অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ১১

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ১১
লেখিকা: অনিমা কোতয়াল

রুদ্র নামক এই পাষাণ মানুষটাকে সাধারণত বাধ্য হতে কিংবা চমকাতে দেখা যায়না। সবার ধারণা বাধ্যবাধকতা কিংবা চমক জিনিসটা রুদ্রের জন্যে তৈরী হয়নি। কিন্তু একটা মানুষের সামনেই রুদ্রের এই দুটো অনুভূতিই বেরিয়ে আসে। তাকে বাধ্য করতে কিংবা চমকে দিতে একমাত্র রাশেদ আমের নামক মানুষটাই পারে। রাশেদের কথাটা শুনে নিঃসন্দেহে রুদ্র ভীষণভাবে চমকে উঠেছে। কারণ বিশেষ কোন প্রয়োজন না পড়লে রাশেদ নিজের হাতে খুন করেনা। এমন কী প্রয়োজন পড়ল? মুহূর্তের মধ্যেই নিজেকে একদম স্বাভাবিক ফেলল। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে বলল, ‘কেনো?’

রাশেদ আমের কিছু বলল না। রুদ্র বুঝতে পারল রাশেদ একটু সময় নিয়ে বলতে চাইছে। সে অপেক্ষা করল। রাশেদ বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে সোজা হয়ে বসল। একটা সিগারেট জ্বালিয়ে ঠোঁটের মাঝে নিল। নিরুৎসুক দৃষ্টিতে রুদ্রের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘সম্মানীয় গুপ্তচর ছিল সে। সবুজ আর খোকনের মতোই। যদিও ব্যপারটা আগেই আন্দাজ করতে পেরেছিলাম আমি। ভেবেছিলাম তোমায় কিংবা ইকবালকে বলব। কিন্তু সম্ভবত ওর কপালে সহজ মৃত্যু লেখা ছিল। তাইতো তোমার কানে খবরটা পৌঁছে যাওয়ার আগেই আমাদের বৈঠকঘরে ঢুকে পেনড্রাইভ আর ফাইল চুরি করছিল।’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

রুদ্র ভ্রু কোঁচকালো। একটু ভেবে বলল, ‘ও একা ভেতরে ঢুকল কীকরে? করিডরে তো আটকে দেওয়ার কথা।’
‘সম্ভবত পূর্ব পাশের দেয়াল দিয়ে বারান্দা টোপকে ঢুকেছিল। অনেকদিন সময় নিয়ে পরিকল্পনা সাজিয়েছে। তুমি বাড়ি ছিলেনা, সেই সুযোগে রাতের মধ্যে ওগুলো চুরি করে এখান থেকে সরে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল।’

চোয়াল শক্ত হয়ে উঠলো রুদ্রর। সে অবাক হচ্ছে রাশেদকে এতো নির্বিকারভাবে কথাগুলো বলতে শুনে। রক্ত গরম করে দেওয়া কথাগুলো রাশেদ এতো শান্ত, নির্বিকার থেকে বলে কীকরে? রাশেদ আবার বলতে শুরু করল, ‘স্বপনের দুর্ভাগ্য ছিল সৌভাগ্যও বলতে পারো যে ঐসময় আমি গিয়েছিলাম ঐ ঘরে আমার ডায়েরিটা নিতে। ওর সত্যিটা জানা থাকলেও এখনই এতোটা সাহস করে ফেলবে ভাবতে পারিনি আমি। আমাকে দেখে চমকে উঠেছিল। হয়তো দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারেনি ঐসময় আমি গিয়ে উপস্থিত হব ওখানে। বুঝতে পেরেছিলাম যে ওকে এক মুহূর্তের জন্যে জীবিত ছেড়ে দিলে আমাদের পরবর্তী প্রজেক্টের ইনফরমেশন অন্য গ্রুপের কাছে অবশ্যই চলে যাবে। আর সেটা হলে কতবড় ক্ষতি হতো তা তোমার অজানা নয়। তাই বাধ্য হয়ে টেবিলের ঝুড়িতে রাখা ছুরিটা সোজা ওর গলায় চালিয়ে দিয়েছি। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই শেষ হয়ে গেছে। ইকবালকে বলেছিলাম লাশটা ফেলে দিয়ে আসতে। ওই হয়তো লোক দিয়ে লেকের পাশে ফেলে দিয়ে এসছিল লাশটা।’

সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে রাশেদ নির্বিকারভাবে বর্ণনা করল তার করা এক হত্যাকাণ্ড। রাগে রুদ্রর শিরা ফুলে উঠছে। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দাঁতে দাঁত চেপে বসে আছে সে। ঐ বিশ্বাসঘাতকটাকে নিজের হাতে মারতে না পারার জন্যে চরম আফসোস হচ্ছে। এতো সহজ মৃত্যু স্বপনের পাওনা ছিল না। পারলে এখন মৃত স্বপনকে জীবিত করে আবার নির্মমভাবে হত্যা করতো সে। কিন্তু সেটা আর সম্ভব নয় ভাবলেই শরীর জ্বলে উঠছে যেন। রাশেদ বলল, ‘আমরা হত্যা করি শুধুমাত্র প্রয়োজন পড়ে তাই। নিজেদের হিংস্রতা জাহির করার জন্যে নয় রুদ্র। কতবার বোঝাবো এটা তোমাকে?’

রুদ্র কিছু বলল না। শুধু ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলল। রাশেদের এই উপদেশ যে রুদ্রর ওপরে কোনরকম কোন প্রভাব ফেলেনি সেটা যেন রাশেদ নিজেও বুঝতে পারল। তাই প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, ‘তুমি বোধ হয় কিছু বলতে এসেছিলে।’
রুদ্র এবার শান্ত হলো। যা হওয়ার হয়ে গেছে। এবার ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। বলল, ‘ওদের সাথে আরও কেউ আছে বাবা। আমাদের সাবধান হতে হবে।’

‘ আরও একজন আছে।’
‘ একজন?’ চমকে উঠল রুদ্র। সঙ্গে সঙ্গে ভেতরের হিংস্র সত্ত্বাটা বেড়িয়ে আসতে চাইল ওর। ক্রোধে জ্বলে উঠল চোখ দুটো। দাঁতে দাঁত চেপে জিজ্ঞেস করল, ‘কে সে?’
‘ তিনজন আছে সন্দেহের তালিকায়। কে সেটা নিশ্চিতভাবে বলতে পারছিনা আমি। তবে তিনজনের মধ্যেই যে একজন সেটা নিশ্চিত। তপু, আক্কাস, জালাল। এদের মধ্যে কে সেটা বের করার দায়িত্ব তোমার।’

রুদ্র বাঁকা হাসল। স্বপনকে না মারতে পারার আফসোস এবার এদের মধ্যে কোন একজনকে মেরে মেটাতে পারবে। রুদ্র উঠে চলে যেতে নিলে রাশেদ বলল, ‘ আর হ্যাঁ, ইন্সপেক্টরকে এতো হালকাভাবে নিওনা সবসময়। আত্মবিশ্বাস থাকা ভালো, কিন্তু অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস ধ্বংসের কারণ হতে পারে। যা করবে ঠান্ডা মাথায় করবে।’
রুদ্র মাথা নেড়ে বেরিয়ে গেল রাশেদের ঘর থেকে। রুদ্রর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল রাশেদ। এরপর আবার চেয়ারে গা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল সে।

‘ কী বলছিস কী ভাই? আরও একটা শু*র আছে দলের মধ্যে?’
অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল উচ্ছ্বাস। রুদ্র কিছু বলল না। আপনমনে সিগারেট টেনে যাচ্ছে। রোজ রাতের মতো আজও ইউনাইটেড হসপিটালের পাশের রাস্তায় জিপের ওপর বসে সিগারেট টানছে দুজন। রুদ্রের কোন জবাব না পেয়ে উচ্ছ্বাস আবার বলল, ‘বুঝবি কীকরে তিনজনের মধ্যে বেইমানটা কে? কোন প্লান করেছিস?’

রুদ্র এবারেও কিছু বলল না। তার দৃষ্টি আকাশের দিকে স্হির। উচ্ছ্বাস বুঝল এই ছেলে এখন গভীরভাবে কিছু ভাবছে। পেটে বম্ব ফাটলেও এখন এর মুখ দিয়ে কোন কথা বেরোবে না। কিন্তু সবসময় আকাশের দিকে তাকিয়ে কী ভাবে সে? বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে সিগারেট টানাতে মনোযোগ দিল সে। কিছুক্ষণ পর খেয়াল করল হসপিটালের সামনে একটা রিকশা এসে থামল। রিকশা থেকে নেমে এলো নাজিফা। কালো রঙের হ্যান্ড ব্যাগটা থেকে একটা নোট বের করে রিকশাওয়ালার দিকে বারিয়ে দিল। বাকি টাকাটা ফেরত নেওয়ার জন্যে অপেক্ষা করতে করতে একটা বিরক্তিমিশ্রিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল উচ্ছ্বাসদের দিকে। মুহূর্তের মধ্যে সে দৃষ্টি ফিরিয়েও নিল। বরাবরের মতো এবারেও উচ্ছ্বাস হাসার একটা ব্যর্থ চেষ্টা করেছিল। নাজিফা টাকাটা নিয়ে এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে হনহনে পায়ে চলে গেল হসপিটালের মধ্যে। উচ্ছ্বাস হাতের ঘড়িতে সময় দেখে বলল, ‘আজ নাইট ডিউটি পড়েছে বোধহয়।’

‘ আমার মনে হয় মেয়েটাও তোকে পছন্দ করে।’ এতক্ষণে মুখ খুলল রুদ্র।
চোখ বড় বড় হয়ে গেল উচ্ছ্বাসের। রুদ্রের কথাটা ঠিক হজম হলোনা তার। উত্তেজনায় অস্হির হয়ে বলল, ‘কেনো? তোর এমন মনে হল কেন?’
‘ মেয়েটার চোখে তোর জন্যে তীব্র বিরক্তি দেখেছি আমি।’
‘ তো এতে তো অপছন্দ করা বোঝালো। পছন্দের কী দেখলি এখানে?’ হতাশ হয়ে বলল উচ্ছ্বাস।
রুদ্র এবার সরাসরি উচ্ছ্বাসের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মেয়েটার সাথে এর আগে কখনও কথা হয়েছে তোর?’

‘ না, হয়নি।’
‘ পূর্ব পরিচয় আছে কোনভাবে?’
‘ কোনভাবেই না।’
‘ ওকে কোনভাবে ডিসটার্ব করেছিস? রাস্তাঘাটে কিংবা অন্যভাবে?’
উচ্ছ্বাস একপ্রকার বিষম খেয়ে বলল, ‘ নাউজুবিল্লাহ! নির্বিকারভাবে খুন করার সাহস আমার আছে। কিন্তু এই সাহস নাই ভাই। এই মেয়ে শুধু মেয়ে না, ঝাঁসির রাণী। তাছাড়া রাশেদ বাবা জানলে আমার ঠ্যাং ভেঙ্গে ঘরে বসিয়ে দিয়ে বলবে, বাছাধন এবার ঘরে বসে বিশ্রাম করো। বাহিরের জগৎ তোমার জন্যে নয়।’

হেসে ফেলল রুদ্র। সিগারেটটা নিচে পেলে পা দিয়ে পিষতে পিষতে বলল, ‘ তাহলে মেয়েটা তোর প্রতি শুধুশুধু বিরক্ত হতে যাবে কেন? তোর দিকে তাকায়ই বা কেন? বিরক্তি সবসময় অপছন্দের মানুষটার ওপরেই আসতে হবে তার কোন মানে নেই। পছন্দের মানুষটা যখন অপছন্দের কাজ করে তখনও বিরক্তি আসে।’
উচ্ছ্বাস ভ্রু তুলে জিজ্ঞেস করল, ‘তারমানে তুইও জ্যোতিকে পছন্দ করিস? তাই এতো বিরক্তি?’

রুদ্র কিছু বলল না। আবার তারায় ভরা আকাশের দিকে তাকাল। চোখের সামনে স্পষ্ট ভেসে উঠল জ্যোতির মুখ। তার পাগলামো, কাঁদা, হাসা সবকিছুই। নিজের মনকে একবার প্রশ্ন করল ‘পছন্দ করিস জ্যোতিকে?’ কিন্তু বরাবরের মতোই মন নিশ্চুপ রইল। কোন উত্তর দিলোনা রুদ্রকে। রুদ্রর উত্তর না পেয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল উচ্ছ্বাস। দুটো চোখ মেলে চাইল আকাশের দিকে। প্রেম-ভালোবাসা কী সত্যিই তাদের জন্যে? তারা যে দুনিয়ায় নিজেদের জড়িয়েছে সেখানে প্রেম-ভালোবাসা নামক এসব অনুভূতিকে স্হান দেওয়া উচিত? কিন্তু মনটা যে মাঝেমাঝে ভীষণ অবুঝ আচরণ করে। কিছুতেই মানতে চায়না এই নিষ্ঠুর বাস্তবতা।

আরও একটা সিগারেট শেষ করে ওরা চলল নাইট ক্লাবের উদ্দেশ্যে। মদের নেশা জেগেছে। মাঝরাত অবধি ওখানেই কাটাবে। রাত আড়াইটার পর ক্লাব থেকে বেরিয়ে এলো রুদ্র আর উচ্ছ্বাস। অভ্যাস আছে তাই হুইস্কি তেমন কাবু করতে না পারলেও ক্লান্তি বেশ কাবু করে ফেলেছে তাদের। বাড়ি গিয়ে টানটান হয়ে শুয়ে পড়বে বিছানায়। রুদ্রের আজ বাড়ি ফেরার কোন ইচ্ছে ছিলোনা। ক্লাবের ওপরের তলার রুমটা তৈরী করে রাখাই ছিল তার জন্যে, সাথে রাতের সঙ্গিনীও। কিন্তু পরে আর তেমন কোন ইচ্ছে হলোনা তার। আজ নিজের ঘরে গিয়ে শান্তিতে ঘুমোনোটাই বেশি ভালো মনে হল।

অগ্রহায়ণ মাস। যার আরেক নাম মার্গশীর্ষ। বাংলা বছরের অষ্টম মাস হলেও একসময় অগ্রহায়ণ-ই ছিল বছরের প্রথম মাস। শীত ঋতুর ঠিক আগের মাস বলে ঠান্ডার আমেজ অগ্রহায়ণ থেকেই চলে আসে। রাত তিনটায় প্রায় ফাঁকা রাস্তা দিয়ে গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফিরছে রুদ্র আর উচ্ছ্বাস। নিরবিলি ফাঁকা রাস্তা সোডিয়ামের আলোয় চমৎকার লাগছে। সাথে ঠান্ডা হাওয়া আর মেঘলা আকাশ। উচ্ছ্বাসের বেশ ভালো লাগছে এই পরিবেশ। এখানেই রাতটা থেকে যেতে ইচ্ছে করছে।

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ১০

কিন্তু রুদ্রকে বলার সাহস করে উঠতে পারছেনা। কারণ রুদ্রের মুখভঙ্গি দেখে বোঝার উপায় নেই তার ভালো লাগছে নাকি খারাপ। হঠাৎ করেই রুদ্রর কাছে কেমন অস্বাভাবিক মনে হল গাড়িটা। অদ্ভুত এক অনুভূতি হল। অবচেতন মন তাকে বারবার সাবধান করে দিতে লাগল কোন আসন্ন বিপদের থেকে। কিছুক্ষণ অস্হির হয়ে ভাবল রুদ্র। উচ্ছ্বাসের সেদিকে কোন খেয়াল নেই সে প্রকৃতিকে অনুভব করতে ব্যস্ত। কিছু একটা ভেবে ব্রেক চাপার সাথেসাথেই স্হির হয়ে গেল রুদ্র। কয়েক সেকেন্ডের জন্যে স্তব্ধ হয়ে গেল সে। ব্রেক কাজ করছে না!

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ১২