অন্তর্দহন পর্ব ১১ || লেখনীতে- অলিন্দ্রিয়া রুহি

অন্তর্দহন পর্ব ১১
লেখনীতে- অলিন্দ্রিয়া রুহি

হঠাৎ কোথা থেকে যেন কালো মেঘের ভারী দল এসে আকাশটাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিয়ে প্রকৃতি গুমোট করে তুলল। উল্লাসী পাতলা নেকাবের তল দিয়ে গোমড়া মুখের আকাশটাকে একনজর দেখেই পাপনকে বলে উঠল,
-“বাকি কেনা কাটা কাল করবোনি? এখন বাসায় যাই চলো। আকাশের অবস্থা দেখো!”
পাপন রিকশার খোঁজে মনোযোগী ছিল, উল্লাসীর কথায় নিজেও একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,
-“হুম, বাসায় যাওয়ার আগে তোমার নাকফুলটা কিনে নিয়ে যাই চলো। ওই গলির পরের রাস্তাতেই একটা স্বর্ণকারের দোকান আছে। আমি কালকে হাঁটতে বেরিয়েছিলাম না? তখন দেখছি।”
উল্লাসী মৃদু হাসে।
-“আচ্ছা।”

ওরা দু’জন বেরিয়েছে নতুন সংসারের জন্য টুকটাক কিছু কেনাকাটা করতে। সেদিন মোল্লা সাহেবের ঘরে যাওয়ার পর উল্লাসীই তাদের জীবন বৃত্তান্ত আদি থেকে অন্ত অবধি সবকিছুই খুলে বলে৷ এও বলে তারা বিবাহ করে একটি পবিত্র সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ হতে চায়৷ কিন্তু দু’জনেরই বয়স কম, আর বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী তারা কোনো কাজীর কাছ থেকেই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে না। এই শুনে মোল্লা সাহেব মৃদু হেসে বলেছিলেন,

-“এগুলো সব বর্তমানের প্রচলিত সিস্টেমরে বাবা! কম বয়সে বিয়ে করা যাবে না, কোনো বিবধা বা তালাক প্রাপ্ত নারী কোনো অবিবাহিত ছেলেকে বিয়ে করতে পারবে না! এসব আজকালকার বিরক্তিকর নিয়ম৷ অথচ ইসলামে এমন কোনো নিয়ম নেই। যদি ছেলে-মেয়ে সাবালক হয়, আর তাদের দু’জনেরই মত থাকে তবে পরিবার তাদের বিয়ের আয়োজন করে ফেলবে অতিদ্রুত। এতে করে তারা কোনো জেনায় লিপ্ত হবে না। বরং আল্লাহর রহমত বরকতে ভরা একটা সুন্দর জীবন যাপন করবে। তোমরা চিন্তা করো না। আমি কালাম মোতাবেক তোমাদের বিয়ে পড়িয়ে দিবো। কিন্তু তোমাদের বাবা-মা কেউই নেই, এটা একটু কষ্টের আসলে। এতবড় একটা মুহূর্তে তারা কেউ থাকবে না এটা কেমন করে হয়?”
উল্লাসী তৎক্ষনাৎ বলেছিল,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-“আপনিও তো আমার বাবারই বয়সী চাচা। আমার তো বাবা নেই, আপনিই নাহয় আমাকে পাত্রস্থ করুন।”
মোল্লা সাহেব এরপর আর বাঁধ সাধেননি। ওদের দু’জনকে মাগরিবের আগে আগে বিবাহ পড়িয়ে দিলে উল্লাসী পাপনকে নিয়ে মাগরিবের নামায পড়ে। কাবিন নামা করা হয় না, দেনমোহর ধার্য্য করা হয় মাত্র পনেরোশো টাকা… যেটা পাপনের কাছে ছিল। তার সাধ্যের ভেতরই দেনমোহর ধরেন মোল্লা সাহেব, আর এটাই প্রকৃত নিয়ম! সেই পনেরোশো টাকা নগদই উল্লাসীর হাতে তুলে নিয়ে তাকে নিজের স্ত্রী হিসেবে ছোঁয়ার অনুমতি নিয়ে নেয় সে। সেদিন রাতটা মোল্লা সাহেবের বাসাতেই থাকে ওরা। কিন্তু পরদিনই উল্লাসীর চাপাচাপিতে পাপন আশেপাশে বাসা খুঁজতে বের হয়।

মোল্লা সাহেবের বাসা থেকে একটু ভেতরে, যেতে দু’মিনিট লাগে- সেখানে একটি একরুমের ভালো মানের ফ্ল্যাট পেয়ে যায় তারা। তিনতলায় বাসা, তবে সাবলেট। একসঙ্গে তিনটি ফ্যামিলি থাকে। সকলেই স্বামী-স্ত্রী। একজনের একটি বাচ্চা আছে, নিশাত করে নাম। রুম খালি ছিল বলে সেদিনই ওরা উঠে যায় ওই বাসায়। বাড়িওয়ালা মহিলা খুবই আন্তরিক। প্রথমে ওরা বিবাহিত কীনা তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করলেও মোল্লা সাহেব যখন স্বয়ং ওদের বিবাহ দিয়েছেন, শুনেছেন, তারপর আর কোনো সন্দেহ প্রকাশ করেননি তিনি। সেদিন বিকেলেই হাজার তিনেকের ভেতর একটা স্টিলের খাট, দু’হাজারের ভেতর একটা র‍্যাক, আর ছোট ছোট দুইটা আসবাবদানী কিনে নিয়ে আসে পাপন আর মোল্লা সাহেব মিলে।

আজ বেরিয়েছে হাড়ি-পাতিল কেনার জন্যে। টুকটাক অনেক কিছু কিনেছে ইতিমধ্যে। বাকিটা কাল বা পরশু কিনলেই চলবে। বৃষ্টি আসবে আসবে করেও এলো না। বাতাসের তোড়ে কালো মেঘেদের দল দূরে উড়ে গেল। পাপন একটা সুন্দর স্বর্ণের নাকফুল কিনে সেটা উল্লাসীকে পড়িয়ে দিলে উল্লাসীকে একদম বউ বউ মনে হলো তার কাছে। গোলগাল মুখে ছোট্ট এই নাকফুলটা অন্যরকম স্নিগ্ধতা নিয়ে এলো যেন। পাপন বিড়বিড়িয়ে উচ্চারণ করল,
-“সুন্দর!”
উল্লাসী লজ্জা পেয়ে মাথা নামিয়ে ফেলল৷ দু’জনে বেরোতেই পাপন বলল,
-“চলো, আজকের লাঞ্চটা কোনো রেস্টুরেন্ট থেকে করি। একটা সেলিব্রেশন আর কী।”
উল্লাসী কনুই দিয়ে গুতো মেরে বলল,
-“কোনো সেলিব্রেশনের দরকার নেই মিস্টার। বাসায় চলো, আমার হাতের রান্না কম নাকি?”
-“না তা না… তবুও…”

-“উঁহু, অযথা টাকা নষ্ট করার কোনো মানেই হয় না। রেস্টুরেন্টে ঢুকলেই হাজার খানেক শেষ! সামনে তোমাকে চাকরি করতে হবে। অথবা নিজে কিছু হলেও করতে তো হবে! তখন টাকা লাগবে অনেক। এই জন্যে এখন এসব বাদ… টাকা যতটা সেভ করা যায় অতই ভালো।”
পাপন অবাক হয়। উল্লাসীর বয়স তারচেয়েও কম। ষোলো বোধহয়! অথচ এত ম্যাচুরিটি! উল্লাসী পাপনের চোখের দৃষ্টি বুঝতে পেরে ভ্রু কুঁচকে বলল,
-“কী হলো? এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?”
পাপন ধ্যান ভেঙে অল্প হাসে।
-“উঁহু.. কিছু না। চলো বাসায় যাই। পা ভেঙে আসতেছে।”
উল্লাসীর কালো মোজায় ঢাকা আঙুল গুলোর ফাঁকে আঙুল গুঁজে পাপন। তারপর হাঁটা ধরে। মরা রোদ, গায়ে লাগে না। বাতাস সুন্দর, ঝরঝরে… উল্লাসীর দারুণ লাগছে। এভাবে মাইলের পর মাইল হেঁটে যেতেও সে রাজী।

অভ্র বিছানার চাদর খামচে খামচে ছিঁড়ে ফেলতে চাইছে। তার মাথায় আগুন চেপেছে যেন। পারছে না আশেপাশের সবকিছু ভেঙে গুড়িয়ে দিতে… জাওয়াদরা খানিক আগে চলে গিয়েছে। যাওয়ার আগে তাদের ভাবসাব দেখে মনে হয়েছে, পড়ন্তকে তারা পছন্দ করেছে। এখন কী হবে? পড়ন্তও কী রাজী হয়ে যাবে? তাহলে তো শেষ…! সব শেষ। অভ্র শেষ, এই দুনিয়া শেষ, তার জীবনই শেষ। ঘরে কারও উপস্থিতি টের পেয়ে অভ্র লাল বর্ণের চোখজোড়া মেলে শায়লাকে দেখতে পেল। এই মেয়েটার জন্যেই আজ তার পাগল হবার দশা! এই মেয়েটা.. হ্যাঁ, এই মেয়েটা তার জীবন ধ্বংস করে দিয়েছে। পড়ন্তকে, তার কলিজাকে তার থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে। অভ্রর সহ্য হলো না। শায়লা কিছু বুঝে ওঠার আগেই হিংস্র বাঘের ন্যায় তার দিকে তেড়ে আসলো অভ্র। শায়লা সরে যাবে, তার আগেই তার গলা চেপে ধরল সে। শায়লা বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল। অভ্র হিসহিসিয়ে বলল,

-“তু..তুই.. তুই আমার জীবনটা শেষ করে দিলি শায়লা। একমাত্র তোর কারণে আজ আমি নিঃশ্বাসটা নিতে পারি না। আমার পড়ন্ত আমারই চোখের সামনে ভেঙে গুড়িয়ে গিয়েছে। হয়ে উঠেছে অন্য এক পড়ন্ত! তুই… তুই আমার জন্য অভিশাপ। তুই মরিস না কেন রে? মরে যা.. আমাকে বাঁচা! আমি আর পারছি না বুঝলি!? হয় আমাকে একেবারে মেরে ফেল নইলে তুই মরে যা। এই যন্ত্রণা আমার আর সহ্য হচ্ছে না রে.. একদম সহ্য হচ্ছে না।”
অভ্রর চোখ দিয়ে আপনা আপনি পানি গড়িয়ে পড়ল। শায়লা এই প্রথম অভ্রকে কাঁদতে দেখছে তাও পড়ন্তর জন্য! শায়লার মনে হলো, তার ব্রক্ষ্মতালুতে কেউ আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। অভ্র সরে গেল। দ্রুত হাতে চোখের পানি গুলো মুছে নিতে গিয়েও পারল না। তার বুক জ্বলছে। এবার সে বুঝতে পারছে পড়ন্ত কতটুকু অন্তর্দহনে জ্বলেছে এতদিন! অভ্র ফিসফিস করে স্বগতোক্তি করল,

-“তুই বড় শক্ত রে পড়ন্ত। আমি যে এই ব্যথা সইতে পারছি না!”
শায়লা হাত জোড়া মুষ্টিবদ্ধ করে নিলো। তার বুক হাপড়ের মতো উঠছে নামছে। মেজাজ খিঁচিয়ে তেজী গলায় বলল,
-“কাজটা তুমি মোটেও ঠিক করলে না।”
অভ্র ঝট করে শায়লার দিকে ফিরে তাকিয়ে আবার তেড়ে আসলো।
-“কাকে ভয় দেখাস তুই? হ্যাঁ? তোকে আমি তুলোধুনো করে ছাড়বো যদি আমার পড়ন্তকে এতটুকুও কষ্ট দিস তো।”
-“পড়ন্ত, পড়ন্ত, পড়ন্ত!!” চিৎকার করে উঠে শায়লা।
-“এই পড়ন্তই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় কাঁটা। ওকে আমি মেরেই ফেলবো। একদম সরিয়ে দিবো।”
শায়লা রাগ নিয়ে ঘর ছাড়তে নিলে পেছন থেকে টান অনুভব করে। অভ্র ওর হাতের বাহু টান দিয়ে ধরেছে।
-“তোর কলিজা ছিঁড়ে ছাদে শুকাতে দিবো। চিনিস তুই আমাকে?”

শায়লা ঝামটা মেরে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বেরিয়ে গেলে অভ্র হাতের কাছে থাকা একটা ফুলদানী ধাক্কা মেরে ফেলে দিলো। কাঁচের জারটি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে ছিটিয়ে পড়ল ঘরের মেঝেতে।
পড়ন্ত হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে রয়েছে। মনটা ভীষণ রকমের খারাপ তার। জাওয়াদরা নাকি যাওয়ার আগে তাকে পছন্দ হয়েছে, এমনটাই মিথুন উদ্দিনের কাছে মন্তব্য করে গেছেন। এখন শুধু তাদের পক্ষ থেকে পজিটিভ সাইন পাওয়ার অপেক্ষা। বাড়ির সবাই রাজী হলেও পড়ন্ত কিছুতেই রাজী হয়নি। এই নিয়ে নাসরিন হাজারটা কথা শুনিয়ে গেছেন। মিথুন উদ্দিন কতক্ষণ রাগে গজগজ করেছেন। পড়ন্তর কী যে অসহায় লাগছে নিজেকে! ইচ্ছে করছে কোথাও একটা চলে যেতে। কিন্তু কোথায় যাবে সে! আর জাওয়াদকে এত বুঝিয়ে বলার পরেও কেন এই বিয়েতে মত দিলো? পড়ন্ত শত ভেবেও কূল কিনারা পায় না।

নাসরিন বিছানা ঝাড়ছিলেন, এমন সময়ে হন্য পায়ে শায়লা এসে ঘরের ভেতর ঢুকলো।
-“পড়ন্ত কই চাচী?”
-“ওর রুমে৷ একটু বুঝা তো ওকে। এত ভালো পরিবার, এত সুন্দর পাত্র আর ওই গর্দভটা কোনো মতেই রাজী হচ্ছে না।”
শায়লা মৃদু শ্বাস ফেলল।
-“আমি বোঝাচ্ছি।” বলে পড়ন্তর ঘরের দিকে পা বাড়ালো। পড়ন্ত শায়লা কে দেখে চোখ সরিয়ে নিলো। শায়লার নাকের উপর জ্বলজ্বল করতে থাকা নাকফুলটা জানান দেয়, তার বিয়ের অস্তিত্ব, অভ্রর স্ত্রীর পরিচয়, যা সহ্য হয় না পড়ন্তর।
শায়লা গমগমে কণ্ঠে বলল,
-“বাহিরে আয়। কথা আছে।”
পড়ন্ত ঠান্ডা কণ্ঠেই বলল,
-“কী কথা?এখানেই বলো।”
-“চাচীর কাছে তোকে ছোট করতে চাচ্ছি না বলেই বাইরে আসতে বলছি। এখন আসবি নাকি অভ্রর ব্যাপারে এখানেই কথা সাড়বো?”

অগত্যা পড়ন্তকে উঠে বাহিরে বেরোতে হলো। আকাশে চাঁদের অস্তিত্বও নেই। পড়ন্তর মনে হলো, তাদের জীবন থেকে শায়লার অস্তিত্ব এভাবেই মিশে যেত যদি!
শায়লা পড়ন্তকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে উত্তেজিত কণ্ঠে বলল,
-“তোর সমস্যা কী? বিয়ে করতে চাচ্ছিস না কেন? বিয়ে করে আমার আর অভ্রর জীবন থেকে বেরিয়ে যা না… তোর কারণে অভ্র আমাকে এক্সেপ্ট করতে পারছে না। অথচ ও… ও আমার উপর দুর্বল হয়ে পড়েছে।”
পড়ন্ত যেন ঠিক বুঝলো না। কপাল কুঁচকে ফেলল সে।
-“কী বললে? দুর্বল হয়ে পড়েছে? তাও অভ্র তোমার উপর!” পড়ন্তর ঠোঁটে বিদ্রুপ মাখানো হাসি। শায়লা নাকের পাঠা ফুলিয়ে ফেলে তৎক্ষনাৎ।

অন্তর্দহন পর্ব ১০

-“হুম, আমার উপর। তুই প্রমাণ দেখতে চাস?”
পড়ন্তর বুকটা ঢিপঢিপ করছে। কী এমন দেখাবে শায়লা! সেটা সে সহ্য করতে পারবে তো?
তবুও জোরালো কণ্ঠে কৌতূহল দমন করতে পড়ন্ত জবাব দিলো,
-“হ্যাঁ,চাই। দেখাও।”
শায়লা দুর্বোধ্য হাসল। আশেপাশে তাকিয়ে নিজের জামার গলাটা খানিকটা নামিয়ে ধরতেই গলার অনেকটা নিচে দুটো লাল দাগ দেখা গেল। কেউ নখ দিয়ে আঁচড় দিয়েছে যেন। পড়ন্তর চোখজোড়া বড় বড় হয়ে গেল। সেই সাথে চোখের কোণ ঘেঁষে গড়িয়ে পড়ল পানি।
শায়লা জামা ঠিকঠাক করে বলল,

-“আর কিছু বলতে হবে? নাকি এখনো তেড়ামি করে বলবি, অভ্র তোকে ভালোবাসে, কোনটা?”
পড়ন্ত কোনো কথা বলল না। হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরল। তারপর একপ্রকার ছুটে শায়লার সামনে থেকে চলে গেল। শায়লা হাসল,পৈশাচিক হাসি। পড়ন্তকে তার প্রাপ্য জবাব দিতে পেরে খুশি সে।

অন্তর্দহন পর্ব ১২