অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৩৫

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৩৫
লেখিকা: অনিমা কোতয়াল

প্রিয়তাদের ছোট রুমটাতে পিনপতন নিরবতা। রুদ্র চেয়ারে পায়ে পা তুলে বসে আছে। থুতনিতে হাত রেখে তাকিয়ে আছে প্রিয়তার দিকে। প্রিয়তা পা নামিয়ে বসে আছে বিছানায়। গভীর মনোযোগ দিয়ে কিছু ভাবছে মেয়েটা। মাঝেমাঝে আড়চোখে তাকাচ্ছে রুদ্রর দিকে। কিন্তু প্রতিবারই সঙ্গে সঙ্গে চোখ ফিরিয়ে নিতে হচ্ছে। কারণ রুদ্র ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। ফলে চোখাচোখি হয়ে যাচ্ছে বারবার।

মীরা আসাম করে বসে তাকিয়ে আছে দুজনের দিকে। পুরো ব্যাপার মাথার অনেকটা ওপর দিয়ে চলে গেছে ওর। সন্ধ্যার দিকে হঠাৎই রুদ্র এসে হাজির হলো এখানে। কেন এসেছে জিজ্ঞেস করেও কোন উত্তর পায়নি মীরা। এমনিতেই রুদ্রর ওপর ভীষণ রেগে ছিল ও। তারওপর এমন হু কেয়ারস্ এটিটিউড! বারোটা দিন প্রিয়তাকে গুমরে গুমরে কষ্ট পেতে দেখেছে। আড়ালে কাঁদতেও দেখেছে। ইচ্ছে ছিল কোনদিন সামনে পেলে ইচ্ছেমতো ঝেড়ে দেবে রুদ্রকে। কিন্তু সামনাসামনি দাঁড়িয়ে একটা কথা বলারও সাহস হয়নি ওর। দেখলেই কেমন গলাটা শুকিয়ে আসে। আওয়াজ-ই বের হতে চায়না, বকা দেওয়া তো অনেক দূরের কথা। সরাসরি বকতে না পেরে রান্নাঘরে রান্না করতে করতে একা একাই রুদ্রর চৌদ্দ গুষ্ঠি উদ্ধার করছিল মীরা। সঙ্গে প্রিয়তাকেও ছেড়ে দেয়নি। এতো মানুষ থাকতে শেষে কি-না একটা গ্যাংস্টারের প্রেমে পড়ল! বলদ মাইয়া! হঠাৎ কারো কথাবার্তার আওয়াজ শুনতে পেয়ে ভেতরে এসে দেখে প্রিয়তা চলে এসছে। এরপর একঘণ্টা কেটে খেল। এদের দুজনের টুকটাক কথাবার্তা আর নিরব ঝগড়া থেকে যেটুকু বুঝতে পারল তার সারমর্ম এই যে, রুদ্র সেই গুলশান থেকে চট্টগ্রাম ছুটে এসেছে প্রিয়তাকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে। কিন্তু প্রিয়তাও নাছোড়বান্দা। ও যাবেনা রুদ্রর সঙ্গে। যে লোকটা একবার ওকে আগাছার মতো জীবন থেকে ছেটে ফেলতে পেরেছে, সে যে আবার একই কাজ করবে না তার কী গ্যারান্টি? তাছাড়া ওরও তো আত্মসম্মান বলে কিছু আছে না-কি? যখন ইচ্ছে হবে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেবে, আবার যখন ইচ্ছে হবে কাছে টেনে নেবে। মগের মুল্লুক!

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

কিন্তু রুদ্র তার চেয়েও কয়েক কাঠি ওপরের নাছোড়বান্দা। প্রিয়তাকে না নিয়ে সেও এখান থেকে নড়বেনা। যেন পণ করেই এসেছে সে।
দীর্ঘ সময়ের নিরবতা ভেঙ্গে প্রিয়তা যান্ত্রিক কন্ঠে বলল, ‘আপনি এখনো এখানে বসে আছেন কেন?’
রুদ্র শুরুতেই উত্তর না দিয়ে চুপচাপ কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল প্রিয়তার দিকে। তারপর থুতনি থেকে হাত নামিয়ে শিরদাঁড়া সোজা করে বসে বলল, ‘আমি আগেও বলেছি তোমাকে না নিয়ে আমি এখান থেকে যাচ্ছিনা।’
‘ আমি কোথাও যাবোনা আপনার সাথে।’
‘ ফাইন। তাহলে আমিও উঠছি না। তোমার এই ঘরটা মন্দ লাগেনি আমার। কয়েকটা দিন আরাম করে কাটিয়ে দেওয়া যাবে।’
প্রিয়তা বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকাল রুদ্রর দিকে। মেজাজ ভীষণ খারাপ হল ওর। বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আপনি কেন বুঝতে পারছেন না বাইরে আপনার পাঁচজন লোক দাঁড়িয়ে আছে, ভেতরে আপনি। বাড়িওয়ালি আন্টি জানতে পারলে এক্ষুনি ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেবে আমাদের। এমনিতেই নানারকম ঝামেলার মধ্যে আছি। আর ঝামেলা বাড়াবেন না। প্লিজ চলে যান। কেন অশান্তি করছেন?’

সকৌতুকে প্রিয়তার দিকে তাকাল রুদ্র। উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘এইজন্যইতো বলছি আমার সাথে চলো। আমার সাথে গেলে কোন আন্টির কথাও শুনতে হবেনা আর কোন ঝামেলাও থাকবেনা। আমি কোথায় তোমাকে শান্তিতে রাখার চেষ্টা করছি, আর তুমি বলছো আমি অশান্তি করছি? নট ফেয়ার সুইটহার্ট!’
‘আমি মজা করছিনা আপনার সঙ্গে।’
‘ আমিও না। আ’ম ভেরী সিরিয়াস।’
কথাটা বলে আবার নিজের চেয়ারটা টেনে বসে পড়ল রুদ্র। টেবিল থেকে একটা বই নিয়ে পাতা উল্টাতে শুরু করল যেন কিছুই হয়নি। সবকিছুই স্বাভাবিক। ব্যপারটাকে আরও কৌতুকপূর্ণ করতে মীরা বলে উঠল, ‘দুলাভাই, ডিম পোজ খাবেন নাকি ভাজব?’
রুদ্র চোখ তুলে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল, ‘পোজ।’
রাগে দুঃখে কান্না পেয়ে গেল প্রিয়তার। এতো সিরিয়াস একটা ব্যপারকে সার্কাস বানিয়ে রেখে দিয়েছে এরা। অসহ্য! ও নিজেও কড়াভাবে রুদ্রকে কিছু বলতে পারছেনা। মন চাইছে কঠোর, তিক্ত কিছু বাণী শুনিয়ে, অপমান করে, দূর দূর তাড়িয়ে দিতে রুদ্রকে। কিন্তু পারছেনা। চেষ্টা করেও পারছেনা।

মীরার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে প্রিয়তা। পারলে এক্ষুনি চোখ দিয়েই ভস্ম করে দিতো। মীরা ঘন ঘন ঢোক গিলছে প্রিয়তার দৃষ্টি দেখে। কখন বো’মা ফাটে কে জানে? রাতের খাবার খেয়ে একটু আগে বেরিয়েছে রুদ্র। সিগারেট খেতে। এই সুযোগেই দুই বান্ধবী নিজেদের মধ্যকার আলাপ আলোচনা সেরে নিচ্ছে।
মীরা মোটা ফ্রেমের চশমাটা ঠিক করে বলল, ‘ আমার দিকে এভাবে তাকাচ্ছিস কেন বোন? আমি কী করছি?’
প্রিয়তা তেঁতে উঠল মীরার কথায়। একটা বালিশ ছুড়ে দিয়ে বলল, ‘ “দুলাভাই, ডিম পোজ খাবেন নাকি ভাজব?” এক চড়ে সবগুলো দাঁত ফেলে দেব বেয়াদব। কোন কালের দুলাভাই লাগে তোর?’
মীরা অবাক হওয়ার ভান করে বলল, ‘ বাহ রে! তুই একটা গ্যাংস্টারের সাথে একমাস থাকতে পারিস, তার প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে রাতের পর রাত বালিশ ভেজাতে পারিস। আর আমি দুলাভাই বললেই দোষ?’
প্রিয়তা ইতস্তত করল কয়েক সেকেন্ড। বলল, ‘ ওসব পাস্ট।’
মীরা দাঁত বের করে হেসে বলল, ‘ থাক! আর জোকস্ মারিস না। পাস্ট, প্রেজেন্ট, ফিউচার সব লজ্জা পাবে তোর ‘পাস্ট’ শুনে। আগেই বলেছিলাম আর যাই হোক কোন ক্রিমিনালের প্রেমে পিছলে যেও না। পালানোর রাস্তা পাবেনা। এবার ঠ্যালা সামলাও।’

প্রিয়তা অসহায় চোখে তাকাল মীরার দিকে। ও কীরকম মিশ্র অনুভূতিতে ভুগছে শুধুমাত্র ও-ই জানে। রুদ্রর সঙ্গে যাওয়ার ইচ্ছে আছে ওর। কিন্তু এতো রাগ অভিমানের ভীড়ে সেই ইচ্ছেটা কেমন পানসে লাগছে। তিক্ত হয়ে উঠছে সবকিছু।
হঠাৎই দরজা ঠেলে কেউ একজন ভেতরে প্রবেশ করল। চমকে দরজার দিকে তাকাল প্রিয়তা আর মীরা। বাড়িওয়ালি মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন। রুদ্র বাইরে আছে তাই দরজা ভিড়িয়ে রেখেছিল। সিটকানি লাগায় নি। ওরা কিছু বলার আগেই মহিলা কাঠ কাঠ গলায় বলল, ‘শোন, তোমাগো কাছে যা যা ভাড়া পাওনা আছে তাড়াতাড়ি দিয়া দাও। অ‍্যাক্ষনই দিবা। কাইলকের মইধ্যে ঘর ছাড়বা। অনেক দেখছি আর না।’
প্রিয়তা এই ভয়টাই পাচ্ছিল এতক্ষণ। এই মহিলার চক্ষুশূল হয়ে উঠেছে ও ইদানিং। এবার কী হবে? প্রিয়তা উঠে দাঁড়িয়ে কোনরকমে নিজেখে সামলে বলল, ‘ কী হয়েছে আন্টি? কী করেছি আমরা?’
প্রিয়তার প্রশ্ন শুনে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল মহিলা। দু পা এগিয়ে এসে ঝাঝালো কন্ঠে বলল, ‘ আগেও কইছি তোমাগো। এইডা ভদ্দর মাইনসের বাড়ি। তোমাগো নষ্টামি করার জায়গা না। আগে আছিল ঐ এক ছোকরা। আর এখন আরেকজন জুটাইছো। পারোও তোমরা। নষ্টপাড়া বানাই ফেলছে বাড়িটারে। তাড়াতাড়ি টাকা বাইর করো। আর কালকে জানি এই বাড়িতে না দেখি তোমাগো।’

প্রিয়তা বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল। এরকম জঘন্য কথায় কান গরম হয়ে উঠেছে ওর। কান্না পাচ্ছে। মীরার মেজাজ তুঙ্গে উঠে গেল এসব কথা শুনে। কোমরে হাত দিয়ে বলল, ‘আজব তো! কিছু না জেনেই এরকম নোংরা কথা বলছেন কেন?’
প্রিয়তা হাত ধরে মীরাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘ আন্টি আমাদের কাছে এখন এতো টাকা নেই। এই মাসটা শেষ হতে দিন আমরা এমনিতেও চলে যাবো। চলতি মাসে আমরা এখন কোথায় যাবো বলুন?’

নিজের কন্ঠস্বরই কেমন অচেনা লাগল প্রিয়তার কাছে। কান্নায় গলা ধরে আসছে। কেঁপে উঠতে আওয়াজ। মীরা রাগে গজগজ করছে। মহিলা মুখ ঝামটা দিয়ে বলল, ‘হেইডা আমার বাড়িতে এইসব কান্ড করার আগে মনে আছিল না? বাইরে ঐ লোকগুলা দাঁড়াইয়া রইছে কেন? সবগুলারেই তো গুন্ডা মনে হইতাছে। ছিহ্! বাড়িটারে ধান্দার জায়গা বানাই ফেলছে। এইজন্যই গার্জেন ছাড়া মাইয়া, পোলা বাড়ি ভাড়া দেওন নাই। কান ধরছি ফেমলি ছাড়া আর যদি ভাড়া দিছি।’
বলে শাড়ির আঁচলে মুখ চেপে ধরলেন মহিলা। যেন ওরা কোন নোংরা আবর্জনা। লজ্জায়, অপমানে চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল প্রিয়তার। কিন্তু তাতে মহিলার দয়া হলোনা। নির্দয় হয়ে বলল, ‘ এসব ন্যাকাকান্না বাইরে গিয়া করো। এসব করার লাইগা নষ্টগলী আছে, সস্তা হোটেলও আছে। আমার বাড়ি ছাড়ো বাপু। আর বাইরের ওগুলারে ভাগাও। অক্ষনি। আর আমার টাকা দাও। নাইলে পুলিশে ফোন করমু কিন্তু।’

‘ কত টাকা পান আপনি?’
গম্ভীর, থমথমে কন্ঠস্বরে কেমন নিস্তব্ধ হয়ে গেল ঘরটা। কেঁপে উঠল মহিলা। ভয়ে নয়। স্বরটাতেই কিছু একটা ছিল যাতে পশম দাঁড়িয়ে গেছে ওনার। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই নিজেকে সামলে নিল। বুঝলো এই মেয়ের সেই নাগর এসেছে। ছেলেটাকেও কয়েকটা শুনিয়ে দেওয়ার বাসনা নিয়ে পেছন ঘুরে তাকাল। কিন্তু তাকাতেই ফাটা বেলুনের মতোই চুপসে গেল। এতক্ষণ জঘন্য শব্দে বকবক করে যাওয়া মুখটা কথা বলতেই ভুলে গেল। কারণ দরজার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রুদ্র আমের। সেটা মহিলার ভয়ের কারণ নয়। মহিলার ভয়ের কারণ রুদ্রর হাতে ধরে রাখা এম টি 608 পিস্তল। খুব স্বাভাবিকভাবে ধরে রাখলেও পিস্তলের মুখটা সোজা মহিলার গলার দিকে তাকিয়ে আছে। যেটা একটু ভালোভাবে খেয়াল করে বুঝতে পারল প্রিয়তা আর মীরা।
রুদ্র জুতোয় ঠক ঠক আওয়াজ করে আস্তে আস্তে এসে দাঁড়াল মহিলার সামনে। শান্ত কিন্তু গম্ভীর গলায় আবার জিজ্ঞেস করল, ‘ কত পাওনা আছে?’

ইতিমধ্যে ঘেমে গেছে মহিলা। হাত পা কাঁপছে। কিন্তু রুদ্রর ভয়ে কোনমতে উচ্চারণ করল, ‘ ন্ নয় হাজার।’
রুদ্র পকেট থেকে ফোন বের করে কাউকে কল লাগালো। বলল, ‘ রঞ্জু! দশ হাজার টাকা নিয়ে ভেতরে আয়। এক্ষুনি।’
দূই মিনিটের মধ্যে রঞ্জু প্রায় দৌড়ে ভেতরে এলো। হাতে টাকা। রুদ্র টাকাটা নিয়ে ইশারা করতেই আবার একইভাবে দৌড়ে চলে গেল রঞ্জু। রুদ্র টাকাটা নিয়ে তাকাল মহিলার দিকে। তার তীক্ষ্ম চোখজোড়া দেখে আবারও কেঁপে উঠলেন মহিলা। ভয়ে এখনো কাঁপছে সে। পি’স্ত’ল জিনিসটা সামনাসামনি এর আগে কখনও দেখেনি হয়তো। রুদ্র টাকাগুলো মহিলার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘ এক হাজার এক্সট্রা আছে। ওটা ভিক্ষা ধরে নিন। এখন চুপচাপ নিজের ঘরে যান। মহিলা বলে ছেড়ে দিচ্ছি। পরেরবার ওদের সাথে কথা বলার সময় ভেবেচিন্তে বলবেন। এবার টাকা বেরিয়েছে, কিন্তু পরেরবার আমার পিস্তল থেকে বুলেট বের হবে। আর হ্যাঁ, পুলিশকে ফোন করে আমার কিচ্ছু করতে পারবেন না আপনি। কিন্তু সেই বাড়তি সাহসটা দেখালে আপনাকে জীবিত রেখে যাবনা আমি। বোঝা গেছে?’

মহিলাটি রুদ্রর হাতে ধরে রাখা পিস্তলের দিকে তাকাল একবার। এরপর চাবি লাগানো পুতুলের মতো দ্রুত গতিতে ওপর নিচ মাথা ঝাকালো। রুদ্র পিস্তল দিয়ে ইশারা করল ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ায় জন্যে। মহিলা একপ্রকার প্রাণ নিয়ে পালালো।
রুদ্র দরজা বন্ধ করে সিটকানি লাগালো। পেছনে তাকিয়ে দেখে প্রিয়তা আর মীরা পাশাপাশি মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। দু চোখ ভর্তি বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। রুদ্র ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে দরজায় হেলান দিল। হাতে রাখা পিস্তলটা নাড়াচাড়া করতে করতে প্রিয়তাকে বলল, ‘ হোয়াট এবাউট ইউ ডার্লিং? আপনাকেও বু’লে’টের ভয় দেখাতে হবে? নাকি ভালোয় ভালোয় সঙ্গে যাবেন?’

ঘোর থেকে বেরিয়ে এলো প্রিয়তা। মাসখানেক আগে হলে হয়তো ভয় পেতো। কিন্তু একমাস রুদ্রর সঙ্গে থেকেছে ও। অব্যক্ত হলেও গভীর প্রনয়ের কিছু চমৎকার মুহূর্ত কাটিয়েছে ওরা একসঙ্গে। তাই রুদ্র ওকে মেরে ফেলবে সেই ভয় পাওয়ার মতো বোকা মেয়ে প্রিয়তা নয়। কিছুক্ষণ আগের ঘটনা মনে পড়তেই চোয়াল শক্ত হয়ে এলো ওর। চোখ মুছে এগিয়ে গিয়ে সোজা রুদ্রর কলার বলল, ‘ শান্তি হয়েছে আপনার? আমাকে এভাবে অপমানিত করতে পেরে মন ভরেছে? কী চান কী আপনি? যখন আমি আপনার কাছে থাকতে চেয়েছিলাম তখন দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন আমাকে। কী বলেছিলেন? আমাকে গ্রহন করা সম্ভব নয় আপনার পক্ষে। সেদিনের সব কথা, কাজ সবকিছুই নেশার ঘোরে করেছেন। আমি ঝামেলা আপনার কাছে। তো আজ আবার কেন এসেছেন এখানে? নেশা করে? কী মনে করেন আমাকে আপনি? আপনার হাতের পুতুল? যখন খুশি যা ইচ্ছে করা যায় আমার সাথে? আমার অনুভূতির, ইচ্ছার কোন দাম নেই? খেলনা আমি আপনার? যখন ইচ্ছে হবে নিয়ে নিয়ে খেলবেন, মন উঠে গেলে আবার ছুড়ে ফেলে দেবেন?’
রুদ্র শান্ত চোখে তাকাল প্রিয়তার দিকে। বলল, ‘ কলার ছাড়ো প্রিয়তা।’

কিন্তু প্রিয়তা শুনলোনা। আরও শক্ত করে কলার ধরে বলল, ‘না ছাড়বো না। আপনার জন্য ঐ মহিলা আমাকে যা নয় তাই বলে গেল। বেশ্যার সঙ্গে তুলনা করল। শুধুমাত্র আপনার জন্যে। মাসের মাঝখানে ঘর কোথায় পাব এখন আমরা? টাকা কোথা থেকে আসবে? কী ক্ষতি করেছি আমি আপনার? কেন এমন করছেন আমার সঙ্গে? কোন জন্মের শোধ নিচ্ছেন? নাকি সত্যি সত্যি আমাকে ওরকম নোংরা মেয়ে ভেবে নিয়েছেন?’
রুদ্র জোর করে নিজের কলার থেকে প্রিয়তার হাত ছাড়িয়ে নিল। ঠান্ডা গলায় বলল, ‘ তোমাকে চড় লাগানোর অদম্য ইচ্ছেটা বহু কষ্টে দমন করলাম। কারণ দোষটা আমার। তখন আমি যা করেছিলাম তার পেছনে কারণ ছিল প্রিয়। কিন্তু এখন আমার বাবা বলেছে তোমাকে নিয়ে যেতে। আর ওনার আদেশ কখনও অমান্য করিনা আমি। ইউ হ্যাভ টু কাম উইথ মি। নিজের ইচ্ছেতে রাজি না হলে তুলে নিয়ে যাব।’

প্রিয়তা থমকে গেল। অবাক চোখে তাকিয়ে রইল রুদ্রর দিকে। আস্তে করে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, ‘ ওহ, আপনার বাবা বলেছে বলে আমাকে নিয়ে যেতে এসেছেন আপনি?’
‘ অনেকটা তাই। ওনার কথা আজ আবধি কখনও অমান্য করিনি আমি। আর যখন ওনার আদেশ আর আমার ইচ্ছে দুটোই এক হয় তখন যেকোন মূল্যে আমি সেটা করি।’
‘ তারমানে বাবার বাধ্য ছেলে হয়ে এখানে এসেছেন আপনি। নিজের তাগিদে নয়। লজ্জা করছেনা আপনার সে কথা বলতে?’
রুদ্র হেসে ফেলল। প্রিয়তার কপাল থেকে চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে বলল, ‘বোকা মেয়ে।’
প্রিয়তা ঝাড়া দিয়ে সরিয়ে দিল রুদ্রর হাত। আবার কেঁদে ফেলেছে। দরজার দিকে আঙ্গুলের ইশারা করে বলল, ‘বেরিয়ে যান এক্ষুনি। আপনার মুখ দেখতে চাইনা আমি।’
রুদ্র একটানে প্রিয়তাকে নিজের দিকে টেনে নিয়ে বলল, ‘যাব। এক্ষুনি যাব। তবে তোমাকে সঙ্গে নিয়ে। অনেক ভালোভাবে বুঝিয়েছি। চেয়েছিলাম তোমার ইচ্ছেতেই তোমাকে নিয়ে যাব। তাই সন্ধ্যা থেকে এখানে সার্কাসের জোকার সেজে বসে আছি। কিন্তু আর না। চলো।’

রুদ্রর চোখের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইল প্রিয়তা। তারপর মৃদু গলায় বলল, ‘সবকিছু পি’স্ত’ল দেখিয়ে হয়না।’
বলে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলো প্রিয়তা কিন্তু পারলোনা। মীরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে লাইভ সিনেমা। একটা জিনিস ভীষণভাবে মিস করছে ও এখন। পপকর্ণ। রুদ্র আরও শক্ত করে প্রিয়তার হাত ধরে সকৌতুকে বলল, ‘ ছিহ্ প্রিয়। আমি তোমাকে পি’স্ত’ল দেখাতে পারি? শত হলেও ভবিষ্যতে আমার বাচ্চারাতো তোমাকেই মা বলে ডাকবে না-কি? চ্যাহ্! কিছুই বোঝনা তুমি!’
মীরা হেসে ফেলল। প্রিয়তা রাগ করতেও ভুলে গেল। বোকার মতো তাকিয়ে রইল রুদ্রর দিকে। এই লোকটা কী দিয়ে তৈরী? রুদ্র এবার সিরিয়াসলি বলল, ‘ শেষ বারের মতো জিজ্ঞেস করছি। যাবে?’
প্রিয়তা সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল ‘না।’

উত্তর দিয়ে নিজেই চমকে উঠল। মীরাও চকিতে তাকাল ওদের দিকে। মনে পড়ে গেল মাসখানেক আগের সেই ভয়ানক চড়ের কথা। চড়টা মারার আগে রুদ্র একইভাবে, একই প্রশ্ন করেছিল। দ্রুত চোখ বন্ধ করে চড়টা খাওয়ার জন্যে নিজেকে প্রস্তুত করে নিল প্রিয়তা। মীরাও ভাবছে কানে হাত দেবে কি-না।
কিন্তু ওদেরকে অবাক করে রুদ্র ঝট করে প্রিয়তাকে কোলে তুলে নিল। প্রিয়তা থতমত খেয়ে গলা জড়িয়ে ধরল রুদ্রর। কী হল বুঝতে কয়েক সেকেন্ড লেগে গেল। রুদ্র গম্ভীর স্বরে বলল, ‘ বলেছিলাম না, ভালো কথায় রাজি না হলে তুলে নিয়ে যাব। ভুলটা আমারই। ভালো কথার মানুষ তুমি আগেও ছিলেনা, এখনো নও। শুধুশুধুই সময় নষ্ট করলাম।’
এটুকু বলে আবার মীরার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ শ্যালিকা! তুমি এখন যাবে নাকি পরে?’
মীরা বাকিসব ভুলে গেল। চরম উৎসাহের সাথে বলল, ‘বিয়েতো ছয়দিন পরে তাইনা ভাইয়া?’
মাথা নাড়ল রুদ্র। মীরা বলল, ‘দুদিন আগে পৌঁছে যাব। এদিকে একটু কাজ আছে।’
রুদ্র মৃদু হেসে বলল, ‘গাড়ি পাঠিয়ে দেব। আসছি।’
মীরা হাত নেড়ে বলল, ‘ দুজনকেই টাটা।’

বিস্ময়ে প্রতিক্রিয়া করার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছে প্রিয়তা। মূর্তির মতো স্হির হয়ে, বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছে রুদ্রর দিকে। রুদ্র সেদিকে কোনরকম পাত্তা না দিয়ে ওকে নিয়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।প্রিয়তাদের ছোট রুমটাতে পিনপতন নিরবতা। রুদ্র চেয়ারে পায়ে পা তুলে বসে আছে। থুতনিতে হাত রেখে তাকিয়ে আছে প্রিয়তার দিকে। প্রিয়তা পা নামিয়ে বসে আছে বিছানায়। গভীর মনোযোগ দিয়ে কিছু ভাবছে মেয়েটা। মাঝেমাঝে আড়চোখে তাকাচ্ছে রুদ্রর দিকে। কিন্তু প্রতিবারই সঙ্গে সঙ্গে চোখ ফিরিয়ে নিতে হচ্ছে। কারণ রুদ্র ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। ফলে চোখাচোখি হয়ে যাচ্ছে বারবার।

মীরা আসাম করে বসে তাকিয়ে আছে দুজনের দিকে। পুরো ব্যাপার মাথার অনেকটা ওপর দিয়ে চলে গেছে ওর। সন্ধ্যার দিকে হঠাৎই রুদ্র এসে হাজির হলো এখানে। কেন এসেছে জিজ্ঞেস করেও কোন উত্তর পায়নি মীরা। এমনিতেই রুদ্রর ওপর ভীষণ রেগে ছিল ও। তারওপর এমন হু কেয়ারস্ এটিটিউড! বারোটা দিন প্রিয়তাকে গুমরে গুমরে কষ্ট পেতে দেখেছে। আড়ালে কাঁদতেও দেখেছে। ইচ্ছে ছিল কোনদিন সামনে পেলে ইচ্ছেমতো ঝেড়ে দেবে রুদ্রকে। কিন্তু সামনাসামনি দাঁড়িয়ে একটা কথা বলারও সাহস হয়নি ওর। দেখলেই কেমন গলাটা শুকিয়ে আসে। আওয়াজ-ই বের হতে চায়না, বকা দেওয়া তো অনেক দূরের কথা। সরাসরি বকতে না পেরে রান্নাঘরে রান্না করতে করতে একা একাই রুদ্রর চৌদ্দ গুষ্ঠি উদ্ধার করছিল মীরা। সঙ্গে প্রিয়তাকেও ছেড়ে দেয়নি। এতো মানুষ থাকতে শেষে কি-না একটা গ্যাংস্টারের প্রেমে পড়ল! বলদ মাইয়া! হঠাৎ কারো কথাবার্তার আওয়াজ শুনতে পেয়ে ভেতরে এসে দেখে প্রিয়তা চলে এসছে। এরপর একঘণ্টা কেটে খেল। এদের দুজনের টুকটাক কথাবার্তা আর নিরব ঝগড়া থেকে যেটুকু বুঝতে পারল তার সারমর্ম এই যে, রুদ্র সেই গুলশান থেকে চট্টগ্রাম ছুটে এসেছে প্রিয়তাকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে। কিন্তু প্রিয়তাও নাছোড়বান্দা। ও যাবেনা রুদ্রর সঙ্গে। যে লোকটা একবার ওকে আগাছার মতো জীবন থেকে ছেটে ফেলতে পেরেছে, সে যে আবার একই কাজ করবে না তার কী গ্যারান্টি? তাছাড়া ওরও তো আত্মসম্মান বলে কিছু আছে না-কি? যখন ইচ্ছে হবে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেবে, আবার যখন ইচ্ছে হবে কাছে টেনে নেবে। মগের মুল্লুক!

কিন্তু রুদ্র তার চেয়েও কয়েক কাঠি ওপরের নাছোড়বান্দা। প্রিয়তাকে না নিয়ে সেও এখান থেকে নড়বেনা। যেন পণ করেই এসেছে সে।
দীর্ঘ সময়ের নিরবতা ভেঙ্গে প্রিয়তা যান্ত্রিক কন্ঠে বলল, ‘আপনি এখনো এখানে বসে আছেন কেন?’
রুদ্র শুরুতেই উত্তর না দিয়ে চুপচাপ কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল প্রিয়তার দিকে। তারপর থুতনি থেকে হাত নামিয়ে শিরদাঁড়া সোজা করে বসে বলল, ‘আমি আগেও বলেছি তোমাকে না নিয়ে আমি এখান থেকে যাচ্ছিনা।’
‘ আমি কোথাও যাবোনা আপনার সাথে।’
‘ ফাইন। তাহলে আমিও উঠছি না। তোমার এই ঘরটা মন্দ লাগেনি আমার। কয়েকটা দিন আরাম করে কাটিয়ে দেওয়া যাবে।’

প্রিয়তা বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকাল রুদ্রর দিকে। মেজাজ ভীষণ খারাপ হল ওর। বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আপনি কেন বুঝতে পারছেন না বাইরে আপনার পাঁচজন লোক দাঁড়িয়ে আছে, ভেতরে আপনি। বাড়িওয়ালি আন্টি জানতে পারলে এক্ষুনি ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেবে আমাদের। এমনিতেই নানারকম ঝামেলার মধ্যে আছি। আর ঝামেলা বাড়াবেন না। প্লিজ চলে যান। কেন অশান্তি করছেন?’
সকৌতুকে প্রিয়তার দিকে তাকাল রুদ্র। উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘এইজন্যইতো বলছি আমার সাথে চলো। আমার সাথে গেলে কোন আন্টির কথাও শুনতে হবেনা আর কোন ঝামেলাও থাকবেনা। আমি কোথায় তোমাকে শান্তিতে রাখার চেষ্টা করছি, আর তুমি বলছো আমি অশান্তি করছি? নট ফেয়ার সুইটহার্ট!’
‘আমি মজা করছিনা আপনার সঙ্গে।’
‘ আমিও না। আ’ম ভেরী সিরিয়াস।’

কথাটা বলে আবার নিজের চেয়ারটা টেনে বসে পড়ল রুদ্র। টেবিল থেকে একটা বই নিয়ে পাতা উল্টাতে শুরু করল যেন কিছুই হয়নি। সবকিছুই স্বাভাবিক। ব্যপারটাকে আরও কৌতুকপূর্ণ করতে মীরা বলে উঠল, ‘দুলাভাই, ডিম পোজ খাবেন নাকি ভাজব?’
রুদ্র চোখ তুলে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল, ‘পোজ।’
রাগে দুঃখে কান্না পেয়ে গেল প্রিয়তার। এতো সিরিয়াস একটা ব্যপারকে সার্কাস বানিয়ে রেখে দিয়েছে এরা। অসহ্য! ও নিজেও কড়াভাবে রুদ্রকে কিছু বলতে পারছেনা। মন চাইছে কঠোর, তিক্ত কিছু বাণী শুনিয়ে, অপমান করে, দূর দূর তাড়িয়ে দিতে রুদ্রকে। কিন্তু পারছেনা। চেষ্টা করেও পারছেনা।

মীরার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে প্রিয়তা। পারলে এক্ষুনি চোখ দিয়েই ভস্ম করে দিতো। মীরা ঘন ঘন ঢোক গিলছে প্রিয়তার দৃষ্টি দেখে। কখন বো’মা ফাটে কে জানে? রাতের খাবার খেয়ে একটু আগে বেরিয়েছে রুদ্র। সিগারেট খেতে। এই সুযোগেই দুই বান্ধবী নিজেদের মধ্যকার আলাপ আলোচনা সেরে নিচ্ছে।
মীরা মোটা ফ্রেমের চশমাটা ঠিক করে বলল, ‘ আমার দিকে এভাবে তাকাচ্ছিস কেন বোন? আমি কী করছি?’
প্রিয়তা তেঁতে উঠল মীরার কথায়। একটা বালিশ ছুড়ে দিয়ে বলল, ‘ “দুলাভাই, ডিম পোজ খাবেন নাকি ভাজব?” এক চড়ে সবগুলো দাঁত ফেলে দেব বেয়াদব। কোন কালের দুলাভাই লাগে তোর?’
মীরা অবাক হওয়ার ভান করে বলল, ‘ বাহ রে! তুই একটা গ্যাংস্টারের সাথে একমাস থাকতে পারিস, তার প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে রাতের পর রাত বালিশ ভেজাতে পারিস। আর আমি দুলাভাই বললেই দোষ?’
প্রিয়তা ইতস্তত করল কয়েক সেকেন্ড। বলল, ‘ ওসব পাস্ট।’
মীরা দাঁত বের করে হেসে বলল, ‘ থাক! আর জোকস্ মারিস না। পাস্ট, প্রেজেন্ট, ফিউচার সব লজ্জা পাবে তোর ‘পাস্ট’ শুনে। আগেই বলেছিলাম আর যাই হোক কোন ক্রিমিনালের প্রেমে পিছলে যেও না। পালানোর রাস্তা পাবেনা। এবার ঠ্যালা সামলাও।’

প্রিয়তা অসহায় চোখে তাকাল মীরার দিকে। ও কীরকম মিশ্র অনুভূতিতে ভুগছে শুধুমাত্র ও-ই জানে। রুদ্রর সঙ্গে যাওয়ার ইচ্ছে আছে ওর। কিন্তু এতো রাগ অভিমানের ভীড়ে সেই ইচ্ছেটা কেমন পানসে লাগছে। তিক্ত হয়ে উঠছে সবকিছু।
হঠাৎই দরজা ঠেলে কেউ একজন ভেতরে প্রবেশ করল। চমকে দরজার দিকে তাকাল প্রিয়তা আর মীরা। বাড়িওয়ালি মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন। রুদ্র বাইরে আছে তাই দরজা ভিড়িয়ে রেখেছিল। সিটকানি লাগায় নি। ওরা কিছু বলার আগেই মহিলা কাঠ কাঠ গলায় বলল, ‘শোন, তোমাগো কাছে যা যা ভাড়া পাওনা আছে তাড়াতাড়ি দিয়া দাও। অ‍্যাক্ষনই দিবা। কাইলকের মইধ্যে ঘর ছাড়বা। অনেক দেখছি আর না।’
প্রিয়তা এই ভয়টাই পাচ্ছিল এতক্ষণ। এই মহিলার চক্ষুশূল হয়ে উঠেছে ও ইদানিং। এবার কী হবে? প্রিয়তা উঠে দাঁড়িয়ে কোনরকমে নিজেখে সামলে বলল, ‘ কী হয়েছে আন্টি? কী করেছি আমরা?’
প্রিয়তার প্রশ্ন শুনে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল মহিলা। দু পা এগিয়ে এসে ঝাঝালো কন্ঠে বলল, ‘ আগেও কইছি তোমাগো। এইডা ভদ্দর মাইনসের বাড়ি। তোমাগো নষ্টামি করার জায়গা না। আগে আছিল ঐ এক ছোকরা। আর এখন আরেকজন জুটাইছো। পারোও তোমরা। নষ্টপাড়া বানাই ফেলছে বাড়িটারে। তাড়াতাড়ি টাকা বাইর করো। আর কালকে জানি এই বাড়িতে না দেখি তোমাগো।’

প্রিয়তা বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল। এরকম জঘন্য কথায় কান গরম হয়ে উঠেছে ওর। কান্না পাচ্ছে। মীরার মেজাজ তুঙ্গে উঠে গেল এসব কথা শুনে। কোমরে হাত দিয়ে বলল, ‘আজব তো! কিছু না জেনেই এরকম নোংরা কথা বলছেন কেন?’
প্রিয়তা হাত ধরে মীরাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘ আন্টি আমাদের কাছে এখন এতো টাকা নেই। এই মাসটা শেষ হতে দিন আমরা এমনিতেও চলে যাবো। চলতি মাসে আমরা এখন কোথায় যাবো বলুন?’
নিজের কন্ঠস্বরই কেমন অচেনা লাগল প্রিয়তার কাছে। কান্নায় গলা ধরে আসছে। কেঁপে উঠতে আওয়াজ। মীরা রাগে গজগজ করছে। মহিলা মুখ ঝামটা দিয়ে বলল, ‘হেইডা আমার বাড়িতে এইসব কান্ড করার আগে মনে আছিল না? বাইরে ঐ লোকগুলা দাঁড়াইয়া রইছে কেন? সবগুলারেই তো গুন্ডা মনে হইতাছে। ছিহ্! বাড়িটারে ধান্দার জায়গা বানাই ফেলছে। এইজন্যই গার্জেন ছাড়া মাইয়া, পোলা বাড়ি ভাড়া দেওন নাই। কান ধরছি ফেমলি ছাড়া আর যদি ভাড়া দিছি।’
বলে শাড়ির আঁচলে মুখ চেপে ধরলেন মহিলা। যেন ওরা কোন নোংরা আবর্জনা। লজ্জায়, অপমানে চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল প্রিয়তার। কিন্তু তাতে মহিলার দয়া হলোনা। নির্দয় হয়ে বলল, ‘ এসব ন্যাকাকান্না বাইরে গিয়া করো। এসব করার লাইগা নষ্টগলী আছে, সস্তা হোটেলও আছে। আমার বাড়ি ছাড়ো বাপু। আর বাইরের ওগুলারে ভাগাও। অক্ষনি। আর আমার টাকা দাও। নাইলে পুলিশে ফোন করমু কিন্তু।’
‘ কত টাকা পান আপনি?’

গম্ভীর, থমথমে কন্ঠস্বরে কেমন নিস্তব্ধ হয়ে গেল ঘরটা। কেঁপে উঠল মহিলা। ভয়ে নয়। স্বরটাতেই কিছু একটা ছিল যাতে পশম দাঁড়িয়ে গেছে ওনার। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই নিজেকে সামলে নিল। বুঝলো এই মেয়ের সেই নাগর এসেছে। ছেলেটাকেও কয়েকটা শুনিয়ে দেওয়ার বাসনা নিয়ে পেছন ঘুরে তাকাল। কিন্তু তাকাতেই ফাটা বেলুনের মতোই চুপসে গেল। এতক্ষণ জঘন্য শব্দে বকবক করে যাওয়া মুখটা কথা বলতেই ভুলে গেল। কারণ দরজার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রুদ্র আমের। সেটা মহিলার ভয়ের কারণ নয়। মহিলার ভয়ের কারণ রুদ্রর হাতে ধরে রাখা এম টি 608 পিস্তল। খুব স্বাভাবিকভাবে ধরে রাখলেও পিস্তলের মুখটা সোজা মহিলার গলার দিকে তাকিয়ে আছে। যেটা একটু ভালোভাবে খেয়াল করে বুঝতে পারল প্রিয়তা আর মীরা।
রুদ্র জুতোয় ঠক ঠক আওয়াজ করে আস্তে আস্তে এসে দাঁড়াল মহিলার সামনে। শান্ত কিন্তু গম্ভীর গলায় আবার জিজ্ঞেস করল, ‘ কত পাওনা আছে?’

ইতিমধ্যে ঘেমে গেছে মহিলা। হাত পা কাঁপছে। কিন্তু রুদ্রর ভয়ে কোনমতে উচ্চারণ করল, ‘ ন্ নয় হাজার।’
রুদ্র পকেট থেকে ফোন বের করে কাউকে কল লাগালো। বলল, ‘ রঞ্জু! দশ হাজার টাকা নিয়ে ভেতরে আয়। এক্ষুনি।’
দূই মিনিটের মধ্যে রঞ্জু প্রায় দৌড়ে ভেতরে এলো। হাতে টাকা। রুদ্র টাকাটা নিয়ে ইশারা করতেই আবার একইভাবে দৌড়ে চলে গেল রঞ্জু। রুদ্র টাকাটা নিয়ে তাকাল মহিলার দিকে। তার তীক্ষ্ম চোখজোড়া দেখে আবারও কেঁপে উঠলেন মহিলা। ভয়ে এখনো কাঁপছে সে। পি’স্ত’ল জিনিসটা সামনাসামনি এর আগে কখনও দেখেনি হয়তো। রুদ্র টাকাগুলো মহিলার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘ এক হাজার এক্সট্রা আছে। ওটা ভিক্ষা ধরে নিন। এখন চুপচাপ নিজের ঘরে যান। মহিলা বলে ছেড়ে দিচ্ছি। পরেরবার ওদের সাথে কথা বলার সময় ভেবেচিন্তে বলবেন। এবার টাকা বেরিয়েছে, কিন্তু পরেরবার আমার পিস্তল থেকে বুলেট বের হবে। আর হ্যাঁ, পুলিশকে ফোন করে আমার কিচ্ছু করতে পারবেন না আপনি। কিন্তু সেই বাড়তি সাহসটা দেখালে আপনাকে জীবিত রেখে যাবনা আমি। বোঝা গেছে?’

মহিলাটি রুদ্রর হাতে ধরে রাখা পিস্তলের দিকে তাকাল একবার। এরপর চাবি লাগানো পুতুলের মতো দ্রুত গতিতে ওপর নিচ মাথা ঝাকালো। রুদ্র পিস্তল দিয়ে ইশারা করল ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ায় জন্যে। মহিলা একপ্রকার প্রাণ নিয়ে পালালো।
রুদ্র দরজা বন্ধ করে সিটকানি লাগালো। পেছনে তাকিয়ে দেখে প্রিয়তা আর মীরা পাশাপাশি মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। দু চোখ ভর্তি বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। রুদ্র ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে দরজায় হেলান দিল। হাতে রাখা পিস্তলটা নাড়াচাড়া করতে করতে প্রিয়তাকে বলল, ‘ হোয়াট এবাউট ইউ ডার্লিং? আপনাকেও বু’লে’টের ভয় দেখাতে হবে? নাকি ভালোয় ভালোয় সঙ্গে যাবেন?’

ঘোর থেকে বেরিয়ে এলো প্রিয়তা। মাসখানেক আগে হলে হয়তো ভয় পেতো। কিন্তু একমাস রুদ্রর সঙ্গে থেকেছে ও। অব্যক্ত হলেও গভীর প্রনয়ের কিছু চমৎকার মুহূর্ত কাটিয়েছে ওরা একসঙ্গে। তাই রুদ্র ওকে মেরে ফেলবে সেই ভয় পাওয়ার মতো বোকা মেয়ে প্রিয়তা নয়। কিছুক্ষণ আগের ঘটনা মনে পড়তেই চোয়াল শক্ত হয়ে এলো ওর। চোখ মুছে এগিয়ে গিয়ে সোজা রুদ্রর কলার বলল, ‘ শান্তি হয়েছে আপনার? আমাকে এভাবে অপমানিত করতে পেরে মন ভরেছে? কী চান কী আপনি? যখন আমি আপনার কাছে থাকতে চেয়েছিলাম তখন দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন আমাকে। কী বলেছিলেন? আমাকে গ্রহন করা সম্ভব নয় আপনার পক্ষে। সেদিনের সব কথা, কাজ সবকিছুই নেশার ঘোরে করেছেন। আমি ঝামেলা আপনার কাছে। তো আজ আবার কেন এসেছেন এখানে? নেশা করে? কী মনে করেন আমাকে আপনি? আপনার হাতের পুতুল? যখন খুশি যা ইচ্ছে করা যায় আমার সাথে? আমার অনুভূতির, ইচ্ছার কোন দাম নেই? খেলনা আমি আপনার? যখন ইচ্ছে হবে নিয়ে নিয়ে খেলবেন, মন উঠে গেলে আবার ছুড়ে ফেলে দেবেন?’

রুদ্র শান্ত চোখে তাকাল প্রিয়তার দিকে। বলল, ‘ কলার ছাড়ো প্রিয়তা।’
কিন্তু প্রিয়তা শুনলোনা। আরও শক্ত করে কলার ধরে বলল, ‘না ছাড়বো না। আপনার জন্য ঐ মহিলা আমাকে যা নয় তাই বলে গেল। বেশ্যার সঙ্গে তুলনা করল। শুধুমাত্র আপনার জন্যে। মাসের মাঝখানে ঘর কোথায় পাব এখন আমরা? টাকা কোথা থেকে আসবে? কী ক্ষতি করেছি আমি আপনার? কেন এমন করছেন আমার সঙ্গে? কোন জন্মের শোধ নিচ্ছেন? নাকি সত্যি সত্যি আমাকে ওরকম নোংরা মেয়ে ভেবে নিয়েছেন?’
রুদ্র জোর করে নিজের কলার থেকে প্রিয়তার হাত ছাড়িয়ে নিল। ঠান্ডা গলায় বলল, ‘ তোমাকে চড় লাগানোর অদম্য ইচ্ছেটা বহু কষ্টে দমন করলাম। কারণ দোষটা আমার। তখন আমি যা করেছিলাম তার পেছনে কারণ ছিল প্রিয়। কিন্তু এখন আমার বাবা বলেছে তোমাকে নিয়ে যেতে। আর ওনার আদেশ কখনও অমান্য করিনা আমি। ইউ হ্যাভ টু কাম উইথ মি। নিজের ইচ্ছেতে রাজি না হলে তুলে নিয়ে যাব।’

প্রিয়তা থমকে গেল। অবাক চোখে তাকিয়ে রইল রুদ্রর দিকে। আস্তে করে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, ‘ ওহ, আপনার বাবা বলেছে বলে আমাকে নিয়ে যেতে এসেছেন আপনি?’
‘ অনেকটা তাই। ওনার কথা আজ আবধি কখনও অমান্য করিনি আমি। আর যখন ওনার আদেশ আর আমার ইচ্ছে দুটোই এক হয় তখন যেকোন মূল্যে আমি সেটা করি।’
‘ তারমানে বাবার বাধ্য ছেলে হয়ে এখানে এসেছেন আপনি। নিজের তাগিদে নয়। লজ্জা করছেনা আপনার সে কথা বলতে?’
রুদ্র হেসে ফেলল। প্রিয়তার কপাল থেকে চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে বলল, ‘বোকা মেয়ে।’
প্রিয়তা ঝাড়া দিয়ে সরিয়ে দিল রুদ্রর হাত। আবার কেঁদে ফেলেছে। দরজার দিকে আঙ্গুলের ইশারা করে বলল, ‘বেরিয়ে যান এক্ষুনি। আপনার মুখ দেখতে চাইনা আমি।’
রুদ্র একটানে প্রিয়তাকে নিজের দিকে টেনে নিয়ে বলল, ‘যাব। এক্ষুনি যাব। তবে তোমাকে সঙ্গে নিয়ে। অনেক ভালোভাবে বুঝিয়েছি। চেয়েছিলাম তোমার ইচ্ছেতেই তোমাকে নিয়ে যাব। তাই সন্ধ্যা থেকে এখানে সার্কাসের জোকার সেজে বসে আছি। কিন্তু আর না। চলো।’

রুদ্রর চোখের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইল প্রিয়তা। তারপর মৃদু গলায় বলল, ‘সবকিছু পি’স্ত’ল দেখিয়ে হয়না।’
বলে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলো প্রিয়তা কিন্তু পারলোনা। মীরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে লাইভ সিনেমা। একটা জিনিস ভীষণভাবে মিস করছে ও এখন। পপকর্ণ। রুদ্র আরও শক্ত করে প্রিয়তার হাত ধরে সকৌতুকে বলল, ‘ ছিহ্ প্রিয়। আমি তোমাকে পি’স্ত’ল দেখাতে পারি? শত হলেও ভবিষ্যতে আমার বাচ্চারাতো তোমাকেই মা বলে ডাকবে না-কি? চ্যাহ্! কিছুই বোঝনা তুমি!’
মীরা হেসে ফেলল। প্রিয়তা রাগ করতেও ভুলে গেল। বোকার মতো তাকিয়ে রইল রুদ্রর দিকে। এই লোকটা কী দিয়ে তৈরী? রুদ্র এবার সিরিয়াসলি বলল, ‘ শেষ বারের মতো জিজ্ঞেস করছি। যাবে?’
প্রিয়তা সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল ‘না।’

উত্তর দিয়ে নিজেই চমকে উঠল। মীরাও চকিতে তাকাল ওদের দিকে। মনে পড়ে গেল মাসখানেক আগের সেই ভয়ানক চড়ের কথা। চড়টা মারার আগে রুদ্র একইভাবে, একই প্রশ্ন করেছিল। দ্রুত চোখ বন্ধ করে চড়টা খাওয়ার জন্যে নিজেকে প্রস্তুত করে নিল প্রিয়তা। মীরাও ভাবছে কানে হাত দেবে কি-না।
কিন্তু ওদেরকে অবাক করে রুদ্র ঝট করে প্রিয়তাকে কোলে তুলে নিল। প্রিয়তা থতমত খেয়ে গলা জড়িয়ে ধরল রুদ্রর। কী হল বুঝতে কয়েক সেকেন্ড লেগে গেল। রুদ্র গম্ভীর স্বরে বলল, ‘ বলেছিলাম না, ভালো কথায় রাজি না হলে তুলে নিয়ে যাব। ভুলটা আমারই। ভালো কথার মানুষ তুমি আগেও ছিলেনা, এখনো নও। শুধুশুধুই সময় নষ্ট করলাম।’

এটুকু বলে আবার মীরার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ শ্যালিকা! তুমি এখন যাবে নাকি পরে?’
মীরা বাকিসব ভুলে গেল। চরম উৎসাহের সাথে বলল, ‘বিয়েতো ছয়দিন পরে তাইনা ভাইয়া?’
মাথা নাড়ল রুদ্র। মীরা বলল, ‘দুদিন আগে পৌঁছে যাব। এদিকে একটু কাজ আছে।’
রুদ্র মৃদু হেসে বলল, ‘গাড়ি পাঠিয়ে দেব। আসছি।’
মীরা হাত নেড়ে বলল, ‘ দুজনকেই টাটা।’

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৩৪

বিস্ময়ে প্রতিক্রিয়া করার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছে প্রিয়তা। মূর্তির মতো স্হির হয়ে, বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছে রুদ্রর দিকে। রুদ্র সেদিকে কোনরকম পাত্তা না দিয়ে ওকে নিয়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৩৬