অন্তর্লীন প্রণয় পর্ব ১৬

অন্তর্লীন প্রণয় পর্ব ১৬
সাদিয়া মেহরুজ দোলা

আয়ন্তিকা থম মেরে তাকিয়ে রইল! কিছু কঠিন কথা বলার জন্য প্রয়াস চালাতে সে ব্যার্থ হয়। আজ তার শব্দভান্ডার কেমন কেমন শূন্য শূন্য লাগছে। অধরের মাঝে ব্যাবধান সৃষ্টি করে আয়ন্তিকা গোল গোল করে চোখে তাকিয়ে আছে অহর্নিশের পানে! অহর্নিশ তা দেখে মিটিমিটি হাসে। আজকাল প্রায়ই সে এমন কথা বলে আয়ন্তিকা কে লজ্জায় ফেলে! আয়ন্তিকার লাজুক রূপ তার কাছে আসক্তির ন্যায়, দেখলে শুধু দেখতেই ইচ্ছে করে।
‘ আপনি কি রাস্তায় মেয়েদের সাথে ফ্লার্টিং করেন?’

অধর কোণে বিস্তৃত হাসি নিমিষেই মিটে যায় অহর্নিশের। আঁখিযুগল ছোট ছোট করে থতমত খেয়ে বলল,
‘ মা..মানে? কি বলছ এসব হ্যা? আমি ফ্লার্টিং করতে যাবো কেন, আমাকে দেখে কি তোমার ঐ টাইপ ছেলে মনে হয়? ‘
‘ হ্যা অবশ্যই! আপনার মতো এমন অশালীন টাইপ কথাবার্তা তারাই বলে থাকে মেয়েদের রাস্তার মাঝে। আপনিও এমন অশালীন কথা বললেন তাই মনে হলো আপনিও তাদের মতোই কাজ করেন।’
অহর্নিশ মুখ পাংশুটে করে শক্ত কন্ঠে বলল,
‘ শাট আপ আয়ন্তিকা! আমি ওমন নই। ‘

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আয়ন্তিকা মৌনতা রূপে আটস্থ হলো। তার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। বর্ষণের এই নির্মল রূপটাকে আঁকড়ে নিয়ে উপভোগ করার ইচ্ছা জন্মেছে গহীনে। অহর্নিশের কথায় তার তেমন কিছু যায় আসে না। এসব উদ্ভট কথা শুনতে শুনতে এক প্রকার অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে আয়ন্তিকা। তাই আগের মতো এখন আর তুমুল লজ্জা কাজ করেনা এসব কথা শ্রবণ করলে।

অহর্নিশ ঠোঁটের মাঝে ব্যাবধান সৃষ্টি করে কিছু বলতে নিবে তৎক্ষনাৎ তার দৃষ্টি যায় সামনের এপার্টমেন্টে। ঠিক তাদের বরাবরের ফ্লাটটাতে। পর্দার আড়ালে একজন মধ্য বয়স্ক লোক উঁকি মেরে আয়ন্তিকার দিকে লোলুপ দৃষ্টি দিচ্ছে। আয়ন্তিকার মাথা থেকে অব্দি তাকিয়ে কুৎসিত হাসি দিতেই অহর্নিশের মাথায় আগুন জ্বলে ওঠে। দাঁতে দাঁত চেপে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে সে। পরবর্তীতে আয়ন্তিকার বাহু ধরে টেনে নিয়ে রুমের ভেতর নিয়ে আসে। আয়ন্তিকা বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকায়। বিরক্তি কন্ঠে বলল,

‘ কি সমস্যা? ভেতরে আনলেন কেন, আমি আরেকটু বৃষ্টিতে ভিজতে চাই। ‘
অহর্নিশ মাথায় হাত গলিয়ে দিয়ে আয়ন্তিকার দিকে দৃষ্টি দিয়ে বলল,
‘ একদম না! আর ভেজার দরকার নেই। এন্ড আর কখনো জানো তোমাকে বেলকনিতে যেতে না দেখি। বুঝতে পেরেছো?’
অহর্নিশের রক্তিম চোখ, কঠিন স্বরে বলা কথাগুলো শুনে আয়ন্তিকা হতবাক হয়। এই অল্প সময়ের মাঝে এই লোকের আবার কি হলো? ভেবে পায়না সে। নাকি তার বলা কথায় অহর্নিশ রেগে আছে?
আয়ন্তিকা কে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অহর্নিশ গম্ভীর কন্ঠে বলল,
‘ ড্রেস পাল্টে গোসল করে আসো জলদি। ঠান্ডা লেগে যাবে। ‘
‘ যাচ্ছি! ‘

আয়ন্তিকা চলে যাওয়ার পর সিক্ত দেহ নিয়ে অহর্নিশ বেডে বসে পড়ে। ঘাড় বাকিয়ে বেলকনিতে দৃষ্টি দেয় সে। সেই লোকটার এক বন্দোবস্ত না করা অব্দি তার নিভৃতে প্রশান্তি আসবেনা কোনোমতে।ফোন আসার কর্কশ শব্দে সে উঠে দাঁড়িয়ে ফোন রিসিভ করে। অতঃপর অপাশ হতে অয়ন ক্লান্ত কন্ঠে বলল,
‘ দোস্ত সাফিয়ার লাশ থানায় দিয়া আসছি। ভিডিও সহ! এখন আর চিন্তার কোনো কারণ নাই। বাকি কাহিনি তারা দেখবে। ‘
নিভৃতে ছোট্ট শ্বাস ফেলে অহর্নিশ। শুষ্ক ঠোঁটে সিক্ততা রূপ দিয়ে বলল,

‘ ওর বাবা মাকে জানিয়েছিস?’
‘ না। পুলিশ অফিসার জানাবে। আচ্ছা শোন আমি বাসায় যাইতেসি। আর কোনো কাজ আছে?সারা কে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবো। ‘
অহর্নিশ ভ্রুকুটি কুঁচকে নিয়ে বলল,
‘ সারার কি হয়েছে? ‘
‘ কিছুনা চেকাপের জন্য। প্রেগ্ন্যাসির তিন মাস হলো আজ। ‘
অহর্নিশ ছোট্ট করে প্রতুত্তরে বলল, ‘ অহ! ‘

অয়নের সাথে আরো কিছু কথা বলে ফোন কেটে দেয় সে। মাথা ব্যাথা করছে। বৃষ্টিতে ভিজলেই তার প্রচন্ড মাথা ব্যাথা করে। তবুও আজ ইচ্ছে হলো আয়ন্তিকার সাথে সিক্ত রূপে পরিণত হতে। খানিক বাদে আয়ন্তিকা ওয়াশরুম হতে বেড়িয়ে আসে। অহর্নিশ মাথা থেকে অনায়াসে সরিয়ে নিয়ে শুষ্ক ঢোক গিলে আয়ন্তিকার মুখশ্রীর দিকে দৃষ্টিপাত স্থাপন করে। স্পষ্টত সে অনুভব করছে তার হাত পা প্রবল গতীতে কাঁপছে। কিছু নিয়ম ভেঙে অন্যায় আবদারে আড়ষ্ঠিত হতে চাচ্ছে। অহর্নিশ নিজেকে ধাতস্থ করার প্রয়াস চালায়।
আয়ন্তিকা আরেকদফা হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। আজ অহর্নিশ একটু বেশিই উদ্ভট ব্যাবহার করছে। আসলে হয়েছে কি তার? অহর্নিশের কাঁপা কাঁপি দেখে আয়ন্তিকা সামনে এগোয়। পা যুগলের পদচারণা থামিয়ে দিয়ে চিন্তিত কন্ঠে বলল,

‘ ঠিক আছেন আপনি? এমন ভাবে কাঁপছেন যে, আপনার কি জ্বর এসেছে?’
বলতে বলতেই অহর্নিশের কপালে হাত দেয় আয়ন্তিকা। অহর্নিশ তখন বলতে ইচ্ছে হলো,
‘ কপালে হাত না দিয়ে বুকের বা পাশটায় হাত দিয়ে দেখো আয়ন্তিকা। জ্বর এখানে নয় বুকের বা পাশটায় এসেছে। তোমার প্রেমে পড়ে সে শুধু জ্বর নয় প্রেম অসুখ বাঁধিয়েছে। সেই অসুখের মেডিসিন তুমি। একটিবার বুকের বা পাশে নিজের মাথাটা রাখোনা। উত্তপ্ত আভাসটা তৎক্ষনাৎ চলে যাবে। ‘
আয়ন্তিকা সন্তপর্ণে নিজের হাত সরিয়ে নেয় অহর্নিশের কপাল হতে। অতঃপর বলল,

‘ জ্বর আসেনি তো আপনার। তাহলে এমনভাবে কাঁপছেন কেনো?’
আয়ন্তিকার কথার পরিপ্রেক্ষিতে অহর্নিশের কিছু বলা হলোনা। সে নিজের কাঠিনত্যতা ফেলে আয়ন্তিকার একহাত টেনে নিজের বুকের বা পাশে রাখলো। চোখ বন্ধ করে অহর্নিশ প্রস্ফুটিত হয়ে বলল,
‘ আমার এখানটায় বড্ড যন্ত্রণা করছে আয়ন্তিকা। তাই এমন কাঁপা কাঁপি শুরু হয়েছে। ‘
আয়ন্তিকা ব্যাকুল কন্ঠে বলল,

‘ সেকি! হটাৎ বুকের বা পাশে যন্ত্রণা হচ্ছে, বেশি ব্যাথা করছে আপনার? তবে তো ডাক্তার দেখানো উচিত। আপনি জলদি ভেজা কাপড়গুলো চেঞ্জ করে আসুন। হসপিটালে যাওয়া দরকার। ‘
অহর্নিশ আয়ন্তিকা কে নিজ উষ্ণ আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে নেয়। এই কর্মের পরিপ্রেক্ষিতে আয়ন্তিকা কিছু বলল না। ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। তার চিন্তা হচ্ছে বড্ড! চিন্তায় গলা শুকিয়ে কাঠ। কেমন ধড়ফড় করছে হৃদপিন্ড। অহর্নিশ আয়ন্তিকার কাঁধে থুতনি রেখে বলল,

‘ মেডিসিন আছে বাসাতেই আয়ন্তিকা। হসপিটালে গেলে চলবে না। মেডিসিন নিতে হবে। ‘
‘ তো নিচ্ছেন না কেনো? কোথায় রাখা আছে ঔষধ? বলুন আমি এনে দিচ্ছি। ‘
অহর্নিশ হাসলো। আর কিছুক্ষন একই ভাবে থেকে হটাৎ করেই আয়ন্তিকার হতে ছিটকে দূরে সরে যায়। আজকাল নিজের কাজে সে প্রচন্ড অবাক। এখন, এই মূর্হতে আয়ন্তিকার সামনে থাকলে নিশ্চিত অতি ভয়ংকর কিছু করে ফেলবে সে। যার কারণে হয়ত তাকে সারাজীবন অনুশোচনায় ভুগতে হবে। যা অহর্নিশ চাচ্ছে না। মেইন ডোর খুলে গাড়ির চাবি নিয়ে চটজলদি বেড়িয়ে যায়। এখানে আর থাকা যাবেনা। পুরো ঘটনায় আয়ন্তিকা নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইল শুধু। হুটহাট হওয়া উদ্ভট কান্ডে সে কিছুই বুঝতে পারলো না। পরিশেষে বিড়বিড় করে বলল,
‘ এই লোকের হটাৎ করে আবার কি হলো আজিব! ‘

ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে দরজা খুলে এক প্রকার চোরের মতোন বাসায় প্রবেশ করে অহর্নিশ। সে মনে প্রাণে আল্লাহর কাছে চাইছে যেনে এই ক্ষনটায় আয়ন্তির মুখোমুখি না হতে হয়। অহর্নিশ চাচ্ছে না তা। পুরো বাসা অন্ধকার দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো সে। রাত দেড়টা বাজে! আয়ন্তিকা নিশ্চিত এতক্ষণ জেগে থাকবেনা। ঘুমিয়ে গিয়েছে হয়ত। অহর্নিশ এসেছে অনেক আগেই। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রায় ৩ ঘন্টা নিয়ে অপেক্ষায় ছিলো ১ টা বাজার।

চুপিসারে নিজের রুমে এসে ড্রেস চেঞ্জ করে অহর্নিশ। অতঃপর নিজের রুম থেকে বের হয়ে সে আয়ন্তিকার রুমে আসে। গভীর ঘুমে মগ্ন আয়ন্তি! ঘুমন্ত আয়ন্তিকার কপালে সন্তপর্ণে চুমু খায় সে। কোমল হাতদুটো নিজের ওষ্ঠদ্বয়ের ছোঁয়া আলত রূপে স্থাপন করে। এক মূর্হত বিলম্বিত না করে আয়ন্তিকার পাশে ব্যাবধান বজায় রেখে ঘুমিয়ে পড়ে অহর্নিশ।

অহনার কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে আছে আয়ন্তিকা। তার মন বিষন্ন। হৃদগহীনে সুচালো ব্যাথা অনুভব করছে একটু আধটু করে। অহনা আয়ন্তিকা কে চুপচাপ দেখে চিন্তিত কন্ঠে প্রশ্ন করলো,
‘ তোর আর অহর্নিশের মাঝে কি ঝগড়া হয়েছে আয়ু?’
আয়ন্তিকা নাক টেনে বলল,
‘ না মামি। ‘
‘ তাহলে ও তোকে এখানে রেখে গেলো যে? যাওয়ার সময় বলে গেলো তুই নাকি এখন থেকে এখানেই থাকবি। এখান থেকেই পড়াশোনা করবি। অহর্নিশ নাকি তোকে ওর বাসায় আর নিবেনা। হটাৎ এমন কথা কেন বলল অহর্নিশ? ‘

অন্তর্লীন প্রণয় পর্ব ১৫

‘ বলতে পারিনা তো আমি। ‘
আয়ন্তিকার কন্ঠ শুনে অহনা কিছুটা আচ করতে পারলো। এখানে আয়ন্তিকার কোনো দোষ নেই। পুরো দোষ তার ছেলেরই। পরিশেষে অহনা আলত হেঁসে বলল,
‘ কাঁদছিস কেনো? ‘
আয়ন্তিকা উঠে বসে বলল,
‘ সত্যি বলছি আমি মামি। আমি কিছুই জানিনা। আজ সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর উনি বললেন রেডি হতে। এখানে আসবেন। রেডি হয়ে আসার পর দেখলাম উনি আমার বই, খাতা, জামাকাপড় সব একসাথে ব্যাগে নিয়ে নিচ্ছেন। অনেকবার জিজ্ঞেস করলাম এগুলো কেনো নিচ্ছেন? তিনি উত্তরই দিলো না। আর এখানে এসে তো কথা বলারই সুযোগ হলোনা। কিছু না বলেই চলে গেলেন। ‘
অহনা আশ্বস্ত হয়ে বললেন,
‘ হয়েছে! আর কান্না করা লাগবেনা। এখানে তোর কোনো হাত নেই জানি। এখন আয় আমার সাথে। সকালে তো কিছু খাওয়া দাওয়া করিসনি। ‘

অহর্নিশ আয়ন্তিকা কে দিয়ে এসে বাসায় আসার পর হতেই তার শূন্যতা অনুভূত শুরু হলো। বুকে তীব্র ব্যাথা হচ্ছে। আয়ন্তিকা কে দূরে সরিয়ে রেখেছে কারণ সে চায়না এসব প্রেম নামক বেড়াজালে জড়াতে। সামনে কত বড় এক কাজ তার। বাঁচবে কি তা জানা নেই।অহর্নিশ দূর্বল হতে চায়না কারো প্রতি।
দিনশেষে রাত পেরুতেই অহর্নিশ আর না পেরে মিরপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। ক্ষনের মাঝে অহনার বাসায় পৌঁছে যায়। অহনা তাকে দেখে হেঁসে বলল,
‘ টিকতে পারলি না তো বেশিক্ষণ। অযথাই দিয়ে গেলি ওকে। ‘

অহর্নিশ নিচু কন্ঠে বলল,
‘ আয়ন্তিকা কই মা?’
‘ তোর রুমে আছে যায়।’
অহর্নিশ নিজের রুমে এসে দেখে আয়ন্তিকা বই নিয়ে অন্যমনষ্ক হয়ে বসে আছে। সে নিঃশব্দে এগিয়ে গিয়ে ফিচেল কন্ঠে বলল,
‘ আয়ন্তিকা? ‘

অন্তর্লীন প্রণয় পর্ব ১৭