অনুভূতির শীর্ষবিন্দু গল্পের লিংক || Nurzahan Akter Allo

অনুভূতির শীর্ষবিন্দু পর্ব ১+২+৩
written by Nurzahan Akter Allo

–“যে ছেলের পেট টানটান হবে। যার পেটে কোনো মেদ থাকবেনা। আমি ভেবেছি এমন একটা ছেলেকে বিয়ে করবো। কারন ভুঁড়িওয়ালা বা বেশি স্বাস্থ্যবান অবিবাহিত ছেলের পেট মোটা থাকে। আর অতি সহজেই তাদের কোমর বেঁকে যায়। কোমর বেঁকে যাওয়ার প্রধান সমস্যা হলো’ টেস্টোস্টেরন হরমোনের’ সমস্যা। টেস্টোস্টেরন হরমোনের সমস্যার কারনেই দিন দিন তাদের কোমর বেঁকে যেতে থাকে,চুল পড়া শুরু করে, পেশি দূর্বল হতে থাকে,বদমেজাজী হয়ে যায়। অর্থাৎ যাদের পেট টানটান না সে সব ছেলে হরমোনজনীত রোগে ভোগে। তাই আমি ভেবে রেখেছি..।”
কথাটা বলে তিতিক্ষা নিজেই হো হো করে হেসে দিলো। বিভা হাঁটা থামিয়ে দিয়ে, তিতিক্ষার দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে। একটুপর সে নিজেও হেসে ফেললো। বিভা তিতিক্ষাকে জিজ্ঞাসা করেছে,
–“এই বনু তোর কেমন ছেলে পছন্দ বল তো?”

বিভার এমন প্রশ্ন শুনে তিতিক্ষা মুচকি হেসে উপরের কথাটা বললো। বিভা তিতিক্ষার থেকে এমন উওর পেয়ে হাসতে হাসতে লুটোপুটি খাচ্ছে। দুইবোন একসাথে বের হয়েছে প্রাইভেট পড়তে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। ওরা সম্পর্কে কাজিন ।বিভা এবার এসএসসি দিবে আর তিতিক্ষা অনার্স ২য় বর্ষের ছাত্রী। দু’জনেই বাসায় থেকে একসাথে বের হয়। আর বেশ খানিকটা রাস্তা একসাথে যাওয়ার পর আলাদা হয়ে যায়।কারন দুইজন দুই টিচারের কাছে পড়ে। হালকা শীতের পাতলা লেডিস চাদর দুজনেই শরীরে জড়িয়ে নিয়েছে। ওরা একটু সামনে এগোতেই দেখলো শিউলি ফুল বিছিয়ে আছে পুরো রাস্তা জুড়ে। শুভ্র শিউলি ফুলের মাদুর বিছানো যেন রাস্তাটুকুতে। সুগন্ধ ছড়িয়ে চারদিকে মৌ মৌ করছে। তিতিক্ষা আর বিভা দুজনেই এক মুঠো করে শিউলি ফুল তুলে নিলো। এরপর আবার দু’বোন গল্প করতে করতে সামনের দিকে অগ্রসর হলো।
শীতের আগমন ঘটেছে। শুষ্ককাঠিন্য ও রিক্ততার বিষাদময় প্রতিমূর্তি রূপেই শীত আবির্ভাব ঘটে। তবুও শীতকালের প্রকৃতি ও মানুষের পরিবর্তনের বাস্তব লীলা অনেকেরই ভালো লাগে। বলা যায় যে, কবি সাহিত্যিক সংস্কৃতমনা মানুষের কাছে শীত কাল কাব্য সৃষ্টিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটাও বলতেই হয় যে, বিশ্বের যত মনোরম দৃশ্যের স্থান আছে। সেই গুলোর মধ্যে শীত প্রধান স্থান-ই বেশি। তাই শীতল সেই সকল এলাকা অনেকেরই মন ছুঁয়ে যায়। স্বাভাবিক ভাবেই এ দেশেও শীতকালীন আবহাওয়া অনেকের খুব পছন্দ। শীত এসে আমাদের কে যেন নতুন করে প্রকৃতির সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। শীতের ঠান্ডা বাতাস। আর শিশির ভেজা ঘাসের উপর মুক্তোর মতো দানা। সকাল-সন্ধ্যার কুয়াশার চাদর মুড়ে দেয় চারপাশ। ভোরের কাঁচা রোদ, হিমেল হাওয়া প্রাণে তুলে শিহরণ। পৌষ-মাঘ শীতকাল হলেও অগ্রহায়ণ থেকে শীতের শুরু। এসময় প্রকৃতিকে আমরা নতুন করে আবিষ্কার করি। কুয়াশায় আচ্ছন্নতা ঘিরে রাখা চারপাশে দিনের সূর্য ঢেলে দেয় মায়াবি রোদ। রাতের আকাশে রূপালি তারা খচিত শুভ্রতা ছড়িয়ে পড়ে। চাঁদের ধবধবে সাদা জোছনার পূর্ণিমা চাঁদ হয়ে ওঠে শিশির ধোয়া রূপার থালা।
তিতিক্ষা আর বিভা কেবল বাসায় ফিরলো। দুজনে বসে বসে সবার কার্যকলাপ গুলো পরিদর্শন করছে। বাসায় পুরোদমে গোছগাছের কাজ চলছে। সোফার কভার থেকে শুরু করে পাপোস পর্যন্ত সব বদলে ফেলা হচ্ছে। পরিপাটি করে সাজানো গুছানোর কাজ চলছে পুরো ফ্ল্যাট জুড়ে। বিভা উঠে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল। তিতিক্ষাও বসে না থেকে ওর রুমে চলে গেল ফ্রেস হওয়ার জন্য। ফ্রেস হয়ে খেয়ে বেডে বসতে না বসতেই মামনির আগমন। মামনি কাজের মেয়ে জোসনাকে ডেকে তিতিক্ষার রুমের বেডশীট থেকে শুরু করে, জানালার পর্দা গুলোও বদলে ফেলার হুকুম দিলো। জোসনা গুনগুন করতে করতে তার কাজে লেগে গেল।
মামনি তিতিক্ষার সামনে সাথে এসে বললো,–

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

–“তিতিক্ষা মা তোর আব্বু আম্মু আজকে আমাদের বাসায় আসছে।”
তিতিক্ষা ভ্রু কুঁচকে মামনির দিকে তাকালো। কিন্তু ওর মামনি যেমন ঝড়ের গতিতে এসেছিলো। তেমনি তিতিক্ষাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে, ঝড়ের গতিতে রুম ত্যাগ করলো। তবে তিতিক্ষা ওর মামনির মতিগতি কোনদিন বুঝতে পারিনা। আজও কিছু বুঝতে পারলো না। তাই শুধু শুধু বৃথায় বোঝার অভিযান না চালিয়ে, তিতিক্ষা ওর ফোনটা নিয়ে বারান্দায় চলে গেল। বাসায় হয়তো কোন গেস্ট আসবে। সবার কাজ দেখে তো তেমনটাই মনে হচ্ছে। এজন্য তিতিক্ষা আর সেদিকে পাত্তা দিলো না।তবে একটা কথা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে,
— “আব্বু আম্মু আসছে তাহলে আমাকে কিছু জানালো না কেন?”
তিতিক্ষার বাবার বিজনেস আছে। আর ওর মা একটা কলেজের প্রফেসর। দুজনেই খুব বিজি মানুষ। তিতিক্ষা উনাদের একমাত্র মেয়ে। উনারা তিতিক্ষাকে একেবারেই সময় দিতে পারেনা। তিতিক্ষাও এক বাসায় মোটেও থাকতে চাই না। এজন্য সে এখানে ওর ভাই বোনদের সাথে মজা করে থাকতে চাই। তিতিক্ষার মনে হয় এটাই ওর নিজের বাসা। এখানেই সে খুব ভাল থাকে। ওদের ভাইবোনদের মধ্যে সবার সাথে গভীর ভালবাসাপূর্ন সম্পর্ক। এজন্য তিতিক্ষা ওর বাবা-মার কাছে বেশিদিন থাকতেও চাইনা।
তিতিক্ষা ওর খালামনি অর্থাৎ মামনির কাছে থাকে। মামনির চারজন ছেলে মেয়ে। সবচেয়ে ছোট ছেলে অাহান,(ক্লাস ৭ম)। যে দুষ্টুর শিরোমণি। নবীন বাসার বড় ছেলে (খুলনাতে ইন্জিনিয়ারিং পড়ছে)। তনুকা বাড়ির বড় মেয়ে(ডাক্তারী পড়ছে)আর বিভা সে এবার (এসএসসি) দিবে। মামনির হাজবেন্ড সারোয়ার জামান উনারও নিজের বিজনেস আছে।উনি ভোজনরাশিক, খোশ মেজাজী, রসিক টাইপের অমাইক একজন মানুষ।

আহান, নবীন, বিভা, ড্রয়িংরুমে কিছু একটা নিয়ে মারামারি করছে। আহানের গলার ফুল পাওয়ারের সাউন্ড ভেসে আসছে । জোসনা একটু পর পর তিতিক্ষার দিকে তাকিয়ে হাসি দিচ্ছে। তিতিক্ষা এই নিয়ে তিনবার জোসনাকে জিজ্ঞাসা করলো ওর এভাবে তাকানো আর হাসার কারন।কিন্তু জোসনা প্রতিউত্তরে কিছু বলেনি। শুধু বোকার মত হেসেছে। তিতিক্ষা বারান্দায় বসে কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে পছন্দ মত একটা গান শুনছিলো। তখনই আবার ওর মামনি দ্রুত পায়ে এসে তিতিক্ষার কানে থেকে ইয়ারফোন কান থেকে খুলে নিলো। তিতিক্ষা কিছু বলার আগেই মামনি টাওয়াল আর ড্রেস ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে ওয়াশরুমের ভেতর ঢুকিয়ে দিলো। তিতিক্ষার আর না দাঁড়িয়ে গিজার অন করে হট সাওয়ার নিলো। ওয়াশরুমে থেকে বের হয়ে দেখে তিতিক্ষার আব্বু আম্মু ওর রুমে বসে আছে। তিতিক্ষা উনাদের দিকে এগিয়ে গিয়ে কুশল বিনিময় করলো।তিতিক্ষার আব্বু আজমাইন ইয়াসির ও আম্মু আফিয়া ইয়াসির তিতিক্ষার সাথে কথা বলে চলে গেল। একটুপর মামনি একহাতে ওনার মাথায় আইস ব্যাগ। আর অন্য হাতে কলাপাতা কালার কাতান জামদানি শাড়ি নিয়ে তিতিক্ষার হাতে ধরিয়ে দিলো। শীতেও মামনি আইস ব্যাগ মাথায় নিয়ে ঘুরছে। কারন বাসায় স্পেশাল গেস্ট আসবে কিছুতেই যেন উনার মাথা গরম না হয়। আর এত টেনশন দৌড়াদৌড়ি মধ্যে মাথা ঠান্ডা রাখা সম্ভব হচ্ছে না। তাই উনি এই পন্থা অবলম্বন করেছে। তিতিক্ষা ওর মামনি দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো। তবে কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই ওর আব্বু রুমে প্রবেশ করলো। এজন্য তিতিক্ষা চুপ করে গেল। তিতিক্ষার আব্বুকে দেখে ওর মামনি রুম ত্যাগ করলো।
তিতিক্ষা ওর আব্বু দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিলো। তখন ওর আব্বু তিতিক্ষাকে ওনার পাশে বসিয়ে দিলো।আর তিতিক্ষার দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

–“আম্মু আজকে তোমার এংগেজমেন্ট। আশা করি তুমি আমার পছন্দের উপর ভরসা করো?”
এই কথা শোনার সাথে তিতিক্ষা অবাক হয়ে ওর আব্বুর দিকে তাকালো। মনে হচ্ছে, পুরো আকাশটা ভেঙে ওর মাথার উপর পড়েছে। তিতিক্ষা ছলছল চোখে ওর আব্বুর দিকে তাকিয়ে থাকলো। আজকে ওর এংগেজমেন্ট। তারমানে ‘ওর আব্বু ওকে পর করে দিচ্ছে’। তিতিক্ষার মাথায় শুধু এই কথায় ঘুর পাক খাচ্ছে । মেয়ের চোখে পানি দেখে তিতিক্ষার আব্বু যতটুকু বলে মেয়েকে বোঝানো সম্ভব।
উনি তেমনভাবেই বোঝালো। এরপর রুম ত্যাগ করার জন্য দরজার কাছে পা বাড়াতেই তিতিক্ষা কান্না জড়ানো কন্ঠে বললো,
–“আমি কি এখন খুব বেশি তোমাদের কাছে আবদার করি আব্বু? আমি কি তোমাদের কাছে বোঝা হয়ে গেছি? এজন্যই বুঝি পর করে দেওয়ার জন্য এত তাড়াহুড়ো শুরু করেছো?”

তিতিক্ষার আব্বু মেয়ের অভিমান বুঝতে পারলো। উনি উনার চোখের জমে থাকা পানিটুকু আড়াল করে গলা পরিষ্কার করে বললো,
–“আলহামদুলিল্লাহ! আমি একটা মেয়ের বাবা। প্রতিটা বাবার দায়িত্ব সুপাত্রের হাতে তার রাজকন্যাকে তুলে দেওয়া।প্রতিটা বাবাই চাই তার কলিজার টুকরোকে কেউ একজন স্বযত্নে আগলে রাখুক। ছায়া হয়ে সব সময় তার পাশে থাকুক। কেউ একজন এসে তার দিকে ভরসার হাত বাড়িয়ে দিক। এক মুঠো সুখ দিয়েই বাবার রাজকন্যাদের সুখে রাখুক। আমিও তো একজন বাবা। তাই আমিও এসব খুব করে চাই। আম্মু আমার সোনা আম্মু কষ্ট পেও না। সব মেয়েদেরই একদিন শশুড়বাড়ি যেতে হবে। শশুড় শাশুড়িকে বাবা-মা হিসেবে মেনে নিতে হবে। একটা ছেলেকে ভাল রাখার সব দায়িত্ব নিতে হবে। আমি সব বাবাদের মত ছেলেকেই শুধু বলবো না, বাবা আমার মেয়েকে ভাল রেখো।আমি বলবো,’আম্মু তুমিও ভাল থেকো আর যার হাত ধরে পথচলা শুরু করবে তাকেও ভালো রেখো।’ আম্মু বিয়ে হলো যোগ বিয়োগের অদ্ভুত এক খেলা। নতুন কিছু আগমন আর অনিচ্ছাকৃতভাবে হলেও প্রিয় কিছু জিনিসের ত্যাগ স্বীকার করা। এটাই যে আমাদের সমাজের নিয়ম। উনারা আপাতত এংগেজমেন্টটা করে রাখবে। পরে তোমার অনার্স কমপ্লিট করার পর অনুষ্ঠান করবো। ততদিনে তোমরা দুজন দুজনাকে বুঝে নেওয়ার সময়ও পাবে।”

তিতিক্ষা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেই যাচ্ছে। ওর আব্বু ওর চোখের পানি মুছে কপালে একটা আদর দিয়ে চলে গেল।তিতিক্ষার বাবার কথা গুলোও ফেলার না। তারপরেও ওর কেন জানি এত কষ্ট হচ্ছে। তনুকা ওর ক্লাস শেষ করে বাসায় চলে এসেছে। বিভা আর তনুকা মিলে তিতিক্ষাকে ওর রুমেই সাজিয়ে দিলো। একদম সিম্প্যাল সাজ যাকে বলে। চোখের পানিতে বার বার কাজল লেপ্টে যাচ্ছে। এজন্য তনুকা তিতিক্ষাকে বেশ কয়েকবার বকা দিলো। তিতিক্ষার কেন জানি চাইলেও ওর চোখের পানিকে আটকাতে পারছেনা।বুকের ভেতরে অদ্ভুত এক কম্পনের সৃষ্টি হয়েছে। নিঃশ্বাস আটকে যাচ্ছে। এ কেমন অঙ্গাতনামা ভয়ংকর অনুভূতি। এমন মারাত্মক ভাবে হৃদপিন্ডটা ধুকপুক করার কারনটাই বা কি?
গেস্টরা চলে এসেছে। আহান চিৎকার করতে করতে মিনি সাংবাদিক সেজে, এই তথ্যটা দিয়ে গেল। ড্রয়িংরুম থেকে অনেক জনের কথার আওয়াজ ভেসে আসছে। একটুপর খুব কিউট একটা মেয়ে রুমে ঢুকে বললো,
–“মাশাল্লাহ আমার ভাবিমনিকে দেখতে দারুন লাগছে।”
কথাটা বলে মেয়েটি মুচকি হাসি দিলো। তিতিক্ষাও সৌজন্যমূলক হাসি বিনিময় করলো। এরপর নিজে থেকেই মেয়েটি ওর পরিচয় দিলো। ও হচ্ছে পাত্রের ছোট বোন অদ্রি । তিতিক্ষাকে অদ্রি এটা ওটা জিজ্ঞাসা করছে। আর তিতিক্ষার অল্প কথায় সেগুলোর উওর দিচ্ছে। এরপর মামনি এসে তনুকা আর বিভাকে বললো তিতিক্ষাকে ওখানে নিয়ে যেতে। তিতিক্ষা খুব কাঁপছে। ওর শরীর যেন অসাড় হয়ে পড়ছে। বুকের ভেতর ধড়ফড় করাটা যেন দ্রুত গতিতে বেড়েই চলেছে। হৃদপিন্ডটা যেন আজকে বেইমানী খেলায় মেতে উঠেছে। অচেনা অজানা একটা ছেলেকে আজকে জীবনসঙ্গী হিসেবে গ্রহন করতে হবে। এটা ভাবলেই যেন গলা শুকিয়ে মরুভূমির হয়ে যাচ্ছে। সাথে হাত আর পা ঘেমে ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে ।

মৃদু পায়ে হেটে বিভা তিতিক্ষাকে নিয়ে গেল ড্রয়িংরুমে।মামনির শিখিয়ে দেওয়া কথা অনুযায়ী, তিতিক্ষা উপস্থিত সবাইকে সালাম দিলো। একজন মহিলা এসে তিতিক্ষাকে একটা ছেলের পাশে বসিয়ে দিলো। মহিলাটি তিতিক্ষার সাথে খুব সুন্দর করে কথা বলছে। উনি তিতিক্ষার কপালে আদর দিলো। তিতিক্ষা চোখ তুলে উনাররদিকে একবার তাকালো।উনি তিতিক্ষার থুতনী ধরে জিজ্ঞাসা করলো,
–“আম্মু তুই দেখতে একদম বারবী ডলের মত রে।এবার তোর পুরো নাম বলতো শুনি।”
তিতিক্ষার মৃদু স্বরে বললো,
–“তাবিয়া নুজহাত তিতিক্ষা।”
উনি নাম শুনে, মহিলাটি আবার তিতিক্ষার একটা কপালে আদর দিলো। মহিলাটির বচন ভঙ্গি আর ড্রেসআপ দেখে মনে হচ্ছে, সে যথেষ্ট স্মার্ট এ্যান্ড স্টাইলিশ। মহিলাটি তিতিক্ষাকে যে ছেলের পাশে বসিয়েছে । সেই ছেলেটিকে উদ্দেশ্য করে বললো,
–“এই আব্বু আমার মেয়েকে তোর পাশে বসালাম। খবরদার বলছি দুইবারের বেশি তাকাবি না। নাহলে আবার আমার আম্মুটার তোর নজর লেগে পিমপোল উঠতে পারে। তোর তো আবার বিড়াল মার্কা নজর।”

একথা শুনে সবাই হো হো করে হেসে দিলো। পাশে বসা ছেলেটিও যে নিঃশব্দে হাসছে। সেটা তিতিক্ষা বুঝতে পারছে।অদ্রি সবার সাথে তিতিক্ষার পরিচয় করিয়ে দিলো। স্মার্ট মহিলাটির হলো পাত্রের আম্মু মৃধা আবরার। আর উনার ডানপাশে বসে থাকা ভদ্রলোকটি আতিফ আবরার(পাত্রের বাবা)। সামনে বসে থাকা তিনটা ছেলে উনারা হলো পাত্রের বন্ধু আফান, রুহান,‌ সাফওয়ান। তিনটা ছেলেই যথেষ্ট ভদ্র আর সুর্দশনও বটে। পরিচিত হওয়ার সময় তিতিক্ষা সবার দিকে তাকিয়েই ভদ্রতাসূচক মুচকি হাসি দিলো। অদ্রি এবার হেসে বললো,
–“আর পাশে বসে থাকা ছেলেটি হচ্ছে তোমার হবু বর। আর আমার ভাইয়া। আমার ভাইয়ার জন্যই আমরা তোমাকে নিতে এসেছি হুম। তোমার বরের নাম হলো, ‘নাহিয়ান আবরার নক্ষত্র।’ নামটা আবার ভুলে যেও না কিন্তু।”
অদ্রির কথা শুনে রুমে ভেতর আরেক দফা হাসির রোল পড়লো। বর শব্দটা শুনে তিতিক্ষার মনের ভেতর অদ্ভুত এক অনুভূতি অনুভব করতে পারছে। সবার সাথে পরিচয় করার সময় তিতিক্ষা এক নজর সবার মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বললেও, সে নক্ষত্রের দিকে তাকালো না। তিতিক্ষা মাথা নিচু করে বসে আছে। আর কিভাবেই বা এতগুলো গুরুজনদের সামনে বেহায়ার মত তাকাবে। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকানোটা মোটেও শোভনীয় নয়। পাশের বসা ছেলে যে কেমন হবে? এটা নিয়ে তিতিক্ষার আপাতত কোন টেনশন নেই। কারন তিতিক্ষার ওর বাবার চয়েজের উপর ওর যথেষ্ট ভরসা আছে।

ড্রয়িংরুমে সবাই কথা বলছে। নক্ষত্রও মাঝে মাঝে দু’একটা কথা বলছে। তিতিক্ষা নক্ষত্রকে না দেখলেও, নক্ষত্রের পারফিউমের সুগন্ধটা তিতিক্ষার নাকে এসে বারি খাচ্ছে। আর ওর পারফিউমের মৃদু সুগন্ধটা মন ভাল করার মত।তিতিক্ষা এতটুকু বুঝলো, ছেলেটার পছন্দ রুচিসম্মত ।নক্ষত্রের আম্মু নক্ষত্রের দিকে একটা রিং এগিয়ে দিলো।নক্ষত্র রিং নিয়ে তিতিক্ষার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো।তিতিক্ষা বার বার ওর হাত মুচড়াচ্ছে। আর তিতিক্ষার চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে ওর হাতে পড়ছে। বারবার হাত মোচড়ানোর কারনে ওর হাত লাল হয়ে গেছে। নাকের ডগাটাও লাল বর্ণ ধারণ করেছে। নক্ষত্র তিতিক্ষার এমন করার মানেটা খুব সহজেই বুঝতে পারলো। আর এখানে না বোঝার মত কিছু নেই। আসলে তিতিক্ষা খুব নার্ভাস ফিল করছে। হয়তো ভয়ও পাচ্ছে। নার্ভাস হওয়াটাও অস্বাভাবিক কিছু নয়। তিতিক্ষার অবস্থা বুঝতে পেরে, তিতিক্ষাকে অভয় দেওয়ার উদ্দেশ্যে নক্ষত্র মৃদু কন্ঠে বললো,
–“এমন মায়াবী অনায়াসে কাউকে ঘায়েল করা কাজল কালো দু’নয়নে অশ্রুর ফোঁটা বড্ড বেমানান। প্রিয় থেকে প্রিয়তরও মানুষটার চোখে অশ্রু দেখলে, যে কোন একজনের কলিজাটাও যে কেঁপে ওঠে। এটা কি কেউ বুঝে?” (আদুরে সুরে ধীর কন্ঠে)

–“এমন মায়াবী অনায়াসে ঘায়েল করা কাজল কালো দু’নয়নে অশ্রুর ফোঁটা বড্ড বেমানান। প্রিয় থেকে প্রিয়তরও মানুষটার চোখে অশ্রু দেখলে, কোন একজনের কলিজাটাও যে কেঁপে ওঠে।এটা কি কেউ বোঝে?” (আদুরে সুরে)
নক্ষত্রের মুখে এমন কথা শুনে তিতিক্ষা অবাক হয়ে নক্ষত্রের দিকে তাকালো। চোখের কোণে জমে থাকা এক বিন্দু পানি টুকুও না চাইতেও ওর গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো। তিতিক্ষা নক্ষত্রের চোখের দিকে সাত সেকেন্ডের মত তাকিয়ে ছিলো। আচানক ক্যামেরাতে পিক তোলার শব্দে তিতিক্ষা দৃষ্টি সরিয়ে মাথা নিচু করে নিলো। এত সুন্দর মুহূর্তটাকে সাফওয়ান ক্যামেরা বন্দি করে নিয়েছে। তিতিক্ষা অবাক হয়ে তাকানোর সময় নক্ষত্র চোখে ওর চোখ পড়েছে। কেমন অদ্ভুত চোখের চাহনি। চোখ দিয়েই যেন অপ্রকাশিত না বলা ভাষা বুঝে নেওয়া সম্ভব হবে। চোখের এমন মারাত্মক চাহনি যে কোন মেয়ের মন কেড়ে নিতে সক্ষম হবে।
তিতিক্ষা এর আগে কোন ছেলে চোখে চোখ রেখে কথা বলেনি। এজন্য হয়তো ওর জানা নেই।যে কিছু কিছু ছেলের চোখের চাহনিতে মারাত্মক কোন এক মায়া
লুকিয়ে থাকে। নক্ষত্রের এমন অদ্ভুত দৃষ্টি তিতিক্ষার বুকের ভেতর তোলপাড় সৃষ্টি করছে। ওর পুরো শরীর এখনও মৃদুভাবে কাঁপছে। বার বার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। হৃদপিণ্ডটা ঢোল বাজানোর মত করে কম্পিত হচ্ছে। মনে হচ্ছে এক্ষুনি ছিটকে বেরিয়ে যাবে। এ কেমন অদ্ভুত অনুভূতি! এর আগে তো এমনটা হয়নি। তিতিক্ষার মনে হচ্ছে ওর কানের কাছে নক্ষত্রের বলা প্রতিটা শব্দ প্রতিধ্বনি হয়ে চারদিকে বেজে উঠছে। তিতিক্ষার অবস্থা বুঝতে পেরে নক্ষত্র আর কথা বাড়ালো না। নিজেই তিতিক্ষার হাতটা টেনে নিয়ে ওর অনামিকা আঙ্গুলে রিং পড়িয়ে দিল। তিতিক্ষা তখনো মাথা নিচু করে ছিলো।এরপর কাঁপা হাতেই তিতিক্ষা নক্ষত্রের আঙুলেও রিং পড়িয়ে দিলো।বাসার সবাই তখন আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠলো। তিতিক্ষা যে কাঁপছে নক্ষত্র ওর হাত ধরেই বুঝতে পারছিলো। ওর হাতটাও তখন ঘেমে একাকার অবস্থা।
রিং পড়ানো হয়ে গেলে সবার করতালিতে নক্ষত্রের ধ্যান ভাঙ্গলো। নক্ষত্রের আব্বু তো বলেই ফেললো,

–“আব্বাজান এবার আপনি খুশি তো”?
নক্ষত্রের মুখে তখন বিশ্বজয় করা হাসি। নক্ষত্র ওর আব্বু আম্মুর দিকে তাকিয়ে ইশারাতে কৃতজ্ঞতা জানালো। ছেলের এমন কাজে নক্ষত্র বাবা-মা দুজনেই মুচকি হাসি দিলো। নক্ষত্রের আব্বু আম্মু দুজনেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।
তিতিক্ষার খালু সবাইকে মিষ্টি মুখ করালেন। সবার মুখে তৃপ্তির হাসি বিরাজমান। রুহান আর সাফওয়ান নক্ষত্রকে খোঁচাচ্ছে। কিন্তু নক্ষত্রের সেদিকে খেয়াল নেই। সে আড়চোখে তিতিক্ষাকে দেখতে ব্যস্ত। এত হালকা সাজে একটা মেয়েকে এত মায়াবী লাগতে পারে? এটা নক্ষত্রের জানা ছিল না। এই মায়াবী পরীটাই এখন থেকে ওর হবু বউ। একথা ভাবলেই নক্ষত্রের নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ হিসেবে গন্য করতে মন চাচ্ছে । রুহান নক্ষত্রের পেটে কনুই দিয়ে গুঁতো মেরে বললো,
–“শালা হামলার মত তাকিয়ে আছিস কেন? বাচ্চা মেয়েটার এবার সত্যি সত্যিই নজর লেগে যাবে তো।” (রুহান ফিসফিস করে)
–“বিয়ে না হতেই ওর এই অবস্থা মাম্মা। না জানি বিয়ের পর তো ও রুম থেকেই বের হবেনা।” (সাফওয়ান বিরবির করে)
–“ভাই তোরা এমন করিস না তো। তৃষার্ত চোখ দুটোকে তৃষ্ণা মিটাতে দে। কোনটাই তো তোদের অজানা নয়।” (আফান মুখে হাত দিয়ে বিরবির করে)

তিতিক্ষার খালু আর ওর আব্বু দুপুরে লাঞ্চের জন্য সবাইকে ডাইনিং টেবিলে যাওয়ার আহ্বান জানালো। নক্ষত্র আশে পাশে একবার চোখ বুলিয়ে চেয়ার টেনে বসলো। নক্ষত্রের আম্মু, তিতিক্ষার আম্মু আর মামনি তিনজন তো গল্প জুড়ে দিয়েছে। ওদের দেখে মনে হচ্ছে, ওরা কতকাল আগের পরিচিত। নক্ষত্রের আম্মুর যথেষ্ট মিশুক আর বন্ধুসুলভ আচরণ করে ছেলেমেয়েদের সাথে। নক্ষত্র আর অদ্রি ওদের সব পার্সোনাল কথা ওদের আম্মুকে শেয়ার করে। তখন নক্ষত্রের আম্মু নক্ষত্রের সাথে তিতিক্ষা কে নিয়ে এজন্যই মজা করছিলো। আর এই ব্যাপারটাতে প্রথমে তিতিক্ষার পরিবার অবাক হলেও পরে বুঝলো যে, নক্ষত্রের আম্মু যথেষ্ট বন্ধুসুলভ এবং রসিক টাইপের একজন মহিলা।
সবাই খেতে শুরু করেছে। নক্ষত্রের আব্বুর সাথে তিতিক্ষার খালু আর আব্বু কথা বলছে। মাঝে মাঝে তিতিক্ষার আব্বু নক্ষত্রকে কিছু জিজ্ঞাসা করছে। নক্ষত্র মুচকি হাসির সাথে উনার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে। নক্ষত্রের আম্মু তিতিক্ষা কে শাড়ি চেঞ্জ করে আসার জন্য রুমে পাঠিয়ে দিয়েছে। উনি বুঝেছে, যে তিতিক্ষা শাড়িতে আনইজি ফিল করছে। শাড়িতে অভ্যস্ত না থাকলে যা হয় আর কি। নক্ষত্রের আব্বু আতিফ আবরার তিতিক্ষার আব্বুর দিকে তাকিয়ে বললো,

–“ভাই! আমরা দুই পরিবার আজকে থেকে নতুন একটা সম্পর্ক স্থাপন করলাম। আমাদের ছেলে মেয়েরা সুখে থাকুক এটাই আমরা কামনা করব। তারপরেও কথা হলো, শুধু ছেলে মেয়ে না আমরা দুই পরিবারও আমাদের সম্পর্কটাকে সুন্দর করে গড়ে তুলবো। আমরা মানুষ আর আমাদের পদে পদে ভুল হয়েই থাকে। ভাই আমাদের যদি কোন ভুল হয়ে থাকে। তাহলে আপনারা সেটা সোজাসুজি বলবেন। কারন কোন ভুল পরবর্তীতে সেটা যেন বিরাট আকার ধারণ করতে না পারে । আমরা দুজনেই কিন্তু সবার সাথে খুব মজা করি।আমাদের কথায় কেউ মাইন্ড করবেন না। আর যদি মাইন্ড করেন। তাহলে আরো বেশি করে মজা করবো।” (নক্ষত্রের আব্বু হেসে হেসে)
–“হা হা হা। ভাই এজন্য আপনাদের আমার খুব পছন্দ হয়েছে । নাহিয়ান শুধু আমার জামাই না। যেদিন ওর সাথে আমার প্রথম কথা হয়েছিলো। ওকে আমি আমার ছেলের আসনে বসিয়েছি। নাহিয়ান আপনার ছেলে, আর তিতিক্ষা শুধু আমার মেয়ে। একথাটা আমি আমার মনে ধারণ করিনি। আমি একটা কথায় মনে করি, যে ছেলে মেয়ে দুটোই আমাদের।” (তিতিক্ষার বাবা)
তিতিক্ষা রুমে বসে এখনো নক্ষত্রের বলা কথা গুলোই ভাবছে। অদ্ভুত এক অনুভূতি তিতিক্ষাকে যেন গ্রাস করে নিচ্ছে। নক্ষত্র কি তিতিক্ষাকে আগে থেকে চেনে? নক্ষত্রের বলা প্রতিটা শব্দ যেন তিতিক্ষাকে অদ্ভুত ভাবে ভাবাচ্ছে।তিতিক্ষার মাথায় এখন একটা কথায় ঘুরপাক খাচ্ছে,

–“প্রথম দেখায় একটা মেয়ের সাথে কি এত সহজ ও সাবলীলভাবে কথা বলা যায়?”
তনুকা এসে মামনির পাশে দাঁড়ালো। তিতিক্ষার আম্মু সবার সাথে তনুকার পরিচয় করিয়ে দিলো। তিতিক্ষা যাওয়ার সময় তনুকার ফোন এসেছিলো। এজন্য তনুকা তখন উপস্থিত হতে পারে নি। ওর হবু বর ফোন দিয়েছিল। এজন্য কথা বলা শেষ করে ওর আসতে একটু দেরি হয়ে গেছে। তনুকা সবার সাথে খুব সুন্দর ভাবে কথা বললো। তিতিক্ষার আম্মু এটাও বললো যে, তনুকার এংগেজমেন্ট করা আছে। ছেলে আপাতত দেশের বাইরে আছে। সামনেই মাসেই চলে আসবে। আর তখনই বিয়ের ডেট ধার্য করা হবে। তনুকা এখন ডাক্তারী পড়ছে। বিয়ের ঝামেলার জন্য পড়াশোনার যেন ক্ষতি না হয়। তাই ওরা দুজন মিলে বিয়েটা পেছানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো। ওদের এমন সিদ্ধান্তটা বড়রা সবাই মেনে নিয়েছিলো। তনুকার ইন্টার্নি শুরু করার আগেই বিয়ের ডেট ঠিক করা হবে। এসব কথার মাঝেই নবিন তখন তনুকাকে ভিডিও কল করলো। নবিন উপস্থিত সবার সাথে কথা বললো। আজকে ওর একটা এক্সাম ছিলো। এজন্য এখানে সবার মাঝে উপস্থিত হতে পারেনি। কেবল এক্সাম দিয়ে বের হয়েই কল দিয়েছে। এদিকে আহান কুটুর কুটুর করে খাচ্ছে । আর নক্ষত্রকে পর্যবেক্ষণ করছে। নক্ষত্রও এই ব্যাপারটা অনেকক্ষণ ধরেই লক্ষ্য করছে। নক্ষত্র মুচকি হেসে আহানকে বললো,

–“আহান আমাকে কিছু বলতে চাও?”
আহান মাথা নাড়িয়ে না বোঝালো। নক্ষত্র তখন আর কিছু না বলে খাওয়াতে মনোনিবেশ করলো।
তিতিক্ষা আপাতত ওর সব চিন্তা বাদ দিলো। বেড থেকে উঠে শাড়ি বদলে, ব্লু কালারের একটা থ্রি-পিস পড়ে নিল। মাথাতে খুব সুন্দর করে ওড়না টেনে দিলো। আয়নাতে একনজর নিজেকে দেখে মৃদু পায়ে সবার সামনে গিয়ে উপস্থিত হলো। তিতিক্ষাকে দেখে মামনি এগিয়ে এসে ট্রে ভর্তি দইয়ের পিরিচ গুলো তিতিক্ষার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,
–“যাও সবাইকে দিয়ে এসো”।
তিতিক্ষাও ভদ্র মেয়ের মত আর কথা না বাড়িয়ে একে একে সবাইকে দিলো। আহানকে দেওয়ার সময় বেখেয়ালেই নক্ষত্রের সাথে তিতিক্ষার চোখাচোখি হয়ে গেল। তিতিক্ষা দ্রুত চোখ সরিয়ে ওখান থেকে সরে দাঁড়ালো। সবার আড়ালে দাঁড়িয়ে তিতিক্ষার মামনি অগ্নি দৃষ্টিতে ওনার হাজবেন্ডের দিকে তাকিয়ে আছে। কারন উনার হাজবেন্ডের হাইপ্রেশার থাকা সত্ত্বেও, উনি গরুর মাংস খেয়েই যাচ্ছে। সবার কথা যেন উনার কানে যাচ্ছেই না। উনি আছে উনার ভোজন রাজ্যে মশগুল। এর মধ্যে তিতিক্ষার আব্বু নক্ষত্রের প্লেটে মাংস তুলে দিতে দিতে বললো,
–“পেট শান্তি তো দুনিয়া শান্তি। আর পেট শান্তিতে থাকলে মস্তিষ্কও শান্ত থাকে। তখন বউয়ের তিতা কথাও মিঠা লাগে।এখন থেকে নিজেকে এমনভাবেই অভ্যস্ত করো।” (তিতিক্ষার আব্বু)

তিতিক্ষার আব্বুর এমন কথা শুনে, সবার মাঝে আরেক দফা হাসির রোল পড়লো। সবাই উচ্চশব্দে হাসলেও নক্ষত্র মুচকি হাসিতেই বিদ্যামান। কেউ লক্ষ্য না করলেও তিতিক্ষা এটা লক্ষ্য করেছে। নক্ষত্র এখনও জোরে শব্দ করে হাসেনি। তবে মানুষটাকে মুচকি হাসিতে মনে হয় একটু বেশী মানায়। ডেনিম এ্যাশ কালারের শার্টের সাথে কালো প্যান্ট ইন করে পড়া। আর এমন ফর্মাল লুকে উনাকে ভালোই মানিয়েছে। হাতে একটা ইউনিক ডিজাইনের ওয়াচ। তিতিক্ষা আড়চোখে নক্ষত্র কে এতোটুকুই খেয়াল করলো। এরপর অনেক কথা , খুনসুটি দুষ্টুমির মধ্যে ওরা ওদের খাওয়া শেষ করল। ছেলেরা উঠে গেলে। সব মেয়েরা একসাথে বসে খাওয়া-দাওয়ার পর্ব সমাপ্ত করল।
বড়রা উনাদের মত করে কথা বলছে। আর বাকিরা বিভা, আহান ,রুহান, অদ্রি,সাফওয়ান, আফান,তনুকা ,নক্ষত্র ,আর তিতিক্ষা। এরা সবাই গোল হয়ে বসে একটা রুমে আড্ডা দিচ্ছে। সাফওয়ানের এক একটা কথা শুনে সবাই হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে। সাফওয়ান ওর প্রেমের কাহিনী শোনাচ্ছে। ওর গার্লফ্রেন্ড ওকে কত রকমের প্যারা দেয় । এটাই সবার সামনে অসহায় মুখ করে প্রকাশ করছে। এদিকে নক্ষত্র আড়চোখে তিতিক্ষা কে দেখতে ব্যস্ত। তখনই ওদের আড্ডার মাঝেই নক্ষত্রের আম্মু প্রবেশ করলো। নক্ষত্র আর তিতিক্ষাকে ডেকে নিলো। এরপর ওদেরকে আলাদা করে কথা বলার একটা সুযোগ করে দিলো। এটা নিয়েও রুহানরা নক্ষত্রকে পিঞ্চ মেরে কথা বললো।
তিতিক্ষা নক্ষত্রকে ওর রুমে নিয়ে গেল। নক্ষত্র চারিদিকে একবার করে চোখ বুলিয়ে নিল। রুমের এক পাশের দেওয়ালে বিভিন্ন ধরনের পেইন্টিং ঝুলানো। তার পাশের দেওয়ালে তিতিক্ষার অনেকগুলো ফটো ফ্রেম। বিভিন্ন ধরনের আসবাবপত্র দিয়ে রুমটা পরিপাটি করে সাজানো গোছানো। গোলাপি আর কালোর সংমিশ্রণে সুন্দর একটা বেডশীট বেডে বিছানো আছে। নক্ষত্র রুমের এক কোনায় রাখা সিঙ্গেল একটা সোফায় বসল। তিতিক্ষা তখনও রুমের এক কোণে গুটিসুটি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এখন নক্ষত্র ওকে কি বলবে? কি জিজ্ঞাসা করবে? এসব ভাবলেই তিতিক্ষা যেন কাল ঘাম ছুটে যাওয়ার উপক্রম।
নক্ষত্র তিতিক্ষার অবস্থা বুঝতে পেরে উঠে দাঁড়ালো। এরপর তিতিক্ষার দিকে কয়েক পা এগিয়ে গেল। মুচকি হেসে তিতিক্ষাকে উদ্দেশ্য করে বলল,

–“আচ্ছা তুমি কি আমাকে কোন কারনে ভয় পাচ্ছো? আমার সাথে এই রুমে তোমার যদি কথা বলতে সমস্যা হয়। তাহলে চলো আমরা ছাদে যাই?”
তিতিক্ষার কেন জানি সত্যিই ভয় করছিল। নক্ষত্র যে এত সহজে যে ব্যাপারটা বুঝে যাবে। তিতিক্ষা এটা ভাবতে পারেনি। আর কোন ভনিতা না করে মৃদু সুরে তিতিক্ষা নক্ষত্র কে উদ্দেশ্য করে বলল,
–“আমরা বেলকনিতে যাই?”
নক্ষত্র তিতিক্ষার কথা অনুযায়ী বেলকনির দিকে পা বাড়ালো। বিভিন্ন ধরনের ফুলের গাছ দিয়ে সাজানো বেলকনি। অনেক রকমের ফুলও ফুটে আছে। পাশে রাখা একটা গোলাপের টবে তিনটে সাদা গোলাপের কলি ফুটেছে। নক্ষত্র বেলকনির রেলিং এর সাথে হেলান দিয়ে দাড়ালো। ওর দুই হাত বুকের কাছে ভাজ করে তিতিক্ষা দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিয়ে বলল,
—“তোমার কাছে আমার কিছু একটা চাওয়ার আছে। জানিনা সে চাওয়াটা আমার কবে পূর্ণ হবে? তুমি কি শুনবে আমার চাওয়াটা কি?” (শান্ত কন্ঠে)
তিতিক্ষা নক্ষত্রের দিকে না তাকিয়েই বলল,
–“বলুন আপনার কি চাই?”
নক্ষত্র আবারও মুচকি হেসে বলল,
–“আমি তোমার চুলের হাতখোঁপাটা শুধু একটাবার ছুঁয়ে দেখতে চাই।” (আদুরে সুরে)
তিতিক্ষা এবার যেন অবাকের চরম শিখরে। কারণ তিতিক্ষার যতটুকু মনে আছে। তিতিক্ষা যখন শাড়ি পড়েছিল তখন সে মাথায় ঘোমটা দিয়ে ছিল। এখনো মাথায় ওড়না দেওয়া আছে। তাহলে তো নক্ষত্র ওর চুল বা চুলের খোপা দেখার কোনো সুযোগই পায়নি। আর নক্ষত্র কি করেই বা জানল তিতিক্ষা চুলে হাত খোঁপা করে। নক্ষত্র তিতিক্ষার দিকে তাকিয়ে আবার বললো,
—“তবে তোমার মন সায় না দিলে থাক। কারণ মনের বিরুদ্ধে গিয়ে কোন কিছু করা উচিত নয়। আমি তোমাকে জোর করছিনা আর করবোও না। ইনশাআল্লাহ! খুব শ্রীঘই আমার চাওয়াটা পূর্ণ হবে।” (নক্ষত্র মুচকি হেসে)
কথা বলতে বলতে নক্ষত্র ওর পকেট থেকে একটা ছোট্ট বক্স বের করল। সেটা তিতিক্ষার দিকে এগিয়ে দিল। তিতিক্ষা বক্সটা নিয়ে হাতেই ধরে রাখলো। নক্ষত্র তিতিক্ষাকে বলল,

–” গিফ্টটা খুলে দেখো।”
তিতিক্ষা বক্সটি খুলে দেখল একটা ছোট্ট সাদা পাথরের নোজ পিন। নোজপিনের পাথরটা নরমাল পাথরের তুলনায় একটু বেশি জ্বলজ্বল করছে। নোজপিনের পাথরটা গোল আকৃতির নয়। সেটা দেখতে স্টার (নক্ষত্র ) আকৃতি। তিতিক্ষা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে নক্ষত্রকে কিছু বলার আগেই নক্ষত্র বললো,
–“তোমার ঘামার্ত নাকটা আমার বেশ পছন্দের। অদ্ভুত এক সৌন্দর্য মিশ্রিত আছে, তোমার এই ঘামার্ত নাকটাতে। এজন্যই আমার তরফ থেকেই তোমার ঘামার্ত নাকের জন্য খুব ছোট্ট একটা উপহার।” (নক্ষত্র মুচকি হেসে)

–“তোমার ঘামার্ত নাকটা আমার বেশ পছন্দের। অদ্ভুত এক সৌন্দর্য মিশ্রিত আছে, তোমার এই ঘামার্ত নাকটাতে। এজন্যই তোমার ঘামার্ত নাকের জন্য খুব ছোট্ট একটা উপহার।” (নক্ষত্র মুচকি হেসে)
নক্ষত্রের এই কথা শুনে তিতিক্ষা এবার সত্যিই খুব
লজ্জা পেলো। তিতিক্ষা লজ্জা পেলে ওর দুই গাল লালবর্ণ ধারণ করে। এখনও তার ব্যাতিক্রম কিছু ঘটলো না। মুখের উপর কেউ যদি এমন কথা বলে। তাহলে লজ্জা পাওয়াটা তো অস্বাভাবিক কিছু না। তিতিক্ষা মাথা নিচু করে মুচকি হাসলো। নক্ষত্র তিতিক্ষার হাসিটা খুব যত্ন করে ওর মনের কোঠরে গেঁথে নেওয়া মত করে পলকহীন ভাবে দেখে নিলো। বিভা বাইরে থেকে ওদের ডাকছে। নক্ষত্র বিভাকে আস্তে করে ডেকে বললো,

–“সোনাআপি আর একটা মিনিট দাও প্লিজ।”
নক্ষত্রের কিউট করে কথা বলার ফেসটা দেখে বিভা হেসে ওখান থেকে চলে গেল। নক্ষত্র তিতিক্ষার দিকে তাকিয়ে ওর অনামিকা আঙুল এগিয়ে দিলো। যে আঙুলে তিতিক্ষা ওকে রিং পড়িয়ে দিয়েছে। তিতিক্ষা ভ্রু কুঁচকে নক্ষত্রের দিকে তাকালো। নক্ষত্র ইশারাতে তিতিক্ষাকেও ওর আঙুল এগিয়ে দিতে বললো। নক্ষত্রের ইশারা অনুযায়ী তিতিক্ষাও তাই করলো। নক্ষত্র তিতিক্ষার সেই আঙুলের সাথে ওর আঙুল ছোঁয়ালো। নক্ষত্রের এমন কান্ডে তিতিক্ষা কিছুই বুঝতে পারলো না। নক্ষত্র তখন তিতিক্ষার দিকে তাকিয়ে বললো,
–“শুনেছি অনামিকা আঙুল নাকি আমাদের হার্টের সাথে সম্পর্কিত। এজন্য তোমার অনামিকা আঙুলের সাথে আমার অনামিকা আঙুল ছোঁয়ালাম। যাতে আমাদের দুজনের হার্ট দুইটা অতিশ্রীঘই একে অপরের হার্টকে টার্চ করে।” (নক্ষত্র মুচকি হেসে)
নক্ষত্রের এই কথা শুনে তিতিক্ষা বোকার মত ওর তাকিয়ে থাকলো। এটা আবার কেমন যুক্তি। তবে ব্যাপারখানা এমন করে তো ভেবে দেখা হয়নি! নক্ষত্র আর কথা না বাড়ালো না। সে মুচকি হাসতে হাসতে তিতিক্ষার নাকটা আলতো করে টেনে দিয়ে চলে গেল। এখন আর দাঁড়ানো উচিত হবেনা। কারন বাইরে সবাই অপেক্ষা করছে। তিতিক্ষা এখনো ওখানে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। নক্ষত্রের কথাগুলো তিতিক্ষার খুব মনে ধরেছে। আসলেই ব্যাপারটা গভীরভাবে চিন্তা না করলে এমন যুক্তি দেওয়ায় সম্ভব না। এই যুক্তিটা ঠিক কতটুকু সত্য তিতিক্ষার জানা নেই। তবে ব্যাপারটা নিয়ে ওর ভাবতে খুব ভাল লাগছে।
–“প্রিয়মানুষটা+ অনামিকা আঙুল+ হার্ট= অনুভূতির শীর্ষবিন্দু।”
নক্ষত্ররা এখন চলে যাবে। হালকা নাস্তার আয়োজন করা হয়েছে। তিতিক্ষা ড্রয়িংরুমে গিয়ে দাঁড়ালো। নক্ষত্রের আম্মু তিতিক্ষার কপালে আদর দিলো। অদ্রি তিতিক্ষাকে জড়িয়ে ধরলো। নক্ষত্রের আব্বু তিতিক্ষার হাতে দশ হাজার টাকা ধরিয়ে দিলো। তিতিক্ষা প্রথমে নিতে চাচ্ছিলো না। এজন্য নক্ষত্রের আব্বু বললো,

–“মেয়ে দেখতে আসলে নাকি টাকা দিতে হয়। আর মেয়ে পছন্দ হলে নাকি একটু বেশিই টাকা দিতে হয়। তো মেয়ে আমাদের পছন্দ হয়েছে। অতিশ্রীঘই আবার আসবো। আমার মেয়েকে আমার বাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্য। ভালো থাকিস আম্মু।” (তিতিক্ষার মাথায় হাত বুলিয়ে)
রুহান, আফান আর সাফওয়ান তিতিক্ষার সাথে কথা বললো। আফান তিতিক্ষাকে বললো,
–“আমরা কিন্তু তোমাকে ভাবি ডাকতে পারবো না। ভাবি ডাকটা আমার কাছে পর পর লাগে। তুমি আমার ছোট বোনের বয়সী। এজন্য আমরা তোমার নাম ধরে ডাকবো কেমন?” (আফান)
তিতিক্ষা আফানের কথা শুনে মুচকি হেসে বললো,
–“জ্বি ভাইয়া! ভাবি বলে আমাকে আর লজ্জায় ফেলবেন না। আমি আপনাদের থেকে অনেক ছোট। আমি ভাবি নয় বরং বোন হয়েই থাকতে চাই।”
সাফওয়ান তিতিক্ষাকে বললো,
–“আর নক্ষত্র যদি তোমাকে ডির্স্টাব করে শুধু আমাদের একটাবার জানাবে। তারপর ওকে আমরা দেখে নিবো।আসছি আপু ভালো থেকো।”
তিতিক্ষা মুচকি হেসে বললো,
–“জ্বি ভাইয়া। আপনারাও ভাল থাকবেন আর সাবধানে যাবেন।”
রুহান কিছু বলতে যাবে, তার আগেই আফান আর সাফওয়ান রুহানকে টেনে হিঁচড়ে নিচে নিয়ে চলে গেল।নক্ষত্র আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো, বড়রা কথা বলতে বলতে নিচে নেমে গেছে। নক্ষত্র মৃদু স্বরে বললো,
–“সাবধানে থেকো আর অবশ্যই নিজের খেয়াল রেখো। আল্লাহ হাফেজ।”
তিতিক্ষা প্রতিউত্তরে মৃদু সুরে বললো,
–” আল্লাহ হাফেজ।”

বাসার সবাই নিচে চলে গেছে ওদের এগিয়ে দিতে। তিতিক্ষা শুধু যায়নি। নক্ষত্রের আব্বু আম্মু তিতিক্ষার আব্বু আম্মুর থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো। নক্ষত্র তিতিক্ষার আব্বুকে আর খালুকে জড়িয়ে ধরলো। এরপর সালাম দিয়ে উনাদের থেকে বিদায় নিলো। নক্ষত্ররা দুটো গাড়ি এনেছিলো। প্রথমটাতে অদ্রির ওর আব্বু আম্মু চলে গেল।আর পরেরটাতে নক্ষত্ররা যাবে। নক্ষত্রকে এখন গাড়ি ড্রাইভ করতে হবে। এই অলসগুলো কেউ এখন ড্রাইভ করবে না। এজন্য আগেই গাড়িতে উঠে সিট দখল করে বসে আছে। নক্ষত্র গাড়ির ড্রাইভিং সিটের দিকে আসতে আসতে এক বার তিতিক্ষার রুমে দিকে তাকালো। তখনই জানালার পাশে থেকে কিছু একটা সরে যেতে দেখলো। এটা দেখে নক্ষত্রের মুখে হাসির রেখা দেখা দিলো। নক্ষত্র ওর নিচের ঠোঁট কামড়ে হাসিটা আড়াল করে নিলো। এরপর গাড়িতে উঠে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চলে গেল।
নক্ষত্ররা চলে যাওয়ার পর বাসাটা খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। তিতিক্ষার আম্মু, মামনিও একই কথা বললো। এতগুলো মানুষ এতক্ষণ বাসায় ছিলো। সত্যি বলতে নক্ষত্ররা এমন ভাবে ওদের সাথে মিশেছে যে, মনে হচ্ছিল ওরা খুব কাছের কেউ। তিতিক্ষা ওর রুমে গিয়ে চুল ছেড়ে দিয়ে বেডের উপর বসলো। একটু পরে তনুকা আর বিভা আসলো তিতিক্ষার রুমে। বিভা মুচকি হেসে বললো,
—“বনু নক্ষত্র ভাইয়া জিজু হিসেবে পারফেক্ট। সাথে অসম্ভব ভালো একজন মানুষ। আমি শুধু ভাবছি নক্ষত্র ভাইয়া এত সুন্দর করে কথা কিভাবে বলে?” (বিভা)

বিভার কথা শুনে তিতিক্ষা মুচকি হাসলো। তনুকা তিতিক্ষার থুতনী ধরে ওর দিকে ফিরালো। তিতিক্ষা মুখটা লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠেছে। তনুকা বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে হাসলো। তিতিক্ষা মাথা নিচু করে নিয়েছে। তনুকা মুচকি হেসে বললো,
—“জানিস তিতু, যে মেয়েরা তাদের বরের দেওয়া এক টুকরো ভালবাসা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকে। সে মেয়েরা তাদের বরের নামটা অন্য কারো মুখ থেকে শুনলেও তাদের চেহারায় অদ্ভুত এক আভা ছড়িয়ে পড়ে। যেটা আমি এখন তোর চেহারায় দেখতে পাচ্ছি।”
এরপর তিন বোন আরও কিছুক্ষণ গল্প করে ওরা চলে গেল। তিতিক্ষা ওর হাতের রিংটার দিকে তাকিয়ে আছে। তনুকা, বিভা, মামনি,তিতিক্ষার আম্মু তো নক্ষত্রের খুব প্রশংসা করলো। আহানও এখন নক্ষত্রের সাপোর্টার। সে তো নক্ষত্রের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তিতিক্ষা আব্বু তিতিক্ষার কাছে এসে বলল,
–“আম্মুরে আমি তোমার জন্য খাঁটি হীরেই তুলে এনেছি। তুমি নক্ষত্রের সাথে কিছুদিন কথা বল। তাহলে তুমিও বুঝতে পারবে, ছেলেটা আসলেই খুব ভালো মনের অধিকারী।”
তিতিক্ষা ওর আব্বুর কথার প্রতিউত্তরে কিছু বললো না। কারণ তিতিক্ষাও বুঝে গেছে নক্ষত্র কেমন। একটা ছেলের চোখের দিকে তাকালেই বুঝা যায়, সে কেমন ক্যারেক্টারের। মানুষ মুখে মিথ্যা বললেও চোখের ভাষা মিথ্যা হতে পারেনা। হুমায়ূন আহমেদ এই ব্যাপারে একটা উক্তি দিয়েছে,
–“পুরুষ মানুষ দুইভাগে বিভক্ত। একদল হলো, যারা সরাসরি মেয়েদের চোখের দিকে তাকাই। আরেক দল আছে, তারা সরাসরি মেয়েদের বুকের দিকে তাকায়।”

তিতিক্ষা ও যে নক্ষত্রকে লক্ষ্য করেনি তা কিন্তু নয়। কিন্তু তিতিক্ষা নক্ষত্রের মধ্যে সেরকম কিছু দেখতে পায়নি। বরং নক্ষত্রের বলা কিছু কিছু কথা, ওর মুচকি হাসি, ওর পছন্দের কথা সরাসরি বলা, ওর বলা অনামিকা আঙ্গুলে যুক্তিটা, এসবকিছু তিতিক্ষার মনে একটু হলেও ভালোলাগার সৃষ্টি হয়েছে।
তিতিক্ষা যখন শাড়ি চেঞ্জ করতে রুমে এসেছিল। নক্ষত্র তখন আহানের সাহায্যে নিয়ে তিতিক্ষার ফোন নাম্বার, ইমু নাম্বার, ফেসবুক আইডি এগুলো কালেক্ট করে নিয়েছে। এই তথ্য তিতিক্ষার এখনো অজানা। নক্ষত্র ঠান্ডা মাথায় তিতিক্ষার সাথে কনটাক্ট করার সব পথই নিজেই তৈরী করে নিয়েছে। যদিও এই কাজটা করেছে সবার আড়ালে। এজন্য আহানকে ঘুষও দিতে হয়েছে। এই ব্যাপারটা নক্ষত্র তিতিক্ষাকে ক্ষুনাক্ষরেও টের পেতে দেয়নি। আহানও মার খাওয়ার ভয়ে তিতিক্ষাকে কিছু বলেনি। এজন্য নক্ষত্রকে অনেক কাঠ খড় পুড়িয়ে আহানকে বশে আনতে হয়েছে।
তিতিক্ষার আব্বু রুম থেকে চলে গেল। তিতিক্ষা নক্ষত্রের বলা সব কথাগুলো ভেবে মুচকি হেসে বললো,
–“মানুষটা আসলেই একটা পাগল।”
প্রায় দুই সপ্তাহ পর…..
নক্ষত্রের সাথে তিতিক্ষার এখন মেসেজে কথা হয়। সারাদিনে তিতিক্ষার ফোনে নক্ষত্রের দশটা মেসেজ আসবেই। তিতিক্ষা নক্ষত্রের মেসেজের মাঝে মাঝে আনসার করে। তাছাড়া নক্ষত্রের মেসেজ গুলো তিতিক্ষা মনোযোগ দিয়ে পড়ে আর মুচকি মুচকি হাসে। তবে নক্ষত্র কল দিলে, তিতিক্ষা যেন কথা বলার শক্তিটুকু হারিয়ে ফেলে। ওর বুকের ভেতর ধুকপুকানি বাড়তেই থাকে। নক্ষত্র ওকে যা জিজ্ঞাসা করে ,সে কথার প্রতিউত্তরে হুম, হ্যা, না, জ্বি এসব ছাড়া কোন উত্তরই খুঁজে যেন সে খুঁজে পায়না। নক্ষত্রকে কিছু বলার জন্য তিতিক্ষা যতই আগে থেকে কথা সাজিয়ে রাখুক; নক্ষত্রের পুরু কন্ঠে হ্যালো বলার সাথে সাথে তিতিক্ষার কেন জানি সবটা গুলিয়ে যায়। তবে নক্ষত্রের ফেসবুক আইডির টাইমলাইনের নক্ষত্রের যতগুলো পিক আছে। তিতিক্ষার ঘুমানোর আগে একবার দেখে নেওয়াটা যেন অভ্যাসে পরিনত হচ্ছে। আর এই কাজটা তিতিক্ষা কেন করে সেটা ওর ও অজানা। এটাই হয়তো একবিন্দু ভালোলাগা থেকে শুরু করে, এক সিন্ধু ভালোবাসা জন্মানের প্রথম ধাপ। এই ভালোবাসা নামক ব্যাধিটার জন্যই মনের কোঠায় প্রিয় মানুষটার জন্য একটু একটু করে সৃষ্টি হয় অনুভূতির শীর্ষবিন্দু। তবে চূড়ান্ত পর্যায়ে বুকের বা পাশে কারো জন্য ভালোবাসা উৎপত্তি হওয়ার সর্বশেষ অনুভূতির নামই হলো,

–“#অনুভূতির_শীর্ষবিন্দু।”
নক্ষত্র তিতিক্ষার আব্বু, মামনি, আহান সবাইকেই ফোন দিয়ে কথা বলে। তবে নক্ষত্র বুদ্ধি করে মামনিকে একটু বেশিই ফোন দেয়। কারণ উনাকে পাম মারলেই উনি তিতিক্ষার সব খবরাখবর নক্ষত্রের কাছে পৌঁছে দেয়। আর তখন ফোনের ওপাশ থেকে নক্ষত্র শুধু মুচকি হাসে। নক্ষত্র কিছু বলে না শুধু কান পেতে শুনে। প্রিয় মানুষটার খবরা-খবর শুনতে কার না ভালো লাগে। আর সে যদি হবু বউ হয়, তাহলে তো কথাই নেই। তাই নক্ষত্র ওর এই টেকনিকটাকেই বেশি কাজে লাগায়। সারাদিনে তিতিক্ষার ইউনিভার্সিটি, ওর প্রাইভেট, পড়াশোনা, সন্ধ্যার পর ভাই বোন মিলে জমপেশ আড্ডা, নক্ষত্রের মেসেজ, টুকটাক হাতের কাজ, এসব নিয়েই তিতিক্ষার দিনগুলো কাটছে। তিতিক্ষার আব্বু আম্মু ঢাকাতে চলে গেছে।
এদিকে শীতের প্রকোপটাও দিন দিন বাড়ছে। আজকে তিতিক্ষার সকালবেলা একটু দেরী করেই ঘুম থেকে উঠেছে। কালকে রাতে পড়া কম্পিলিট করতে একটু বেশিই রাত হয়ে গিয়েছিলো। এজন্য উঠতে দেরী হয়ে গেছে। আজকে তো শুক্রবার। এজন্য কোন তাড়াহুড়োও নেই। তিতিক্ষা ওর এলোমেলো চুল গুলো উচু করে বেঁধে চুলের কাটা দিয়ে আটকে নিলো। এরপর ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো প্রতিদিনের মতো আজকেও নক্ষত্রের দুইটা মেসেজ এসেছে। মেসেজটা এই রকম….
“সুপ্রভাত আমার বেঁচে থাকার চাবিকাঠিটা।”
(নক্ষত্র)
তার দু’মিনিট পরের মেসেজটা..

–“উহুম! উহুম! এই যে মিসেস নাহিয়ান আবরার, এবার তো উঠুন। বারান্দায় গিয়ে একটাবার আকাশের দিকে তাকান। আমি এখন আকাশ দেখছি। আর আপনাকেও আকাশের দিকে তাকাতে বলছি, কারন আমি তো এখন সরাসরি আপনাকে দেখতে পাচ্ছিনা। কিন্তু একই আকাশের নিচে তো আমরা অবস্থান করছি।” (নক্ষত্র)
মেসেজটা পড়ে তিতিক্ষা মুচকি হাসলো। বারান্দায় গিয়ে আকাশের দিকে তাকালো। ফোনটা হাতে নিয়ে নক্ষত্রকে মেসেজ করলো,
–“দেখলাম।”
এরপর তিতিক্ষা ওয়াশরুম ঢুকে বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে চোখ মুখে পানির ছিটা দিলো। ফেসওয়াশটা হাতে নিয়ে চোখ বন্ধ করে ওর মুখ ম্যাসাজ করছে। ওয়াশরুমের দরজা খোলা দেখে আহান দরজার কাছে এসে বললো,
–“এই তিতু আপু তুমি কি করছো?”
–“আহান বাবু আমি ফুটবল খেলছি। তুমি কি খেলবে আমার সাথে?”
তিতিক্ষার কথা শুনে আহান মুখ বাঁকালো। এরপর বললো,
–“তিতু আপু নক্ষত্র ভাইয়া কি জানে তুমি এতোটা ঝগড়ুটে?”

আহানের কথা শুনে তিতিক্ষা চোখ বন্ধ করেই আহানের গায়ে পানি ছুঁড়ে মারলো। আহান তখন চিৎকুর দিয়ে বলে উঠলো,
–“তিতু আপু তুমি নক্ষত্র ভাইয়াকে ভিজিয়ে দিলে কেন?” (চিৎকার করে)
নক্ষত্রের কথা শুনে তিতিক্ষা সাথে সাথে চোখ খুলতে লাগলো। চোখে ফেনা ঢুকে চোখ জ্বালা করতে লাগলো। তিতিক্ষা সাথে সাথে ওর চোখ বন্ধ করে নিলো। নক্ষত্র তখনই বলে উঠলো,
–“ইস! তুমি এতো ছটফট করো কেন? চোখ কি বেশি জ্বালা করছে? তারাতারি চোখে পানির ঝাপটা দাও।”
নক্ষত্রের কথা শুনে তিতিক্ষা যেন জমে গেছে। তিতিক্ষা উল্টো দিকে ঘুরে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। তিতিক্ষা ওর চোখে পানির ঝাপটা দিলো। নক্ষত্র তখন আদুরে সুরে বলে উঠলো,
–“আমি কি আপনার ভেজা মুখটা আর একবার দেখার সুযোগ পেতে পারি?”

অনুভূতির শীর্ষবিন্দু পর্ব ৪+৫+৬