অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ২৪

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ২৪
ইফা আমহৃদ

মাথা নাড়িয়ে নৌকা চলমান করলো। আরশি তার ভেতরকার অনুভূতি থেকে এখনো বের হতে পারে নি। পুনরায় আবার হাত রাখলো। এবার মাটির সংস্পর্শ পেল না। হাতটা আরেকটু নিচে দিলো। এবারও পেল না। আরেকটু গভীরে হাত দিতেই উল্টে যেতে নিলো নৌকা। পড়ে যেত নিলো আরশি। মাঝি ছেলেটা আরশির হাত ধরতে গিয়ে ব্যর্থ হলো। বিনিময়ে চুল ধরলো। অপূর্বের দেওয়া ব্যাথার সাথে যোগ হলো। তার ধ্যান ভাঙল ছেলেটির কথায়।

-” এইটা হচ্ছে রানী পাথর আর ঐযে দেখছেন, ওটা রাজা পাথর। আমাদের বিশ্বাস এই দুই পাথর, আমাদের এই সাঙ্গু নদীকে ঘিরে রয়েছে। এই পাথরকে কিছু বললেই, নদীর গতি প্রবল হয়ে উঠে। ভয়ানক আকার ধারণ করে!”
আরশি পাথরের দিকে চেয়ে রইল নীরব দৃষ্টিতে। বড় বড় পাথর দুটির মাঝে দিয়ে নৌকা চলছে। ডানে সর্বপ্রথম রানী পাথর, অতঃপর বামদিকে রাজা পাথর। বলে,
-” এইসব কি আদোও সম্ভব?”
-” জানি না, তবে আমার বিশ্বাস। সম্ভব।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

৯টা পঁয়তাল্লিশ। নৌকা এসে থামলো দোকানের সামনে। আমরা চারজন সহ ছেলেটিও নাস্তা করে নিলাম। দুইটা পাহাড়ি কলা, একটা ডিম। অতঃপর আবার ছুটল।
বারোটা সাতান্নতে আমরা রেমাক্রি হয়ে নাফাখুম এসে পৌঁছেছি। দুপুরের খাবার খাবো মাঝি ছেলেটি পেমম্প্রোর বাড়িতে। একটু রেস্ট নিয়ে যাবো প্যারাসেলিং করতে। নাফাখুম ঝর্নার থেকে অদূরে অবস্থিত তাদের বাড়ি। বেশ ভালো লেগেছে তাদের।

আমি আর আরশি দাঁড়িয়ে আছি নাফাখুম ঝর্নার কিছুটা দূরে। স্তরে স্তরে পানি নদীতে মিশে যাচ্ছে। পানির ঝুমঝুম শব্দে শ্রবণ শক্তি লোপ পেয়েছে। আমি দাঁড়িয়ে থাকলেও আরশি বসে আঁকি ঝুঁকি করছে। সে কিছুতেই নামবে না। ইতিমধ্যে নেমে পড়েছে অরিশ ভাইয়া আর অপূর্ব ভাইয়া। তাদের পড়নে লাইফ জ্যাকেট। বাকি দুটো পাড়ে পড়ে আছে। আমি জামার উপরে পড়ে নিলাম। ওরনাটা গলায় পেঁচিয়ে বললাম,

-” আরু, আমরা আর এখানে আসতে পারবো কি-না জানি না। তবে মনে হয় না আসা হবে। জানি না তোর কি হয়েছে, তোর তো প্রবল ইচ্ছে ছিল নাফাখুম ঝর্নার ভেজার। আয়।”
আরশি গাছের শুকনো ভেজা ডাল দিয়ে মনের অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ করছে। আমার কথন শ্রবণেন্দ্রিয় পর্যন্ত পৌঁছাতেই ফিরে চাইলো। হাতের শুকনো কাঠিটা পানিতে ফেলে হাত ঝাড়া দিলো। উঠে আমার সন্নিকটে দাঁড়িয়ে স্মিত হেসে বলল,
-” খুব ইচ্ছে ছিলো। এখন আর নেই। তুই ভিজ। আয় তোকে জ্যাকেট টা পড়িয়ে দেই।”

বলেই এগিয়ে এসে জ্যাকেট পড়াতে ব্যস্ত হয়ে গেল। আমি নিঃপ্রান হয়ে চেয়ে রইলাম আরশির মুখশ্রীর পানে।
ঝাঁপ দিলাম হিম শীতল অম্বু ধারাতে। পানিতে পা স্পর্শ করে ভেসে উঠলাম উপরে। কিন্তু লাইফ জ্যাকেটের ক্রুটি থাকার কারণে মাথায় উপর দিয়ে ভেসে গেল। এমনিতেই সাঁতার জানি না। পায়ের নিচে মাটির দেখা পাচ্ছি না।

গলা ফাটিয়ে ভাইয়া ভাইয়া চিৎকার করলাম। কিন্তু আমার চিৎকার শ্রবণ হলো না কারো কর্ণপথে। অম্বুর তলদেশে চাপা আর্তনাদ গুলো চাপা স্বরে বয়ে গেল। নাক, মুখ দিয়ে অন্তর্ভাগে প্রবেশ করতে লাগলো পানির ধারা। হাত দিয়ে পানির উপরে আঘাত করে চলেছি। শরীর ধীরে ধীরে ভারী হয়ে আসছে। একসময় কেনো বলিষ্ঠ পুরুষালী হাত আমার কোমর জড়িয়ে ধরলো। পানির উপরে তুলে ধরলো আমায়। শরীরের ভার ছেড়ে দিলাম। পানির উপরে মাথা তুলতেই গভীর ভাবে টেনে নিজের শ্বাস ত্যাগ করলাম। নিভু নিভু চোখে অরিশ ভাইয়ার মুখশ্রী দর্শন করলাম। মনের কোণে সুপ্ত অনুভূতি জানান দিচ্ছে, আমি পুরোপুরি নিরাপদ। এই মানুষটির বাহুডোরে থাকলে আমার ক্ষতি অনিশ্চিত।

লাইফ জ্যাকেট টা আমায় পড়িয়ে দিলেন। সাঁতরাতে সাঁতরাতে তীরে নিয়ে এলো আমায়। উপরে তুললো আমায়। লজ্জায় মাথা নিচু করে করে নিলাম লাইফ জ্যাকেট টা খুলে নিলাম। ওরনা স্রোতের টানে ভেসে গেছে বহুদূরে। নিজের পড়নের ভেজা শার্ট টা খুলে আমার দেহে জড়িয়ে দিলো। মৃদু ঝুঁকে কোলে তুলে নিলেন। সামনের দিকে অগ্রসর হতে হতে বললেন,

-” তোর আর ভিজতে হবে না। আমার প্রান পাখিটা আরেকটু হলেই উড়ে যেত।”
দূর্ঘটনা ঘটা থেকে মুক্তি মিললেও বিপদ আমার পিছু ছাড়ল না। দুপুরের খাওয়া শেষ করে একটু রেস্ট নিয়ে অগ্ৰসর হতে লাগলাম পশ্চিমে। প্রতেকের হাতে একটা বাশের তৈরি ওয়াকিং স্টির্ক। প্রতি পদক্ষেপ ফেলার আগে মাটিতে আওড়াচ্ছে। যাতে বিষাক্ত পোকা মাখর থাকলে দূরে সরে যায়।

ঠান্ডা পড়তে শুরু করেছে। সরু পথ। সামনে অরিশ ভাইয়া, পেছনে অপূর্ব ভাইয়া। মাঝে আমি আর আরশি। আরশি ফোন উঁচু করে নেটওয়ার্ক খোঁজার চেষ্টা করছে। মামুনি ফোন করেছিলো। হ্যালো উচ্চারণ করার পর নেটওয়ার্ক লো হয়ে কল কেটে গেছে। এখন আর কানেক্ট হচ্ছে না। যতোটা পশ্চিমে যাচ্ছি ততোটা ডিসকানেক্ট হয়ে যাচ্ছে।
লাঠি এক হাতে নিয়ে অন্যহাত বড় বড় লতা টানতে টানতে শিস বাজাতে লাগলাম। আমার শিস বাজানো শুনে পাখিরা কিচিরমিচির শব্দ তুলছে, কাক কা কা করছে। হাঁটা থামিয়ে দিল ভাইয়া। সাথে আরশিও থামালো। আরস ভঙ্গিতে হাতের ইশারায় বললেন,

-” তোর শিস বাজানো শুনে সাপ, কেঁচো, যোগ সব চলে এসেছে। এবার ওদের সাথে উড়ে যা।”
সাপ কথাটা শুনে থেমে গেল চরণ। সামনের পথ ঘাস দিয়ে ডাকা। ঘাসের উপরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র যোগ দেখা যাচ্ছে। হাওয়ার তালে রাবারের মতো শরীর দুলাচ্ছে। সরু রাস্তার পাশের মেহেগুনি গাছের ডালে একটা সাপ ফনা তুলে বসে আছে। বেশ কিয়ৎক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে পারলাম, এটা দাড়াই সাপ। বছর দুই আগে অরিশ ভাইয়ার জানালায় পেঁচানো ছিল। অবিকল দেখতে এমন একটি সাপ পাওয়া গেছিলো। তার পরে প্রায় এক সপ্তাহ আমি অরিশ ভাইয়ার রুমের দিকে পা বাড়াই নেই। তবে অদ্ভুত ব্যাপার সাপটাকে আঘাত করেনি ভাইয়া, দূর জঙ্গলে ছেড়ে দিয়েছিল।
অসহায় মুখে বললাম,

-” আমি ওদের সাথে যাবো না। প্লীজ ওদের তাড়িয়ে দাও।”
-” অসুস্থ শরীর নিয়ে কতোকষ্ট করে ওদের ডাকলি। একটু আপ্পায়ন করবি। না! তুই তো ওদের অপমান করছিস। আমি দেশের নাগরিক হয়ে, ওদের অপমান করতে পারি না। ওরা যদি রাগ করে দেশ ছেড়ে চলে যায়, তাহলে আমাদের দেশের সম্পদ বিলুপ্ত পাবে। এটা কিছুতেই হতে দেওয়া যাবে না।”

অরিশ ভাইয়া স্টির্কের উপর হাত রেখে নির্বিকার স্বরে বললেন। একসাথে সাপ, যোগ দেখে আমার অবস্থা শোচনীয় আর তিনি দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবছে। মাঝে মাঝে মনে হয়, তর্ক বিতর্ক প্রতিযোগিতায় তার নামটা দিয়ে দেই। নিশ্চিন্তে সে প্রথম হবে।
দাঁতে দাঁতের অদ্ভুত ঘর্ষণ সৃষ্টি করে বললাম,

-” তারচেয়ে বরং আপনি ওদের আপ্পায়ন করেন। আমার মতো পিচ্চি মেয়ে, ঠিকভাবে আপ্পায়ন করতে পারবে না। আপনি তো দায়িত্ব প্রাপ্ত নাগরিক, আপনিই করুন।”
-” তুই পিচ্চি।” ভ্রু নাচিয়ে বলল অরিশ ভাইয়া।
-” কোনো সন্দেহ আছে।”

মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ বোঝালেন তিনি। লাঠির মাথায় সাপ পেঁচিয়ে আমার দিকে ছুঁড়ে মারলেন। আমি এক চিৎকার করে বসে পড়লাম সেখানে। অপূর্ব ভাইয়া এগিয়ে এলেন। চোখ রাঙিয়ে বললেন,-” সাপটা তোর প্যাকেটে রাখ, বাড়িতে গিয়ে গ্রিল করে খাস। এখন চল বাবা।”
সাপটা আস্তে করে দূরে রাখলেন। জিন্স হাঁটু পর্যন্ত গুটিয়ে রাখলেন। ব্যাগ থেকে স্যাভলন বের করে হাতে পায়ে এমনকি স্টির্কে মেখে নিলেন। হাঁটলেন সামনে। আমরাও তার দেখানো পথ অনুসরণ করে আগালাম।

অবশেষে আমরা এসে পৌঁছালাম আমাদের কাঙ্খিত জায়গায়। পাহাড়টা বের বড়। চূড়ায় দাঁড়িয়ে আছি। প্যারাসেলিং এর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। ইতিমধ্যে সাইন করে নিয়েছি আমি আর আরশি। প্যারাসেলিং টিম আমাদের আকাশে উড়ানোর চেষ্টা করছে। মিনিট পনেরোর ভেতরে আকাশে উড়ন্ত পাখির মতো উড়তে সক্ষম হলাম। উপর থেকে বান্দরবান শহরকে ভিন্ন এঙ্গের থেকে চেনা যায়। একদমই আলাদা। আরশি ভীত হয়ে নয়ন যুগল গ্ৰথণ করে রয়েছে। তার সূচালো নখের আঘাতে আমার হাত আঘাত প্রাপ্ত।

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ২৩

সবকিছু বেশ ভালোই চলছিলো। আমার এই ইচ্ছেটাই আমার কাল ডেকে আনল। বেশ কিয়ৎক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পর হুট করেই বন্য শিকারীদের তীর এসে লাগলো প্যারাসেলিং এ। ধীরে ধীরে উল্টে যাচ্ছিলো। অতিশয় ভয়ে গুটিয়ে গেলাম আমি। পাহাড়ের পাদদেশে হাওয়ায় বেগে পড়তে লাগলো প্যারাসেলিং। সাথে সাথে প্যারাসেলিং টিম একশন নিলো। উপর থেকে ঝুলে রইলাম। তদানীং অনুভব করলাম জালের মতো পেচালো রশি গুলো ছিঁড়তে লাগল। উদ্ধার টিম আমাদের নিকট পৌঁছানোর পূর্বেই নিচে পড়ে গেলাম আমি।
পশ্চায় থেকে ভেসে এসে ছিল চিৎকার চেঁচামেচির আওয়াজ।

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ২৫