অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ২২

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ২২
ইফা আমহৃদ

হিম শীতল হাওয়া বইছে। ওরনাটা শালের মতো দেহে জড়িয়ে নিয়েছে আরশি। সামান্য একটু বৃষ্টিতে রাস্তাঘাট পিচ্ছিল হয়ে গেছে। পা টিপে টিপে অপূর্বের পেছনে হাঁটছে সে। অপূর্ব তার থেকে ঢের দূরে। আর যাই হোক একজন পুরুষের সাথে হেঁটে পারা যায় না। আরশি কোমরে হাত রেখে ঘনঘন শ্বাস নিলো। পেছনে থেকে হতাশাগ্ৰস্থ কন্ঠে বলল,
-” আপনি একটু আস্তে আস্তে হাঁটতে পারেন না। এভাবে ঘোড়ার মতো ছুটছেন কেন? যতোই ঘোড়ার মতো ছুটে নিজেকে ঘোড়ার প্রমাণ করতে চান, আপনি জীবনেও ঘোড়া হতে পারবেন না।”

অপূর্ব পিছু ফিরলো। আরশি এতোটাই জোরে কথা বলেছিলো, অনেকটাই দূরত্ব থেকেও শ্রবণ করা সম্ভব। অপূর্বের দৃষ্টিগোচর হলো না আরশিকে। বিনিময়ে কয়েকপা পিছিয়ে এলো। মাথা থেকে পা অবধি পর্যবেক্ষণ করে বলল,
-” ঘোড়ার মতো ছুটতে হলেও জোর লাগে, চেষ্টা লাগে। এভাবে পিঁপড়ার গাড়ির মতো হাঁটলে জীবনেও নিজের গন্তব্যে পৌঁছাতে পারব না।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-“আমাকে আপনার পিঁপড়ার মনে হচ্ছে।” ফট করে বলল আরশি। অপূর্ব ঝুঁকলো আমার মুখশ্রীর দিকে। আরশি পিছিয়ে যেতে নিলো। অপূর্ব কোমর জড়িয়ে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নিল। নাকের ডগায় নিজের নাক ঘসে বলে,
-” পিঁপড়া তো গন্ধ শুঁকে নিজের গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে। কিন্তু তোমার দ্বারা তা সম্ভব নয়।”

বলেই আরশিকে ছেড়ে পথ ধরলো অপূর্ব। আরশি কেবলা ক্লান্তের ন্যায় চেয়ে রইলো অপূর্বের যাওয়ার পানে। ছোপ ছোপ পানির শব্দে হুস ফিরলো আরশির। ঝিরিঝিরি ধারায় গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। জনশূন্য, নিস্তব্ধতায় ভীত হলো সে। ওরনার ভেতর দিয়ে অন্য হাত চেপে ধরলো। আশে পাশে চেয়ে ছুটলো অপূর্বের পিছু পিছু। হাত পেঁচিয়ে ধরলো তার। করুন সুরে বলে, “আরেকটু আস্তে হাঁটেন না।”

অপূর্ব হাত ছাড়িয়ে নিলো। পায়ের গতি কমিয়ে দিলো। ছোট ছোট পা ফেলে সামনে এগুতে লাগলো আর বলল,
-” চলতে শিখ, নিজেকে গড়তে শিখ। কখনো অন্যর ভরসায় হাহাকার করো না। যার জন্য আশায় বসে থাকবে, দেখবে একদিন সেই মানুষটি নেই। ভেঙে পড়তে হবে। তাই আগে থেকেই নিজেকে গড়তে শিখ।”

-” মাস্টার মশাইয়ের মতো জ্ঞান দিয়েন না তো। যদি এতোই জ্ঞান দিতে মন চায়, একটা জ্ঞানের স্কুল খুলে বসুন না। আমাকে ফ্রি তে কেন দিচ্ছিন, আজব।”
দু’জন ভালোবাসার মানুষ একে অপরের সাথে ঝগড়া করতে করতে গন্তব্যে ছুটে চলছে। তবে তারা অরিশ তরীর খবর পেলো কি-না, তা জানা নেই। তবে দুষ্টু মিষ্টি ঝগড়াতে বেশ জমে উঠেছে।

পাহাড়ি বাতাসে অনবরত উড়ে চলেছে অবাধ্য চুলগুলো। বান্দরবানে ঘুড়তে আসার জন্য কতো বায়না, অভিযোগ, অভিমানের পাহাড় সাজাতে হয়েছিল আমাকে। অবশেষে কাঙ্খিত ইচ্ছেটা পূর্ণতা পেতে চলেছে। কিন্তু এখনো নিদ্রা আচ্ছন্ন হয়ে আছে নয়ন যুগল। ভোর পাঁচটায় নিদ্রা ভঙ্গ হওয়াতে তার রেশ কাটতে বেগ পেতে হচ্ছে। মাথা ভাইয়ার কাধে রেখে এদিক ওদিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে চলেছি।

উপরের অংশ একদম ফাঁকা। দিনের আকাশের কুয়াশাচ্ছন্ন সূর্য দেখা যাচ্ছে। হয়তো ভুল করে গাড়িটার নাম রাখা হয়েছে চান্দের গাড়ি। সূর্যের গাড়ি রাখলে বেশ মানাতো। আমাদের সাথে আরো কয়েকটা দম্পতি রয়েছে। জানালা দিয়ে মাথা হেলিয়ে দিলাম। সরু রাস্তা দিয়ে গাড়িটি ছুটে চলেছে। ক্রমাগত উপরে উঠছে। সাড়ি সাড়ি পাহাড় মেঘের গমন পথে বাঁধা দিচ্ছে। ঠান্ডা শীতল বাতাস বইছে।

-” তরী, মাথা ভেতরে আন। দূর্ঘটনা ঘটতে পারে।”
আমি বাধ্য মেয়ের মতো মাথা ভেতরে নিয়ে এলাম। ফুড়িয়ে গেল আরো মিনিট পনেরো। গাড়ি এসে থামলো রাস্তার উপরে। ধীরে ধীরে নিচে নামলে আমার পৌঁছে যাবো শৈলপ্রপাতের কাছে। একে একে নেমে গেল সকলে, সাথে আমরাও পা চালালাম। তবে বিশেষ কোনো লাভ হয়নি। আমার পাকামির ফলে সবকিছু ভেস্তে গেছিলো। বাধ্য হয়ে ফিরে যেতে হয়েছিল। কিন্তু রিসোর্টে নয়, থানচি শহরে।

ভালোই চলছিলো সবকিছু। পাহাড়ি শৈলপ্রপাতের পাল দিয়ে হাঁটছি আমি। বাকিরা ইতিমধ্যে পা ভিজিয়ে ফেলেছে। আমি জুতো খুলে ভাইয়ার হাতে ধরিয়ে দিলাম পানিতে পা ভেজাবো এই আশায়। কিন্তু ভেজানোর মতো শক্তিটুকু নেই।-” দা ওয়াটার অফ দা ক্লিফ, ইফ দা ফিট আর নট ওয়েট ইউ হেভ টু রিগ্ৰেট। বিকজ উই উইল নট কাম হেয়ার এগেইন।
প্রপাতের পানি এদিক ওদিক ছুঁড়ে অন্যদিকে ফিরে বললেন অরিশ ভাইয়া। তার হাটুর উপরে গোটানো জিন্স। অতিশয় সাহস সঞ্চয় করে পা ভেজালাম পানিতে।

যা হলো তাকে সবাই কিংকতব্যবিমূঢ়। পানিতে পা রাখতেই লাফ দিয়ে ভাইয়ার গলা ঝুঁলে পড়লাম। শরীরের লোম গুলো দাঁড়িয়ে গেছে। সূর্যের আলো এদিকটায় পৌঁছাতে না পারায় হিম শীতল হয়ে আছে। ফ্রিজের ঠান্ডা পানিকেও হার মানাতে রাজি আছে। কদাচিৎ নুইড়ে পড়লেন তিনি। ছুপ ছুপ শব্দে হাত থেকে নিচে পড়লো জুতো জোড়া। কোলে তুলে নিলেন আমায়। ফলস্বরূপ ধড়াম করে পানিতে। অসহায় ভাবে চাইলেন তিনি। দাঁত কেলিয়ে বললেন,

-” আমাকে ভিজিয়া শান্তি হইয়াছেন মহারানী? যদি হইয়া থাকেন, তাহলে দয়া করিয়া উঠিয়া দাঁড়ান।”
ঠান্ডা পানিতে চরণ দুটি ঠেকিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। অরিশ ভাইয়ার হাত টেনে তাকে দাঁড় করালাম। এতোটাই ঠান্ডা ছিল, মুহুর্তেই তার চোখ মুখের অবস্থা শোচনীয়। নয়ন যুগল রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। ঠান্ডায় রীতিমত কাঁপতে লাগলো সে। কিয়ৎক্ষণ নিজের সাথে যুদ্ধ করে অসহায় হয়ে বললেন,

-” অপূর্ব, তুই ওদেরকে নীল দিগন্ত, নীলগিরি, চিম্বুক দেখিয়ে নিয়ে আয়। আমি থানচি চলে যাই। এই পানি বহমান, কোথা থেকে কি নিয়ে এসেছে। হিতে বিপরীত হয়ে যাবে।”
বলেই উল্টো পথে হাঁটা ধরলেন তিনি। কি হলো জানা নেই আমার। হুট করে ভাইয়ার হাত ধরে ফেললাম। অশ্রুদয় চিকচিক করছে চোখের কোণে। পলক ফেললেই গড়িয়ে পড়বে। অশ্রুসিক্ত নয়নে বললাম,
-” ভাইয়া, আমিও যাবো।”

তার এক কথা, ঘুড়তে এসে শুধু শুধু সবকিছু একজনের জন্য বন্ধ করে বসে থাকতে রাজি নয়। কিন্তু আমার জন্যই ভাইয়ার এই অবস্থা। প্রকৃতি দেখায় মনযোগী হওয়া দায়। ভাইয়াকে জোড়াজুড়ি করতেই রাজি হয়ে গেলেন তিনি। অপূর্ব আর আরশি আমাদের ছাড়া ওখানে থাকতে রাজি নয়‌। তাই আবার থানচি শহরের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। তিনটা নাগাদ থানচি শহরে এসে পৌঁছালো তারা। মাঝপথ বৃষ্টি হয়েছিলো বিধায় গাড়িতে সমস্যা হয়েছিলো, তারউপর বিজিবি ক্যাম্পে এন্ট্রি করানো।

সকালে কিছু না খাওয়াতে ক্ষুধার্ত হয়ে পড়েছিল সকলে। তাই ছোট একটা খাবারের দোকানের গিয়েছিলো তারা। ঠান্ডা ঠান্ডা আমেজে খিচুড়ি আর সাঙ্গু নদীর পাবদা মাছ। আরশি অপূর্ব একটু খেয়েছিল। পারি নি আমি আর অরিশ ভাইয়া। তাই খাবার প্যাকিং করে আনা হয়েছে। বিকেল যখন চারটা পঞ্চাশ তখন খুঁজে খুঁজে থাকার উপযোগী একটা রেস্ট হাউস পাওয়া যায়। দুটো রুম ভাড়া নেওয়া হয়েছে। একটায় অরিশ আর অপূর্ব ভাইয়া আর অন্যটায় আমি আর আরশি।

আজকের দিনটা শুধু জার্নি করতে করতে কেটে গেছে। দর্শনীয় স্থানগুলো চোখের পাতায় একবার গহীন নয়নে চেয়ে দেখেছিলাম। ঠান্ডায় অরিশ ভাইয়ার অবস্থা শোচনীয়। কাঁশতে কাঁশতে দাড়ি ওয়ালা গালগুলো স্পষ্ট লাল দেখা যাচ্ছে। মেডিসিন খেয়ে নিদ্রাচ্ছন্ন সে।

আমি দরজার কড়া নড়ালাম। অপূর্ব ভাইয়া জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে চিলেন, আমাকে দেখে সোজা হয়ে বসলেন। ভেতরে প্রবেশ করলাম আমি। উড়ন্ত চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে নিয়ে আওড়ালাম,
-” ভাইয়া যদি আমি একটু..

শেষ করার পূর্বেই হাতের ইশরা থামিয়ে দিলেন আমায়। উপরে শীত নিয়ন্ত্রণ জ্যাকেট নিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে বললেন, -” খেয়াল রেখে।”
আমি মাথা হ্যাঁ সূচক নাড়িয়ে সায় দিলাম। কিন্তু দৃষ্টিগোচর হলো না তার। প্রস্থান করলেন।
ওরনার তলদেশ থেকে তেলের বোতলটা বের করে বেডের পাশে বসলাম। মাথা নিজের কোলে তুলে তেল দিয়ে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলাম।

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ২১

নিভু নিভু চোখে আমার সমীপে অবলোকন করলেন তিনি। মৃদু শব্দে বললেন,-” এতোক্ষণে আসার সময় হলো তোর ডিঙিরানী? আমি যে চাতক পাখির ন্যায় হাপিত্যেশ করে রয়েছি।”
হাতের সাহায্যে চোখের পাতা বুজে দিলাম। মাথা বেডের সাথে ঠেকিয়ে দিলাম। তখনও নির্বিকার ভাবে আমার ডান হাত তার চুলের ভাঁজে বন্দী। কখন গভীর নিদ্রা এসে চোখের পাতা ভারী করে ফেলেছে জানা নেই। গভীর থেকে গভীরতর হয়ে এলো নিদ্রা।

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ২৩