অন্তর্দহন পর্ব ৩ || লেখনীতে- অলিন্দ্রিয়া রুহি

অন্তর্দহন পর্ব ৩
লেখনীতে- অলিন্দ্রিয়া রুহি

ভোরের দিকে চাপা গোঙানির শব্দে নাসরিনের ঘুম ছুটে গেল। পিটপিট করে চোখ মেলতেই তিনি পুরোপুরি ভাবে অবাক হয়ে দেখতে লাগলেন, বেলা ন’টার আগে না ওঠা মেয়েটা আজ ফজরের নামাযে মোনাজাত ধরে হাউমাউ করে কাঁদছে, তবে পুরোটাই নিঃশব্দে৷ যদিও তার অজান্তেই একধরনের চাপা গোঙানির শব্দ পুরো ঘরময় ধ্বনিত হচ্ছে। নাসরিন তবু উঠলেন না। মটকা মেরে পড়ে রইলেন। এতক্ষণ যাবত পড়ন্তর কোনো শারীরিক অসুখ হয়েছে- এমনটা ভাবছিলেন তিনি, কিন্তু এখন চিন্তাধারার মোড় পাল্টে গেছে। তার মেয়ে জটিল কোনো মানসিক বিপর্যস্ততার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কী সেই বিষয়টি? পড়ন্ত তো বলছেও না! প্রেমঘটিত কোনো কারণ হলে বলার সম্ভাবনাও কম। আমার দেশের ছেলেমেয়েরা বাবা-মায়ের সাথে এতটা ফ্রেন্ডলি আচরণ করতে পারে না চাইলেও! অজানা আশংকার ভয় মনে সবসময় দানা বেঁধে থাকে।

পড়ন্ত উঠছে। তাই দ্রুত চোখ মুদে ফেললেন নাসরিন। তার হঠাৎই ভীষণ কষ্ট হতে লাগল। মেয়েটা তার একা একা কষ্ট পাচ্ছে অথচ সে মা হয়েও কিছু কর‍তে পারছে না! কীইবা করবে সে? এই কষ্টের উৎপত্তি কোথায়, তাই তো জানেন না তিনি! রাতের আঁধার কেটে ধীরে ধীরে আলোকিত হচ্ছে চারপাশ। বড় জানালার পাশে দাঁড়িয়ে অবাক নয়নে দিনের শুরু দেখলো পড়ন্ত। মনে মনে প্রার্থনা করল,
-“ইয়া রব, অন্ধকার সরিয়ে যেভাবে আলো ফুঁটাও তুমি, ঠিক সেভাবেই আমার জীবন থেকে কষ্ট গুলো সরিয়ে দাও। যেহেতু সে আমার না, তাহলে তার জন্য আমার মনের হা-হুতাশ গুলো বিলীন করে দাও। আমি বাঁচতে চাই… একটা সুন্দর জীবন চাই।”

সকাল সকাল মেয়ের ভার মুখ দেখে এর কারণ শিখা কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পারলেন। চুলোয় চায়ের পানি বসিয়ে দিয়ে তিনি শায়লার দিকে ফিরলেন। শায়লার শরীরে হালকা গোলাপী জামদানী। সুন্দর মানিয়েছে। ফর্সা শরীরে গোলাপের পাপড়ির ন্যায় লাগছে। শিখা মনে মনে আওড়ালেন, “মাশা-আল্লাহ।” তারপর বললেন,
-“কী রে? তুই এভাবে প্যাঁচার মতো মুখ করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? জামাই ওঠেনি?”
শায়লা সে কথার জবাব না দিয়ে অস্থির দৃষ্টিতে এদিক ওদিক তাকাতে লাগল। শিখার মনে হলো, শায়লার চোখে পানি জমেছে। সেটাই লুকোনোর ব্যর্থ চেষ্টা করছে মেয়েটা। শিখা এগিয়ে এসে মেয়ের কাঁধে হাত রাখলেন।
-“কী হইছে মা? আমাকে খুলে বল।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

শায়লা নিজের আবেগ ধরে রাখতে পারল না আর। শিখার সামনেই কেঁদে দিল।
-“ও আমাকে মেনে নেয়নি মা।”
কথাটি শুনে শিখা মোটেও চমকালেন না বরং এটিই স্বাভাবিক। একটা দুর্ঘটনার বশবর্তী হয়ে বিয়েটা হওয়া, একদিনেই সবকিছু মেনে নেওয়া যায় না নিশ্চয়ই? সময়ের প্রয়োজন। সময়ই পারে সব সম্পর্ককে নতুন ভাবে জুড়ে দিতে, আবার ভেঙেও দিতে!

-“এতে এতো কান্নাকাটি করার কী আছে? আজ না মেনে নিছে, কাল নিবে। কাল না নিলে পরশু.. শোন, বিয়ে যখন হইছে, তখন মেনে নিতেই হবে। তুই ওকে সময় দে বুঝলি? তার সামনে সেজেগুজে থাকবি সবসময়। ওর খেয়াল রাখবি। হাসিমুখে কথা বলবি। দেখবি, তোর মায়াজালে অভ্র ফাঁসবে। এরকম ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করলে কোনোদিনই মেনে নিবে না। নে, চোখ মোছ এবার।”
শিখা নিজেই শায়লার চোখ মুছিয়ে দিলেন। তারপর চায়ের পানিতে চা-পাতি, চিনি, আর দুধ দিয়ে কিছুক্ষণ জ্বাল করে গাঢ় চা তৈরি করলেন। এক কাপ চা শায়লার হাতে দিয়ে বললেন,

-“এটা নিয়ে যা। খেতে না চাইলে জোর করবি না, রেখে চলে আসবি চুপচাপ। ওকে বুঝাবি যে তুই তাকে সময় দিয়েছিস নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার জন্য। একসময় না একসময় সে ফিরবেই তোর কাছে। বিয়ে ব্যাপারটাই এমন৷ আল্লাহর আলাদা রহমত থাকে এতে…”
শায়লাকে দেখে মনে হলো মায়ের কথায় সে অনেকটাই শান্ত হয়েছে। চুপচাপ চায়ের কাপ নিয়ে নিজেদের রুমের দিকে যাত্রা শুরু করলো।

বাহিরে ঝলমলে রোদ। উত্তপ্ত আবহাওয়া। সূর্যের রশ্মি জানালা ভেদ করে টাইলসের মেঝের উপর এসে আছড়ে পড়েছে। টাইলস চিকচিক করছে। দেখতে সুন্দর লাগছে। সেদিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে অভ্র। পড়ন্ত যদি আজ তার জীবনে থাকত, তবে তার জীবনটাও এরকক চকমকে হতো! সুন্দর আর আকর্ষণীয় হতো! আফসোস… পড়ন্তকে সে হারিয়ে ফেলেছে। পরমুহূর্তেই নিজের চিন্তাভাবনায় বাঁধা দিলো নিজেই। পড়ন্তকে কেন হারাবে সে? পড়ন্ত কোথাও যায়নি.. বিয়ে হয়েছে তো কী হয়েছে? শায়লাকে ডিভোর্স দিবে দরকার পড়লে। একটা ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিল তখন অতিরিক্ত উত্তেজনায়। নইলে এই বাড়ি ছেড়ে কোথাও পালিয়েও তো যেতে পারতো অভ্র! ইশ… চোর পালালে যে বুদ্ধি বাড়ে, এই তার বাস্তব প্রমাণ! এইজন্যেই গুরুজনেরা বলেন, বিপদের সময় উত্তেজিত না হয়ে মাথা ঠান্ডা রাখতে।

দরজা দিয়ে কারও আগমনের উপস্থিতি টের পেয়ে অভ্র ভাবনার গতিপথের রাশ টেনে ধরল। আড়চোখে দেখল, শায়লা এসেছে। তার হাতে চায়ের কাপ। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই চা খাওয়াটা অভ্রর অনেকদিনের অভ্যাস। কিন্তু এতদিন এই চা-টা পড়ন্ত এনে দিতো। একদিনের ব্যবধানে সেটা শায়লার দখলে চলে গিয়েছে! বুক ফুঁড়ে আবারও একটি দীর্ঘশ্বাস বাতাসে মিশিয়ে দিয়ে ঝটপট উঠে পড়ল অভ্র। একটা টি-শার্ট গায়ে চাপাতে চাপাতে বাথরুমের দিকে এগোতেই শুনল, শায়লা বলছে,

-“তোমার চা..”
অভ্র না চাইতেও থামলো। শায়লার এসব বউ বউ আদিখ্যেতা একদম সহ্য হচ্ছে না।
-“একটা উপহার পেয়ে বোধহয় তোর মজা লেগে গেছে। তাই আরও উপহার চাইছিস!”
-“বারে! আমি কী করলাম?”
-“এই বউ হওয়ার নাটকটা করতে মানা করছিলাম না?”

শায়লার মেজাজ চটে গেল। এভাবে অপদস্ত হয়ে থাকা যায় না! বিয়েটা হয়েছে না যেন মাথা কিনে নিয়েছে অভ্র! যেটা বলবে সেটাই শুনতে হবে! সিরিয়ালের নায়িকার মতো এখন তার থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হবে! কত্তো নাটক!!
মাথাটা জোর করে ঠান্ডা করল শায়লা। মা বারবার করে বলে দিয়েছেন, মেজাজ না দেখিয়ে বুদ্ধি দিয়ে কাবু করতে।
-“আচ্ছা, আমি চা রেখে চলে যাচ্ছি। আর শোনো, আমি মোটেও বউ হওয়ার নাটক করছি না। তুমি মানো বা না মানো, আমি তোমার বউই! আমি যদি আমার অধিকার চাই, তুমি কী না দিয়ে থাকতে পারবে? আমার তো এখানে দোষ ছিল না! শুধু একটা সম্পর্ক আমি ভাঙতে চাইনি তাই বিয়েটাকে মন থেকে মেনে নিয়েছি।”

-“অথচ আমার আর পড়ন্তর সম্পর্কটা ঠিকই ভেঙে দিয়েছিস!”
-“আমি ভাঙিনি। উপরে যিনি আছেন, উনি করেছেন। উনার হুকুম ব্যতীত একটা গাছের পাতাও নড়ে না, আর তো বিয়ে! উনিই তোমার কপালে আমাকে লিখে রেখেছিলেন। আর একটা কথা জানো তো, আমরা সবসময় ভুল মানুষকেই ভালোবাসি। যাকে পাবো না, তাকেই পাওয়ার জন্য মন বেহায়া হয়ে উঠে। মাথা ঠান্ডা হলে একটু ভেবে দেইখো, আসলেই তোমার এসব আচরণ পাওয়ার যোগ্য আমি কী-না! আমি কিন্তু কিছুই করিনি। ভাগ্যের উপর আমার বিন্দুমাত্র হাত নেই। তবুও যা হয়েছে তা মেনে নিয়ে তোমার মন ভালো করার চেষ্টা করছি। অথচ তুমি…!

থাক, চা টা খেয়ে নিও ঠান্ডা হওয়ার আগে। তোমাকে তোমার মতো ছেড়ে দিলাম।” বলে একমুহূর্ত অপেক্ষা করল না শায়লা। বেরিয়ে গেল ঘর ত্যাগ করে। অভ্র হতভম্বের ন্যায় দাঁড়িয়ে রইল। শায়লার কথাগুলো কানে বাজছে তার। আসলেই তো.. শায়লার কী আদৌও কোনো দোষ আছে? সেও যেভাবে চাপে পড়ে বিয়েটা করেছে, শায়লাও চাপে পড়েছিল। আর একবার বিয়ে হয়ে গেলে সেখান থেকে সহজে বেরিয়ে আসতে চায় না, এমনটাই মেয়েদের সাইকোলজি। সম্পর্ক ভাঙতে প্রচুর ভয় আর জড়তা কাজ করে তাদের মনে।

এই জন্যে কত মেয়েরা ভালোবাসা নেই, তবুও দায়বদ্ধতা মেনে নিয়ে যুগের পর যুগ হাসি মুখে সংসার করে যাচ্ছে! অভ্র ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে তার মন জানান দিলো, শায়লার মিষ্টি মিষ্টি কথায় ভুলে যাস না সবকিছু। শায়লার দোষ নেই, অথচ সে কিন্তু একবারও কাউকে বলেনি এই বিয়েটা ভাঙার কথা! যদিও সে জানতো, তোর পোড়া মন একজনের অনুপস্থিতিতে পুড়ছে। তার সাথে খারাপ ব্যবহার না কর, ভালো ব্যবহারও করার দরকার নেই। নির্বিকার থাক। সময় সু্যোগ আর পরিস্থিতি বুঝে বাসায় বল যে শায়লার সাথে তোর যাচ্ছে না। তুই এই সম্পর্ক থেকে মুক্তি চাস। তারপর পড়ন্ত তোর.. শুধুই তোর। আজকে যে করেই হোক, পড়ন্তর সঙ্গে কথা বলতে হবে। অভ্র বিহনে পড়ন্ত নিশ্চয়ই ভেঙে পড়েছে…
কথাগুলো ভাবতেই অভ্র নিজের ভেতরে একধরনের ছটফটানি অনুভব করল। দ্রুত ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পড়ল ঘর ছেড়ে। উদ্দেশ্য, পড়ন্তকে খোঁজা…

নাশতার টেবিলে পারিবারিক মিটিং বসেছে। দাদীবু তিন ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
-“আজকে যদি তোদের বাপ বেঁচে থাকতো, সে যে কী খুশি হইতো! আহারে… মানুষটা অকালেই চলে গেল আমাদের ছেড়ে।” মৃত স্বামীর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে উনার গলার স্বর ভারী হয়ে আসে।
তমিজ উদ্দিন বললেন,
-“আম্মা, আপনে কাঁদবেন না। আব্বা নাই কে বলছে? উনি আমাদের সাথেই আছে আর সবই দেখে। উনি নিশ্চয়ই অভ্র আর শায়লার বিবাহবন্ধনে খুশি হইছে।”
খোকন উদ্দিন বললেন,
-“আম্মা, একটা কাজ করলে কেমন হয়? ওরা নতুন দম্পতি, অথচ আব্বার দোয়া পাবে না এটা কেমন কথা? তাই চলেন, আজকে সবাই মিলে গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দেই। দুদিন থেকে চলে আসলাম। আব্বার দোয়া নেওয়া হলো, গ্রামের সবাইকে মিষ্টিও খাওয়ানো হলো।”
তমিজ উদ্দিন খোকনের পিঠ চাপড়ালেন।

-“এটা তো খুবই ভালো কথা। এখন বাজতেছে নয়টা… বারোটার মধ্যে রওনা দিলে বিকেলের মধ্যে পৌঁছানো সম্ভব।”
-“আমি দুইটা মাইক্রো ভাড়া করে ফেলি দ্রুত তাইলে…” বলে ব্যস্ত ভঙ্গিতে মিথুন উদ্দিন উঠে গেলেন। দাদীবু তিন বউকে ডেকে যথারীতি গোছগাছ শুরু করতে বললেন। দুপুরের খাবার বাহির থেকে কিনে নেওয়া হবে, তাই রান্নার ঝামেলা নেই। ঘরবাড়ি তালা দিয়ে সবাই যাবে।
খবরটা শুনে পাপন দুইটা লাফ মারলো। কতদিন উল্লাসীর চেহারাটা দেখে না! এবার গেলে নিশ্চয়ই দেখা হবে! পাপন দ্রুত নিজের জামাকাপড় গোছাতে শুরু করল। পড়ন্ত পাপনের রুমে এসে গোছগাছ দেখে একটু অবাক হলো। জিজ্ঞেস করল,
-“কীরে? কই যাবি?”
-“গ্রামে..”
-“ওমা! হঠাৎ?”
-“অভ্র ভাইয়া আর শায়লা আপুর বিবাহ উপলক্ষে… সবাই যাবে। দাদার দোয়া নিবে। আর গ্রামবাসীকে মিষ্টি বিতরণ করবে।”
মুহূর্তেই বুকটা ভার হয়ে এলো পড়ন্তর। নাসরিন ঠিক সেই মুহূর্তেই ঘরে এসে ঢুকে পড়ন্তকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
-“তোর কোন জামা গুলি নিবি? দেখে দে… সময় কম। আর পাপন, তুই গোসলে যা..”
পড়ন্ত নির্বিকার কণ্ঠে জবাব দিলো,

-“আমি যাব না মা।”
-“যাবি না মানে?”
-“যাব না মানে যাব না।”
-“সবাই যাবে, আর তুই একা বাসায় থাকবি?”
-“দরকার পড়লে থাকব। তবুও যাব না। আমার ভালো লাগছে না।”
নাসরিন রেগে গেলেন। কেন ভালো লাগছে সেই কারণ তো অজানা নয়। কোন না কোন ছেলের থেকে ছ্যাঁকা ট্যাকা খেয়ে মুহূর্তেই দেবদাসী বনে গেছেন! একটু গ্রামে গেলে হাওয়া বদল হতো, ভালো লাগতো, মনটাও হালকা হতো, তা না… উনি নাকি যাবেন না!
-“তুই যাবি, তোর বাপও যাবে। যা গোসলে ঢুক… আমার কথার উপর কথা বলবি না খবরদার।”
-“মা, অন্যের উপর নিজেদের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতেই পারো তোমরা?”
-“মানে?”

-“এই যে.. আমি যাব না বললাম, তাও তোমার সিদ্ধান্ত আমার উপর চাপিয়ে দিচ্ছো। আবার অভ্র ভাইয়ার বিয়েটাও তার সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে দিয়েছো৷ কেউ কী একবারও জানতে চেয়েছো অভ্র ভাই বিয়েতে রাজী কী-না?”
-“এক মিনিট, এখানে অভ্র আসছে কোথথেকে?”
-“কিছু না।” বলে উঠে দাঁড়াল পড়ন্ত। নিজের রুমের দিকে হাঁটা দিলো। নাসরিন হতবাক, পড়ন্তের আচরণ কিছুতেই তার মাথায় ঢুকছে না। পাপনও গোছগাছ থামিয়ে পড়ন্তের কথা শুনছিল। সে চলে যেতেই বলল,
-“মা, আপার না কী যেন হইছে। কেমন করতেছে, দেখো না। হাসেও না একটু। সারাক্ষণ এমন মুখে থাকে যেন কেঁদে ফেলবে।”

-“ওর ভূত আমি তাড়াবো মাথা থেকে। গ্রামে যেয়ে নেই আগে। তুই কাপড় গুছিয়ে গোসলে ঢুক..”
বলে নাসরিন চলে গেলেন। পাপন মৃদু নিঃশ্বাস ফেলল।
পড়ন্ত যাবে না যাবে না করলেও শেষ পর্যন্ত তাকে তৈরি হতে হলো মিথুন উদ্দিনের ধমক খেয়ে। মাকে যতটা অভয় করে, বাবাকে ঠিক ততটাই ভয় করে সে। নাকেমুখে কেঁদেকেটে তৈরি হয়ে গাল,মুখ ফুলিয়ে লম্বা বারান্দায় এসে দাঁড়াল পড়ন্ত। মাথার উপর উত্তপ্ত সূর্য, লম্বা কিরণ দিচ্ছে। গরমে গা টা চিট চিট করছে। রোদের উত্তাপে গা ঘেমে উঠছে। থাকা যাচ্ছে না। পড়ন্ত ঘরের উদ্দেশ্যে যাবে, পেছন ঘুরে তাকাতেই থমকে গেল। অভ্র দাঁড়িয়ে… সেই চিরচেনা মুখ, চিরচেনা চোখ,নাক,ঠোঁট… হালকা দাড়িতে ভরে আছে থুতনি… তবুও একটা সূক্ষ্ণ পার্থক্য আছে। পড়ন্তের অবচেতন মনে পার্থক্যটা ধরা পড়ল। অভ্রর চোখ দুটো আগে ওকে দেখলে আনন্দে উল্লাসে ফেটে পড়ত, আর আজ বিষন্ন, খানিকটা লাল বর্ণের। কান্না আঁটকে রাখলে এরকমটা হয়। পড়ন্ত ঢোক গিলে নিজেকে সামলালো। অভ্র কিছু একটা বলবে- বুঝতে পেরে পড়ন্ত নিজ থেকে পরিবেশ টাকে সহজ করে দিলো। মুখে কৃত্রিম হাসি ফুঁটিয়ে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,

-“অভ্র ভাইয়া! তুমি এখানে?”
অভ্র চমকালো। পড়ন্তের টোনটা ভালো ঠেকছে না। তবে কী অভ্রকে মন থেকে পুরোপুরি ভাবে মুছে দিয়েছে সে?
-“আশেপাশে তো কেউ নেই। ভাইয়া ডাকছিস কেন?”
-“আজব তো! তুমি আমার বড় ভাই.. আমার কাজিন, তোমাকে ভাইয়া বলব না তো কী বলব?”
-“দেখ পড়ন্ত…”
-“হুম বলো ভাইয়া, শুনতেছি।”
অভ্র অসহায় চোখ করে তাকাল। তার ভীষণ ব্যর্থ আর অপদার্থ মনে হচ্ছে নিজেকে। একটি মেয়ে ঠিক কোন পর্যায়ে এসে নিজের ভালোবাসার মানুষকে ইগনোর করার চেষ্টা করে, তা কী বোঝাতে হয়?
-“ভাইয়া ভাইয়া করবি না তো। আমি তোর ভাই? বল… ভাই?”

পড়ন্তের বুক ফেটে কান্না বেরিয়ে আসতে চাইছে। সে নিজেকে যথেষ্ট শক্তভাবে সামলালো। এতটা শক্তি আর সাহস তার মধ্যে কোথা থেকে উদিত হলো, কে জানে!
-“এসব ফালতু আলাপ বাদ দিয়ে কী বলবা বলো। আমার কাজ আছে।”
-“ইগনোর করছিস?” অভ্রর কণ্ঠটা অভিমানী শোনায়।
-“ইগনোর? তোমাকে ইগনোর কেন করব আমি? যার প্রতি মানুষের অধিকার থাকে, তাকে ইগনোর করা যায়। তোমার প্রতি আমার কোনো অধিকারই নেই!”
-“এভাবে বলিস না… যেটা হইছে, পুরাটাই গণ্ডগোল। তুইও ভালো করে জানিস, তোকে ছাড়া কাউকে ভাবতেও পারি না আমি।”

-“তাহলে শিখে নাও। আর আমাকে ভাবা ভুলে যাও। তোমার জন্যেই মঙ্গল।”
-“তুইও আমাকে ভুল ভাবছিস?” বিষন্ন কণ্ঠ।
পড়ন্ত স্বাভাবিক স্বরেই উত্তর দিলো,
-“তুমি আমার এমন কে হও যে তোমাকে ভুল ভাববো! আমি?”
-“কেউ হই না, না?”
-“দেখো পুরোনো জিনিস মনে রাখার মতো মেয়ে আমি না। ইট কিন্তু নরম মাটি দিয়ে তৈরি হয়। অথচ সেটাকে পোড়ালে কতটা শক্ত আর কঠিন হয়ে উঠে, তুমিও জানো। আশা করি, আর ভেঙে বলতে হবে না।”
-“আমার জন্য তুই পুড়েছিস। আর এখন আমাকেও পোড়াচ্ছিস। শোন পড়ন্ত, আমি তোকে যে স্বপ্ন দেখিয়েছি, সেসব মিথ্যা না। এখনো কিচ্ছু হয়নি। আমি শায়লাকে ডিভোর্স দিবো। তারপর তোকে…” বাকি কথা শেষ হওয়ার আগেই পড়ন্ত হাতের ইশারায় অভ্রকে থামতে বলে নিজে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল,

-“এক মিনিট, এক মিনিট… বিয়েটা একটা খেলা তোমার কাছে। তাই না?”
-“তুই কী চাইছিস আমাকে বল তো! তোকে ভুলে শায়লাকে নিয়ে সুখের সংসার করি?” অভ্র অধৈর্য্য হয়ে উঠল।
-“আজ নাহয় কাল, শায়লা তোমাকে জিতে নিবে। আমি জানি.. আমাকে বোঝাতে এসো না। আমি অনুভূতি মাটি চাপা দিয়েছি। সেই মাটি খুঁড়তে এসো না প্লিজ.. আমার সামনে না এলেই বরং ভালো। আমি হোস্টেলে সিট পেলেই চলে যাব। ততদিন তুমি আর তোমার শায়লা আমার থেকে দূরে দূরে থাকো। আমার মেজাজ যদি একবার খারাপ হয়, তামাম দুনিয়া ফাতা ফাতা করে ফেলব। শান্ত আছি, শান্ত থাকতে দাও।”

পড়ন্ত চলে যেতে নিলে অভ্র হাত ধরে ফেলল। অগ্নি চোখে তাকাল পড়ন্ত। দৃষ্টি দিয়ে যেন বলছে, ‘হাত ছাড়ো।’ অভ্র ছাড়লো না, আরও শক্ত করে চেপে ধরল। একজন ভালোবাসা পেতে চাইছে নতুন করে, আরেকজন ভালোবাসা ভুলতে চাইছে সম্পূর্ণ রূপে… কী হবে এই দুইজনের ভবিষ্যৎ?
-“হাতটা ছাড়ো।” শান্ত কিন্তু দৃঢ় কণ্ঠে বলে উঠতেই অভ্র আরেকটু এগিয়ে এসে গোয়ারের ন্যায় বলল,
-“ছাড়ব না।”
-“আমার মেজাজ অত্যধিক গরম হচ্ছে। রাতে একজন আর দিনে আরেকজন নিয়ে থাকার শখ হইছে নাকি?”
-“তুমি এসব কী বলছো পড়ন্ত!! আমি শায়লাকে… ছিঃ!”
পড়ন্ত হাসল অল্প একটু।
-“হাত ছাড়ো, যেতে দাও।”
-“ছাড়ব না, বললাম তো।” অভ্রও এবার দৃঢ় কণ্ঠে বলল।
-ছাড়বে না?”

-“না।” কথাটি মাটিতে পড়ার আগেই গালে তীব্র থাপ্পড়ের অনুভবে চকিতে পড়ন্তের দিকে তাকাল অভ্র। লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে তার।পড়ন্ত তাকে চড় মারল! এমনটা কী কোনোদিনও কল্পনাতেও ভেবেছিল অভ্র?
পড়ন্ত হিসহিসিয়ে বলল,
-“আমি যেটুকু আঘাত পেয়েছি, তার তুলনায় এটা খুবই কম। নিজের স্ত্রীর হাত ধরে টানাটানি করো গে যাও… ভুলেও আমাকে আগুনে ডোবাতে আসবে না। ইটস এ ওয়ার্নিং।” বলে পড়ন্ত চলে গেল। অভ্র গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল বোকার মতো। সে এসেছিল কী করতে,আর হলো কী! এখন তো নিজেরই অভিমান জমছে পড়ন্তের উপর। তবে কী এখানেই তাদের সম্পর্কের সমাপ্তি?

দুটো মাইক্রো ভাড়া করা হয়েছে। সবাই মাইক্রোর সামনে জড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পড়ন্ত এক কোণায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার গায়ে সাদা রঙের থ্রিপিস, তাকে দেখতে স্নিগ্ধ লাগছে। অভ্র একনজর তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিল। এখনো পড়ন্তের দেওয়া থাপ্পড়ের দৃশ্যটা চোখের সামনে ভাসছে। অভিমানী হচ্ছে মন। অথচ দীর্ঘ বছরের ভালোবাসার স্বপ্ন গুলো এক নিমিষে ভেঙে দেওয়ায় পড়ন্ত কতটা অভিমানী হয়ে উঠেছে, তা কী আদৌও বুঝতে পারবে অভ্র?
পড়ন্তের পাশে এসে শায়লা দাঁড়াল। পড়ন্ত ফিরেও তাকাল না। শায়লা নতুন বউয়ের মতো করে সেজেছে। বিয়ের পর থেকে কেউ তাকে শায়লা বলে ডাকছে না। সবাই ‘অভ্রের বউ, অভ্রের বউ’ বলে বলে মুখে ফেনা তুলছে। বিষয়টা একজন প্রেমিকার কাছে কতটা যন্ত্রণার তা বোঝার ক্ষমতা বোধকরি ভুক্তভোগী ছাড়া আর কারও নেই!
শায়লা গা ঘেঁষে দাঁড়াল এবার৷ ফিসফিস করে ডাকল,

অন্তর্দহন পর্ব ২

-“এই পড়ু..”
পড়ন্ত চোখা চাউনিতে তাকাল। সাড়া প্রদান করল না। তার মেজাজ এখন অল্পতেই গরম হয়ে যায়৷ সবকিছু কেমন অসহ্য আর বিস্বাদ লাগে। ছ্যাঁকা খেলে মানুষ বোধহয় কাঠখোট্টা হয়ে উঠে!
-“আমরা যে গাড়িটায় যাবো, ওটাতেই তোর জন্য সিট রেখেছে চাচ্চু। তুই ওটাতে না গিয়ে অন্যটায় যাস কেমন? দেখ, অভ্র আমার স্বামী। তোদের একত্রে কাছাকাছি থাকা আর ঠিক না৷ যত থাকবি, ততই কষ্ট পাবি। শিয়ালের সামনে মুরগী রাখলে শিয়ালের স্বভাব তো খারাপ হবেই, কী তাই না?”

গা জ্বলে উঠল পড়ন্তের। শায়লার দিকে ফিরে তাকিয়ে জোরপূর্বক হাসি ছুঁড়ে দিল। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
-“ভালোবাসার দখল ছেড়ে দিতে পারছি, আর সামান্য একটা সিটের দখল ছেড়ে দিতে পারব না?”
শায়লা চুপসে গেল। মাথা ঝাকিয়ে অন্যত্র চলে গেল। পড়ন্তর বুক চিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। বাতাসে কেউ বিষ মিশিয়ে দিয়েছে বোধকরি…

অন্তর্দহন পর্ব ৪