অন্তর্লীন প্রণয় পর্ব ২৯

অন্তর্লীন প্রণয় পর্ব ২৯
সাদিয়া মেহরুজ দোলা

পরবর্তী দিন ভোরে সেন্স আসে আয়ন্তিকার।নেত্রপল্লব টেনে খুলে আয়ন্তিকা পেট ব্যাথার যন্ত্রণায় ছটফট করার মতো অবস্থা। ডানে দৃষ্টি দিতেই দৃশ্যমান হয় অহর্নিশ কে। মেয়েকে কোলে নিয়ে তখন সে ব্যাস্ত ছিলো নানার কথার মধ্যিতে। আয়ন্তিকা গলার স্বর তীব্র করে অহর্নিশ কে দু’বার ডাকে। কিন্তু অহর্নিশ একবারও তাকায় না তার দিকে ফিরে। অভিমান হয় আয়ন্তিকার! অভিমানে নেত্রে এসে জমেছে অশ্রুকণা। ইচ্ছে হলে এখনই সে চুপ হয়ে যেতো কিন্তু তার এই মূর্হতে বাচ্চাদের ছুঁয়ে দেয়ার তীব্র বাসনা জেগেছে। তাই আরেকবার দূর্বল গলায় উঁচু কন্ঠে ডাক দেয় অহর্নিশ কে।

অহর্নিশ তৎক্ষনাৎ সামনে ঘাড় বাকিয়ে তাকায়। আয়ন্তিকার নেত্রপল্লব উন্মুক্ত দেখে সে নিভৃতে আল্লাহর নিকট শুকরিয়া আদায় করে। মেয়েকে কোলে নিয়েই অহর্নিশ আয়ন্তিকা নিকট এগিয়ে যায়। বেডের সাইডে দাঁড়িয়ে মৃদু হেঁসে বলল,
‘ ফাইনালি জ্ঞান ফিরেছে তোমার। আলহামদুলিল্লাহ কেমন লাগছে এখন?পেটে ব্যাথা করছে?কোথায় যন্ত্রণা করছে?ঠিক আছো তো?’
অহর্নিশের করা এতো এতো প্রশ্নের একটারও প্রতুত্তর করলো না আয়ন্তিকা। সে অভিমান করেছে বড্ড, অহর্নিশের ওপর! থমথমে কন্ঠে সে অধরের মাঝে ব্যবধান সৃষ্টি করে বলল,
‘ আমি বাচ্চাদের দেখতে চাই। ‘

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

অহর্নিশ অসন্তুষ্ট হেঁসে মেয়েকে আয়ন্তিকার পাশে শুইয়ে দেয়। পরিশেষে পদচারণ করে নিয়ে আসে ছেলেকে। তাকেও আয়ন্তিকার পাশে শুইয়ে দিয়ে অহর্নিশ পাশে একটা টুল টেনে নিয়ে বসে পড়ে। অতঃপর নম্র কন্ঠে বলে,
‘ আমার প্রশ্নগুলোর উত্তর দিলেনা যে?’
আয়ন্তিকা ছেলে, মেয়ের গালে, হাতে আদুরে স্পর্শ দিয়ে বলল,
‘ দিতে বাধ্য নই! ‘

অহর্নিশ ছোট্ট করে শ্বাস ফেললো। তার বোধগম্য হয়ে গিয়েছে আয়ন্তিকা নিশ্চিত কোনো ব্যাপার নিয়ে তার ওপর অভিমান করেছে। এই মেয়েটা বড্ড অভিমানী! অল্প কিছুতে যেমন কেঁদে আকুল হয়ে উঠে। তেমনি সামান্য ব্যাপার নিয়ে অভিমান করে গাল ফুলিয়ে বসে থাকে। এই ব্যাপারটা অহর্নিশের কাছে মোটেও ভালো লাগেনা। বরং রাগ লাগো তার, আর দশটা প্রেমিকের মতো সে না যে প্রেমিকার সব ধরনের ব্যাবহার সে নরমালি নিবে!ভালোবাসবে, আয়ন্তিকা তার সাথে যখন এমন ব্যাবহার দেখায় তখন তার ইচ্ছে হয়ে এই মেয়েকে ধরে তুলে আছাড় দিতে।

নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়ে অহর্নিশ ফের বলল,
‘ আমি কি কিছু করেছি আয়ন্তিকা? কথা বলছো না কেনো আমার সাথে?’
আয়ন্তিকা এবারও প্রতুত্তর করলো না। সে ব্যাস্ত বাচ্চাদের চুমু খেতে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকছে আবার কিছুক্ষণ আদুরে ভাব নিয়ে চুমু খাচ্ছে। বাচ্চাগুলো হয়েছে একটু বেশিই কিউট। দেখলেই আদর করতে ইচ্ছে করে। আয়ন্তিকা ভেবে পায়না তার মতো শ্যামলা মেয়ের এমন সাদা ধবধবে দুটো কিউট বাচ্চা হলো কি করে?পরক্ষণেই অহর্নিশ এর কথা মনে পড়তে তার কাছে স্বচ্ছ হলো ব্যাপারটি। তার ছেলে – মেয়ে তাদের বাবার মতোই হয়েছে। অতিরিক্ত সুন্দর, অতিরিক্ত কিউট!

অহর্নিশ ধৈর্য রাখতে পারে না।হাস ফাঁস করা শেষে রুষ্ট কন্ঠে বলল,
‘ এই তুমি কি কথা বলবে? ‘
আয়ন্তিকা কেঁপে ওঠে খানিকটা। সাথে তার ঘুমন্ত রাজকন্যা ঠোঁট ভেঙে কেঁদে দেয়। চোখ দু’টো গরম করে তাকাতেই অহর্নিশ আমতা আমতা করলো। তবে সে দমে না গিয়ে বলল,
‘ এভাবে তাকাচ্ছো কেনো আজব?দোষ তো তোমারই! একটু রিপ্লাই করলে কি আমি অতো জোরে চিল্লিয়ে উঠতাম বলো? কথা বলো আয়ন্তিকা প্লিজ! দেখো কতোটা সময় আমি তোমার গালে একটু আদুরে স্পর্শ দেইনি! কাছে টেনে নিয়ে তোমার চুলের ঘ্রাণ নেইনি! হাতের আঙুলে চুমু খাইনি। তুমি বুঝতে পারছো আমার অবস্থাটা?একটু কথা বল! এমন থম মেরে বসে থাকলে আমি আমার কাজ করতে পারবো না তো। ‘

আয়ন্তিকা মেয়ের কান্না থামিয়ে ওকে পাশে শুইয়ে দেয়। হাত দিয়ে চুলগুলো ঠিক করে নিয়ে সটান হয়ে বসে। কিছু সময় পার হওয়ার পর সে অভিমানী কন্ঠে বলল,
‘ আপনাকে কতোবার আমি বলেছিলাম আমার সাথে থাকতে। ডাক্তার অনুমতি পর্যন্ত দিয়েছিলো আপনি আসেননি কেনো?’
অহর্নিশ নতজানু হয়ে ঠোঁট কামড়ে লাজুক রূপে রূপান্তর হয়! পরিশেষে সে মাথা উঁচু করে বলল,
‘ নিজের চোখের সামনে তোমাকে কাটা ছেড়া করা দেখতে পারবো না আমি। আর না তোমার কষ্ট সহ্য করতে পারতাম! তাছাড়া… ‘
‘ তাছাড়া?’
‘ আমি রক্ত, মেডিকেল ইন্সট্রুমেন্ট ভয় পাই। ‘

আয়ন্তিকা সেকেন্ড খানিক বাকরুদ্ধ রইল। অতঃপর শব্দ করে হেঁসে দেয় সে। হাসতো হাসতে গড়াগড়ি খাওয়ার মতো অবস্থা তার। তবে পেটের দিকে খানিকটা ব্যাথা অনুভূত হতেই সে থেমে যায়। কিন্তু এখনও সে নিঃশব্দে হাসছে। হাস্যরত মুখেই বলল,
‘ সিরিয়াসলি? আপনাকে তো আমি সাহসী মনে করতাম। ছিহ্! এমপি সাহেবের এই হাল তলে তলে?’
অহর্নিশ চোখ পাকিয়ে বলল,
‘ এই টপিক এখানেই অফ! চুপ! ‘
আয়ন্তিকা চুপ হয়ে যায়। মৌন রূপে থাকাকালীন এক সময় সে উৎসাহ নিয়ে বলল,
‘ ছেলে – মেয়ের নাম কি রাখবেন ঠিক করেছেন?’
‘ উঁহু! তুমি ঠিক করো। ‘

‘ তা কি করে হয়?আপনি বাবা আপনার ও তো একটা অধিকার আছে তাই না?’
‘ তাহলে তুমি ছেলের নাম ঠিক করো! আমি মেয়ের নাম দেখি। ‘
‘ ওকে! কয়েক মিনিট পর বলছি। দু’জন একসাথে বলবো। ‘
দু’জন একসাথে মৌন রূপে চলে যায়। কয়েক মিনিট পর আয়ন্তিকা বলে উঠলো,
‘ আমার নাম ভাবা হয়ে গিয়েছে। ‘
অহর্নিশ ম্লান হেঁসে বলল, ‘ আমারও! ‘
‘ ফার্স্টে আপনি বলুন। ‘
‘ আমাদের মেয়ের নাম হবে তোমার নামের সাইরিশ থেকে সাঈশা! সাঈশা আহমেদ ! কেমন হয়েছে? ‘
আয়ন্তিকা গমগম সুরে বলল, ‘ খুব বেশি সুন্দর। ‘
‘ ছেলের নাম কি রাখলে?’
‘ ফারদিন আনাফ ‘

অহর্নিশ ছেলেকে কোলে তুলে নিয়ে চুমু খেয়ে কানের কাছে ফিসফিস করে তার নাম উচ্চারণ করলো। অহর্নিশের কেনো যেনো মনে হলো তার ছেলে নাম শোনামাত্র হালকা ঠোঁট যুগল প্রসারিত করেছে। যার মানে অহর্নিশ ধরে নিয়েছে তার ছেলে একটু হেঁসেছে।
খানিক বাদে আগমন ঘটে অহনা, ইমান এবং আয়ন্তিকার বাবা মার! একে একে সবাই বাচ্চাদের কোলে তুলে নিয়ে একে একে আদরের বাহার খুলে বসলো। অহর্নিশ, আয়ন্তিকা মুগ্ধ চোখে তা দেখলো। এরই মাঝে টুপ করে অহর্নিশ আয়ন্তিকার ললাটে তার অধরের স্পর্শ মিলিয়ে দিয়েছে। আয়ন্তি তেমন রাগ দেখায়নি এতে! চুপ ছিলো পুরোপুরি!

কয়েকদিন পর আয়ন্তিকা কিছুটা সুস্থ হলে হসপিটাল থেকে রিলিজ পায়! আজ তিনদিন হলো সে বাসায়। পুরো দিন তার আনাফ, সাঈশার পিছে ব্যায় হয় তার! অহর্নিশের দিকে বিন্দুমাত্র নজর দেয়ার সময় নেই। এতে অহর্নিশ ভিষণ ক্ষুব্ধ! সে পারে না আয়ন্তিকা কে নিয়ে কোথাও দূরে চলে যায়। আয়ন্তিকা এখন শুধু আনাফ, সাঈশা! আনাফ, সাঈশা করেই পার করে দেয়। অহর্নিশ কে দেখার সময় কই তার?
রাত আটটা!

অহর্নিশ রুমে পায়চারি করছে অস্থিরভাবে। আয়ন্তিকা কে আজ এক নজরও দেখা হয়নি তার। মেয়েটাকে ধরে কেলানি দিতে পারলে বুঝি ভালো হতো। অহর্নিশ কে ইগনোর করা?হুহ্!
অবশেষে রাত একটার দিকে রুমে আসে আয়ন্তিকা। ক্লান্তি সর্ব মুখশ্রীতে এঁটে সেঁটে আছে। তা দেখে অহর্নিশ মন গলে পানি হয়ে যায়। সে মনে মনে এঁটে নিয়েছিলো আয়ন্তিকা রুমে আসলেই ইচ্ছে মতো বকবে! কিন্তু আয়ন্তিকার হাল দেখে তার খারাপ লাগে। মেয়েটা সারাদিন কতো খাটুনিই না করে। সে তো সারাদিন বাহিরে থাকে। কিন্তু আয়ন্তিকা কে দুই বাচ্চাকে সামলাতে হয়, সংসারের সব কাজ করতে হয়, পড়াশোনায় টাইম দিতে হয়, অহনা, ইমানের আদেশ মানতে হয়! ইশশ! কতো চাপ যাচ্ছে মেয়েটার ওপর। একবারও তো অহর্নিশ এটা ভেবেই দেখেনি।

অন্তর্লীন প্রণয় পর্ব ২৮

আয়ন্তিকা সাঈশা কে বিছানায় ঠিকঠাক শুইয়ে দিয়ে দুপাশে কোলবালিশ রেখে দেয়। আনাফ অহনার কাছে! সেখানেই ঘুমাবে। দু’জন কে রাখা আয়ন্তিকার পক্ষে সম্ভব না। অহর্নিশ তো ঘুমালে তার দিন – দুনিয়ার কোনো ঠিক থাকেনা। সে বাচ্চাদের দেখবে কি করে?
অহর্নিশ ছটফট করার এক পর্যায়ে বলল,
‘ আয়ন্তিকা?’
আয়ন্তিকা পিছন ফিরে তাকিয়ে বলল, ‘ কিছু বলতে চান?’
‘ হু! সাঈশাকে শুইয়ে দিয়েছো না? আর কোনো কাজ থাকলে শেষ করে বারান্দায় আসো। আমি অপেক্ষা করছি।

‘ ঠিক আছে। আপনি যান আমি আসছি! ‘
ক্ষনিক পর আয়ন্তিকা এসে দাঁড়ায় অহর্নিশ এর পাশে। অহর্নিশ তখন বাহিরে দৃষ্টি আবদ্ধ করে পরিবেশ দেখতে মত্ত ছিলো। কারো অবস্থান টের পেয়ে সে বুঝতে পারলো আয়ন্তিকা এসেছে। চট করে ঘাড় বাকিয়ে সে ডানে তাকায়। আয়ন্তিকা তা দেখে বলল,
‘ কি বলবেন?’
অহর্নিশ কিছুক্ষণ ঠোঁট কামড়ে তাকিয়ে আয়ন্তিকা কে পর্যবেক্ষণ করলো। অতঃপর অদ্ভুত হেঁসে বলল,
‘ সাঈশা, আনাফ হওয়ার পর শুকিয়ে তো কাঠ হয়ে গেছো। বাচ্চারা বড় হলে তোমার হাড্ডি গুনতে পারতো। ‘
এতটুকু বলে থেমে অহর্নিশ আয়ন্তিকার কর্ণধারে ফিসফিস করে কিছু বলল। উক্ত কথা শুনে আয়ন্তিকা তৎক্ষনাৎ লজ্জায় মিইয়ে যায়। খানিক বাদে বলল,

‘ যাহ্ অসভ্য! যত্তসব ফাউল কথা। ‘
অহর্নিশ স্ব- শব্দে হেঁসে বলল, ‘ এটাই সিরিয়াস কথা। ‘
অতঃপর মৌনতা..!
আয়ন্তিকা বাহিরে দৃষ্টি দেয়। ঠিক তখনি অহর্নিশ তার পিছন গিয়ে দাঁড়িয়ে আলত করে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে। আয়ন্তিকা কেঁপে ওঠে কিছুটা। অহর্নিশ শীতল কন্ঠে বলল,
‘ আমার জীবনটাকে পূর্ণতা দান করার জন্য ধন্যবাদ আয়ন্তিকা। বিশেষ বিশেষ ধন্যবাদ! আমি তোমার নিকট কৃতজ্ঞ থাকবো আজীবন।’
আয়ন্তিকা তপ্তশ্বাস ফেলে একটু হাসলো। অহর্নিশ তা দেখে ফের বলল,
‘ আমার সামনে হেঁসোনা তো আর কখনো। ‘
আয়ন্তিকা চমকে বলল, ‘ কেনো?’

‘ তুমি হাসলে গালদুটো কেমন ফুলে ওঠে। তখন ইচ্ছে করে টুস করে কামড় বসিয়ে দিতে। নয়তো আস্ত গালটাই গিলে ফেলতে! তোমার গালদুটো হাসলে আমার কাছে আপেলের মতো দেখতে লাগে। ‘
আয়ন্তিকা বিরক্ত সুরে বলল, ‘ আপনি যে পাগল জানেন? পাবনায় এডমিট করালে ডাক্তাররা নিশ্চিত আপনার উদ্ভট কথা শুনে তারা নিজেরাই পাগল হয়ে যেতো। ‘
অহর্নিশ কিছু বলল না আয়ন্তিকার কথার পরিপ্রেক্ষিতে। সে সরে দাঁড়ালো। চোখ বন্ধ করে নিয়ে ব্যস্ত হলো কিছু মূর্হতের ছবি আঁকতে নিভৃতে! দেখা গেলো তারা একে দিলো আয়ন্তিকার ছবি। নাহ! সে কখনোই বলতে পারবে না আয়ন্তিকা কে নিজের ভালোবাসার কথাটি।

অন্তর্লীন প্রণয় শেষ পর্ব