অন্তর্দহন পর্ব ১০ || লেখনীতে- অলিন্দ্রিয়া রুহি

অন্তর্দহন পর্ব ১০
লেখনীতে- অলিন্দ্রিয়া রুহি

লোকটির নাম জাওয়াদ। বয়স তিরিশের কাছাকাছি। শ্যামবর্ণটিই তার শরীরে ভীষণ মানিয়ে গেছে। হালকা চাপ দাড়িতে তাকে কেমন দৃঢ় মনোভাবাপন্ন ব্যক্তি বলে মনে হয়। জাওয়াদের সঙ্গে তার বাবা আনিসুল তালুকদার,মা জেসমিন এবং দুলাভাই শ্যামল এসেছেন। জাওয়াদ মাথানিচু করে বসে রয়েছে। অভ্র দরজার গোড়ায় দাঁড়িয়ে একবার জাওয়াদের মুখমন্ডল পুরোটা মুখস্থ করে নিলো। নাসিকারন্ধ্র ভেদ করে রাগের উত্তপ্ত নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো তার। পেছনে কারও পায়ের উপস্থিতি টের পাওয়ায় অভ্র ঘুরে তাকিয়ে দেখল শায়লা হাস্যজ্বল মুখ করে তাকিয়ে রয়েছে।

-“লোকটাকে কেমন দেখলে? আমাদের পড়ন্তর সাথে মানাবে, কী বলো?”
বলে অভ্রর কাটা গায়ে নুনের ছিঁটে দিলো সে। অভ্র হিসহিসিয়ে বলল,
-“ওর সাথে সাথে তোরেও খুন করতে পারলে বাঁচতাম আমি।” বলে সরে যেতে চাইলে শায়লা বিদ্রুপের স্বরে বলে উঠল,
-“আহ! তাই বুঝি? এখন দেখবে কী করে চোখের সামনে দিয়ে তোমার প্রেয়সী অন্য কারো হয়ে যায়। তারপর তোমাকে আমার সঙ্গেই সংসার করতে হবে।”

অভ্র থমকে দাঁড়াল এই কথা শুনে। শায়লার হাসি হাসি মুখটা তার অন্তর্দহন বাড়িয়ে দিচ্ছে। সহ্য হচ্ছে না। সে তেড়ে আসতে গিয়েও থেমে গেল, পাছে কেউ চলে এসে দেখে ফেলে এই ভয়ে। কিন্তু কঠিন স্বরে বলল,
-“তোর মুখের নকশা বদলে দিতে আমার এক মিনিটও লাগবে না। তাই যা বলার ভেবেচিন্তে বলিস। আর পড়ন্তকে ও কেন, এই পৃথিবীর কেউই আমার চোখের সামনে দিয়ে নিয়ে যেতে পারবে না। আমি হতে দিবো না।”
-“কেন? কী করবে শুনি? পড়ন্তকে নিয়ে চলে যাবে?”
-“দরকার হলে তাই করব।” বলে হন্যপায়ে ঘর ছাড়লো অভ্র। শায়লা ঠাট্টার সুরে হেসে উঠতে উঠতে থমকালো ক্ষণিকের জন্য। তার চিন্তা হচ্ছে। সত্যি যদি অভ্র পড়ন্তকে নিজের করার জন্য এইবার কোনো স্টেপ নিয়ে নেয়? তখন! শায়লা মনে মনে ভাবনায় জমে গেল।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

দু’দিন আগেই ঢাকায় ফিরেছে পড়ন্তরা। তারপর থেকেই একপ্রকার হম্বিতম্বি শুরু করে জাওয়াদ ও তার পরিবারকে বাসায় নিয়ে এসেছেন মিথুন উদ্দিন। তার সঙ্গে নাসরিন একমত। তাই পড়ন্ত দু’জনের কারো কাছেই কোনো পাত্তা পেলো না। পাপনের জন্য তাকে কেন এভাবে হুট করে বিয়ের দড়ি গলায় পড়তে হবে- এই বলে অনেকক্ষণ চেচামেচি করলেও আপাতত চুপচাপ রয়েছে সে। তাকে মেরুন রঙের জামদানী পড়িয়ে নাসরিন নিজ হাতে সাজিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকিয়ে বাহির থেকে তালা মেরে গেছেন। তার কেন যেন ভয় হয়, পাপনটার মতো পড়ন্তটাও না চলে যায় কোথাও! এরচেয়ে বরং যতদিন বিয়েটা না হয় ঘরে তালাবন্দী হয়ে থাক, মানসম্মান পুরোপুরি যাওয়ার থেকে এই-ই ভালো।

নিরবে চোখের জল ফেলে বালিশ ভিজাচ্ছে পড়ন্ত। তার বুকটা ছারখার হয়ে যাচ্ছে পোড়া কপালের কারণে। জীবনে কী এমন দোষ করেছিল, যার বিনিময়ে আজ এত কষ্ট সইতে হচ্ছে তাকে! উত্তর পায় না পড়ন্ত। এতদিন অভ্রকে চোখের সামনে অন্যের বিবাহিত স্বামী হিসেবে দেখে দেখে মনটাকে তাও যা শক্ত করে ফেলেছিল পড়ন্ত, এখন আবার এ এক নতুন উৎপাত যেন! তার ভেতর ভালোবাসা নামক শব্দটির কোনোকিছুই অবশিষ্ট নেই আর! অভ্রকে নিংড়ে নিংড়ে সবটুকু সেই কবেই দিয়ে দিয়েছে সে! সে চায় না জাওয়াদ নামক লোকটিকে ঠকাতে।

ভালোবাসা না থাকলে এক ছাদের তলায় থাকা বড্ড কঠিন হয়ে পড়ে! শারীরিক চাহিদা যেমন হুট করে আসে, তেমন হুট করেই চলে যায়.. কেউ যদি ভেবে থাকে, শারীরিক ভাবে স্বামীকে সুখী করতে পারলেই স্বামীকে আঁটকে রাখবে পারা সক্ষম, তবে এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। শুধু শারীরিক শান্তিই না, মানসিক এবং আত্মিক শান্তি বলেও একটি কথা আছে! আর স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক হয় আত্মিক.. আত্মার সম্পর্ক! এই সম্পর্ক তো কারও সঙ্গেই গড়ে তোলা সম্ভব নয় পড়ন্তর। ভাঙা অন্তর জোড়া লাগালেও ভাঙার দাগ তো থেকেই যায়! পড়ন্ত কী করবে ভেবে পায় না! একবার ইচ্ছে করে, বিয়ে করেই থিতু হয়ে যাক। অন্তত চোখের সামনে অভ্রকে তো আর সহ্য করতে হবে না। পরক্ষণেই যখন নিজের শরীরে অভ্রর স্পর্শ ব্যতীত অন্যকারো স্পর্শের কথা ভাবে সে, তৎক্ষনাৎ শিউরে ওঠে ভেতরটা। নাহ, সে পারবে না। যেই জায়গায় অভ্রর নামটি লেখা, সেখানটায় আর কারো ঠাঁই নেই। দরকার পড়লে জাওয়াদকে সব খুলেই বলবে সে। অনুরোধ করবে, এই বিয়েটা না করার জন্য!

দরজায় খুট করে একটা শব্দ হতেই পড়ন্ত মাথা তুললো। নাসরিন ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ন্তর অবস্থা দেখে হা হয়ে গেলেন।
-“এসব কী পড়ন্ত? তোর চোখমুখের এই অবস্থা কেন? কাজল লেপ্টে ফেলেছিস, চুলের সেটিং ঠিক নেই! আর লিপস্টিক দিসনি কেন তুই?” নাসরিনের মেজাজ মুহূর্তেই সপ্তমে চড়ে গেল।
-“তোর সমস্যা কী হ্যাঁ? বিয়ে কী আর কারো হয় না? বিয়ে দিয়ে দিব বলে কেঁদেকেটে দুনিয়া ভাসাতে হবে? নাকি পছন্দের কেউ আছে? শোন,ওসব পছন্দ টছন্দ থাকলেও চলবে না। আমাদের পছন্দই মেনে নিতে হবে। তোমাদের দুই ভাইবোনের চয়েজ তো আমি চিনি.. পাপনটা তো ওই উল্লাসীর মতো একটা ছোটলোক কে নিয়ে ভাগলো, তুইও নিশ্চয়ই ওমন ছোটলোক গোছের কেউ বা কোনো গাঞ্জা খাওয়া ছেলেকেই পছন্দ করছিস। আমার কপালটাই খারাপ… অন্যান্য মেয়েরা কই রাণীর হালে থাকার জায়গা খোঁজে। আর আমার গাধা দুইটা গর্তে ঢুকতে চায়! এই ওঠ.. একদম নাকেমুখে কাঁদবি না। মেজাজ গরম করে ফেলছিস।”

পড়ন্তকে শক্ত হাতে হ্যাঁচকা টানে ওঠায় নাসরিন, তারপর আবার মুখে পাউডারের প্রলেপ মেখে দিয়ে ছড়ানো কাজল ঠিকঠাক করে দিলো। চুলের খোঁপাটা সুন্দর করে দিয়ে ঠোঁটে লিপস্টিকের হালকা ঘঁষা দিলো। আঁচলটা মাথায় তুলে দিয়ে পড়ন্তকে দাঁড়া করিয়ে তিনি আবার ধমকালেন,
-“মুখটাকে একদম প্যাঁচার মতো করে রাখবি না বলে দিলাম। ওখানে গিয়ে আগে সালাম দিবি, তারপর তারা যা যা জিজ্ঞেস করবি ভদ্র ভাবে উত্তর দিবি। আর মাথা নিচু করে রাখবি। নির্লজ্জের মতো আচরণ করিস না যেন..”

শিখিয়ে পড়িয়ে মেয়েকে ঠেলতে ঠেলতে ড্রয়িং রুমে নিয়ে এলেন নাসরিন। আসার পথে বারান্দায় অভ্রর সাথে দেখা হয়ে গিয়েছিল পড়ন্তর। অভ্র যে অবাক নয়নে তার দিকে তাকিয়ে ছিল তা বুঝতে এতটুকু সমস্যা হয়নি তার। এই প্রথম পড়ন্তর মনের মধ্যে একধরনের শান্তি শান্তি ভাব অনুভূত হয়েছে। অভ্র যে জ্বলে যাচ্ছে ভেতরে ভেতরে, তা যেন পড়ন্তর অবচেতন মন ঠিকই আঁচ করতে পারছে। আর তাই তো আনন্দে মনটা স্বস্তি দিয়ে কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠল। তবে এর জন্যে যে জাওয়াদকে বিয়ে করে নিয়ে অভ্রকে চিরজীবনের জন্য একটা শিক্ষা প্রদান করবে সে, এমনটাও কিন্তু নয়! জাওয়াদের সঙ্গে আলাদা ভাবে কথা বলার ছলনায় সবটাই খুলে বলবে পড়ন্ত। অনুনয় করবে যেন বাবা-মাকে কিছু না জানানো হয়। সেই যেন নিজ থেকে বিয়েটা ভেঙে দেয়। পড়ন্তর মন আগের চাইতে অনেকটাই ঠান্ডা হলো এইবার। সে হাসিমুখেই ভেতরে ঢুকলো।

তাকে বসানো হলো উপস্থিত ব্যক্তিদের মুখোমুখি করে। সবাই বেশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ন্তকে দেখতে লাগলে পড়ন্তর শরীরটা অস্বস্তিতে কাঁটা দিয়ে উঠল। একবার এখান থেকে ছাড়া পেলেই বাঁচে যেন। সে কী ঈদের গরু নাকি যে এতটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে হবে! কী আজব! একমাত্র জাওয়াদ নাম করে লোকটাই একনজর দেখে চোখ নামিয়ে ফেলেছে। পড়ন্ত আঁড়চোখে সেটা খেয়াল করলে মনে মনে অবাক না হয়ে পারে না সে। হতে পারে গায়ের রঙ চাঁপা, দেখতে আহামরি কিছু নয়, তবুও একবার তাকিয়ে দ্বিতীয়বার তো তাকানো উচিত ছিল! উফ না… পড়ন্ত এসব কী ভাবছে! সে দেখল বা না দেখল, তাতে পড়ন্তর কী এসে যায়? সে নিজের চিন্তাভাবনায় নিজেই আহাম্মক হলো। ইদানীং কালে এত এত ঝামেলার ভেতর দিয়ে মনটাও ছলনা করতে লেগেছে!

জাওয়াদের মা জেসমিন এটা ওটা প্রশ্নের পর প্রশ্ন করেই গেলেন… ‘কী নাম তোমার’ থেকে শুরু করে ‘রুটি বেলতে পারো’ পর্যন্ত সবটাই জিজ্ঞেস করলে পড়ন্ত হাসিমুখে যথাসম্ভব উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করল। মনে মনে ভাবল, এই মহিলার ঘরে যে মেয়ে বউ হয়ে যাবে, সে শেষ! তার জীবন ত্যানা ত্যানা…

শেষে জাওয়াদকে আর পড়ন্তকে একত্রে আলাদা কক্ষে পাঠানো হলো। ঘরটা নিতুর, জাওয়াদকে বিছানায় বসতে ইশারা করে দরজাটা ভিজিয়ে দিলো পড়ন্ত। জাওয়াদ চমকে গেলেও মনেরটা মনেই চেপে রাখলো। প্রকাশ করার সাহস পেল না। মেয়েটার ফোলা ফোলা চোখ জোড়া তাকে এমনিতেই মরণাস্ত্র দ্বারা বশ করে ফেলেছে। এখন আবার একঘরে দু’জন.. তাও দরজা চাপিয়ে! জাওয়াদ ভেতরে ভেতরে শিহরিত বোধ করল।
পড়ন্তর মুখের হাসিটা আর নেই। এতক্ষণ যাবত কৃত্রিম হাসি ঝুলিয়ে রাখতে গিয়ে চোয়াল ব্যথা হয়ে গিয়েছে। সে হাঁপ ছেড়ে জাওয়াদের পাশে এসে বসল, তবে দূরত্ব বজায় রেখে…

-“কেমন আছেন?” প্রথম প্রশ্নটা জাওয়াদই করল। নিরবতা ভেঙে কথাবার্তা আগানোর চেষ্টা আর কী। পড়ন্ত ক্ষীণ গলায় উত্তর করল,
-“জি, আলহামদুলিল্লাহ, আপনি?”
-“আমিও আলহামদুলিল্লাহ। কিছু মনে না করলে একটা প্রশ্ন করি?”
-“জি..”
-“আপনি কী কাঁদছিলেন?”
পড়ন্ত হকচকিয়ে গেলে জাওয়াদ দ্রুততার সঙ্গে বলে উঠল,
-“ইয়ে মানে.. প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড। আপনার চোখ ফুলে রয়েছে আবার লালও, তাই আর কী অনুমান করলাম।”
পড়ন্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
-“আপনার অনুমান সঠিক।” বলে হাতের তালু ঘঁষতে লাগল। তার ভীষণ অস্বস্তি লাগছে।

-“কারনটা জানতে পারি কী?” জাওয়াদের প্রশ্নে পড়ন্ত নিশ্চুপ রইলো। মনে মনে কথাগুলো গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে সে। অদ্ভুত একধরনের জড়তা তাকে গ্রাস করে নিয়েছে পুরোপুরি ভাবে৷ কেন যেন মনে হচ্ছে, এই কথাগুলো বলা খুব একটা সহজ হবে না জাওয়াদের কাছে।
নির্বাক পড়ন্তকে দেখে জাওয়াদ ফের বলে ফেলল,
-“এই বিয়েতে আপনি রাজী নন, তাই তো? আবারও অনুমান করলাম।”
পড়ন্ত পূর্বের ন্যায় ক্ষীণ গলায় জবাব দিলো,
-“আপনার অনুমান এবারও সঠিক। আর কী কী অনুমান করতে পারেন, বলেন তো..”
জাওয়াদ অল্প হেসে বলে,

-“পড়ালেখা করতে চান, তাই এতদ্রুত বিয়েটা করতে চান না.. রাইট?”
পড়ন্ত এবার মুচকি হাসে। জাওয়াদের অনুমান ঠিক হয়নি ভেবে বিদ্রুপ চিলিক দিয়ে উঠে চোখেমুখে..
-“জি না, এবার আর হলো না। হ্যাঁ, পড়াশোনাটা আসলে একটু অজুহাত মাত্র। আমি কখনোই বিয়ে করতে চাই না..”
-“ওমা! কেন?”
পড়ন্ত মনে মনে নিজেকে স্থির করল, সাহস জুগালো, এবার যে বলতেই হয়। ধানাইপানাই করে কাজের কাজ কিছুই হবে না..
-“আমার সম্পর্ক আছে..”
জাওয়াদ থমকে গেল যেন। কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে সে পুনরায় আগের স্বরে বলার চেষ্টা করল,
-“ওহ! তাহলে তাকে কেন প্রস্তাব নিয়ে আসতে বলেন না বাসায়?”
-“আসলে.. সে ম্যারিড!”

-“অ্যাহ!” জাওয়াদের চোখজোড়া বড় বড় হয়ে উঠলে পড়ন্ত দ্রুত কৈফিয়ত দেওয়ার চেষ্টা করল,
-“না মানে.. ধ্যাৎ! আমি আপনাকে বুঝিয়ে বলি। প্লিজ, লিসেন… আসলে আমি যাকে ভালোবাসি, সেও আমাকে ভালোবাসে। আমাদের অনেক বছরের সম্পর্ক। মাঝখান দিয়ে একটা এক্সিডেন্ট ঘটলে তাকে জোরজবরদস্তি অন্য একটি বিয়ে করে নিতে হয়। কিছুদিন আগেই তার বিয়ে হয়েছে। অথচ এখন পর্যন্ত সে কোনো দাম্পত্য জীবন শুরু করেনি। সে এখনো আমাকেই চায় এবং আমাকে মানানোর চেষ্টা করছে। ওই মেয়েকে যেভাবেই হোক তালাক দিয়ে আমাকে বিয়ে করবে তাই! বাট আমি রাজী না। ভালোবাসি তাই বলে একটা সংসার ভেঙে ফেলব! এইজন্যে আমি সবকিছু বিধাতার উপর ছেড়ে দিয়েছি। উনি আমার জন্য যা ভালো তাই-ই করবেন। শুধু আমি আর কোনো বিয়েটিয়ে অথবা সম্পর্কে জড়াতে চাই না। তাকে একতরফা ভাবেই ভালোবেসে যেতে চাই। নিজের জীবনটা অন্যরকম ভাবে সাজাতে চাই। জানেন, মাঝে মাঝে একতরফা ভালোবাসায় অন্যরকম আনন্দ থাকে। কষ্ট তো থাকেই…তবে এর অনুভূতিটাও অন্যরকম। আপনি বুঝবেন না..”

-“এখন থেকে বুঝবো হয়তো!” জাওয়াদের কণ্ঠটা করুণ শোনায়। পড়ন্ত ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকালে জাওয়াদ হেসে ফেলে।
-“রিল্যাক্স! মজা করলাম। এত দ্রুত কারও প্রেমে পড়ার মতো ছেলে আমি না। ভালো লাগতেই পারে, তবে ভালোবাসা জিনিসটা অন্যরকম… অন্যরকম এর অনুভূতি… ”
-“হুম.. একদম।” স্বস্তি অনুভব করল পড়ন্ত। যাক অবশেষে এই ঝামেলা মুক্ত হলো!
জাওয়াদ ঘর ছেড়ে বেরোনোর পিছু পিছু পড়ন্তও বের হলো আর দেখল, স্তব্ধ নয়নে অভ্র তাকিয়ে রয়েছে। সে যখনি শুনেছে, তাদের দু’জনকে একরুমে কথা বলার জন্য দেওয়া হয়েছে, তখনই ছুটে এসেছে। এসে দেখে দরজা লাগানো, তখনি অভ্রর মনটা এমনভাবে খচ করে কামড় দিয়ে ধরেছে যে দরজাটা ভেঙে ফেলতে ইচ্ছে করছিল তার। অনেক কষ্টে নিজের ইচ্ছা দমন করলেও রুমের সামনে থেকে সরে না সে। পায়চারি করতে থাকে। আধঘন্টা পর যখন পড়ন্ত আর জাওয়াদ বের হলো, তখন পড়ন্তর ঠোঁটে হাসি, জাওয়াদও হাসিমুখেই বেরিয়ে গেল। এর মানে কী? অভ্রর মনে হলো, সে এখানেই মাথা ঘুরে লুটিয়ে পড়বে। তার পড়ন্ত এভাবে তার সামনে দিয়ে অন্যের হয়ে যাবে.. এটা কিছুতেই হতে দেওয়া যাবে না!!

অন্তর্দহন পর্ব ৯

জাওয়াদ আগে আগে চলে গেছে। পড়ন্ত চলে যেতে নিলে অভ্র বজ্র কণ্ঠে বলে উঠল,
-“এই, দাঁড়া..”
পড়ন্ত কপাল কুঁচকে দাঁড়িয়ে পড়ল।
-“তোর ঠোঁটে এত হাসি কেন?”
পুনরায় অভ্র প্রশ্ন করলে পড়ন্ত আকাশ সমান অবাক হয়ে বলল,
-“আজব! আমার ইচ্ছে হয়েছে আমি হাসতেছি, তাতে তোমার কী!”
-“আমার কী? আজকে রাতে আমার সঙ্গে দেখা করবি। তখন বুঝাবো আমার কী..”
-“তুমি আমার কে হ্যাঁ? কেন দেখা করব তোমার সাথে?” বিদ্রুপ মাখানো একটা চাহনি অভ্রর দিকে ছুঁড়ে দিয়ে চলে যেতে চাইলে অভ্র পড়ন্তর এক বাহু খামচে ধরে। এত জোরে যেন মাংসটাই থেতলে দিবে পুরোপুরি…
-“লাগছে কিন্তু আমার!” চাপা স্বরে গুঙিয়ে ওঠে পড়ন্ত।
-“আর আমার যে বুকে লাগছে? সেটা?” অভ্রর কণ্ঠে স্পষ্ট অসহায়ত্ব। পড়ন্ত কয়েক সেকেন্ড নিরবে চোখে চোখ রেখে ক্রুর কণ্ঠে বলে উঠল,

-“লাগছে? লাগুক… এরচেয়েও শতগুণ আমার লেগেছিল অভ্র ভাই। তুমি শুধু এইটুকু দেখেছো। আর আমি তোমার বিয়ে দেখেছি… বাসর ঘর দেখেছি। এখনো প্রতিটি রাত তোমার বিছানায় শায়লাকে দেখতে পাই.. আর তোমার এইটুকুতেই মন ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে! হা হা হা… হাসালে…”
কী যেন ছিল পড়ন্তর কথাগুলোয়। অভ্র ওর বাহু ছেড়ে দিলে পড়ন্তর চোখজোড়া ছলছল করে উঠল। নাহ, এই অশ্রু কারো জন্য নয়.. এটা কাউকে দেখাবে না সে।অভ্রকে তো নয়ই… দ্রুতপায়ে প্রস্থান করল পড়ন্ত। অভ্র বুক জ্বালাপোড়া নিয়ে হতবুদ্ধির ন্যায় দাঁড়িয়ে রইলো।

অন্তর্দহন পর্ব ১১