অন্তর্লীন প্রণয় পর্ব ২৫

অন্তর্লীন প্রণয় পর্ব ২৫
সাদিয়া মেহরুজ দোলা

উসমানের সামনে স্তব্ধ রূপে দাঁড়িয়ে আছে আয়ন্তিকা। যেখানে প্রায় ২ বছর যাবৎ আয়ন্তিকা শুনে এসেছে তার উসমান মৃত্য, আজ সেই লোকটাকেই নিজের সামনে জীবিত অবস্থায় দেখে সে নিস্তব্ধতা ধারণ করেছে। বারংবার নিভৃতে সৃষ্টি হচ্ছে একটাই প্রশ্ন, ‘ তারা নানা মৃত্য হলে তার সামনে সুস্থ – স্বাভাবিক রূপে দাঁড়িয়ে আছে কি করে?’
অহর্নিশ কিছু দূর হতে পর্যবেক্ষণ করে আয়ন্তিকার বর্তমান অবস্থা। সে বুঝতে পারলো আয়ন্তিকার বর্তমান নিভৃতের ভয়ংকর প্রলয়কারী প্রশ্নবিদ্ধ গহীনকে। অয়নকে বলে নিয়ে সে সামনে এগিয়ে যায়। আয়ন্তিকার পাশে দাঁড়িয়ে খানিক নিচু হয়ে আয়ন্তিকার কানে ফিসফিস করে বলল,

‘ রিলেক্স আয়ন্তিকা! মাথায় প্রেশাড দিও না বেশি। নানা বেঁচে আছেন। তাকে এতদিন লুকিয়ে রাখা হয়েছিলো। স্পষ্ট ভাষায় যাকে ‘কিডন্যাপ ‘ বলে। ‘
আয়ন্তিকা বিষ্ফোরিত চাহনি দিয়ে অহর্নিশের দিকে দৃষ্টি দেয়। আঁখিপল্লবের ভাষায় সে আকুতি সুরে অহর্নিশ কে সবকিছু খুলে বলার জন্য অনুরোধ করে। কন্ঠনালি দিয়ে তার কিছু বলার মতো শক্তি, সামর্থ্য নেই। কেমন থরথর করে কাঁপুনি দিচ্ছে শরীর। কন্ঠনালি যেনো জমে বরফ! অহর্নিশ তাকে চোখের ভাষায় আশ্বস্ত করে বলল শান্ত হতে। সে একে একে সব বলবে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

খানিক বাদে জমিদার বাড়ির অন্দরমহল হতে টেনে হিঁচড়ে বের করে আনা হয় নাহিয় আহমেদকে। মহিলা পুলিশ তার হাতে হাতকড়া পড়িয়ে টেনে টেনে নিয়ে আসছে। তারই পিছন আসছে আয়না। চিন্তায় তার চোখমুখে ঘাম জমেছে। চেঁচিয়ে সে বলল,
‘ এই, এই! আপনারা আম্মারে এইভাবে টেনে নিয়ে যাইতেছেন ক্যান?জানেন উনি কে?জমিদার বাড়ির কর্তী উনি! ছাড়েন আম্মারে। ‘

আয়নার কথাগুলো যেনো কানেই গেলো না মহিলা পুলিশ দু’জনের। নিজেদের ওপর আরোপ করা কাজ অনুসারে তারা নাহিয়া আহমেদ কে টেনে এনে জমিদার বাড়ির ঠিক মধ্যিখানে দাঁড় করায়। আয়ন্তিকা হতভম্ব! কি হচ্ছে এসব?অহর্নিশের দিকে চাহনি দিতেই অহর্নিশ তাকে বারংবার বলছে শান্ত হতে, অপেক্ষা করতে! কিন্তু এসব দেখে কি এগুলো পালন করা যায়?

আয়ন্তিকা মৌন রূপ ধরে রাখতে না পেরে সে এগিয়ে যায় অহর্নিশের সামনে। তেজি কন্ঠে বলল,
‘ কি করছেন এসব? পুলিশ ডেকে এনে নানুকে এভাবে হেনস্তা করছেন কেনো?কি সমস্যা আপনার?’
অহর্নিশ আয়ন্তিকার হাত ধরে হেঁচকা টানে তার নিজের পাশে এনে দাঁড় করায়। চোখ গরম করে শক্ত কন্ঠে বলল,
‘ একদম চুপ থাকবা। একদম!’
আয়ন্তিকা ফের চেষ্টা করে মৌনতা পালন করতে। কারণ এখনকার অহর্নিশ কে দেখতে তার বড্ড ভয় লাগছে। কেমন হিংস্র চাহনি! উদভ্রান্তের ন্যায় তাকিয়ে ছিলো তার দিকে।

অহর্নিশের আদেশ অনুসারে জমিদার বাড়িতে অলরেডি গ্রামের সবাই উপস্থিত হয়ে গেছে। সবাই কানাঘুসা করছে। কেও কেও তো ট্যারা চোখে নাহিয়া আহমেদ এর দিকে তাকিয়ে বিদ্রুপ মন্তব্য করছেন। পুরো ঘটনায় নাহিয়া একদম চুপ! উসমান গভীর দৃষ্টিতে তাই দেখছিলেন। নিজের করা কৃতকর্মে উসমানের ইচ্ছে হয় নাহিয়ার পা ধরে মাফ চেতে। আবার নাহিয়ার করা কৃতকর্ম মনে উঠলে তার রাগ তরতর করে বেড়ে যায়!
অহর্নিশ উঠোনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে উঁচু কন্ঠে বলল,

‘ সবাই একটু আমার দিকে তাকান! আজ আপনাদের অতি একজন সম্মানিত ব্যাক্তি নাহিয়া আহমেদ এর করা কু – কর্মের বর্ণনা দিবো। সবাই একটু শুনবেন! ‘
অহর্নিশ বলা শুরু করে। নাহিয়ার করা সব কু-কর্ম একে একে বলতে থাকে। উসমানকে এতবছর আঁটকে রাখা সম্পত্তির জন্য। ছলে চাতুরে তার সাথে আয়ন্তিকার বিয়ে দেয়া বাচ্চার জন্য উইল অনুসারে। উজমার মৃত্যু কাহিনি। প্লেনের আরেক হোতা তার ছোট ভাই নুহিদ। আর্নিয়াকে ফাঁসানো! আর্নিয়ার এই প্লেনে সার্পোট করা। সবকিছু বলে ক্ষ্যান্ত হয় অহর্নিশ। কানাঘুষা করা সবাই এখন নির্বাক ভূমিকা পালন করছে। কারো মাথায় এতো প্যাচ থাকতে পারে এটা তাদের জানা ছিলোনা বোধহয়।

শাফিকেও হাতকড়া পড়িয়ে একপাশে দাঁড় করে রাখানো হয়েছে। উজমা দাঁড়িয়ে আয়ন্তিকার পাশে। শাফি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে উজমার দিকে! উজমা উপেক্ষা করে সেই দৃষ্টি। উজমা আগে থেকেই চাতুরতার সাথে অহর্নিশের সাথে যোগাযোগ করে তার অবস্থান সম্পর্কে বলেছে। অহর্নিশ তাকে খুঁজে বের করেছিলো। অতঃপর তারা ফাঁদ ফেলে শাফির জন্য! উজমা তারই জন্য ঘনিষ্ঠ হতে চায় শাফির সাথে। শাফি তার প্রতি গলে পানি হওয়ার পর উজমা চুপিসারে অহর্নিশ কে সব খবরা – খবর দিতো। শাফি জানতো উসমান কে কোথায় আঁটকে রাখা হয়েছে।

পরিশেষে পুলিশ নুহিদ, নাহিয়া এবং শাফিকে নিয়ে যায়। অহর্নিশ এসে দাঁড়ায় আয়ন্তিকার পাশে। তার দৃষ্টি আয়ন্তিকার ফ্যাকাশে মুখশ্রীর প্রতি! কেমন মনমরা হয়ে চুপসে দাঁড়িয়ে আছে আয়ন্তি! সবাইকে বলে অহর্নিশ আয়ন্তিকা কে টেনে রুমে নিয়ে আসে। সে আয়ন্তিকার কোমল গালে তার বলিষ্ঠ হাত স্থাপন করে নম্র সুরে বলল,
‘ আয়ন্তি? এমন মনমরা হয়ে আছো কেনো? দাদির করা কৃতকর্মে কি তুমি খুব বেশি আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছো?’
আয়ন্তিকা ঠোঁট কামড়ে কান্না আঁটকে বলল,

‘ মানুষ এতো খারাপ হয় কেনো?লোভের বসে তিনি এমনটা করতে পারলেন কি করে?ছোট থেকে তাকে কতো সম্মান করতাম। কতটা ভালোবাসতাম আমি! নানুও তো আমায় আদর করতো, কিন্তু.. ‘
আয়ন্তিকা কেঁদে দেয় নিভৃতে। অহর্নিশ লম্বা শ্বাস ফেলে বলল,
‘ লোভ মানুষকে অন্ধ বানিয়ে দেয়! পশুতে তৈরি করে। এমনটা দাদির ক্ষেত্রেও হয়েছে। লোভে পড়ে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছেন। তাছাড়া এখানে দাদার ও দোষ আছে। তিনি যদি দাদির প্রতি এতোটা অত্যাচার না করতো হয়তোবা এ দিন দেখতে হতো না আমাদের। ‘

আয়ন্তিকা নতজানু হয়ে অশ্রু বিসর্জন দেয়। অহর্নিশ কাছে টেনে নেয় তাকে! নিজ আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে থুতনি রাখে আয়ন্তিকার মাথার ওপর। পিঠে হাত রেখে চেষ্টা করে আয়ন্তিকার কান্না থামানোর। তবে সে বুঝি এবারও ব্যার্থ! আয়ন্তিকা অহর্নিশের বুকের কাছটার শার্ট আঁকড়ে নিয়ে নিভৃতে, বিনাশব্দে অশ্রুপাত করে।

রাতের দিকটায় নানার সাথে কথা বলে এসে আয়ন্তিকা রুমে আসে। রুমটা অন্ধকার! তবে পূর্ণিমা হওয়াতে পুরোপুরি আঁধার ছেয়ে যেতে পারেনি রুমটায়। রুম অন্ধকার দেখে ভ্রুকুটি কুঁচকে নেয় সে।অহর্নিশ কি রুমে নেই?এতো রাতে এই মানব কোথায় গেলো?
আয়ন্তিকা চাপা সুরে বলল,
‘ অহর্নিশ? আপনি কি রুমে নেই? ‘
সঙ্গে সঙ্গে বেলকনি হতে ভরাট কন্ঠে অহর্নিশ বলল,
‘ বেলকনিতে আমি আয়ন্তিক! দরজা লাগিয়ে এখানে আসো। লাইট অন করবে না। ‘

আয়ন্তিকা অহর্নিশের বলা মতোন সব কাজ সম্পূর্ণ করে বারান্দার দিকে এগিয়ে যায়। চাঁদের স্বচ্ছ আলোয় স্পষ্টরূপে সে দেখতে পেলো অহর্নিশ কে। তবে একটা ব্যাপার তাকে মূর্হতে ভারী লজ্জায় ফেললো। অহর্নিশ শার্টলেস! মাথা উঁচু করে রেলিং এ হাত রেখে সে আকাশের চাঁদটার মাঝে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রেখেছে। অহর্নিশ কে আজও আয়ন্তিকা লজ্জা পায় শার্টলেস দেখলে! অথচ গুনে গুনে তাদের সংসার জীবনের বয়স ১ বছর পার করে ফেলেছে।

‘ ওখানে দাঁড়িয়ে কেনো? কাছে আসো! ‘
আয়ন্তিকা খানিকটা অবাক হয় এগোয়। না তাকিয়ে অহর্নিশ বুঝলো কিভাবে সে দাঁড়িয়ে?তাও তার হতে দূরে?
আয়ন্তিকা এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘ আপনি বুঝলেন কি করে আমি আপনার থেকে দূরে দাঁড়িয়ে?’
অহর্নিশ সটান হয়ে দাঁড়িয়ে আয়ন্তিকার পানে দৃষ্টি দেয়। আসক্তময়ী দৃষ্টি! চোখদুটো চাঁদের পূর্ণ আলোয় কেমন নেশাটে আভাসে পরিণত হয়েছে। আয়ন্তিকা কেঁপে উঠলো খানিকটা!
‘ এটা খুবই সিম্পল! তুমি আমায় শার্টলেস দেখে নিশ্চিত নিলজ্জদের মতো দরজায় দাঁড়িয়েই হা করে তাকিয়ে ছিলে। ‘

অহর্নিশের কথা শ্রবণ করা মাত্র আয়ন্তিকা রেগে গিয়ে চেচিয়ে বলল,
‘ এই আপনি কি সবাইকে নিজের মতো নিলজ্জ ব্যাক্তি মনে করেন হ্যা? আপনি নিলজ্জ! আমি নই! যথেষ্ট লজ্জা আছে আমার মাঝে। ‘
‘ হ্যা! এতোই লজ্জা আছে যে আমি শার্ট খুললেই তোমার গালদুটো আপেলের মতো লাল হয়ে যায়। নিজের লজ্জা সামলাও। দেখা যাবে কোনো একদিন তোমার গালকে আপেল মনে করে কামড় দিয়ে খেয়ে ফেলেছি। তখন কিন্তু আমাকে দোষারোপ করতে পারবে না। ‘
আয়ন্তিকা বিড়বিড় করে বলল, ‘ অসভ্য লোক! ‘

আয়ন্তিকা বিড়বিড় করে বললেও কথাটা ঠিকই অহর্নিশের কানে এসে পৌঁছে যায়। সে হাসে নিঃশব্দে। পরিশেষে শীতল কন্ঠে বলে,
‘ এই ‘ অসভ্য ‘ বলা ছাড়া আর কিছু বলতে পারো না? বোরিং হয়ে গিয়েছি আমি এটা শুনতে শুনতে। কয়েকটা গালিও তো দিতে পারো নাকি?তোমার গালিগুলো খুব সুইট হয়! ইউনিক টাইপ। ‘ পাতিলের বাচ্চা ‘ হাউ সুইট গালি! না জাননন..?’
আয়ন্তিকা চোখ গরম করে বলল, ‘ চুপ থাকুন!’

অন্তর্লীন প্রণয় পর্ব ২৪

অহর্নিশ চুপ হয়ে যায়। তবে সে এখনো মিটিমিটি হাসছে আয়ন্তিকা থতমত খাওয়া চেহারা দেখে। আয়ন্তিকা সামনে এগিয়ে দু’হাত রেলিং রেখে কিছু ভর তার ওপর ছেড়ে দেয়। তপ্তশ্বাস ফেলে আশপাশ দেখতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে তার চক্ষুযুগল! রাতের পরিবেশটা অজান্তেই তার মনের বিশাল এক জায়গা দখল করে নিয়েছে।
ক্ষনিক বাদে আয়ন্তিকা অনুভব করে তার ঘাড়ে তপ্তশ্বাস। কিছুটা ধারলো পূর্ণ কিছু তার কাঁধে স্থাপন হয় ক্ষনমাত্র। নেত্রপল্লব বন্ধ করে নিয়ে আয়ন্তি অনুভব করে অহর্নিশের অস্তিত্ব! সে তার কাঁধে থুতনি রেখেছে যার দরুণ অহর্নিশের গালে বহমান চাপ দাঁড়িয় সুচালো খোঁচা আয়ন্তিকা অনুভব করছে এ মূর্হতে! অহর্নিশ তার দুহাত রেলিং এর মাঝে আবদ্ধ থাকা আয়ন্তিকার দুহাতের ওপর সন্তপর্ণে রেখে নিবিড় হয় আয়ন্তিকার সাথে। ফিসফিস করে কানের কাছে সে বলল,

‘ বেঁচে থেকে অসম্ভবনীয় কিছু দেখতে পারলাম। একই সাথে দু’টি চাঁদ! তবে আমায় ভূমিতে অবস্থানকৃত চাঁদটা বেশি আকৃষ্ট করছে! খুব বেশি! ‘
আয়ন্তিকা অহর্নিশের মন্তব্যটি বুঝে যায় তৎক্ষনাৎ। লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে নুইয়ে পড়ে।কিন্তু অনুভূতিটা ফিল করতে দেয়না তার নিভৃতে গড়া কিছু প্রশ্ন! শেষে আয়ন্তিকা চুপ থাকতে না পেরে চটপট কন্ঠে বলল,
‘ আপনাকে কিছু জিজ্ঞেস করার ছিলো। ‘
অহর্নিশ এই মূর্হতে আয়ন্তিকার হতে এমন কথা আশা করেনি তবুও সে নিজেকে ধাতস্থ করে বলল,
‘ কি বলবা বলো। ‘
আয়ন্তিকা শুকনো ঢোক গিলে নম্র কন্ঠে বলল,

‘ শুরুর দিকটায় আপনি আমায় বিয়ে করেছিলেন কারণ শুধুমাত্র নানার জন্য। তখন তো এসবের কিছু সম্পর্কেই আপনি অবগত ছিলেন না। নানাকে উদ্ধার করতে আমায় আপনার বিয়ে করা। তবে নানা তো এখন উদ্ধার হয়েছে। আপনি কি তবে আমায় এখন ডির্ভোস দিয়ে দিবেন অহর্নিশ?’

অন্তর্লীন প্রণয় পর্ব ২৬