অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ১৯

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ১৯
ইফা আমহৃদ

রৌদ্রের গন্ধ হালকা হতেই ঝিরি ঝিরি কুয়াশা শিশির বেসে ঘাসের উপরে ঝড়ে পড়ছে। গাছের উঁচু মগডালে দাঁড়ালে পুরো গ্ৰাম দেখা যায়। ধান ক্ষেত থেকে নতুন ফসল তুলার ফলে খড়ের নিম্নাংশ মাটির শিকড় আকরে রেখেছে। ফাঁকা ক্ষেত দিয়ে সহজে নিজের গমন পথ অতিক্রম করা সম্ভব।

আরশি আজও গাছের ডালে পা দুলিয়ে বসে আছে। গাছটা ছোট দিঘির দিকে নুইয়ে পড়েছে। তবে বেশি উঁচু ডালে নয়, তার ভার বহন করার মতো ক্ষমতা হয়তো উঁচু নরম ডালের নেই। তার দৃষ্টি অদূরে ধান বিহীন ক্ষেতের মাঝে বন্দী। দূর থেকে অস্পষ্ট পরিচিত মুখ দৃষ্টিগোচর হলো। অতিশয় উল্লাসে রীতিমত হাত পা কাঁপতে আরম্ভ করলো।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আরশি চট করে নামতে চেয়ে ব্যর্থ হলো। পড়ে যেতে নিলো দিঘীর মাঝে। মুঠো দিয়ে আঁকড়ে ধরলো গাছের ডাল। ততক্ষণে বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে এলো। ধরাধরি টানাহেঁচড়া করে উপর থেকে নামালো আরশিকে। আরশি জাপটে ধরলেন তাকে। কিছু বলার ক্ষমতা হলো না কারো। কারণ, তার সমীপে অবস্থান করছে, তার একমাত্র ফুফুজান রুসা। তার ছেলে রাফি এবং রাফির শালা বাবু ফারহান। ছেলের বিয়ে উপলক্ষে দাওয়াত দিতে এসেছেন। রুসা ভাই-বোন দের ভেতরে সবার বড় হওয়াতে তার মুখের উপর কথা বলার ক্ষমতা নেই কারো।

বাড়িতে নিজের পা স্থাপন করতেই মিইয়ে গেল সকলে। রুসা গিয়ে দখল করলেন নিজের আসন। এই আসনটা ব্যক্তিগত তার নিজস্ব। তার অনুপস্থিতিতে এখানে বসার ক্ষমতা কারো নেই। আজ তার আসার খবর পেয়ে ড্রয়িং রুমে সাজানো হয়েছে।

খালাজান কখনো আমায় স্নেহের নজরে দেখেন নি। তার কাছে তার একমাত্র আদরের ছোট বোনের খুনি আমি। খালার আসার খবর শোনামাত্র ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে থাকতাম আমি।‌ আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। নিজের নাম শুনে চমকে উঠলাম। আমাকে ডাকা হচ্ছে। ছোট ছোট পা ফেলে মাথা নিচু করে বেরিয়ে এলাম নিচে। নিচে নামতেই চায়ের আদেশ করলেন মামুনি। চোরের মতো মাথায় কাপড় টেনে রান্না ঘরে ছুটলাম। ট্রে ভর্তি চায়ের কাপ নিয়ে হাজির হলাম। মামুনি চা দিতে বললেন সকলকে। ফুফুর নিজস্ব চায়ের কাপটা এগিয়ে দিলাম, তুললেন না তিনি। ডান হাতটা হাতলের উপর রেখে, ডান পায়ের উপর বাম পা রেখে বাজখাঁই গলায় বলেন,

-“অনি, আমি তোমার বাড়িতে এসেছি। চা খাওয়াতে হলে নিজের হাতে করে খাওয়াবে, জুতো মেরে গরু দান করবে না।”
কাঁপতে কাঁপতে চায়ের কাপটা হাতে ফসকে গেল। মৃদু শব্দে নিচে পড়ে খন্ডিত বিখন্ডিত হলো। চায়ের তরল পদার্থ টুকু শাড়ির পাড়ে গিয়ে ঠেকলো ফুফুর। বিনিময়ে শাড়ির নিচের অংশ টুকু হাতের সাহায্যে উপরে তুলে নিলেন। দৃষ্টিপাত করলেন না আমার সমীপে। তবে মামুনি থেমে রইলেন না। কটু করে বললেন,

-“এই মেয়ে তুই কি কোনো ভালো কাজ করতে পারিস না। তুই অপয়া অলক্ষী জানতাম, তোর দ্বারা সব খারাপই হবে। নিজের মাকে খেলি, বাবার ব্যবসা লাটে তুললি, ভাইকে গুন্ডা-মাস্তান বানিয়েও শান্তি হয়নি তোর। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে বাড়ি থেকে বের করে দেই।”

প্রত্যুত্তর দেবার ভাষাগুলো অন্তরালে রয়ে গেল। ভেতরটা ফাঁকা হয়ে গেল। কাঁচ গুলো না তুলে উল্টো ঘুরে ছুটে গেলাম রুমের ভেতরে। তখনই নির্বিকার ভাবে কিছু একটা বলে চলেছেন মামুনি। তবে তা শ্রবণগোচর হলো না আমার।
মিসেস্ রুসা সূক্ষ্ম চোখে অবলোকন করলেন অনিতাকে। নিচে বসে কাঁচ গুলো ধীরে ধীরে তুলে ট্রে তে রাখলেন। পুনরায় নিজের আসন গ্ৰহন করে বললেন,

-“অনু, আমি তোমার ব্যবহার দেখে আশ্চর্য হচ্ছি। তুমি আমার সামনে আমার বোন-জিকে অপমান করছ। আমার বোনের হায়াত ছিলো ঐ পর্যন্ত, তাই সে আর বাঁচে নি। বাকি রইল ব্যবসায় লোকসান আর তারুণ্যে। আল্লাহ সবকিছু আগেই তার ভাগ্যে নির্ধারিত করে রেখেছেন। তাই আমরা চাইলেও খন্ডাতে পারব না।”
রাগে যথারীতি দেহটা নড়ে চড়ে উঠছে তার। আঁচলটা মাথায় ঠিকমতো পেঁচিয়ে অনিতার আর তার মায়ের মুখোমুখি দাঁড়ালেন। আঙুল তুলে বলে,

-” এই বাড়ি থেকে ওকে বের করার কথা দ্বিতীয় বার মুখে আনবে না। তার অধিকার আছে, কিন্তু তোমার আর তোমার মায়ের কোনো অধিকার নেই। এমন মন মানসিকতা পরিহার করে না পারলে, আমার ছেলের বিয়েতে এসো না।”
বলেই ধীর গতিতে হেঁটে চললেন।

আমি তখন নির্বিকার ভাবে কেঁদে চলেছি। দরজার কড়া নড়ে উঠলো। দরজা খোলার মতো শক্তিটুকু অবশিষ্ট নেই। ধীরে ধীরে শব্দ গুলো বেড়েই চলেছে। উপায়হীন হয়ে দরজা খুলি। খালা জানকে দেখে দরজা থেকে দুকদম পিছিয়ে জায়গা করে দিলাম। রুসা মৃদু হাসেন। গালে হাত রেখে ললাটের মধ্যেখানে অধর ছুয়ে দিলেন।
পায়ের নিচের অংশ শুন্যতার মতো অনুভব হলো আমার। নোনাজল গড়িয়ে পড়লো গাল বেয়ে। এখনো হাতটা গালের মাঝে রক্ষিত। কাঁপা কাঁপা হাতজোড়া ঠেকালাম হাতের উপর। তিনি হাত সরিয়ে নিলেন। পানিটুকু মুছিয়ে দিলেন স্বযত্নে। অধর জোড়া নাড়িয়ে বললাম,

-“ফুফু বিশ্বাস করো, আমি ইচ্ছে করে করি নি।”
-” পাগল মেয়ের কথা শোন, তোর সাথে যে আমার আত্মার সম্পর্ক। আমার বোনের রক্ত। তোকে বিশ্বাস করবো না-তো কারে কবর?”
কিছু সময়ের জন্য মনে হলো সুখের সবোর্চ্চ সুখের দেখা মিলে। সূর্য নেই আকাশে, মস্ত বড় একটা চাঁদ উঠেছে আকাশে। পূর্ণ চাঁদ। পূর্ণিমার চাঁদ। আমার আকাশে আজ প্রথমবার সেই অচেনা চাঁদ।

অম্যাবর্ষা তিথি। আকাশের চাঁদের অস্তিত্ব নেই। চাঁদ লুকিয়ে পড়েছে পৃথিবীর বুকে। রাত দশটাকে দুটোর বেশি মনে হচ্ছে। আরশি হোস ফাস করছে। পরপর দুটো বাস ছুটে গেল তার কাঙ্খিত জায়গার উদ্দেশ্য। কিন্তু অরিশদের বাস এখনো গতিশীল হলো না। আরশি অরিশের মুখপানে চেয়ে নেমে যেতে উদ্দেগ হলো। তার ইচ্ছে পূরণ হলো না। প্রবেশদ্বার অতিক্রম করে পা রাখতেই কেউ বাঁধা দিয়ে হাত রাখলো দরজার মাঝ বরাবর।

তদানীং গতি থামাতে পাশ ফিরলো আরশি। বিনিময়ে বাসের দরজার সাথে মাথা ঠেকলো। মাথায় হাত চেপে মানুষটির দিকে তাকাতেই তার রাগ আগ্নেয়গিরির রুপ ধারণ করলো। অপূর্ব এসেছে। মুখে মাস্ক দিয়ে ঢাকা, মাথায় ক্যাপ। হুট করে কারো পক্ষে চেনা সম্ভব নয়। কিন্তু আরশি অপূর্ব কে এতোটাই হৃদ মাঝারে স্থানে দিয়েছে, তাকে দেখার প্রয়োজন পড়ে না।অপর হাত গান গালে রাখল। কিন্তু এই গালে অপূর্ব তাকে মারে নি, মেরেছে বা-গালে। দ্বিতীয় বার নিজের ধ্যান পরীক্ষা না করেই মাথায় হাত চেপে একদম পেছনের সিটে গিয়ে বসলো।

অরিশ মৃদু শব্দে চপল মারল অপূর্বের কাঁধে। অপূর্ব ফিরে চাইলো। ক্লান্তিমাখা হাঁসি দিলো। সাথে অরিশও হাসলো। বলে,
-“এলি তবে! আমি তো মনে করেছিলাম, তোর সময় হবে না।”
-” আমি না এলে খুকি কে কখনো যেতে দিতাম না। সেদিন যা হলো। তাছাড়া বোনের চেয়ে অন্য কিছুর কোনো মূল্য নেই আমার কাছে।”

অরিশের মুখে তখন দেখা মিললো অচেনা মানুষের। সন্তর্পণে পা ফেলে বলে,
-” তাহলে যা, তোর খুকির কাছে বস।”
-“নো, ইউ হেভ টু গো।”

অরিশ নীবর চাইনি নিক্ষেপ করে চলে গেল। অপূর্ব সামনে পেছনে দৃষ্টিপাত করে আরশি দিকে স্থির চাওনি দিল। মেয়েটাকে সেদিন মেরেছে। প্রথমবার কোনো রমনীকে আঘাতপ্রাপ্ত করেছে। আরশি জানালার পার্শে বসা। তার সামনে একটা যুবক তরুণী বসেছে। অপূর্ব মেয়েটিকে অন্য কোথাও বসার অনুরোধ করলো। মেয়েটি দ্বি মুহূর্ত না ভেবে প্রস্থান করলো। অপূর্ব সৌজন্য হাসি মুখে রেখে বিনা বাঁধায় দখল করে নিল আসনটা।

পেরিয়ে গেল কিছু সময়। পাশের মানুষটিকে দেখার বিন্দুমাত্র আকাঙ্ক্ষা নেই তার। আরশি অতিশয় ক্ষোভে জানালার বাইরে মাথা বের করে রইল। একহাত চাদর পেরিয়ে জানালায় স্থাপন করা। শীতলতায় আরশির লোমকূপ দাঁড়িয়ে গেছে। অপূর্ব টেনে টেনে বলে,

-” তোমার ঠান্ডা লাগছে, জানালা বন্ধ করে দাও।”
আরশি ফিরে চাইলো না। জানালাটা আরো খুলে দিলো। শো শো করে ভেতরে হাওয়া ছড়িয়ে পড়লো। দেহে পেঁচানো উমের শাল খুলে নিচে রেখে দিল। প্রমাণ করতে চাইলো, তার শীত করছে না।
অপূর্ব নিজের ভাবনায় বিভোর হলো। আরশির খুলে রাখা শাল দেহে পেঁচিয়ে সিটে মাথা হেলিয়ে ক্লান্ত লোচন যুগল গ্ৰথণ করে নিল। নিরবতার হৃদ মাঝারে আরশির নাম রাখল, পাবনা ফেরত পাগল। চিতল মাস, ভাঙা চিরুনি, আয়নার সাথে যোগ করলো এই নাম।

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ১৮

আরশি বেজায় চটে গেল। ধাড়াম করে জানালার ছিটকিনি তুলে দিল। তদানীং আলোক শূন্যতায় ডুবে গেছে বাসের অভ্যন্তরীণ। শরীরের কম্পনের মাত্রা বেড়ে গেছে। যেন কোনো বরফ সীমান্ত থেকে ভ্রমন করে এসেছে নতুবা ফ্রিজের অন্তর্ভাগে বিরাজ করছিলো সে।

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ২০