অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ২১

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ২১
ইফা আমহৃদ

রাত নয়টা ছুঁই ছুঁই। ঘর ফাঁকা। জানালার পর্দাগুলো হাওয়ার তালে উঠছে। চোখ ঢলতে ঢলতে আসে পাশে দৃষ্টিপাত করলাম। আরশি, মেঘলা কোথাও নেই। প্রতিটি কক্ষে তিনজনের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাই মেঘলা নামক মেয়েটা আমাদের বাড়িতে রুমেই পড়েছে। বাইরে থেকে হট্টগোলের আওয়াজ আসছে। সারারাত সহ অর্ধেক দিন জার্নি করে ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঘুমিয়েছিল সকলে। বুঝতে অসুবিধে হলো না, ওরা কোথায়।

জানালা বন্ধ করে দিলাম। ওরনা টা শরীরে পেঁচিয়ে বেরিয়ে এলাম রুম থেকে। রুম থেকে বেরিয়ে আসতেই দেখতে পেলাম, সকলে চেয়ার পেতে আড্ডায় বসেছে। ভার্সিটির ইয়ং ইয়ং প্রোফেসর থেকে শুরু করে ছাত্র-ছাত্রীমহল। আমি গিয়ে ফাঁকা চেয়ারে বসলাম। আমার সোজাসুজি বসে আছেন নিভ্রান স্যার। তার পাশে আমার বন্ধুমহলের সকলে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

অরিশ ভাইয়া বারবার ছেলেদের সাথে কথা বলতে বারণ করেছেন। তাই সেদিনই ওদের সাথে ফ্রেন্ডশীপ ব্রেকআপ করেছিলাম। আমার দৃষ্টি যেতেই ঘোলাটে চোখে চেয়ে রইলেন নিভ্রান স্যার। বিরাগী হলাম। বিরক্তি রেখা যখন শীর্ষ প্রহরে পৌঁছালো তখন কানের কাছে ভুম করে উঠলো কেউ। আরশিকে দেখে মেজাজ বিগড়ে গেল। চোখ রাঙালাম‌। রাগ দেখিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। সামনে পা বাড়াতেই আমার হাত ধরে পেছন থেকে বলে সে,

-” আমার জায়গায় ভাইয়াকে ভেবেছিলিস তাই তো? সে ঐ দিকটায় আছে। যা..”
-“না।”
না দেখে উল্টো পথে পা বাড়াতেই ধপাস করে পড়ে গেলাম। নিজের কাজে ব্যাঘাত ঘটাতে সবাই তাকালো আমার সমীপে। পরক্ষণেই হেঁসে দিল। লজ্জায় পড়ে গেলাম আমি। পূর্বের ন্যায় যেভাবে পড়েছিলাম, ঠিক সেভাবেই আছি। তদানীং রুদ্র কন্ঠস্বর শুনা গেল,

-” লাইক সিরিয়াসলি! একজন মানুষ পড়ে গেছে, আর তোমরা তাকে না তুলে হাসছো। এইসব শিখেছো তোমরা।”
পরক্ষণেই হাত ধরে টেনে তুললেন আমায়। ওরনাটা ভালো ভাবে পেঁচিয়ে দিয়ে চেয়ারে টেনে বসালেন। আদুরে গলায় বলেন,
-” কোথায় লেখেছে দেখি?”

হাঁটুতে প্রচুর জ্বলছে। মুখ ফুটে সবার সামনে বলা হয়ে উঠেনি আমার। আলতো করে হাতটা হাঁটুর উপর রাখলাম। যা বোঝার তিনি অনুমান সাপেক্ষ বুঝে নিলেন।
আরশি মলম নিয়ে এসেছে। সেটা নিয়ে আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন। মৃদু ঝুঁকে কোলে তুলে নিলো। আসছি বলে সামনের পথ ধরলেন। পেছনে থেকে অস্ফুট হৈচৈ পড়ে গেল।

শুনশান নিরিবিলি পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে ধীরে ধীরে উপরে উঠার চেষ্টা করলো। পাহাড়ি পিচ্ছিল রাস্তা হওয়াতে পা রাখা দায়। তার কুঁচকে যাওয়া চিবুক মাথার আঘাত করছে। আমি একহাতে গলা জড়িয়ে লজ্জার্থ মুখটা লুকিয়ে নিলাম।
পাহাড়ের চূড়ায় উঠে বসিয়ে দিলেন আমায়। হাটু ভাঁজ করে বসলেন আমার নিকটে। নীরবতা কাটিয়ে বললেন,
-“সালোয়ার তুল।”

ফট করে মাথা তুলে তাকালাম তার মুখশ্রীর দিকে। তিনি আশাবাদী চোখে চেয়ে ছিলেন। বিধায় চোখাচোখি হয়ে গেল দুজনার। সরিয়ে নিতেই গাল ধরে সোজা করলেন। ললাট কুঁচকে বললেন,
-” একদম চোখ নামাবি না। চুপচাপ সালোয়ার তুল।”

কদাচিৎ ফাঁক হয়ে এলো ওষ্ঠ যুগল। লজ্জার্থ রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়লো আমার গাল দুটোয়। অন্ধকারের মাঝে দৃষ্টিগোচর না হলেও, আমার লজ্জার কমতি নেই। আমার ভাবনার মাঝেই সালোয়ার তুললেন তিনি। পা নিজের কোলে নিয়ে মলম লাগিয়ে দিতে লাগলেন। পা সরাতে চাইলেই চেপে ধরলেন দৃঢ় করে। চাপা আর্তনাদ করে উঠলাম। অসহায় চাওনি উপস্থাপন করলাম। অন্ধকারের মাঝে তার মুখটা স্পষ্ট দেখা না গেলেও চোখের মণি গুলো জ্বলজ্বল করছে জোনাক পোকার ন্যায়।

মলম লাগিয়ে সালোয়ার ঠিক করে দিলেন। কোমর চেপে কোলের উপর বসিয়ে দিলেন। টেনে টেনে বললেন,
-” আমার সামনে কিসের লজ্জা তোর পিচ্চি? ছোট বেলায় আমার কোলে উঠার জন্য, আমার সাথে গোসল করার জন্য আরশির সাথে কতো ঝগড়া করেছিস।”
একমাত্র এই মানুষটির মুখে কোনোরুপ লাগাম নেই। কি হতো একটু লাগাম দিয়ে কথা বললে। গাল ছুঁয়ে দিলেন আমার। অস্বাভাবিক কন্ঠে বললেন,

-“এতো গাল ফুলাস না চড়ুইপাখি। একদম ব্লাস্ট করে যাবে। তারচেয়ে বরং এই অপরুপ প্রকৃতি অনুভব কর।”
ভাইয়ার কথা অনুসরণ করে নিভু নিভু চোখ করে প্রকৃতি দেখায় মনোনিবেশ করলাম। নিচের দিকে তাকাতেই কিংকতর্ব্যবিমূড় হলাম। নিজেকে মেঘ রাজ্যের রানী বলে মনে হলো। চারদিকে শীতের অনুভব পূর্ণ হিম হাওয়া। পাহাড়ে বাঁধা পেয়ে সূর্যের আলো ঠিকভাবে পৌঁছাতে না পারায় অতিশয় দ্রুত ঠান্ডা হয়ে যায় ভূ-ভাগ! পাহাড়ের চূড়ায় সাদা সাদা মেঘেরা জমাট বেঁধে ঘূর্ণীভূত হয়ে আছে। যখন তখন শৈলোৎক্ষেপ বৃষ্টিপাত ঘটাতে পারে।

অনুভূতি শূন্য লাগছে। উত্তেজনায় নয়ন জোড়া গ্ৰথণ করে নিলাম। নিজেকে স্বপ্ন রাজ্যের রানী লাগছে। মনে হচ্ছে, চোখ মেললেই হারিয়ে যাবে এই সময় টুকু।
ঝুমঝুম ধারায় বৃষ্টি শুরু হলো। চোখ মেলে অবলোকন করলাম। কমপক্ষে ভূপৃষ্ঠ থেকে আঠারো শত ফুট উচ্চতার অবস্থান করছি আমরা। বৃষ্টির ফোঁটা গুলো মেঘের ভেতর থেকে নিচে পড়ে হারিয়ে যাচ্ছে।

-” ধন্যবাদ ভাইয়া, আমাকে এতো সুন্দর একটা মুহূর্ত উপহার দেওয়ার জন্য। স্মৃতির পাতায় বড় বড় অক্ষরে রংহীন সাদা কালোতে লিখে রাখব এই মুহূর্তটা।”
-” আমি যতোক্ষণ আছি, ততক্ষণ তোমার এই মুহূর্ত গুলো লিখার প্রয়োজন নেই ডিঙিরানী। তাছাড়া এই ছোট ছোট মুহূর্তগুলো লিখতে লিখতে স্মৃতির পাতা শেষ হয়ে যাবে। তাহলে আগামী দিনের স্মৃতি কিসে লিখবে?”
-“মানে।” না বোঝার স্বরে।

-” আগামী কাল আর পরশু আমরা ঘুড়তে যাচ্ছি, সকলের থেকে বিভক্ত হয়ে যাচ্ছি চারজনে। নিজেদের মতো ঘুরে ২ দিন পরে আবার এখানে আসবো। আগামি কাল আমরা যাচ্ছি শৈলপ্রপাত, চিম্বুক, নীলগিরি, নীল দিগন্ত। অতঃপর থানচি শহরে থাকবো রাতটা। পরের দিন বাকি দর্শনীয় স্থানগুলো। যার মধ্যে একটি স্থান নীলাচল পর্যটন কেন্দ্র। যেখান থেকে এক নজরে পুরো বান্দরবান শহর দেখা যায়। এক নীল আঁচলে বেঁধে রেখেছে বান্দরবান শহর।”

-” ভাইয়া আমি প্রাসিলিং করবো।” ফট করে বলে ফেললাম আমি।
” ঠিক আছে।” বলেই টস করে হাতের উল্টো পিঠে অধর ছুয়ে দিল। দুজনের মধ্যে দূরত্ব ঘুচে গেল। অধরে অধরে ছুঁই ছুঁই। নিঃশ্বাসের শব্দ গুলো স্পষ্ট শ্রবণ করা যাচ্ছে। চোখাচোখি হলো বহুক্ষণ। মনের অপ্রকাশিত সত্য গুলো নীরব দৃষ্টিতে প্রকাশিত হলো অন্য নীরব চোখে।‌

অতিবাহিত হতে লাগলো সেকেন্ডের পর সেকেন্ড, মিনিটের পর মিনিট, ঘন্টার পর ঘন্টা। আবির্ভাব ঘটলো তৃতীয় ব্যক্তির। হকচকিয়ে গেলাম আমি। ভাইয়ার বন্ধন থেকে মুক্তি মিললো না। শোনা গেল অস্পষ্ট তরুণের স্বর,
-” স্যার, খাবার নিয়ে এসেছি। দুশো টাকা ফিরেছে।”
হাতটা মাটিতে রেখে ইশারা করে বলেন, -” খাবার টা এখানে রাখো আর টাকাটা তোমার কাছে থাক!”

-” কিন্তু স্যার..
লিভ কথাটা বেশ আলাদা ভঙ্গিতে উচ্চারণ করলেন তিনি। সাথে সাথে ছেলেটি প্রস্থান করলেন। খাবারগুলো আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
-” ফিনিশ ইট।”
সারাদিন কিছু না খাওয়ার ফলে খাবার দৃষ্টি নন্দন হতেই পেট মুচড়ে উঠলো। চুপচাপ খাওয়া শুরু করলাম। ভাইয়া বার্গার আনিয়েছেন। আমার প্রিয় খাবার বার্গার। পুরোটা বার্গার এক নিমিষেই শেষ করলাম।

আরশি রিসোর্টের প্রতিটি জায়গা খুঁজেও অরিশ তরীর কোনো খবর মেলাতে পারে নি। কাল ঘুড়তে যাবে বিধায় রুমে ফিরে গিয়েছে সকলে। কিন্তু আরশি এখনো খুঁজে চলেছে তরীকে। খুঁজতে খুঁজতে এগিয়ে গেল অপূর্ব আর অরিশের জন্য নির্দিষ্ট কক্ষে। দরজার খোলা। দরজার দিকে পিঠ দেখিয়ে ফোন কথা বলে চলেছে অপূর্ব। আরশি দরজার কড়া নড়তেই অপূর্ব ফোন রেখে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। ফোনটা তুলনামূলক দূরে সরিয়ে বলে,-“কি?”

-” ভাইয়ার কাছে এসেছিলাম। ভাইয়াকে খুঁজে পাচ্ছি না।”
-” তোমার ভাইয়া তোমার চেয়ে অনেক বড় এবং সেনসেটিভ। সে কখনো হারিয়ে যাবে না।”
পুনরায় ফোন কানে দিলো। ফোঁস করে দম ছাড়লো আরশি। পিত্ত্বি জ্বলে যাচ্ছে তার। অপূর্ব বড় সেটা তার জানা, কিন্তু তরী। সে তো তার বয়সী। যদি তরী হারিয়ে যায় তখন। তেজ নিয়ে বলল, -” তরীকেও পাওয়া যাচ্ছে না।”
অপূর্ব চমকে গেল। লাইন কেটে দিলো। অরিশের নাম্বারে ডায়াল করলো। রিং বেজে উঠলো রুমে। টেনশনে মাথা ধরে যাচ্ছে তার। রুদ্র কন্ঠে বলল,

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ২০

-” সেটা এতোক্ষণে বলার সময় হলো তোমার?”
আরশির উপর ক্ষোভ দেখিয়ে পথ ধরলো অপূর্ব। সন্দেহের পাল্লা প্রশস্ত হয়ে উঠলো। ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে অন্যকিছু ঘুরপাক খাচ্ছে। নিজের দৃষ্টিকে গোয়েন্দার মতো আরেকটু সন্দেহজনক তৈরি করলো। পিছু নিলো অপূর্বের।

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ২২