অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ২৩

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ২৩
ইফা আমহৃদ

পিট পিট করছে চোখের পাতা। এদিক ওদিক ফেরার চেষ্টা করছে আরশি। বারবার ব্যর্থ হচ্ছে সে। বিরাগী হয়ে চোখ মেলে তাকালো। নিভু নিভু চোখ পরিস্কার হয়ে উঠতেই ভরকে গেল সে। তার বক্ষে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে নিদ্রাচ্ছন্ন অপূর্ব। তার এক বলিষ্ঠ পুরুষালী হাত আরশির জামা ভেদ করে উন্মুক্ত পেট স্পর্শ করে আছে। আরশি অপূর্বের শার্ট চেপে ধরলো। নিদ্রা ভঙ্গ হতেই অজানা, অচেনা অনুভূতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে তাকে। নিঃশ্বাসের গতি বেড়ে গেল বহুলাংশে। বক্ষে ধুকপুকানি বেড়ে অস্বাভাবিক হয়ে উঠলো। নিজেকে সংযত করার বৃথা প্রচেষ্টা চালালো কিয়ৎক্ষণ।

অপূর্বের আসার উৎস খুঁজতে দরজার দিকে অবলোকন করলো আরশি। দরজা ভেতর থেকে ছিটকিনি তুলে দেওয়া। তরী রুমের কোথাও নেই। রাতে একসাথে শুয়ে ছিলো। মাঝরাতে হয়তো তরী অরিশের রুমে গিয়েছিল বিধায় অপূর্ব তার রুমে এসেছে। অসন্তুষ্ট হয়ে অপূর্বের দিকে দৃষ্টি মেলালো। নিজের আরো একবার হারিয়ে ফেললো চির পরিচিত মুখের মাঝে। অপূর্বের মুখে তেলাক্ত আভা ফুটে উঠেছে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

নাকের ডগা কালচে হয়ে গেছে। চুলগুলো লেপ্টে আছে ললাটে। নাকের নিচে অবস্থান করা লালচে তিলটা জোনাক পোকার ন্যায় জ্বলজ্বল করছে। শার্টের উপরের তিনটে বোতাম খুলে উন্মুক্ত হয়ে আছে বুক্ষের পুরো অংশ। খোঁচা খোঁচা দাড়ি চোয়ালে, লোমহীন বুক। কোথায় একটা শুনেছিল আরশি, যাদের বক্ষে লোম নেই তাদের অন্তরে দয়া মায়া বলতে কিছু হয় না। এতো দিনের কুসংস্কার আজ চরম সত্য হিসেব অন্তরে টহল দিচ্ছে।

হঠাৎ দৃষ্টি বক্ষের বাম দিকে যেতেই চমকে উঠলো আরশি। অপূর্বের বুকের বামদিকে পুড়ে যাওয়া দাগ দেখা যাচ্ছে। আরশি স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইলো অপূর্বের পানে। চোখ ভর্তি হয়ে গড়িয়ে পড়ে গেল। হাত ছুঁয়ে দিলো দাগের উপরে। এই দাগটা আরশির জন্য হয়েছিলো।‌ যখন তার বয়স সাত বছর, তখন জলন্ত কয়েল রাগের বশে অপূর্বের বুকে চেপে ধরেছিলো।

অপূর্ব নড়েচড়ে উঠলো। নিভু নিভু চোখে আরশির দিকে অবলোকন করে সরে গেল। আরশি পূর্বের ন্যায় কিংকর্তব্যবিমূঢ়। নীরব দৃষ্টিতে কিয়ৎক্ষণ নয়ন তৃষ্ণা মেটালো। অতঃপর হুট করে পেছন থেকে শার্ট টেনে দৃশ্যমান করলো কোমরের দিকটায়। কাঙ্খিত চিহ্ন টা পরিদর্শন করলো। অস্ফুট স্বরে আনমনে বলে উঠে,
-” তারু ভাইয়া।”

ফট করে উঠে বসলো অপূর্ব। পড়নের শার্ট টার খোলা বোতামগুলো লাগিয়ে নিলো। হাত দিয়ে চুলগুলো গুছিয়ে তাড়াহুড়ো করে বলে, -“ক-কি।”
আরশিও উঠে বসলো। সন্দিহান স্বরে বলল,

-” কি নয় কে? কে আপনি? অপূর্ব না-কি তারুণ্য, আমার তারু ভাইয়া?”
-” কিসব যা-তা বলছো তুমি? আ-আমি অপূর্ব। গ্যাং স্টার অপূর্ব।
-“তোমাকে আমি তেমন চিনি না ভাইয়া, তবে আমার চেয়ে কেউ ভালো চিনে না। তোমার কথাই বলে দিচ্ছে, কে তুমি? তোমার বুকের দাগ, জন্ম দাগ তার প্রমাণ।”

অপূর্ব বেশ ঘাবড়ে গেল। কিছুতেই স্বীকার করতে বাধ্য নয় যে, তারুণ্য। আরশিও হার মানতে রাজি নয়। বালিশের ফাঁক দিয়ে ওরনা বের করে, গায়ে জড়িয়ে ছুটল তরীর রুমের দিকে। অপূর্ব বাঁধ সাধল। আরশি ফিরে চেয়ে চাইলো না। হাত ধরলো আরশির। ঝটকায় ছাড়িয়ে নিল সে।

পুনরায় পা চালালো অরিশের রুমে যাওয়ার জন্য। অপূর্বের ভেতরের কষ্টগুলো চাড়া দিয়ে উঠলো। পেছন থেকে টেনে ধরলো আরশির গলায় পেঁচানো ওরনাটা। পেচ না খুলে আলো পেঁচিয়ে টেনে ধরল।
গলায় আঘাত পাওয়াতে চরণ দুটি থামিয়ে দিলো আরশি। পেছনে ফেরার উদ্যোগ হতেই চুলের মুঠি ধরে দেয়ালের সাথে মিশিয়ে ফেললো অপূর্ব। তার চোখ মুখের অবস্থা বিবর্ণ। চোখ দুটি জলন্ত আগ্নেয়গিরির লাভার ন্যায় ফুটছে। ওরনাটা আরো দৃঢ়ভাবে চেপে ধরলো অপূর্ব। হিংস্র বাঘের ন্যায় গর্জন করে বলল,

-” আমি অপূর্ব মানে অপূর্ব। আবার আমিই তারুণ্য আর বাহ্যিক দিকটা প্রকাশ করতে গেলে তাকে আমি জানে মেরে দিবো..
বলে আরো দৃঢ় করলো। সাথে সাথে খক খক করে কেশে উঠলো আরশি। একদিকে চুলের ব্যাথা অন্যদিকে গলা‌। দুহাত দিয়ে ওরনাটা সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করলো আরশি। তেজশক্তি হ্রাস পেতে লাগলো ক্রমাগত। চোখের পাতা উল্টে গেল। গলায় আঁচড়ের দাগ বসলো।

মুখ দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়লো। ধীরে ধীরে দেয়াল ঘেঁষে নুইয়ে পড়তে লাগল আরশি। অপূর্ব নিজের ভেতরে ফিরলো। ওরনার প্যাচ খুলে ফেললো। ততক্ষণে আরশির শক্তি সম্পূর্ণ রুপে হ্রাস পেয়েছে। পুরোপুরি মাটিতে বসে পড়েছে সে। দেয়ালের সাথে শরীর হেলিয়ে সমস্ত ভর ছেয়ে দিয়েছে। কাঁশতে কাঁশতে দম বন্ধ হয়ে আসছে।

অপূর্ব নীরব চাওনিতে চেয়ে রইল। বাক রুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ফিরে এলো ভাবনার জগৎ থেকে। অতি দ্রুত জগ থেকে পানি ঢেলে হাঁটু ভাঁজ করে আরশির মুখের সামনে ধরলো। ক্লান্ত নয়নে অপূর্বের দিকে দূর্বল চাওনি দিলো। মুখ সরিয়ে নিল বিপরীত পাশে। অপূর্ব চিবুক স্পর্শ করলো। পানিটুকু অধরের ফাঁক দিয়ে গলিয়ে দেওয়ার পূর্ব মুহুর্তে অতিশয় ক্ষোভে গ্লাস ফেলে দিলো। ঝনঝন শব্দে অদূরে গিয়ে থামলো।

ঘনঘন শ্বাস নিতে নিতে বিরবির করে আওড়ালো,
-” আপনি সত্যিই আমার তারু ভাইয়া তো? তিনি কখনো আমাকে আঘাত করেনি এবং অন্যকেও আঘাত করতে দেয়নি। সে তো উচ্চ শিক্ষিত হওয়ার জন্য বিদেশি গেছিলো, অমানুষ হতে নয়। আপনি তো একটা অমানুষ, জানোয়ার। আপনার কাছে আপনি আর আপনার বোন ছাড়া কারো জীবনের মূল্য নেই। আই হেট ইউ।

শেষের শব্দ টায় বুক ছিঁড়ে উঠলো অপূর্বের। রক্তে গলার দিকের জামাটা ভিজে উঠেছে। সময় অতিবাহিত হলো কিয়ৎক্ষণ। আরশি মাটি থেকে ওরনাটা তুলে নিল। শুকনো রক্তগুলো মুছে প্রস্থান করলো। যাওয়ার আগে একবার অবধি পেছনে ফিরে দেখল না।

আরশিকে যেতে দেখেই দেয়ালে আঘাত করলো অপূর্ব। হাতের ব্যাথাটা চোখ কুঁচকে সহ্য করে নিলো। না জানি, তার পুচকির কতো কষ্ট হচ্ছে। নিজের উপর বিরক্ত সে। কিন্তু কি করতে পারত সে। যতবার তারুণ্য নামটা শ্রবণ হয়, ততবার সে পুরোনো অতীতে ফেলা আসা ভয়ংকর দৃশ্য গুলো ভেসে উঠছে। প্রিয়শ্রীর মুখটা ভেসে উঠে। তারুণ্য থেকে অপূর্ব হয়ে উঠার সেই দিনগুলো মনে পড়ে।

সেদিনের পেরিয়ে গেছে অনেক মুহূর্ত। দুইজন মানব দুইজনের চাপা অভিমান নিয়ে নিজেদের সংযত করেছে। দেখা হলেও এড়িয়ে চলেছে একে অপরকে। চঞ্চল আরশি হঠাৎ করে গোমড়া হয়ে গেল। সর্বদা নিজেকে সবার থেকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করত।

সাঙ্গু নদীর মাঝ দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছে বিজিবির নৌকা। মূলত বিজিবির কাছে থেকেই ভাড়া করে আনা হয়েছে। বিজিবি ক্যাম্পের দৃষ্টি সর্বদা আমাদের উপর। পাহাড়ে ঘেরা বনভূমির মাঝ দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছি। পাঁচজন চলার উপযোগী নৌকাতে আমরা চারজনে চলেছি। পানির উপর থেকে মাটি দেখা যাচ্ছে। তবে প্রবল স্রোতে নৌকা বারেবারে বেঁকে যাচ্ছে। দূরত্ব বজায় রেখে বসে আছি আমরা। চারদিকের মনোরম পরিবেশ উপভোগ করতে ব্যস্ত। আরশি আমার সন্নিকটে বসা। চোখ মুখের অবস্থা উদ্ভর। দেহে মোটা শাল জড়ানো। অপূর্ব ভাইয়ার দিকে চোখ ফেরাতেই দেখলাম দৃষ্টি লুকাচ্ছেন তিনি। আরশির কাঁধে হাত রেখে বললাম,

-” কি হয়েছে তোর। এতো নিশ্চুপ হয়ে বসে আছিস কেন!”
-” ভালো লাগছে না, বাড়ির কথা প্রচুর মনে পড়ছে।”
বিশ্বাস হলো না, তবুও জোর করে বিশ্বাস করানোর চেষ্টা চালালাম। আরশি বাইরে হাত দিলো পানি স্পর্শ করার জন্য। অপূর্ব একবার চেয়ে মলিন কন্ঠে বলে,
-” বাইরে হাত দিও না, পাথরের সংঘর্ষে আহত হতে পারো।”

ফিচেল হাসলো আরশি। বিনিময়ে অবাধ্য হয়ে আরো হাত বের করে দিলো। তার কাছ থেকে পাওয়া যন্ত্রনার কাছে এগুলো তুচ্ছ। অপূর্ব আহত হলো। স্বল্প বয়সী মাঝি ছেলেটা পেছনে ফিরলো। আরশির ফেকাসে মুখ পানে চেয়ে বলল,
-” হাত বাইরে দিয়েন না আপামনি, এম্মে আহেন। আমি আপনেরে বেবাক দেখাচ্ছি।”
আরশি এগিয়ে গেল। বসলো ছেলেটির পালে। ততক্ষণে নৌকা পৌঁছে গেছে তিন্দু, পাথরের রাজ্যে। টানা এক ঘন্টা বিশ মিনিট সময় অতিবাহিত হয়েছে। ছোট ছোট এবং বিশাল বিশাল পাথর। সেকেন্ড খানিকের জন্য নৌকা থামালো। আরশির দিকে তাকিয়ে বলল,

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ২২

-” আপা হাত বাড়ান পানিতে।”
আরশি হাত রাখলেই শীতল অম্বুর সংস্পর্শে এসে কেঁপে উঠলো। হাত উপরে তুলতেই দৃষ্টিনন্দন হলো মাটি নখের লেগে আছে। আনমনে বলে উঠে,
-” একদম পানি নেই।”

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ২৪