অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ২০

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ২০
ইফা আমহৃদ

একহাতে বাহু জড়িয়ে বিড়াল ছানার মতো গুটিয়ে নিদ্রাচ্ছন্ন অরিশ। হিম শীতল ঠান্ডা রাত্রিতে একই ভঙ্গিতে থাকার ফলে অকেজো হয়ে গেছে দেহ। নড়াচড়া করার মতো শক্তিটুকু অবশিষ্ট নেই। যেন ঠান্ডায় কুপোকাত। অরিশ ভাইয়া এলোমেলো চুলগুলোতে ডান হাত দিয়ে আরেকটু এলোমেলো অগোছালো করে দিলাম। চোখের পাতা নিভু নিভু করছে তার। বহিরাগত সূর্যের তেজ হীন হালকা আলো অন্তর্ভাগে প্রবেশ করছে। আকাশটায় সূর্যের আভা ছড়িয়ে পড়ছে, কুয়াশামাখা ভোরে সূর্যের দেখা নেই। গাছ গাছালি গুলো পেছনে ছুটে চলেছে দুরন্ত গতিতে।

হাত তুললাম আমি। অরিশ ভাইয়া আরেকটু চেপে গলায় মুখ গুঁজে দিলেন। থেমে গেল আমার ঝটফটানি। কম্পিত দেহটা এবার পুরোপুরি অকেজো। বাম হাতে তাকে বন্দী করে নিলাম। সামনে অবলোকন করলাম। নির্ভাবনায় নিদ্রাচ্ছন্ন সকলে। পায়ের কাছ থেকে বোতল তুলে, একহাতে ছিপি খুললাম। এক ঢোক সমপরিমাণ পানি দিয়ে তৃষ্ণা মিটিয়ে নিলাম। দ্বিতীয় ঢোক খাওয়ার আগেই হাত ফসকে বোতলটা নিচে পড়ে গেল। বোতলে অবস্থানরত পানিটুকু গড়িয়ে গড়িয়ে অদূরে চলে গেল।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

সময় অতিবাহিত করার জন্য ব্যাগ থেকে মুঠোফোন বের করলাম। মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি এলো। স্ন্যাপ চ্যাট দিয়ে কুকুর, বিড়াই ইফেক্ট দিয়ে পিক তুলে নিলাম ভাইয়ার। ধীরে ধীরে ব্যাগের ভেতরে রাখতে চাইলেই খপ করে হাত ধরে ফেললেন তিনি। কাঁধ থেকে নিজের মাথা তুলে ভ্রু নাচালেন। তার ভ্রু নাচাতেই আমার হার্ট বিট উর্ধ্বে অবস্থান করলো। বোধগম্য হওয়ার আগেই ফোনটা তার দখলে। ঠোঁট উল্টে গেল আমার। ফোনটা নেওয়ার উদ্যোগ হতেই হাতের দূরত্ব বাড়িয়ে দিলেন। সরিয়ে নিলেন দূরে। ললাট তুলনামূলক কুঁচকে বলেন,

-“হাউ ফানি পিচ্চি! তোর নিজের নামই তো পিচ্চি, পিচ্চি হয়ে আমার সাথে পাঙ্গা নিচ্ছিস কেন?”
কর্ণপাত না করে উঠে দাঁড়ালাম। হাত বাড়ালাম কিন্তু কোনো রুপ উন্নতি হলো না। বাম পায়ের উপরে ডান পা তুলে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বসলেন। সূচালো কন্ঠে বলেন,

-” একপা নড়াচড়া করলে তোর কান ধরে উঠবস করা ভিডিওটা পৃথিবীকে দেখানোর ব্যবস্থা করে দিবো।”
হাত গুটিয়ে গেল। কদম এক পা পিছিয়ে গেল। পূর্বের স্থানে বসে মাথা নিচু করে নিলাম। আমার পরিশ্রম সবটা ধূলোয় ঝাঁপসা হয়ে গেল। আমার সম্মুখে একে একে সব কয়টা ছবি রিমুভ করে ফোনটা হাতে ধরিয়ে দিলেন। ফোঁস করে দম বেরিয়ে এলো। সন্তর্পণে ফোনটা ব্যাগের রাখলাম। বাহু ঝাড়া দিয়ে জানালার দিকে সেটে গেলাম। জানালায় মাথা হেলিয়ে, দু হাত বুকে গুঁজে নয়ন জোড়া গ্ৰথণ করে নিলাম। দেহের সাথে দেহ সংস্পর্শে এলো। সেঁটে এসেছেন আমার নিকটে। সন্দিহান হওয়ার গলায় বলেন,

-“পিচ্চি রানী কি আমার উপর রেখে গেল।”
-“না!” একরোখা প্রশ্নের জবাব আমার।
-“তাহলে কি পিচ্চি রানী, খুশি হয়েছে।”
-” না!” এবারও কিছুটা ঝাঁঝালো স্বর।

কিছু বোঝার আগেই বাহু টেনে নিজের সাথে মিলিয়ে নিলেন আমায়। অধরে অধরে ছুঁই ছুঁই করে, ললাটে ললাটে মেলালেন। নিজের ফোনে তেমন অবস্থায় ছবি তুলে নিলেন আমাদের। স্মৃতিশক্তি সচল হওয়ার আগেই ছেড়ে দিলেন আমায়। পেন্সিল আর সাদা আর্ট কাগজ নিয়ে বসলেন। পিকটা স্ক্রিনে রেখে আঁকতে শুরু করলেন নিজের মনের ন্যায়।
কেটে গেল বেশ কিয়ংক্ষণ সময়। সূর্য উপরে উঠে গেছে। গাছ গাছালির ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়েছে সে।

অভিমানের পাল্লা ভারী হলো দৃঢ়। নিজের সামনে ধরলেন পেন্সিলে আঁকা রং বিহীন এক ভালোবাসার জুটির ছবি। মুহুর্তের মাঝেই অভিমানের বরফের ন্যায় পাহাড় গলতে গলতে তরল পানির রুপ ধারণ করলো। হাতে টেনে নিলাম কাগজটা। হাতে ছুয়ে দেখলাম প্রতিটি বিন্দু। স্তব্ধ হয়ে বাকশক্তির ক্ষয় হয়েছে আমার। আমার ভাবনায় ফোড়ন কেটে বলেন,

-” তাহলে ডিঙিরানীর অভিমান ভাঙলো। এবার একটু হেঁসে আমার আঁকা টাকে সার্থক কর।”
তার শব্দগুলো হারিয়ে যাওয়ার আগেই হাসি উচ্চে পড়লো।

মধ্যাহ্ন পেরিয়ে গেল। বিকেল সন্ধ্যা গড়িয়ে এলো। পিটপিট করে নয়ন যুগল মেলে তাকালাম। আমি বাসে না থেকে বেডের উপরে ঘুমিয়ে আছি। তখন ভাইয়ার কাঁধে ঘুমিয়ে ছিলাম। ব্যাপারটা সচল হতে বেশ কিয়ৎক্ষণ সময় নিলো। আমার পায়ের কাছে বসে নীরব দৃষ্টিতে কাগজের দিতে তাকিয়ে আছে আরশি। ধীরে ধীরে উঠে বসলাম। পেপার টা টেনে নিলাম। হকচকিয়ে উঠলো আরশি। আচম্বিতে এমন হওয়াতে বেশ ঘাবড়ে গেল।

এক নজর পেপারের দিকে অবলোকন করতেই টনক নড়ল আমার। মুড়িয়ে মুড়িয়ে চুলের ফিতা খুলে বেঁধে পাশে রাখলাম। আরশির এখনো অস্বাভাবিক নীরব চাওনি। তর্জনী কামড়াতে কামড়াতে বলে,

-” কি এটা ঋনী? কি চলছে ভাইয়ার সাথে?”
শীতের মাঝেও ললাটে জমে এলো লবনাক্ত জলকণা। সংকোচে পড়লাম আমি। দ্বিধা নিয়ে বললাম,
-” তুই যেটা দেখতে পারছিস, তেমন কিছু নয়।”
-“যদি তেমন কিছু হতো, আমার চেয়ে কেউ বেশি খুশি হতো না।”
-“মানে!” বালিশে মাথা রেখে সিলিং ফ্যানের দিকে স্থির দৃষ্টিতে বললাম।

-“আমি জানি, তোরা একে অপরকে খুব ভালোবাসিস। অপ্রকাশিত ভালোবাসা। কিন্তু একদিন তোদের ভালোবাসা পূর্ণতা পাবে। আমার ভয়ের জায়গা, মা। তিনি কি সবটা সহজে মেনে নিবে তো?”
সূর্যের আলো বিশাল বিশাল পাহাড়ে বাধ্য প্রাপ্ত হয়ে অন্ধকারের রুপ নিলো। কুয়াশার চাদরে মুড়িয়ে গেল পাহাড়ি অঞ্চল। দুইজন মানব এখনো স্থির। চাতক পাখির ন্যায় হাহাকার করে আছে আরশি নামক মেয়েটি। যেই প্রশ্নের প্রত্যুত্তর আমার কাছে নেই, কি দেওয়া উচিত। ভাঙা স্বরে বললাম,-” অভাগা যেদিকে যায়, সেদিকে সাগর শুকায়। এক তরফা ভালোবাসা গুলো খুব কষ্টদায়ক..

বাক্য শেষ করার আগে মৃদু ছিটকিনি খোলার শব্দ শ্রবণ হলো। উচ্চারণের ইতি টেনে চাইলাম ওয়াশরুমের দরজার সমীপে। বাথরোব পড়ে মেঘলা বেরিয়ে এসেছে। ভেজা চুলে টাওয়াল পেচাতে পেচাতে বেরিয়ে এলো। ছিটকিনি তুলে দিল। পানি মিশ্রিত ছোপ ছোপ পা ফেলে লাকেজ খুলে হাতড়ে নিচ থেকে নিজের প্রয়োজনীয় জামা কাপড় বের করলো। সন্দিহান স্বরে বলল,

-” নায়িকা সাহেবার ঘুম ভাঙল তবে। নায়ক আজকে কতো মেয়েদের হার্ট ফুট করে দিয়েছে, তার হিসেব নেই। একদম কোলে করে রুমে রেখে গেছে। এতো ভালোবাসা আর আমরা কিছু জানি না। তাড়াতাড়ি..
এবারও পুর্বের ন্যায় দরজায় কড়া নাড়ালো কেউ। মেঘলা অসহায় চাওনি দিলো। জামা কাপড় হাত ফসকে নিচে পড়ে গেল। তোলার মতো সময় টুকু তার হলো না। এক ছুটে ওয়াশরুমের ভেতরে।

দরজা ভেড়ানো ছিলো। স্বল্প বয়সী তরুণী স্টার্ফ প্রবেশ করলো। ট্রে ভর্তি খাবার নিয়ে এসেছে। ছোট ছোট পা ফেলে অতি সাবধানতা অবলম্বন করে টেবিলের উপরে রাখলেন। যেমন শব্দহীন প্রবেশ করেছিলেন তেমনি শব্দহীন প্রস্থান করলেন। পরক্ষণে মধ্য বয়স্ক মহিলা প্রবেশ করলেন। প্রতিটি জিনিস সূক্ষ্মভাবে গুছালেন।

অতিবাহিত হলো বহুসময়। দরজার ফোকট দিয়ে ক্রমাগত মাথা হেলিয়ে দিচ্ছে মেঘলা। জামা কাপড় পাল্টে নিল।
মধ্য বয়স্ক মহিলাটাকে বেশ ভালো লাগলো আমার। এক পর্যায়ে তার অনুমতি নিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম।
-” চাচিজান, এই বয়সে আপনি কেন কাজ করছেন?”
তিনি ফিরে চাইলেন আমার সমীপে। হয়তো চাচিজান ডাকাতে ভরসা পেলেন। আঁচলে মুখ গুঁজে কেঁদে উঠলেন। বললেন,

-” কাম না করলে খাইমু কি? পোলা বউ পাইয়া আমগো চিনে না। হের আবার মেলা অসুগ। যা টাহা পয়সা পাই, হে দিয়া অসুধ কিনতে কিনতেই যায়।‌ হাত পা ধইরা এইহানে কাম লইছি।”
নিশ্চুপ রইলাম আমি। আমার প্রিয় জনদের ভালোবাসার অভাব আর তার টাকার অভাব। ব্যাগ খুঁজে হাজার দুয়েক টাকা পাওয়া গেল। টাকা আর খাবার দুটোই প্যাকেট করে দিয়ে দিলাম। তিনি নীরব অনুভূতি শূন্য চাওনি দিলাম। মাথায় হাত রাখলেন আমার। বললেন,

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ১৯

-” বাইচা থাহো গো মা, বাইচা থাহো। আমার দুয়া একদিন তোমারে বাঁচাইয়া আনবো মৃত্যুর মুখ থেকে।”
নিজের জীবনের মানসিক আঘাতগুলো অনুভূতির অন্তরালে যত্ন করে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখলাম। যদি কোনো একাকী প্রহরে নিজের জীবনের ইতি টানতে ইচ্ছে হয়, তখন তার কষ্টের সাথে নিজের কষ্টগুলোর মিশিয়ে, বাঁচার নতুন পথ খুঁজে নিবো।

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ২১