অন্তর্দহন পর্ব ৪ || লেখনীতে- অলিন্দ্রিয়া রুহি

অন্তর্দহন পর্ব ৪
লেখনীতে- অলিন্দ্রিয়া রুহি

এক গাদা বমি করে, আবারও জ্বরে পুড়ে, দুর্বল শরীর নিয়ে মাগরিবের আগে আগে গ্রামের বাড়ি পৌঁছায় পড়ন্ত। তাকে দেখে মনে হচ্ছে, সে দাঁড়াতেও পারবে না। নাসরিনের কানের কাছে ফিসফিস করে মিথুন উদ্দিন বললেন,
-“তোমার মেয়ের হইছে টা কী? হঠাৎ করে এরকম দুর্বল হয়ে পড়ল কেন? মেয়ের দিকে খোঁজখবর রাখো নাসরিন?”
নাসরিন বিস্ময় প্রকাশ করল স্বামীর কথায়। মিথুনের এই কথায় একটা অন্যরকম সুরের আভাস পাওয়া গেল। তিনি কোনো জবাব প্রদান করলেন না। কাঠ হয়ে বসে রইলেন।

গ্রামের বাড়িটিতে মূলত কেউই থাকে না। সবাই শহরে থাকায় গ্রামের বাড়ি তালা দিয়ে রাখা হয়। সেই চাবি আকলিমা নামের একজন দুসম্পর্কের আত্নীয়ের কাছে থাকে। তিনি তিনটি বাড়ির পরে থাকেন। মাঝে মাঝে তালা খুলে পুরো বাড়ি গোছগাছ করে রাখাই তার দায়িত্ব। বিনিময়ে মাস শেষে তাকে কিছু অর্থ দেওয়া হয়। খোকন উদ্দিন আসার আগেই আকলিমাকে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে তারা যাচ্ছে। তাই সকাল সকাল আকলিমা আর তার মেয়ে উল্লাসী মিলে পুরো বাড়ি নতুন ভাবে সাজিয়েছে। পরিষ্কার করেছে। রাতের জন্য রান্নাও করে রেখেছে। পড়ন্তদের গাড়ি গিয়ে উঠোনে থামতেই আকলিমা বেরিয়ে এলেন। উল্লাসী এলো না। সে এবার সবেমাত্র ক্লাস টেনে উঠেছে। ক’দিন বাদেই পরীক্ষা। সে তাদের বাসায় চলে গিয়েছে। পড়ছে।

পাপন আঁতিপাঁতি করে পুরো বাসা খুঁজেও উল্লাসীকে না পেয়ে বুঝল, সে তাদের বাসায় রয়েছে। কিন্তু এখন তো যাওয়া সম্ভব না। আগে ফ্রেশ হোক, সবাই একটু থিতু হোক, তারপর না-হয় যাওয়া যাবে। পাপন ঠোঁট গোল করে শিষ দিতে দিতে নিজের জন্য বরাদ্দকৃত রুমের দিকে এগোয়। এর আগে যতবার এসেছে, ততবারই অভ্র আর পাপন এক রুম শেয়ার করে থেকেছে। আর পড়ন্ত, শায়লা, নিতু একরুমে থেকেছে। এখন অবশ্য পাপন একাই এক রুমে থাকতে পারবে। অভ্র আর শায়লার জন্য সুন্দর একটি রুম সাজানো হয়েছে। পড়ন্ত আর নিতু শেয়ার করবে একরুম…
পড়ন্তকে ধরে দাঁড়িয়ে আছেন নাসরিন। গম্ভীর গলায় বারবার বলছেন,
-“আর একটু হাঁট… এই তো চলে আসছি।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

পড়ন্ত হাঁটতে চাইছে না। ওর শরীর পুরোপুরিভাবে জোর ছেড়ে দিয়েছে। অভ্রর পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় পড়ন্ত একবারও অভ্রর দিকে তাকাল না, কিন্তু অভ্র ঠিকই তাকিয়ে রইল। সে জানে, এই শারীরিক অসুস্থতার উৎপত্তি মনের থেকে… মানসিক ভাবে মানুষ ভেঙে পড়লে শারীরিক ভাবেও ভেঙে পড়বে। তবুও কেন অভ্রর কথা শুনতে চাইছে না এই মেয়ে? অভ্র স্পষ্ট দেখছে, তাকে ছেড়ে পড়ন্ত থাকতে পারবে না। পারছেও না… দু’দিনে এই অবস্থা! আর ক’দিন গেলে ওর লাশটাও তো খুঁজে পাওয়া যাবে না! অভ্র শিউরে উঠে। এসব কী ভাবছে সে! নিজেই নিজেকে প্রমোদ দিলো। না, না, পড়ন্ত আর যাই করুক, নিজেকে শেষ করার মতোন মেয়ে নয়…
নিতু এগিয়ে গেল। নাসরিনকে উদ্দেশ্য করে বলল,

-“আমি আপাকে ঘরে নিয়ে যাচ্ছি। আপনি ওদিকে যান চাচী। চাচা খুঁজছে।”
নিতুর হাতে পড়ন্তকে দিয়ে নাসরিন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। নিতু পড়ন্তকে ধীরস্থির ভাবে নিজেদের ঘরে নিয়ে গেল। বিছানায় শুইয়ে দিল। তারপর নিজেও পাশে বসল। পড়ন্তর শরীর অত্যধিক গরম, জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। তার চোখজোড়া যেন সচ্ছ দীঘির পানিতে টইটম্বুর। পড়ন্তর হাতজোড়া নিতু আঁকড়ে ধরে বলল,

-“আপা.. আমার থেকে কিচ্ছু লুকোবে না বলে দিলাম। তোমার কী হইছে, বলো তো..”
পড়ন্ত জবাব দিল না। ফ্যালফ্যাল করে শূন্য দৃষ্টি নিয়ে ক্ষণকাল নিতুর মুখপানে তাকিয়ে থেকে চোখ সরিয়ে নিল। ক্ষীণ কণ্ঠস্বরে বলে উঠল,
-“এখান থেকে যা নিতু… একা থাকতে দে।”
-“না আপা… তুমি আমাকে যতক্ষণ না বলবে তোমার কী হইছে, আমি যাব না। অবশ্য আমি কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পারছি।”

-“কী আন্দাজ করছিস?” পড়ন্তের এবার একটু ভয় হলো। সে চায় না অভ্র আর তার বিষয়টা কেউ জানুক, অন্তত পরিবারের কেউ। একে তো অভ্র তারই কাজিন, উপরন্তু এখন বিবাহিত। বিবাহিত জেনেও অভ্রর জন্য কষ্ট পেয়ে ভেঙে পড়াটা পড়ন্তের কাছে ভীষণ লজ্জার ব্যাপার। কিন্তু কী করবে সে? এই মুহূর্তে শক্ত থাকে তো ওই মুহূর্তে ভেঙে পড়ে। নিজেই নিজের অন্তর্দ্বন্দ্বে অস্থির হয়ে উঠেছে। একটা স্থির সিদ্ধান্তে কিছুতেই আসতে পারছে না। কী করলে তার জীবন সুন্দর হবে, অভ্রর নাম ভুলতে পারবে, আবার হাসিমুখে থাকতে পারবে- তা কিছুতেই মাথায় আসে না।
নিতুকে চুপ থেকে মৃদু হাসিতে মত্ত হয়ে উঠতে দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেলল পড়ন্ত৷ দুর্বল হাত দিয়ে হালকা ধাক্কা দিয়ে বলে উঠল,

-“কী হলো? হাসিস কেন? বল.. কী আন্দাজ করছিস তুই?”
-“বলব? তুমিই কিন্তু লজ্জা পাবে!” নিতুর ঠোঁট জুড়ে মুচকি হাসি।
ফাকা ঢোক গিলে পড়ন্ত সম্মতি দিল,
-“বল।”
-“তুমি অন্তর্দহনে পুড়ছো আপা… অভ্র ভাইয়ার বিয়েটা কিছুতেই মেনে নিতে পারোনি। কারণ, তুমি অভ্র ভাইয়াকে ভালোবাসো। আর সেও তোমাকে ভালোবাসে।”

এক দমে কথাগুলি বলে পড়ন্তের চোখে চোখ রাখতেই পড়ন্ত বিস্ময়ে ‘হা’ মুখ করে ফেলল। এই গোপন খবর তো কেউ জানে না শায়লা ছাড়া! তবে কী শায়লার থেকেই নিতু জেনেছে? এর মানে শায়লা বাসার সবাইকে বলে দিয়েছে নিশ্চয়ই?!
রাগে, অনাকাঙ্ক্ষিত অপমানে আর লজ্জায় পড়ন্তের চোখে পানি জমে উঠল। নিতু ব্যতিব্যস্ত কণ্ঠে বলল,
-“না, না, আমি কাউকে বলব না আপা। তুমি কেঁদো না প্লিজ!”
-“তুই কার থেকে জেনেছিস?” কান্না চাপিয়ে মৃদু ধমকের স্বরে বলল পড়ন্ত। প্রত্যুত্তরে নিতু মুচকি হেসে বিজ্ঞের ন্যায় বলল,

-“কারো থেকেই জানি নাই। নিজে নিজেই বুঝছি। তুমি সবার থেকে লুকাতে পারলেও আমার থেকে লুকাতে পারো নাই আপা। মনে আছে? একদিন সবাই বড় ফুপিদের বাসায় গেছিলো। তুমি, আমি, আর অভ্র ভাইয়া বাসায় রয়ে গেছিলাম? তোমরা দু’জনে সেদিন সারা বিকেল ছাদে গল্প করে কাটাইছিলা। আমি ছাদে উঠেও উঠি নাই। কারণ, তোমাদের চোখে তখন অন্যরকম আনন্দ দেখছিলাম। যেই আনন্দের ভাগ হয় না কোনো। তাই আমি হস্তক্ষেপ করি নাই৷ সেদিনই বুঝছিলাম, তোমাদের সম্পর্কটা অন্যদিকে গড়িয়েছে.. আর তারপর যেদিন অভ্র ভাইয়ার বিয়েটা হলো, সেদিন থেকেই মুষড়ে পড়েছো। দুইয়ে দুইয়ে চার মেলাতে খুব বেশি কষ্ট হয় নাই আমার আপা। কিন্তু কষ্ট হচ্ছে তোমার জন্য।”
পড়ন্ত চুপ করে নির্বিকার ভাবে শুনছিল। নিতু জবাবের আশায় চুপ করলেও সে কিছু বলল না। শুধু ঘুরে ওপর দিকে শুয়ে পড়ল। চোখের কোল ঘেঁষে এক বিন্দু পানি গড়িয়ে গড়িয়ে গাল অবধি গিয়ে ঠেকল। নিতু সশব্দে মৃদু শ্বাস ফেলে নিচু কণ্ঠে বলল,

-“আমি কাউকে বলব না আপা। তোমার কষ্ট গুলো সহ্য হয় না আমার… যদি পারতাম, কিছু একটা করতাম।”
নিতু উঠে দাঁড়াল। পড়ন্ত ঠিক তখনি ডেকে উঠল,
-“নিতু..”
-“হুঁ।”
-“তুই যেই তথ্য জানিস, তা মিথ্যে- এমনটা আমি বলব না। তবে হ্যাঁ, খুব যে সত্যি… তাও না। আমি নিজেকে সামলাতে শিখে গেছি। আমার আর অত কষ্ট হচ্ছে না বিশ্বাস কর। শুধু বুকটা ভার হয়ে থাকে। অভ্রর পাশে যখন শায়লা আপুকে দেখি.. তখন.. তখন আমার বুকে চিলিক মেরে উঠে। এটাও কমে যাবে দেখিস। আমি নিজেকে সামলাতে পারবো একদিন পুরোপুরি।”

-“অবশ্যই পারবে। পারতে তোমাকে হবেই… তুমি জানো, শায়লা আপু আমার আপনা বোন হলেও, তোমাকে তার চাইতেও বেশি ভালোবাসি। কারণ, আমি যখন ছোটো ছিলাম, তুমি আমাকে কাঁটা বেছে মাছ খাইয়ে দিতে। শায়লা আপু কোনোদিন ছুঁয়েও দেখেনি!” ঢুকরে উঠল নিতু। পড়ন্ত উঠে বসে নিতুকে একহাতে জড়িয়ে ধরল।
-“ওসব বাদ দে। কাউকে বলিস না বোন.. পায়ে পড়ি…”
-“ছি আপা! তুমি না বললেও বলতাম না৷ এটা তোমার ব্যক্তিগত গোপন অধ্যায়। যদি সবাইকে জানাতেই চাইতে তবে তো বিয়ের দিনই বলে দিতে, তাই না?”
-“অভ্রই তো এগোয়নি.. ও কী পারতো না বিয়েটা ভেঙে দিতে যেকোনো মূল্যে? ও তো ছেলে! কিন্তু না.. বিয়ে টিয়ে করে এখন আসছে আমার সাথে নাটক করতে।” পড়ন্তর কণ্ঠ দিয়ে রাগ ঝরে পড়ে।
নিতু বলল,

-“কেন, তোমাকে কী বলে আপা?”
-“বলে, শায়লা আপুকে ডিভোর্স দিয়ে আমাকে…” থেমে যায় পড়ন্ত। শত হোক নিতু শায়লার বোন৷ তাকে অনায়াসে সব বলা কী ঠিক হবে?কিছুটা অবিশ্বাসী চোখে নিতুর দিকে তাকালে নিতু আশ্বস্ত ভরা হাসি ছুঁড়ে দেয়।
-“বাদ দাও। আমি জানতে চাই না। ওসব তোমাদের পার্সোনাল ব্যাপার। আর আপা যেটা করেছে, তার জন্য যে শাস্তি পাবে দেইখো। তবে তুমি যাই করো না কেন, সবদিক বিবেচনা করে তবে আগাইয়ো। ভালোবাসাকে প্রায়োরিটি দিতে গিয়ে এমন কিছু করে বসো না, যাতে আমাদের পরিবারের মানুষ গুলা কষ্ট পায় আপা।”
পড়ন্ত কিছু বলল না। নিতু উঠে দাঁড়াল।

-“তুমি শুয়ে থাকো। আমি একটু ফ্রেশ হয়ে আসি।”
-“আচ্ছা।”
পড়ন্তর গায়ের উপর কাঁথা টেনে দিয়ে নিতু চলে গেল। দু’হাত ভাঁজ করে তার উপর মাথা রেখে চুপচাপ শুয়ে রইলো পড়ন্ত৷ তার অবচেতন মন ভাবছে, সামনে আর কী কী পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে….

অভ্র রুমে ঢুকেই হকচকিয়ে গেল। লাল গোলাপের মিষ্টি গন্ধে মাথা ধরে যাওয়ার অবস্থা। এত সুন্দর করে রুমটা সাজালো কে? আর কেনই বা সাজালো? অভ্র বাইরে বেরিয়ে সোজা মায়ের খোঁজ করল।
অভ্রর মা বারান্দা দিয়েই হেঁটে আসছিলেন, মাঝপথে ছেলের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। অভ্রকে রীতিমতো রাগে কাঁপতে দেখে সে খানিকটা অবাকই হলো।
-“কী হইছে আব্বু? তুমি রাইগা আছো কেন?”
-“আম্মু, এসব কী?”
-“কোন সব?”
-“আমার ঘর সাজাইছে কে?”
-“আকলিমা লোক দিয়া সাজাইয়া রাখছে। তোমার আব্বাই আদেশ দিয়া দিছিলো। তোমার দাম্পত্য জীবন এখান থেকেই শুরু হোক, এই জন্যে…”

অভ্র সেকেন্ড দুই চুপ করে থেকে গম্ভীর মুখে বলল,
-“আমি এই বিয়েটা মানি না আম্মু। শায়লার সঙ্গে এক ছাদের তলায় বসবাস করা সম্ভব না আমার পক্ষে।”
ভদ্রমহিলা চোখ কপালে তুলে অবাক হয়ে গেলেন।
-“কী বলতেছো এসব! বিয়ের আগে তো তুমি কিছু বলো নাই। এখন বিয়ে করার পর এসব বললে তো হবে না বাবা.. বিয়েটা কোনো খেলা না।”

-“আমি বলছিলাম আব্বুকে। উনি আমার কথা শোনে নাই। আমাকে জোর করেই বিয়েটা দেওয়া হইছে। উনি পরের মেয়ের সুখ দেখতে গিয়ে নিজের ছেলেকে দুঃখের সাগরে ছুঁড়ে ফেলছে আম্মু। আমি.. আমি সহ্য করতে পারছি না এসব। আমার জীবন টা তছনছ হয়ে গেল আম্মু।” অভ্রর গলা ভারী শোনালো। পারভীন বিস্ময়ের উপর বিস্মিত হলেন। ছেলে তার কাঁদছে! তিনি কিছু বলতে নেওয়ার আগেই অভ্র ফের বলে উঠল,

-“আব্বু নিজের সিদ্ধান্ত আমার উপর চাপিয়ে দিয়ে হাসিমুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অথচ আমি প্রতি মুহূর্তে শ্বাসটাও নিতে পারছি না। আমার ভেতরে যে দহন হচ্ছে,তা তোমাদের কাউকে আমি বোঝাতে পারব না আম্মু।”
বলে ঘুরে ঘরের দিকে হাঁটা দিল অভ্র। পারভীন ডাকতে গিয়েও ডাকলেন না। তার মাথায় কিছুই ঢুকছে না। অভ্র কীসব বলে গেল.. আবার কাঁদছেও ছেলেটা। একটা পুরুষ মানুষ কোন পর্যায়ে গেলে কাঁদতে পারে তা বোঝার ক্ষমতা তার আছে। তিনি বিচলিত বোধ করলেন। স্বামীর সাথে এসব নিয়ে কথা বলার অর্থ, তার মেজাজ চড়িয়ে দিয়ে নিজেও গালি খাওয়া, অভ্রকেও বকা খাওয়ানো। কিন্তু তিনি একাই বা কী করবেন? অকূল দরিয়ায় পড়লে মানুষ যেমন শুধু হাবুডুবু খেতে থাকে, কোনোদিকে কোনো দিকদিশা পায় না, পারভীনের অবস্থাও ঠিক সেরকম এখন।

-“কাকী… ঘরে আছো?” পাপন হাঁক ছেড়ে ডেকে উঠল। আকলিমা শীতল পাটি বুনছিলেন। পাপনের গলা পেয়ে চোখমুখ কুঁচকে গেল তার। উল্লাসী একমনে পড়ছিল। বাবা নেই তার। মা অনেক কষ্ট করে মেয়েকে পড়াচ্ছেন, একদিন অনেক বড় হয়ে তার দুঃখ কমাবে এই আশায়.. উল্লাসীও সেই পথেই হাঁটছে। আর কোনো ভাইবোন নেই তার। মায়ের সব স্বপ্ন পূরনের দায়িত্ব যে তারই কাঁধের উপর। কিন্তু পাপনের গলা পেয়ে তার পড়ার গতি শ্লথ হলো। পাপনরা এসেছে শোনার পর থেকেই মনটা খুব ছটফট করছিল তার। এতক্ষণ তাও জোর জার করে এঁটে রেখেছিল অন্তরের দুয়ার,সেটা এখন হাঁট করে খুলে গেল প্রিয়তমের কণ্ঠস্বরে…

আকলিমা উল্লাসীর উদাসীনতা খেয়াল করে মৃদু আওয়াজে ধমক লাগালেন,
-“ওই ছেমরি.. পড়তাছোস না কেন? একদম বাইরে বাইর হবি না। আর একটা আওয়াজও যেন না হুনি। বড় লোক ঘরের পোলা দেইখা নিজের মাইয়ারে তার পিছে লেলাই দেওনোর মতোন মা আমি না।” বলে তিনি বেরিয়ে গেলে উল্লাসীর মনের প্রদীপ ধপ করে নিভে গেল। তার আর পাপনের মাঝে কোনো সম্পর্ক নেই, আবার আছেও… কেউ কাউকে পছন্দের কথা বলেনি, অথচ দু’জনেই জানে তারা একে অপরকে কতটুকু পছন্দ করে, চায়…

ঢাকায় থাকাকালীনও মায়ের মোবাইল দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে মাঝে মাঝে পাপনের সাথে কথা হয় উল্লাসীর। পাপন তখন শুধু স্বপ্ন দেখায়। কখনো বা জ্যোৎস্না বিলাসের স্বপ্ন, কখনো বা রাতের আঁধারে নৌকায় ভ্রমণ, কখনো আবার বৃষ্টির দিনে ঝাল খিচুড়ি খেয়ে দু’জনের খুনসুটির স্বপ্ন, কখনো বা রাত জেগে মুভি দেখার স্বপ্ন… এসব একটাও বাস্তবে পূর্ণ হবে কী-না, উল্লাসী জানে না। তবুও সে মনেপ্রাণে চায়,তার বিয়েটা কোনো এক যাদুবলে পাপনের সাথেই হোক। পাপনই হোক তার জীবন সঙ্গী আর সে হোক পাপনের অর্ধাঙ্গিনী…
বাইরে বেরিয়ে পাপনের হাস্যজ্বল মুখ দেখে কপালের রেখা মসৃণ করেন আকলিমা। বলেন,

-“কীরে বাবা… এত রাইতে!”
-“এইদিকে একটু হাঁটতে আসছিলাম কাকী। ভাবলাম দেখা করে যাই তোমার মেয়ের সাথে। তা তোমার মেয়ের তো রূপ বেড়ে গেছে মনে হয়। একবারও দেখা দিল না।” মজার ছলে কথাগুলো বলল পাপন, পাছে আকলিমা কিছু টের পেয়ে যায় এই ভয়ে।
আকলিমা মনে মনে চৌকস হাসি হাসলেন। তাকে গাধা মনে করে এই ছেলে, ভাবে সে কিছুই বোঝে না!
-“উল্লাসী তো বাড়িত নাই বাজার। ওর এক বান্ধবীর বাড়িত গেছে। পড়ালেহা লইয়া কী বলে কাম আছে.. এক লগে করব। আইজ রাইত ওইনেই থাকব।”

মুহুর্তেই মুখ থেকে হাসি মুছে যায় পাপনের। সে এসেছে জানার পরেও উল্লাসী কী করে পারল চলে যেতে! মোটে দু’দিন থাকবে তারা গ্রামে! এই সময়টা কই তার আশেপাশে থাকার চেষ্টা করবে, তা না… বুক চিঁড়ে বেরিয়ে এলো একটি ভারী দীর্ঘশ্বাস। জোরপূর্বক হাসি মুখে এঁটে পাপন বলল,
-“ওহ, আচ্ছা, তাইলে আর কী! যাই কাকী। শুভ রাত্রি..”

পাপন বাড়ির পথে হাঁটা ধরে বিষন্ন মনে। আকলিমা অল্প অল্প হাসেন। পাপনের জায়গায় যদি অভ্র তার মেয়ের পিছনে ঘুরঘুর করত, তবে তিনি ঠিকই লেলিয়ে দিতেন। অথচ এই ছেলে তার পিছনে লেগেছে.. বয়সই বা কত? উল্লাসীর চেয়ে বছর তিনেকের বড় হবে! এর কাছে কী দেখে মেয়েকে দিবেন তিনি? তার উপর চেহারাও তো ভালো না… উল্লাসীর জন্য কত ভালো ভালো প্রস্তাব আসে! উল্লাসীটা আসলেই রূপসী… নইলে তার কিছু নাই জেনেও ব্যাটাছেলেরা কী দেখে তার মেয়েকে বিয়ে করতে চায়? আকলিমা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়েন। কলেজটা পার করলেই উল্লাসীকে ভালো জায়গায় বিয়ে দিবেন তিনি… পাপনের চাইতেও সুন্দর ছেলে দেখে… তখন পাপন খালি হা-হুতাশ করবে। করলে করুক, তার কী?

অন্তরীক্ষে কাঁসার থালার মতো গোল শশধর। আলোয় চারিদিকে বন্যা হয়ে যাচ্ছে। আঁধারের মাঝেও সবকিছু স্পষ্ট, সুন্দর! পড়ন্তর ঘুম আসছে না। নিতু বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। পড়ন্ত মৃদু পায়ে গুটিগুটি করে হেঁটে লম্বা বারান্দায় এসে দাঁড়াল। এই বাড়িটি দোতলা। নিচ তলায় অভ্র আর শায়লার জন্য রুম সাজানো হয়েছে বোধহয়, পড়ন্ত সঠিক জানে না। জানতেও চায় না। প্রকৃতির নিখাঁদ সৌন্দর্য দেখতে যেয়ে চোখের কোণায় জল আবিষ্কার করল সে। কথা ছিল এরকম একটি রাতে দু’জনে হাত ধরাধরি করে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থেকে গল্পের আসর জমাবে, আর চাঁদের আলো গায়ে মাখাবে। কথা তো কতই ছিল! কোনটাই বা পূর্ণ হলো?

বিশেষ আদর গুলোর সময় যার কথা চিন্তা করত পড়ন্ত, যার একটুখানি স্পর্শে কেঁপে কেঁপে উঠতো, যাকে এক ঝলক দেখার জন্য চোখজোড়া ব্যাকুল হয়ে থাকত সবসময়, সেই মানুষটির বিশেষ আদর গুলো আজ অন্য একজনের জন্য বরাদ্দ হয়ে গেল! তাকে দেখাও পড়ন্তর জন্য মহাপাপ.. হাহ! এসব কথা মনকে বোঝাবে কে? এই যে অভ্রকে দেখলেই মস্তিষ্কে ভেসে উঠে একটিই দৃশ্য, আর সেটি হলো, অভ্র শায়লা একই বিছানায়, পরস্পর পরস্পরের মাঝে নতুন মুগ্ধতা খুঁজতে ব্যস্ত, অভ্রর বুকের উপর শায়লার মাথা.. কী পরম নিশ্চিন্তে সে ঘুমোচ্ছে… এই দৃশ্য গুলি গায়ে আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছে তো। আফসোস, পোড়া শরীর দেখলে মানুষ স্বান্তনার দেয়, হা-হুতাশ করে,পোড়া মনের পোড়া গন্ধ কয়জন টের পায়? পড়ন্ত রেলিং খামচে ধরল। বুকটা হাপড়ের মতো ওঠানামা করছে। চোখ ভেসে যাচ্ছে নোনাজলের বারিপাতে। অবচেতন মন কাঁদে, চিৎকার করে, চেঁচিয়ে ডাকে, “অভ্র!”

-“পড়ন্ত…”
পড়ন্ত চমকে পেছন ঘুরে তাকাল। সত্যি সত্যি অভ্র তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে! এটা কী স্বপ্ন? নাকি বাস্তব? বাস্তব কেন হতে যাবে? অভ্রর তো এখন শায়লার মধ্যে ডুবে থাকার কথা। সে কেন এখানে আসবে? এটা স্বপ্নই..
-“বাস্তব যখন ভিন্ন, তখন স্বপ্নে এসে ধরা দাও কেন তুমি? জানো, আমার না সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেছে। আমি খেতে পারি না, ঘুমোতে পারি না, নিঃশ্বাস টাও ছলনা করে.. মাঝে মাঝে এত শ্বাস কষ্ট হয়! হুহ… আচ্ছা অভ্র, আমি না হয় একটু শ্যামলাই, শায়লা আপুর মতো অত ইংলিশ বলতে পারি না, কিন্তু আমার মনের গোপন কুঠুরিতে যেটুকু ভালোবাসা তোমার জন্য জমিয়েছিলাম,তার একাংশও তুমি শায়লা আপুর থেকে পাবে কী-না সন্দেহ! তবুও দেখো… রঙের জয় হলো, আমি কালো তাই আমার হাহাকার শায়লা আপুর ফর্সা বর্ণের নিচে চাপা পড়ে গেল। সবাই শায়লা আপুর দিকটাই দেখল, আমার দিকটা কেউ দেখল না!

এমনকি তুমিও না… তুমি তো চাইলে পারতে কোনো না কোনো উপায়ে সব ভেঙে দিতে। না হয় ক’টা দিন বাসা ছেড়ে দূরে চলে যেতে। নইলে আমরাই পালিয়ে যেতাম। অথবা কাউকে অন্তত বলতে যে তুমি আমাকে চাও! আমার সাথে অনেক স্বপ্ন বোনা আছে তোমার… বলোনি, কিছু করোওনি… আমার জন্য বাতাসে বিষ ঢেলে দিয়ে তুমি উচ্চারণ করেছ, ‘কবুল’, আমি কেঁদেকেটে বুক ভাসিয়েছি, তুমি কব্জি ডুবিয়ে বিয়ের বিরিয়ানি খেয়েছ! অদ্ভুত জানো, তোমার প্রতি যতটা না ঘৃণা আর রাগ আসে, তার চাইতেও বেশি রাগ হয় নিজের উপর। এক মুহূর্ত ভেবেছিলাম, মরে যাব। অথচ তুমি আজ এক বিছানায় শায়লা আপুর সঙ্গে ঘুমাও! হাসা উচিত আমার নিজের প্রতি… কী বোকাই না আমি!

কেউ দুটো ভালো কথা বলল, ওমনি তাকে ভালোবেসে ফেললাম! কেউ কিছু স্বপ্ন দেখালো, আমিও তাতে বিভোর হয়ে রইলাম! কেউ আজ মন ভাঙলো, আমি নিজেকেই শেষ করে দেওয়ার কথা চিন্তা করলাম! ইশ… বড্ড বোকা আমি… বড্ড বোকা!”
মৃদুমন্দ বাতাস বইছে। পড়ন্তর চুলগুলো এলোমেলো খোঁপা করা। কিছু চুল সামনে দিয়ে বেরিয়ে এসে মুখের উপর উড়ছে। চোখ দুটো ফুলে ঢোল, নাকের উপরটা লাল বর্ণ ধারণ করেছে। গাল জোড়া ভিজতে ভিজতে একশেষ, রক্তজবার ন্যায় ঠোঁট জুড়ে মৃদু মৃদু কাঁপন… অভ্রর বুকটা খচখচ করতে লাগল। তাকে স্বপ্ন ভেবে নিজের ভেতরের সব কথা উগড়ে দিয়েছে পড়ন্ত।
পড়ন্ত চোখ মুছলো হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে। ঢোক গিলে কষ্ট টাকে হালকা করার চেষ্টা করল। একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে আবার অভ্রর দিকে তাকাল। অসহায়, ব্যর্থ, ভাঙা পাজরের মেয়েটি নির্বিকার অথচ ভেজা কণ্ঠে হঠাৎ অনুরোধ করে বলল,

অন্তর্দহন পর্ব ৩

-“চোখ বন্ধ করে আবার খুললে তোমায় আর দেখতে পাব না জানি। তুমি আমার বিভ্রম,আমার অবচেতন মনের প্রতিচ্ছবি। একটা বার.. একটা বার জড়িয়ে ধরবে? আর তো কোনোদিন সুযোগ পাব না!” কার্নিশ টপকে জল পড়তে শুরু করল আবারও। অভ্র তৎক্ষনাৎ এগিয়ে এসে ঝাপ্টে ধরল পড়ন্তকে। শক্ত করে… পড়ন্তও মিশে গেল তার বাহুডোরে…
অভ্রর পিঠ খামচে ধরে ফুঁপিয়ে উঠল আচমকাই। গোঙানি বেরিয়ে এলো মুখ ভেদ করে। এত ভালোবাসে যাকে, তাকে ভুলে জীবনে নতুন করে আগাতে পারবে কী পড়ন্ত? নতুন করে বাঁচতে শিখবে কী আদৌও?

চাঁদের আলোয় চারিদিক থৈ থৈ করছে। কিছু আলো এসে অভ্র,পড়ন্তকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। একজোড়া কপোত-কপোতীর ভাঙা মনের আর্তনাদের সাক্ষী হয়ে রইলো নির্লিপ্ত নয়নে তাকিয়ে থাকা অন্তরীক্ষের শশধর.. না, না, আরও একজন.. যে সিড়ির একদম মাথায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। অভ্র কে খুঁজতে এসে এমন কিছুর মুখোমুখি হতে হবে, শায়লা কল্পনাতেও ভাবেনি। তার পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে রাগে…

অন্তর্দহন পর্ব ৫