাজটা করতে বারণ করি, তুই সেই কাজটাই করিস। আমাকে অসহায় করে দিস। এরপর আমার অবাধ্য হলে তোকে পানিতে চুবিয়ে রাখব। রিমেমবার ইট, স্টুপিট।”
-” তুমি আমাকে পানিতে চুবিয়ে রাখবে। তোমার আমাকে চুবানোর দরকার নেই। আমি নিজেই পানিতে ডুবে থাকবো। বিকজ, গোস্ট নেভাব ডাই।”

তাজ্জব বনে গেলেন তিনি। দুহাত ফাঁক হয়ে এলো কদাচিৎ। ধপাস করে নিচে পড়ে গেলাম আমি। ব্যাথায় কোমর টা ছিঁড়ে যাচ্ছে। আমার মুখোমুখি বসে বললেন,
-” এমনিতেই এতো উঁচু থেকে পড়ে শরীরটা ক্ষত বিক্ষত হয়ে আছে। আবার তুই না-কি ভূত। হাউ ফানি, তোর মতো অপদার্থের ভূতলোকেও জায়গা নেই।”
এতোক্ষণ বোধগম্য হলো আমি মরে ভূত হয়ে যাই নি। তাহলে গাছে কি করছিলাম।

পাশাপাশি হাঁটছি আমরা। অরিশ ভাইয়া একহাতে আমার হাত শক্ত করে ধরে অন্য হাতে ফোনের সিগন্যাল খুঁজে যাচ্ছেন। অপূর্ব ভাইয়াকে জানাতে পারতেন আমরা ঠিক আছি, সাথে তারা কেমন আছে সেটাও জানা যেত। আজকে আমাদের ফেরার কথা ছিলো।

পরিস্কার আকাশে হঠাৎ করে মেঘেরা ধরা দিলো। মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হলো। জঙ্গলের পথ কাঁদাচ্ছন্ন হয়ে গেল। আশ্রয় নিলাম তাল গাছের নিচে। আমার টেনে নিজের সাথে মিশিয়ে বললেন,
-” নড়াচড়া করিস না, ভিজে যাবি।”
কিছুটা সময় অতিবাহিত হওয়ার পরে সাদা উজ্জ্বল আলো এসে পড়লো চোখে। বেরিয়ে এলো বয়স্ক দম্পতি। ততক্ষণে বৃষ্টির ধাঁচ কমে এসেছে। বললেন,

-” তোমরা কেডা গো বাছারা। এই হানে কি করো?”
-” আমরা টুরিস্ট। এখানে ঘুরতে এসেছিলাম। পথ ভুল করে ফেলেছি আবার বৃষ্টি শুরু হয়েছে। কোন দিকে যাবো বুঝতে পারছি না।”
-” এদিকে একদম নির্জন। কিছুদূরে কয়েকটা বাড়ি ঘর আছে‌। তোমার লগে ঐ মাইয়া কেডা? বউ নি!”(বৃদ্ধ লোকটি)
অরিশ ভাইয়া কিছু না ভেবেই ফট করে উত্তর দিলো,

-” হ্যাঁ। আমার বউ। আমরা হানিমুনে এখানে এসেছি!
-” কিন্তু, মাইয়া ডারে ছোড ছোড লাগে। আবার বিয়াত্তা কোনো চিহ্ন টিহ্ন নাই।”
-” দাদা জান, আজকাল কি এইসব কেউ মানে?”
-” তাও ঠিক কইছো। তোমরা চাইলে এইহানে থাকবার পারো।”
কিন্তু বাদ সাধলেন বৃদ্ধা। কোনো প্রমান ছাড়া আমাদের বাড়িতে ঢোকাতে রাজি নয়। কটু করে বললেন,
-” আমি বলি কি, আজকাল অনেক মাইয়া পোলা পলাইয়া যায়গা। এরাও যদি পলাইয়া আইয়া থাহে। আমি কই কি, হেগো আবার বিয়া দিয়া দেন। কোনো ঝামেলা হইলে, আমরা তো প্রমাণ দেখাইবার পারমু।”

ছোট দুইজনের উপযোগী চৌকিতে বসে আছি আমরা দুইজন। বেড়ার ফাঁক দিয়ে শীতল হাওয়া বইছে। ঘরের মাঝে ল্যাম্প জ্বালানো। হলদেটে আলো সবকিছু হলদে দেখা যাচ্ছে। ইতিমধ্যে কেঁদে কেঁটে ভাসিয়ে দিয়েছি আমি। আমার খুশি হওয়ার কথা থাকলেও খুশি হতে পারছি না। বৃদ্ধা লোকটি প্রবেশ করলেন। খাতায় লিখতে বসলেন। বললেন,

– “নাম কি তোমার বাবা?”
-” অরিশ আহম্মেদ।”
-” তোমার নাম কি মা?”
দম মেরে বসে রইলাম খানিকটা সময়। পুনরাবৃত্তি করে একই প্রশ্ন করলেন তিনি। মৃদু শব্দে বললাম,-” তরিন আরাফিন তরী।”

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ২৪

খাতায় কলম চালালেন তিনি। পুনরায় মুখ খুললেন,
-” দেনমোহর কত ধার্য করব বাবা? ৯১ টাকা লিখমু?”
-” না, আমাকে লিখে দিন। যদি কখনো বিচ্ছেদের প্রশ্ন আসে, তখন দেনমোহর হিসেবে আমিই ওর কাছে থাকতে চাই।”
নীরব দৃষ্টিতে আমার পানে চেয়ে বললেন তিনি। ঘনঘন পলক ফেলে চেয়ে রইলাম তার মুখশ্রীর দিকে। চোখাচোখি হলো দুজনার। আমিও দেনমোহর হিসেবে তাকে তাই। সারাজীবনের জন্য চাই, মৃত্যুর পরেও চাই।

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ২৬