অন্তর্লীন প্রণয় পর্ব ২৭

অন্তর্লীন প্রণয় পর্ব ২৭
সাদিয়া মেহরুজ দোলা

অহনা নিঃশব্দে কেঁদে যাচ্ছে। আয়ন্তিকা হতভম্ব!এভাবে হুটহাট কান্নার মানে তার বোধগম্য হলো না। এবং আয়ন্তিকা এটাও বুঝতে পারলো না কেনো অহর্নিশ অহনা কে দেখে এমন পাংশুটে মুখ বানিয়ে খাবার প্লেটে রেখেই রুমে চলে গেলো। এরকম আরো কয়েককবার লক্ষ্য করেছে সে। অহর্নিশ অহনা কে দেখলেই বিদঘুটে আচরণ করে। কখনো রেগে কথা বলে, কখনো তো কথাই বলেনা! মায়ের প্রতি অহর্নিশের এমন আচরণ দেখে আয়ন্তিকার রাগ হয়। প্রচন্ড রাগ! এ কেমন মানুষ অহর্নিশ?

আয়ন্তিকা সবেমাত্র অহনা কে জিজ্ঞেস করেছিলো কেনো অহর্নিশ তার প্রতি এমন আচরণ করে?এই প্রশ্নটা করার পরপরই অহনা কেঁদে চলেছে একাধারে। কিন্তু আয়ন্তি বুঝলো না সে কি কোনো কান্না করার মতো প্রশ্ন করেছে? না তো! তাহলে?
আয়ন্তিকা অহনার দিকে পূর্ণদৃষ্টি দিয়ে বলল,
‘ মামি তুমি কি আরো কিছুক্ষণ কান্না করতে চাচ্ছো?’
অহনা ঘাড় উঁচু নিচু করে ইশারা করে ‘ হ্যা ‘ জানায়। আয়ন্তিকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘ ঠিক আছে। তুমি তোমার কাজ করো তাহলে। আমি যাবো আর আসবো। আসার পর তোমার এই কান্না যদি চলমান দেখি, তাহলে আমি কিন্তু তোমার সাথে আর কখনোই কথা বলবো না। ‘
কথা শেষে আয়ন্তিকা এক মূর্হতও দাঁড়ালো না। চট করে চলল অহর্নিশের রুমের উদ্দেশ্যে। রুমে এসেই সে দেখলো অহর্নিশ জানালার কাছে কেমন থমথমে মুখ নিয়ে বাহিরে দৃষ্টি স্থাপন করে রেখেছে। চোখদুটো কেমন চকচক করছে! তবে আয়ন্তিকা তা দেখেও না দেখার ভান করে এগিয়ে যায় সামনে। অহর্নিশের সন্নিকটে দাঁড়িয়ে ঠাস ঠাস করে দু’টো থাপ্পড় মেরে দেয়! রাগে রীতিমতো কাঁপছে সে। অহর্নিশ বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকায়। গালে হাত দিয়ে ভড়কানো কন্ঠে বলল,

‘ থাপ্পড় মারলে কেনো আয়ন্তিকা? ‘
আয়ন্তিকা ফুঁসে উঠে বলল,
‘ মাত্র তো দু’টো মেরেছি। এখন আরো চারটা মারতাম। দয়ার খাতিরে ছেড়ে দিয়েছি। ‘
অহর্নিশ অসহায় কন্ঠে বলল, ‘ কিন্তু আমি করেছিটা কি? কি কারণে আমার ওপর এতো রেগে আছো?’
‘ মায়ের সাথে কেও এমন ব্যাবহার করে?মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের জান্নাত! আপনি তা জানেন?উফ! জানবেন কি করে? নামাজ, কোরআন এর তো খবরই নেই আপনার। আমি সেই প্রথম হতে দেখছি আপনি মামীর সাথে উদ্ভট ব্যাবহার করেন। অপমান করতেও দেখেছি একদিন! আপনার বিবেকে বাঁধে না? যেই মা আপনাকে দশ মা দশ দিন গর্ভে ধারণ করে এতো কষ্ট সহ্য করলো আপনি তাকেই কষ্ট দিচ্ছেন? কেনো অহর্নিশ? কারণটা বলুন দয়া করে! কি হয়েছে? আপনি নিজের আপন মায়ের সাথে এমন ব্যাবহার কেনো করছেন?’

অহর্নিশ মূর্হতে কেমন অদ্ভুতুরে হয়ে গেলো। চোখ দুটো লাল! চোখের কার্নিশে এসে জমা হয়েছে স্বচ্ছ নোনা পানির ঢল। যেকোনো সময় টুপ করে গড়িয়ে পড়বে। হাতের উল্টোপিঠে চোখের অশ্রুকণা মুছে নিয়ে অহর্নিশ নিজেকে ধাতস্থ করার প্রয়াস চালায়। পরিশেষে নম্র কন্ঠে বলল,
‘ তিনি আমার আসল মা নন! আমার মা বহু আগেই মারা গিয়েছে। আমাকে একা করে চলে গেছে। ‘
আয়ন্তিকা বিষ্ফোরিত চাহনি দেয় অহর্নিশের দিকে। পাল্টা প্রশ্ন করার জন্য সে উদ্বিগ্ন হতেই ডাক পড়ে অহনার। চটজলদি সে রুম হতে বেড়িয়ে অহনার নিকট এসে দেখে সে ফুপাচ্ছে। অহনা তার হাত ধরে তার পাশে বসিয়ে দেয়। নাক টেনে বলে,

‘ তুই সব জানতে চাস না?আজ তোকে সব বলবো। আমি অহর্নিশের আসল মা নারে আয়ন্তি! ‘
আয়ন্তিকা খানিকটা থতমত খেয়ে বলল,
‘ জানি। মাত্রই বললেন উনি। আপন মা না হলে কি হয়েছে মামি?তাই বলে সে এমন ব্যাবহার কেনো করে সে তোমার সাথে?’

‘ অহর্নিশের আসল মা যিনি ছিলেন আলিশা! তিনি খুব একটা ভালো ছিলেন না। কিন্তু অহর্নিশ ছোট বেলাই থেকে মা ভক্ত ছিলো। মাকে ছাড়া কিছু বুঝতো না। আলিশার নিজের বাচ্চাদের প্রতি কোনো ভালোবাসা ছিলো না। তাট বয়ফ্রেন্ড ছিলো। ইমান ব্যাবসার কাজে প্রায় সময়ই দেশের বাহিরে থাকতেন। আর্নিয়া বোডিং স্কুলে! আলিশা ওর বয়ফ্রেন্ড কে বাসায় এনে অনৈতিক কাজ করতো। অহর্নিশ তখন ক্লাস ফোরে পড়তো। মায়ের এসব কীর্তিকলাপ বাবাকে বলতো না। বাবা মাকে মারবে বলে।

তাড়িয়ে দিবে! আলিশাকে অহর্নিশ পা ধরে, মায়ে মাথা ঠেকিয়ে পর্যন্ত বলেছে একটু ভালোবাসা পাওয়ার জন্য। কিন্তু সেদিন আলিশা ওকে খুব মেরেছিলো। রড আগুনে গরম করে এনে ঐটা দিয়ে পিটিয়ে ছিলো। আলিশার বয়ফ্রেন্ড অহর্নিশ কে সেদিন টানা ২ ঘন্টা লাঠি দিয়ে পিটিয়ে ছিলো। আলিশা তা দেখে কোনো বাঁধা প্রদান করেনি। শুধু হেঁসেছে। একজন মা এতোটা নিষ্ঠর কিভাবে হয় রে আয়ু? সেদিন থেকেই অহর্নিশের ওপর নরক যন্ত্রণা শুরু হলো। প্রায়ই আলিশা অহর্নিশ কে মারতো। হাত দিয়ে না মোটা মোটা লাঠি দিয়ে। কতদিন খেতে দেয়নি আমার ছেলেটাকে! ‘

অহনা আঁচলে মুখ চেপে হু হু করে কেঁদে দেয়। আয়ন্তিকা নিজেও কাঁদছে। ইশ! মানুষ এতো নিষ্ঠুর প্রকৃতির কিভাবে হয়? আয়ন্তিকা নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
‘ আলিশা আন্টি এমন কেনো করতো? নিজের ছেলেকে এতোটা কেও মারে কিভাবে? ‘
‘ ইমানের সাথে বিয়েতে আলিশার মত ছিলোনা। ও অন্যজনকে ভালোবাসতো। ইমান আলিশাকে পছন্দ করতো। অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে রেখে দিয়েছে তিনি আলিশাকে। বাচ্চা হবার পর ইমান আলিশার কিছু পরিবর্তন দেখে ভেবেছিলো ও ভালো হ’য়ে গেছে। তাই সে বাহিরে চলে যেতো নিশ্চিতে! আর তখনই আলিশা এসব করতো।

দিনকে দিন অহর্নিশের ওপর অত্যাচার বেড়েই চলেছিলো। ছোট সেই ছেলেটা কিভাবে যেনো এতো অত্যাচারা সহ্য করেও বেঁচে ছিলো আলিশা তাকে একদিন ভালোবাসবে তার আশায়! তারপর একদিন ইমান বাসায় আসে। নিজ চোখে দেখে ছেলেকে অত্যাচারের দৃশ্য। সেদিনই পুলিশ আলিশা আর ওর বয়ফ্রেন্ড কে ধরে নিয়ে যায়। ওরা এখনো জেলে। তারপর থেকে অহর্নিশ অন্যরকম হয়ে যায়। মেয়েদের ঘৃণা করা শুরু করে। একটু চাপা স্বভাবের হয়ে যায়। অয়ন ওর জীবনে আসলে যদিও ঠিক হয়ে যায় অনেকটা। কিন্তু মেয়েদের ওপর থেকে ঘৃণাটা সরাতে পারেনি। বিশেষ করে আমার! ইমান আমাকে অহর্নিশের খেয়াল রাখার জন্যই বিয়ে করেছিলো। ‘
অহনা থেমে গিয়ে বলল,

‘ আমার কষ্ট নেই অহর্নিশের করা ব্যাবহারে। আমি শুধু চাই ছেলেটা ভালো থাকুক। ওকে দেখে রাখিস আয়ু। আমার ছেলেটা অনেক কষ্ট সহ্য করেছে। আজ আসি! ‘
কথা শেষে ক্ষনের জন্য না দাঁড়িয়ে চটজলদি বাসা থেকে বেড়িয়ে যায় অহনা। আয়ন্তিকা দু’হাতে মুখ চেপে অশ্রুপাতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে। নিজের ডান হাতটাকে তার কেটে কুচিকুচি করে ফেলতে ইচ্ছে করছে। এ কি করলো সে?এই থাপ্পড়টা কেনো আগে সে তার গালে মারলো না?কেনো না জেনে এমন ভয়ংকার কাজটা করলো?

আয়ন্তিকা সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় অহর্নিশের রুমে। কোমল বিছানার ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে আছে অহর্নিশ। নেত্রপল্লব বন্ধ! ঘুমিয়ে পড়েছে কি?সামনে এগিয়ে গিয়ে পাশে বসতেই বোধগম্যতা পায় অহর্নিশ সত্যিই ঘুমে। আয়ন্তিকা যেই গালটায় অহর্নিশ কে দু’টো থাপ্পড় মেরেছিলো সেই গালটাতে পরাপর কয়েকটা চুমু খেয়ে নিলো সে। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো,
‘ আর কখনোই আপনাকে কষ্ট পেতে দিবো না প্রমিস। এখন থেকে আপনাকে সুখে রাখার দায়িত্ব আমার। ‘
আয়ন্তিকা অহর্নিশের পাশ ঘেঁসে শুয়ে পড়লো! তার একটা ঘুম প্রয়োজন। কান্নার করার কারণে মাথায় চাপ সৃষ্টি হয়ে ব্যাথা শুরু হয়েছে। ভীষণ ব্যাথা!

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবনে খানিকটা অস্বস্তি নিয়েই বসে আছে অহর্নিশ। শুভ্র বর্ণের টিস্যুটা দিয়ে বারংবার ললাট হতে ঘাম মুছে নিচ্ছে। এই প্রথম কোনো মন্ত্রী তাকে পারসোনালি মিট করতে ডেকেছে তাি নিজ বাসভবনে! মন্ত্রীদের সাথে মূলত তার অফিশিয়ালি কথা হতো সবসময়। এই মিটিং! সেই মিটিং! তার মাঝেই মন্ত্রীদের তার সহিত সাক্ষাৎ হতো। টুকটাক কথা চলতো। সৎ, নম্র স্বভাব এবং অল্প বয়সেই এতোটা খ্যাতি অর্জনের জন্য বেশ কয়েকজন মন্ত্রীর কাছে সে প্রিয়পাত্র!

আধাঘন্টা পেরুতেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহাদ উদ্দিনের ব্যাক্তিগত কর্মচারী এসে বলল সাহাদ তার জন্য বাগানে অপেক্ষামান। অহর্নিশ সৌজন্যমূলক হাসি দিলেও নিভৃতে সে তিক্ততা প্রকাশ করে। বাগানেই যদি সাক্ষাৎ করবে তাহলে তাকে এতক্ষণ ড্রইং রুমে বসিয়ে রাখার মানেটা কি?হু?
বাগানে যেতেই অহর্নিশ খেয়াল করে সাহাদ সাহেব বাগানে স্থাপনকৃত সোফায় বসে আছে হাসিমুখে। হাত ইশারা করে তাকে ডাকছে! অহর্নিশ পদচারণা দ্রুততর করে সাহাদের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,

‘ আসসালামু আলাইকুম স্যার। ভালো আছেন?’
সাহাদ ম্লান হাসে। পরবর্তীতে ভ্রু কুঞ্চিত রূপে প্রতিস্থাপন করে বলে,
‘ এইতো ভালো আছি! বসো তুমি। ‘
অহর্নিশ বসতে বসতে প্রতুত্তরে বলল, ‘ স্যার হটাৎ আমায় পারসোনালি ডেকে পাঠালেন?এনি প্রবলেম?’
‘ বলছি ইয়াং ম্যান! আগে বলো চা নাকি কফি?’
‘ কফি। ‘
সাহাদ একজনকে নির্দেশ দেয় কফি আনার জন্য। অতঃপর সে সটান হয়ে বসে বলল,

‘ তোমাকে ডেকেছি এক বিশেষ কারণে অহর্নিশ। কারণটা মাসুদ! সে আমার কাছে অভিযোগ করেছে তুমি বাল্যবিবাহ করেছো। ১৫ বছরের একজন মেয়েকে বিয়ে করেছো। এরজন্য সে তোমার বিরুদ্ধে মামলা করতে চাচ্ছে। এবং বলছে যেনো তোমার বিরুদ্ধে স্ট্রং কোনো স্টেপ নিয়ে তোমাকে যে করেই হোক এমপি পদ হতে সরাতে। ‘
অহর্নিশ কফি মগে চুমুক দিয়ে ভাবনা ছাড়াই বলল,

‘ স্যার এখন এতে আমার কি করার আছে?মাসুদ আপনাকে এসব বলেছে তা এখন আমি কি করতে পারি?আমাকে কেনো এসব বলছেন? মাসুদ যা বলছে তা যদি আপনার কাছে ঠিক লাগে তাহলে তা করুন। আমি বাঁধা দিবো না বা বাঁধা দেয়ার সাধ্য আমার নেই! ‘

অন্তর্লীন প্রণয় পর্ব ২৬

‘ জানি তোমার বাধা প্রদানের কোনো ক্ষমতা নেই তাই বলছি তোমার ওয়াইফ এর বর্তমান বয়স ১৭, আর ক’দিন পরই ১৮ তে পড়বে। এসবে আমার কোনো মাথাব্যাথা নেই। মাসুদ তোমাকে হত্যা করতে চেয়েছিলো অনেকবার তার নিশ্চিত কোনো না কোনো প্রমান আছে তোমার নিকট? সেই প্রমান আমার কাছে দাও। আমি ওর বিরুদ্ধে স্টেপ নিবো। মন্ত্রীর নাতী, মেয়রের ছেলে হলে কি হয়েছে? এতো বড় অপরাধী এভাবে পার পেয়ে যেতে পারেনা। তোমার ওপর আমার যথেষ্ট ভরসা আছে। তুমি আমার খুব পছন্দের একজন! আমার ছেলের মতো তাই বলছি। ‘
অহর্নিশ গভীর দৃষ্টিতে তাকায় সাহাদের দিকে। পৃথিবীতে তবে কি এখনো ভালো মানুষের অস্তিত্ব আছে? সে তো ভেবেই নিয়েছিলো তার মৃত্যু দুয়ারে! পৃথিবী একটা ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছে করছে তার। বিশেষ এক ধন্যবাদ।

অহর্নিশ রাত করে বাসায় আসে। আজ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিলো তার। বাসায় এসে নিজের সাথে থাকা চাবি দিয়ে দরজা খুলে নিয়ে লক করে চটজলদি। নিজ রুমে এসে আয়ন্তিকার পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ে। আয়ন্তিকার এক হাত আঁকড়ে ধরে বিড়বিড় করে বলল,

‘ তুমি আমার কাছে খুব বেশি স্পেশাল আয়ন্তিকা! একটু বেশিই স্পেশাল। এইযে তুমি আমার জীবনে পা রাখলে। আমার লাইফটা ফুলের মতো সুন্দর হয়ে উঠছে দিনকে দিন। আমার সাধাসিধে দুঃখে ভরা জীবনটাকে ফুলের মতো সুন্দর করা জন্য ধন্যবাদ তোমাকে। ‘
আয়ন্তিকার হাতে নিজের ওষ্ঠাধরের স্পর্শ এলিয়ে দেয় অহর্নিশ। দিনশেষে এটাই যেনো শান্তি, পূর্ণতা!

অন্তর্লীন প্রণয় পর্ব ২৮