অন্তর্লীন প্রণয় পর্ব ১২

অন্তর্লীন প্রণয় পর্ব ১২
সাদিয়া মেহরুজ দোলা

আয়ন্তিকার ভীতিগ্রস্ত মুখশ্রী। ভয়ে সে রীতিমতো কাঁপা কাঁপি শুরু করে দিয়েছে। বাকরুদ্ধতা তাকে গ্রাস করেছে তীব্রভাবে যার ফলস্বরূপ সে অহর্নিশ কে কিছু বলতেও পারছে না। অল্প বয়সি হলেও অহর্নিশের বলা বর্তমান কথাটির মূল অর্থ সে বুঝে গিয়েছে। যার দরুণ তার এই অবস্থা।
অহর্নিশ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে আয়ন্তিকার দিকে। শেষে সে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারে না। হু হুা করে হেঁসে দেয়। হাস্যরত অবস্থাতেই উঠে বসে পড়ে অহর্নিশ। বুকে হাত দিয়ে লম্বা শ্বাস নিয়ে সে বলল,
-‘ তোমার মাইন্ড কতো খারাপ আয়ন্তিকা, ছিহ্! নটি গার্ল! ‘
আয়ন্তিকা বুঝতে পারলো না অহর্নিশের কথাটি। বেকুব চোখে সে তাকিয়ে রইল ড্যাবড্যাব করে। তা দেখে অহর্নিশ প্রসঙ্গ এড়িয়ে যেতে বলল,

-‘ লেট ইট বি! আই ওয়াস জোকিং।হায়ার ম্যাথ বই টা আনো। কাল এটার ওপর এক্সাম না? কিছু ম্যাথ করিয়ে দিচ্ছি। ‘
আয়ন্তিকা অকপটে জবাব দিলো,
-‘ দরকার নেই। আমি একাই করতে পারবো। ‘
-‘ জিজ্ঞেস করিনি তোমায় আয়ন্তিকা। এটা আমার আদেশ। আর তুমি আমার আদেশ পালন করতে বাধ্য। যাও জলদি বই আনো। ‘
অগত্য আয়ন্তিকা গাল ফুলিয়ে বই নিয়ে এসে বসে পড়ে বিছানাতে। অহর্নিশের পাশে। হাতের তোয়ালে পাশে রেখে দেয়। চুল দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে, তবে মুছতে ইচ্ছে হচ্ছে না আপাতত। সে মনোযোগী হয় বইয়ের পাতা উল্টাতে। আয়ন্তিকার হয়ত জানা নেই তার দিকে এক ঘোরলাগা গভীর পূর্ণ দৃষ্টি আবদ্ধ হয়ে আছে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

অহর্নিশ শুকনো ঢোক গিলে। দৃষ্টি চারপাশে দেয়। কেনো যেনো তার মনে হচ্ছে আয়ন্তিকার পাশে থাকার জন্য ওকে পড়াতে এসে বেশ মুশকিলে পড়েছে। কারণ এই যে আয়ন্তিকা কে ভয়ংকর সুন্দরী লাগছে। এখন তাকে ছুঁয়ে দেয়ার লোভ অহর্নিশ সামাল দিবে কি করে? কি করে? হাউ?কথা গুলো আওড়ানোর সময় কর্ণগোচর হয় আয়ন্তির নিচুস্তর কন্ঠ। ও মাত্রই বলল,

-‘ নিন এইযে বের করেছি। এই চাপ্টার গুলোই আছে। ‘
-‘ বই দাও আমার কাছে। ‘
নিজেকে সংযত করে অহর্নিশ বইয়ের মাঝে ডুব দেয়। কিছুক্ষণ চোখ বুলিয়ে নিয়ে সে ত্রিকোণমিতি এর অংক করানো শুরু করে। পুরো চাপ্টার শেষ হলে অহর্নিশ নিজ থেকে কিছু অংক আয়ন্তিকা কে তৈরি করে দেয় প্র্যাক্টিসের জন্য। চারটা অংক শেষে একটাতে এসে আঁটকে যায় আয়ন্তিকা। তা দেখে অহর্নিশ সুচালো কন্ঠে বলল,

-‘ কি ব্যাপার? বসে আছো যে, জলদি শেষ করো। ‘
আয়ন্তিকা মিনমিনিয়ে বলল,
-‘ এই ম্যাথটা পারছি না। ‘
খাতার দিকে তাকায় অহর্নিশ। পরবর্তীতে তীক্ষ্ণ নজরে আয়ন্তিকার দিকে তাকিয়ে সে বলল,
-‘ এটা পারছো না? সূত্র বসিয়ে করতে হবে এটা। সূত্র লিখো আগে। ‘
-‘ সূত্রটাই ভুলে গিয়েছি। ‘
অহর্নিশ ঠোঁট আঁকড়ে নিয়ে দৃষ্টিপাত দেয় আয়ন্তির মুখশ্রীতে। তৎক্ষনাৎ কিছু মনে করে সে মৃদু হাসে। কন্ঠ সুক্ষ্ম করে বলল,
-‘ ক্লাস ৯ এ কি করেছি? এতো সিম্পল একটা সূত্র মনে রাখতে পারো না? লাইক সিরিয়াসলি! ‘
আয়ন্তিকার অহর্নিশের কথার পরিপ্রেক্ষিতে রেগে যেতে বড্ড ইচ্ছে হলো। কিছু তার জাতীয়গত স্বভাব তাকে রেগে যেতে দিলো না। পর্বতসম অভিমান নিয়ে সে চুপ করে রইল। অপমানে তার চোখের কার্নিশে পানি এসে জমেছে তা বুঝতে পারলো স্পষ্ট রূপে।

অহর্নিশ আহত হয়। সে ভেবেছিলো আয়ন্তিকা রেগে যাবে। রেগে গিয়ে তাকে কঠিন কয়েক কথা শোনাবে। আর এর মধ্য দিয়ে সে রাগীরূপী আয়ন্তিকার সৌন্দর্যও মুখস্থ করে নিবে। আয়ন্তির ভীতিরূপে থাকে সৌন্দর্য, ক্রন্দনরূপে থাকে মায়া, অভিমান করলে সে চেহারা থাকে চুমু খাওয়ার আবদার। এইতো, সব ক্ষণের সর্ব রূপ অহর্নিশ মুখস্থ করে নিয়েছিলো। রাগী রূপটাই বাকি। ভেবেছিলো সে এই কথারা পরিপ্রেক্ষিতে সে তাও মুখস্থ করে নিবে কিন্তু তা হলোনা। হলো উল্টোটা!
অহর্নিশ নিজেকে ধাতস্থ করে আড়ষ্ট ভঙ্গিতে বলল,
-‘ এখন আর করার দরকার নেই ম্যাথ। একটু ঘুমাও মাত্র পরিক্ষা দিয়ে এসেছো বলে তাই হয়ত মাথা কাজ করছে না। ঘুমিয়ে পড়ো একটু। ‘
অহর্নিশ চটজলদি বেড়িয়ে পড়ে রুম থেকে। নিজেকে তার থাপ্পড় মারতে ইচ্ছে করছে। কড়া থাপ্পড়!

শাফি উজমার নিকট এগোতে নিলেই উজমা চুপসে যায়। কাপুনি দিয়ে দূরে সরে বসে। ভীতিগ্রস্ত দৃষ্টি তার। গলা শুকিয়ে কাঠ। তা দেখে শাফি মলিন হাসে। এই মেয়েটা তাকে ভয় কেনো পাচ্ছে? হু? একটু ভালোবেসে তাকানে যায় না? দীর্ঘ কয়েক মাড ধরে এভাবেই উজমা তার দিকে ভীতি চাহনি নিক্ষেপ করছে। শাফি কাছে যেতে নিলেই তার ব্রেইনের নার্ভ দূর্বল হয়ে পড়ে। সেন্সলেস হয়ে যায় উজমা।

শাফি মেরে ফেলেনি উজমাকে। তার সাধ্যে হয়নি এই মিষ্টি মেয়েটাকে খুন করার। অথচ উজমার থেকে আরে কত সুন্দরী মেয়েকে সে অনায়াসে খুন করে ফেলেছে টাকার বদৌলতে। কিন্তু এই মেয়ে, উজমা! একে তার মেরে ফেলা সম্ভব হয়নি। উজমার বদলে সে অন্য একটা মেয়েকে মেরেছে। সেই মেয়েটাকে মারার নির্দেশ দিয়েছিলো একজন। তদ্রুপ মেয়েটাকে মারার পর সে উজমার পোশাক পড়িয়ে নাহিয়াকে ছবি পাঠিয়ে বলেছে সে মেরে ফেলেছে উজমাকে।এবং নাহিয়া আহমেদ তাই বিশ্বাস করেছে। বহুদিন যাবৎ নাহিয়ার সাথে শাফি কাজ করায় নাহিয়া তাকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করে

শাফি উজমার সন্নিকটে এগিয়ে গিয়ে কোমল কন্ঠে বলল,
-‘ উজমা এদিকে আসো। ভয় পাইতেছো কেন আজিব? খাওনাই ক্যান? রেনু খালায় খাবার নিয়া কতবার আইছে তারে বারবার ফিরায় দিছো কেন?’
উজমা কাঁপা কন্ঠে বলল,
-‘ আ..আপনি ক..কে? আ..আমাকে এ..এখানে আঁটকে রেখেছেন ক..কেন? বাসায় যাবো। যেতে দিন দয়া করে। ‘
শাফি হুট করে রেগে গেলো উজমার কথায়। তার মোটেও এই কথাটি পছন্দ হয়নি। শাফি চিবিয়ে বলল,
-‘ যাওয়ার কথা কস ক্যান?কোনোদিন দিয়া কষ্ট দিছি হ্যা? খালি বাসায় যামু, বাসায় যামু করস! আরেহ্ বাসায় যাইয়া তো সেই বান্দির মতোই খাটবি তার থেকে যে এখানে রানির হালে রাখতাসি শান্তি লাগে না এতে?’
শাফির কথাগুলো তিক্ত লাগল উজমার নিকট। এতে করে সে ফ্যাচফ্যাচ করে কেঁদে দেয়। শাফি বিরক্তি, রাগের সংমিশ্রণ নিয়ে চলে যায় রুম হতে বাহিরে।

ওষ্ঠদ্বয়ের মাঝে ব্যাবধান সৃষ্টি করে আয়ন্তিকা ভীতি নিয়ে চেয়ে আছে সামনে। বিছানার ওপর তার দৃষ্টি।ছোট ছোটো কোমল আঙুল গুলি থরথর করে কাঁপছে। কপাল বেয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে গালের দিকে। বিছানার ওপর একটা তেলাপোকা নিজ মনে হাঁটাচলা করছে। আর দশটা মেয়ের মতোই আয়ন্তি ও তেলাপোকা কে প্রচন্ড রূপে ভয় পায়। ফোবিয়া আছে এক প্রকার বলা চলে। ঘুম থেকে উঠে নিজের পাশেই এই তেলাপোকার দেখা মিলে তার।
বিছানার তেলাপোকা উড়াল দিয়ে মেঝেতে এসে পড়তেই আয়ন্তিকা নিজেকে আর কন্ট্রোল করতে পারে না। চিৎকার দিয়ে উঠে উচ্চস্বরে। অস্ফুটস্বরে সে ‘ অহর্নিশ ‘ বলে ডাক দেয়।

সবেমাত্র অহর্নিশ সেভ করতে নিয়েছিলো। উচ্চস্বরে আয়ন্তিকার চিৎকার শুনে হতবিহ্বল হয়ে তার গাল রেজার দিয়ে খানিকটা কেটে যায়। রক্ত তার নিজ নিয়মে গলগল করে ফিনকি দিয়ে বের হতে থাকে। কিন্তু অহর্নিশ সেদিকে পরোয়া না করে হাতের রেজার ছুঁড়ে ফেলে দৌড় মারে আয়ন্তিকার রুমে।
আয়ন্তিকার রুমের ভেতর প্রবেশ করে এক নির্দিষ্ট স্থান নিয়ে দাঁড়াতেই অহর্নিশ লক্ষ্য করে আয়ন্তিকা এর ভীতু চেহারা। কেমন থরথর করে কাঁপুনি দিচ্ছে, এক পাশে গুটিশুটি মেরে দাঁড়িয়ে আছে। অহর্নিশ এবার ঠোঁট যুগল প্রসারিত করে চিন্তিত কন্ঠে বলল,
-‘ আয়ন্তিকা, কি হয়েছে? ‘

আয়ন্তিকা এবার পূর্ণ দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করে অহর্নিশের দিকে। হিতাহিত জ্ঞান ফেলে সে দৌড়ে এসে তার দুহাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে অহর্নিশ গলা। পা উঁচু করে নেয়। গলায় মুখ গুঁজে দিয়ে সে কাঁপা কন্ঠে বলল,
-‘ ত..তেলাপোকা ম..মেঝেতে। প..প্লিজ সরান ঐটা কে। ‘
অহর্নিশ থতমত খায়। মেঝেতে দৃষ্টি দিতেই সে দেখে কালো কুচকুচে এক তেলাপোকা উল্টো হয়ে পড়ে আছে। কিছুটা বোধগম্য হয় তার পুরো ঘটনা। এতে ও বিরক্তি প্রকাশ করে। বিরক্তিমাখা কন্ঠে বলল,
-‘ লাইক রিয়েলি আয়ন্তিকা? এই তেলাপোকা কে ভয় পাও তুমি? এরজন্যই এতো জোড়ে চিৎকার। ‘
আয়ন্তিকা জবাব দেয়না। ভয়ে সিটিয়ে আছে। অহর্নিশ খেয়াল করে আয়ন্তিকার অবস্থান। চোখ দুটো অনায়াসে তার বড় বড় আকার ধারণ করে। ঠোঁট কামড়ে হাসে অহর্নিশ। পরবর্তীতে সে সামলে বলল,

-‘ এভাবে বাঁদরের মতো ঝুলছো কেন?নামো! ‘
-‘ নাহ প্লিজ। আপনি আমাকে এই রুম থেকে নিয়ে যান। ‘
ভীতি কন্ঠে বলল আয়ন্তিকা। অহর্নিশ ফের ঠোঁট কামড়ে হাসে। তার এই মূর্হতে তেলাপোকা টাকে ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছে করছে। এবং সে তাই করে। ইশারায় তেলাপোকার দিকে তাকিয়ে ‘থ্যাংকস’ বলে বেড়িয়ে যায় রুম থেকে।

অন্তর্লীন প্রণয় পর্ব ১১

রুমে এসে আয়ন্তিকা নিজ থেকে লাজুকলতা রূপ ধারণ করে নেমে যায়। গুটিশুটি পায়ে সোফায় গিয়ে বসে পড়ে। অহর্নিশ সেদিকে একবার তাকিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। কাটা জায়গাতে ড্রেসিং করার দরকার। তারপর সেভ ও তো করা বাকি। কাল মন্ত্রীর সাথে দেখা করতে যেতে হবে। পরিপাটি মতোন না গেলে চলে নাকি?

নিজ কার্য সমাপ্ত ঘোষণা করে অহর্নিশ রুমে এসে দেখে আয়ন্তিকা সোফায় হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে গেছে, মাথা এলিয়ে দিয়েছে দেয়ালে। রাত ১১ টা বাজে। একটু পর তারও বের হতে হবে। রাত হলে বেড়িয়ে পড়ে সে রাতের শহরে দুঃখমাখা গল্প শ্রবণ করতে। পুরো এলাকা ঘুরে সে রাস্তা ঘুমিয়ে থাকা মানুষদের নোট করে রাখে, রাতে যেই বাচ্চাগুলো খুদার জ্বালায় মায়ের নিকট কান্না করে তাদেরও মাথায় গেঁথে রাখে। পরবর্তীতে সকাল হলে নিজের দলের কিছু মানুষ দিয়ে টাকা, খাবার পাঠিয়ে দেয় তাদের নিকট। পরিচয় গোপণ রেখে। তবুও সেই অসহায় মানুষগুলো বুঝে যায় এগুলো সব অহর্নিশই দিয়েছে।

অহর্নিশ পড়নের জামা পাল্টে পরিপাটি হয়। তারপর এগিয়ে যায় ঘুমন্ত আয়ন্তিকার নিকট। আস্তে ধীরে কোলে তুলে নেয় আয়ন্তিকা কে সে। নিজের বিছানায় শুইয়ে দিয়ে উঠে যেতে নিলে কি মনে করে অহর্নিশ নিজেও শুয়ে পড়ে আয়ন্তিকার পাশে। অপূর্ব সৌন্দর্যে ঘেরা আয়ন্তি কে দেখতে দেখতে বহুক্ষণ কাটিয়ে দেয়। ফজরের আযান কানপ আসলে অহর্নিশ হতভম্ব হয়। এত সময় পেড়িয়ে গিয়েছে?
অহর্নিশ আয়ন্তিকার নিকট এগিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বলল,

-‘ ব্যাঘাত ঘটিয়ে দিলে তো আমার রোজকার রুটিনে। এমন ভয়ংকর সুন্দরী কে হতে বলেছে তোমায়? তোমার সৌন্দর্য যে আমার প্রতিক্ষণে তীব্র ভাবে গ্রাস করে তা অনুভব করতে পারোনা?’
অহর্নিশ সন্তপর্ণে চুমু খায় আয়ন্তিকার কপালে।

অন্তর্লীন প্রণয় পর্ব ১৩