অন্তর্দহন পর্ব ৯ || লেখনীতে- অলিন্দ্রিয়া রুহি

অন্তর্দহন পর্ব ৯
লেখনীতে- অলিন্দ্রিয়া রুহি

সাড়ে ছ’টার দিকে বাস থেকে পাপন আর উল্লাসী যেখানে নামলো, সেই জায়গাটার নাম হালিশপুর। আকাশে বাতাসে আযানের মধুর ধ্বনি ধ্বনিত হচ্ছে। উল্লাসী মন দিয়ে আযানটা শুনে পশ্চিম দিগন্তের দিকে তাকিয়ে মনে মনে আল্লাহর নিকট তাদের এই বিপদের সময় সাহায্য চাইলো। পাপন হাতে ব্যাগ ধরে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। এখন কোথায় যাবে বা কী করবে, কিছুই মাথায় আসছে না তার। কাজী অফিসটাই বা কোনদিকে- ভাবতেই পাপনের মাথা ঘুরে গেল। তাদের বার্থ সার্টিফিকেটটাই তো আনা হয়নি। ওটা ছাড়া বিয়ে হবে কী করে? আর পাপনের বা উল্লাসীর- দু’জনের বয়সই খুব কম সার্টিফিকেট অনুযায়ী, অর্থাৎ ওটা থাকলেও তাদের বিয়েটা হতে ঝামেলা হতো। ইশ! এখন কী হবে! পাপনের মনে হলো সে মাথা ঘুরে এইখানেই শুয়ে পড়বে। এত চিন্তা আর ভালো লাগছে না।

তাকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় রূপে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার চিন্তা কিছুটা আঁচ করতে পারে উল্লাসী। সে মৃদু শ্বাস ফেলে। তারও একদমই এসব ব্যাপারে খেয়াল ছিল না। এবার সেই বা কী বুদ্ধি দিবে- তা বুঝে উঠতে পারছে না। আকাশপানে আবার তাকায় উল্লাসী। তার চোখজোড়া ছলছল করছে। তার বিশ্বাস সমস্ত বিপদ থেকে যদি কেউ তাদের উদ্ধার করতে পারে, তবে সেটা মহান রাব্বুল আলামিনের পক্ষেই সম্ভব!
-“এখানে কী নতুন আসছো তোমরা?”
একটা অপরিচিত কণ্ঠস্বর তাদের দুটিকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্নটা করতেই ঝট করে পেছন ফিরে তাকাল দু’জনেই। সাদা জুব্বা গায়ে ঘন দাড়ির লোকটিকে দেখে উল্লাসীর প্রাণ কেঁপে উঠল। তবে কী বিধাতা তাদেরকে সাহায্য করার জন্য কাউকে পাঠিয়েছেন?
পাপন ভ্রু কুঁচকে ফেলেছে। চেনে না জানে না, তার সঙ্গে আলগা আলাপের দরকার নেই। বলা তো যায় না, মানুষের ভেতরটা কেমন!

বর্তমান যুগে মানুষ মাকাল ফলে পরিণত হয়েছে। যার উপরটা বড় সুন্দর আর চাকচিক্যময় হলেও ভেতরটা তিতকুটে এবং পঁচা! পাপন ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলতেই লোকটি পুনরায় বলে উঠল,
-“তোমাদের এই এলাকায় কখনো দেখেছি বলে মনে হয় না। ঢাকা থেকে এসেছো?”
পাপন জবাব দিলো না তবে মৃদু ভঙ্গিতে মাথা কাত করে ‘হ্যাঁ’ বলল।
-“পাশে এটা কে? তোমার বউ?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

পাপন দ্বিধায় পড়ে গেল। কী বলবে সে? বউ বলবে? কিন্তু বিয়েটা তো এখনো হয়নি! পাপন প্রশ্নবিদ্ধ চোখে উল্লাসীর দিকে তাকাতেই উল্লাসী হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়লো। নাহ, এই রাম ছাগলের দ্বারা কিচ্ছু সম্ভব না। আপাতত কারো না কারো সাহায্য তো নিতেই হবে নাকি! উল্লাসী নিজেই এগিয়ে এসে প্রথমে সালাম দিয়ে তারপর বলল,
-“আমার নাম উল্লাসী। আমরা ঢাকা থেকে নতুন এসেছি। এখানে কাউকে চিনি না, আমাদের কোনো আত্মীয় স্বজনও এখানে থাকে না। আপনি কী আমাদের একটা সাহায্য করতে পারবেন?”

পাপন চোখ বড় বড় করে ফেলেছে। এই মেয়ে এত বোকা কেন! কোথাকার কে, তাকে এত কথা বলে দিচ্ছে অনায়াসে! আসলেই মেয়েদের মাথায় ঘিলুর জায়গায় মাটি দিয়ে ভরা!! গোবর থাকলেও হতো। তাও যদি একটু সার পাওয়া যেতো!
লোকটি এবার উৎসুক চোখে ওদের দুটিকে ঠিকঠাক ভাবে পরখ করে নিয়ে বলল,
-“আমার সাথে আসো তোমরা। ঘরে বসে কথা বলো। এই মসজিদের ইমাম আমি। নামায পড়ে বাইরে বেরিয়েই তোমাদের এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কিছুটা কৌতুহল জাগে আরকী। তোমরা দু’জনেই খুব ছোট তো! আমার বড় মেয়েটার বয়সী… ভয় পেও না। আসো আসো। আমিও এককালে ঢাকায় ছিলাম। তারপর চট্টগ্রামে বিয়ে করলে এখানেই থিতু হই..” লোকটি এক নাগাড়ে কথা বলে যাচ্ছে। তার পিছুপিছু উল্লাসী হাঁটা ধরতেই পাপন ওর হাত টান দিয়ে ধরে। উল্লাসী বাঁধা পেয়ে পেছন ঘুরে তাকালে পাপন চোখ কটমট করে বোঝায়, ‘কোথায় যাচ্ছো?’

উল্লাসী চাপাস্বরে ফিসফিস করে বলে,
-“যদি বাঁচতে চাও, আসো। আর নইলে এই রাস্তায় পড়ে মরতে হবে।”
অগত্যা পাপনও হাঁটা ধরলো। উল্লাসীর মনে যে কী চলছে, তা বিন্দুমাত্র আঁচ করতে পারছে না পাপন।

বাসার পরিস্থিতি আপাতত শান্ত। বড় চাচা, মেজ চাচারা চুপচাপ, শুধু মিথুন উদ্দিনই পাগলের ন্যায় এদিক সেদিক ছুটে বেরিয়েছেন পুরোটা দিন জুড়ে। সন্ধ্যের পর ক্লান্ত দেহ,মন নিয়ে ফিরে এসেছেন বাড়িতে। নাসরিন ক্ষণে ক্ষণে বিলাপ করে কাঁদেন। গতকালই পাপনকে বিয়ে দিয়ে দেওয়াটা উচিত ছিল বলে আফসোস করেন উনি। মিথুন উদ্দিন বিছানায় শুয়ে আছেন। নাসরিনের এই আহাজারি তার একদমই সহ্য হচ্ছে না দেখে তিনি ধমকের সুরে বললেন,
-“ক্যাঁচরক্যাঁচর করবা না তো। উল্লাসী কোনো মেয়ে হলো? ওর মা মানুষের বাসায় কাজ করে, আর তার মেয়েকে আমি আমার ঘরের বউ করে আনবো?”

ঠিক তখনি ঘরের ভেতর পড়ন্ত এসে ঢুকলো। সে ঢুকতে ঢুকতেই মিথুন উদ্দিনের কথাগুলো শুনতে পেয়ে প্রত্যুত্তর করল,
-“বাবা উল্লাসীর মা মানুষের বাসায় কাজ করে, সে কিন্তু ভিক্ষা করে খায় না। কাজ করে তবেই খায়। আর কাজ ছোট বড় নেই। আল্লাহ যার মাধ্যমে যার রিযিক লিখে রাখছেন… তাই তুমি কোনোমতেই উনার কাজকে ছোটো করে দেখতে পারো না। আর উল্লাসী যথেষ্ট বুদ্ধিমতী একটা মেয়ে। ওর আদব কায়দা আছে, নামায রোজা করে। কী হতো মেনে নিলে ওদেরকে?”

-“তুই হঠাৎ সুর পাল্টালি যে? কেন রে? তোরও কোনো চক্কর চলছে নাকি কারো সাথে?”
পড়ন্ত লজ্জা পেলেও মাথা নোয়ালো না। আসলে অভ্রর সাথে বিচ্ছেদের পর থেকে সে বুঝেছে, নিজের অধিকার নিজেকেই আদায় করে নিতে হয়। বাচ্চা কাঁদলে তবেই তাকে দুধ খাওয়ায় মা, তাই পড়ন্তকেও আর চুপচাপ, নম্র-ভদ্র থাকলে চলবে না। তার হক আদায়ে তাকেই চেঁচাতে হবে। এতে যদি তাকে ‘বেয়াদব’ উপাধী দেওয়া হয়, তাহলে তাই সই।
-“আমি মোটেও সুর পাল্টাইনি বাবা। যেটা উচিত কথা সেটা বলতেছি। পাপনের সুখটা সবার চেয়ে বড়। সে যদি উল্লাসীকে নিয়ে সুখে থাকতে চায়, তবে থাকতে দেওয়া উচিত। তোমরা তো আবার নিজেদের সিদ্ধান্ত অন্যর ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ায় ওস্তাদ!”
মাঝদিয়ে নাসরিন বললেন,

-“এই কথা তুই আমাকে আগেও বলছিস। আমরা তোর ঘাড়ে কী সিদ্ধান্ত চাপাইছি? হ্যাঁ?”
-“কিছু না। পাপনের জন্য দোয়া করো, ছেলেটা যেখানেই থাকুক, ভালো থাকে যেন। আর উল্লাসী যেরকম মেয়ে, ও ঠিক সব পরিস্থিতি সামলে নিবে। আমার বিশ্বাস আছে ওর উপর। আর দয়া করে উল্লাসীকে বা ওর পরিবারকে ছোট করে দেইখো না বাবা। বড় লোক ঘরের ছেলে নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়েকে বিয়ে করলে লোকে ছেলেকে প্রশংসিত করে আর মেয়েকে বলে, ‘যাদুটোনা করে বড়লোক ছেলেকে হাত করছে!’ কী আজব চিন্তাধারা মানুষের! হুহ..‌!” একদমে কথাগুলো বলে থামতেই পড়ন্ত দেখল, তার বাবা-মা তার দিকে কেমম অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে রয়েছে। পড়ন্ত বিশেষ আগ্রহ দেখালো না। যেভাবে হঠাৎ এসেছিল, সেভাবে হুট করেই চলে গেল।
পড়ন্ত চলে যেতেই মিথুন উদ্দিন নিচু কণ্ঠে বললেন,

-“তোমার মেয়ের হাব-ভাব আমার কাছে ভালো ঠেকছে না নাসরিন। পাপনের মতো এও কী কিছু ঘটাতে চাইছে নাকি?”
নাসরিন ঠোঁট কামড়ালেন।
-“কী জানি বাবা! তবে তোমাকে একটা কথা বলা হয় নাই। তুমি কী না কী ভাববা তাই আর কী বলি নাই। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে বলাটা উচিত।”
মিথুন উদ্দিন উঠে বসতে বসতে জিজ্ঞেস করলেন,
-“কী?”

পড়ন্ত যখন অভ্রর বিরহে রাতদিন বুক ভাসানো কান্নায় ডুবে ছিল, নাসরিন সেসব লক্ষ্য করলেও কারণটা যে অভ্র তা বুঝতে পারেননি। তবে পড়ন্তর সাথে নিশ্চয়ই অন্য কারো সম্পর্ক আছে আর সম্পর্ক ঘটিত কারণেই সে এরকম মনমরা হয়ে রয়েছে- এমনটা ধারণা করেন তিনি৷ কথাগুলো মিথুন উদ্দিনের কানে ঢালতেই মিথুন উদ্দিন বেশ চিন্তিত হয়ে উঠলেন। পাপনটা যে কাজ করেছে, পড়ন্তটাও যদি একই কাজ করে, তবে শেষমেশ পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে ভাবা যায়? ভাইদের কাছে ছোট হয়ে যাবে,সমাজের চোখে ছোট হয়ে যাবে। মিথুন উদ্দিন বেশ চিন্তায় পড়লেন। কিছুক্ষণ পর নাসরিনকে বললেন,

-“তোমার মেয়ের মতিগতিও ঠিক লাগছে না। দেখো গিয়ে,সেও এরকম কিছু ঘটানোর অপেক্ষায় আছে কী-না।”
-“তাহলে এখন?”
-“তাকে অপেক্ষা করার সময়টুকুই দিবো না আমি। কালকেই ঢাকায় রওনা হবো আমরা। ওর জন্য বেশ কয়েকটা ভালো ভালো প্রস্তাব আমার কাছে এসেছিল। পড়াশোনা করছে তাই আমি আগ্রহ করিনি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে বিয়েটা দিয়ে দেওয়াই ভালো হবে। বিয়ের পর পড়াশোনা যত মন চায় করুক। অন্তত আমার মাথা থেকে চিন্তা তো দূর হবে!”
নাসরিন সায় দিলেন। মিথুন উদ্দিনের পরিকল্পনাই ঠিক। দুটো ছেলেমেয়েই একদম জলে ভেসে যাক, এমনটা চান না তিনি…

হাঁটুতে মুখ গুঁজে ‘দ’ ভঙ্গিতে বসে রয়েছে পড়ন্ত। মনটা ভীষণ বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। ইদানীং কোনো কিছুই ভালো লাগে না তার। একটা কথা সবসময় বুকে খোঁচা দেয়, শায়লা আর অভ্র এক ঘরে রয়েছে। কী করছে তারা? অভ্রকে জিতে নিয়েছে শায়লা? নিতে কতক্ষণ! পড়ন্তর বুক চিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। চোখ দুটো জ্বালা করতে লাগল। কাঁদবে না কাঁদবে না করে বারংবার অন্তর্দহনের কাছে পরাজিত হতে হয় তাকে। অভ্রকে যত ভুলতে চেষ্টা করে ততই মনে পড়ে বেশি বেশি! ব্রেইন একদিকে, তো মন আরেকদিকে..

এই অসহ্যকর দ্বিধাদ্বন্দ্ব পড়ন্তকে আগুনে পুড়িয়ে ছারখার করে দিচ্ছে।
কাঁধে কারো স্পর্শ পেতেই পড়ন্ত চমকে মাথা তুলে দেখলো নিতু কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
-“তোমার মন খারাপ আপা? অভ্র ভাইয়ের কথা মনে পড়ছে?” বলতে বলতে তার পাশে বসে নিতু।
পড়ন্ত মাথা নাড়ালো। মিথ্যে করে বলল,
-“নাহ, পাপনটার কথা মনে পড়ছে। না জানি কোথায় আছে, কী করছে ও!”
নিতু উশখুশ করল খানিকক্ষণ। তারপর হঠাৎই চাপা কণ্ঠে প্রায় ফিসফিস করে বলল,

-“আমি একটা কথা বলতে চাই আপা।”
-“কী কথা?”
-“আসলে আমি… আমি পাপন আর উল্লাসীকে পালিয়ে যেতে দেখেছি।”
-“বলিস কী!” প্রায় চিৎকার করে উঠে পড়ন্ত। নিতুর হাত জোড়া শক্ত করে চেপে ধরে উৎসুক কণ্ঠে বলল,
-“তারপর? ওরা কোথায় আছে জানিস?”

অন্তর্দহন পর্ব ৮

-“না আপা। আমি তো রাতে বাথরুমের জন্য উঠছিলাম। তখন পাপনের ঘরে হুট করে কাউকে ঢুকতে দেখে চমকে যাই। নিজেকে ধাতস্থ করে ওর ঘরের দরজায় কান পাতি আর তখনি উল্লাসী আর পাপনের কথাবার্তা শুনতে পাই। উল্লাসীই পাপনকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে নিয়ে গেছে। আমি কাউকে ডাকতে চাইছিলাম কিন্তু কেন যেন ডাকিনি। ওদের কথাবার্তায় যে ভালোবাসা আর একে অপরের প্রতি টান টুকু অনুভব করতে পেরেছিলাম, তা আমাকে থামিয়ে দিয়েছিল।”
পড়ন্ত হেসে উঠল।

-“সিরিয়াসলি! উল্লাসী পাপনকে ভাগিয়ে নিয়ে গেছে? হায় আল্লাহ! আমার ভাইটা এজীবনে অকর্মার ঢেকিই রয়ে গেল!”
নিতু হাসলো মৃদু।
-“হুঁ… আর উল্লাসীর বিয়ে হয়ে যেতো নাকি। ওই সজলের বাবার সাথে।”
-“অ্যাহ!” ভ্যাবাচ্যাকা খায় পড়ন্ত। নিতু শব্দ করে হাসে।
-“হুম.. এইজন্যেই তো উল্লাসী পালিয়েছে। সঙ্গে করে তোমার গাধা ভাইটাকেও নিয়ে গেছে।”
-“হা হা হা!পাপন কে যদি কোনোদিন সামনে পাই, তবে আজীবন টিপ্পনী কাটবো, দেখিস।” বলতে বলতে অট্টহাসিতে মেতে উঠে পড়ন্ত। হঠাৎই একটা ভাবনা তার মাথায় ধরা দেয়, আর সে থমকে যায়। আচ্ছা, সেও কী পারতো না অভ্রকে এভাবে নিয়ে পালিয়ে যেতে? ভাবনায় ডুবে যায় পড়ন্ত।

অন্তর্দহন পর্ব ১০