অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৬৯

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৬৯
লেখিকা: অনিমা কোতয়াল 

যখন বুঝল ঘটনাটা কোন দুঃস্বপ্ন নয়, কঠিন বাস্তব। নিঃশ্বাস নেওয়া দ্বায় হয়ে উঠল ইকবালের। সমস্ত শরীরে কেমন শিরশিরে অনুভূতি ছেঁয়ে গেল। এও সম্ভব! যে মেয়েটাকে দেখলেই মনে সুখের অনুভূতি ছেঁয়ে যেতো। যার আগমনে আমের ভিলা নতুন রঙে সেজে উঠেছিল। যার ছোঁয়ায় জীবন্ত থাকতো আমের ভিলার প্রতিটা কোণ। ‍যার চলনে আমের পরিবারে প্রাণ সঞ্চার হতো। যার হাসিতে হেসে উঠতো ওরা।

কঠোর, গম্ভীর রাশেদ আমেরও যার প্রতি ছিলেন নমনীয়। পাথর হৃদয়ের রুদ্র আমেরও যাতে বিলীন হয়েছিল। সীমাহীন ভালোবেসেছিল। অতি যত্নে আগলে রেখেছিল নিজের বক্ষকুটিরে। সেই মেয়েটা! সেই মেয়েটাই কি-না সবকিছুর মূল! যে মেয়েটা এই মুহূর্তে ওর সামনে বসে আছে, সে সত্যিই রাশেদ আমেরের একমাত্র পুত্রবধু। রুদ্র আমেরের প্রাণপ্রিয় স্ত্রী। প্রিয়তা!

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

যে মেয়েটা আমের পরিবারের সৌভাগ্য হয়ে প্রবেশ করেছিল। সেই কি-না আমের পরিবারের সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য! এতোটা অভিনয় সম্ভব?
প্রিয়তা ঠোঁটে সেই সামান্য হাসি রেখেই বলল, ‘চিনতে পেরেছেন?’
ইকবাল প্রিয়তার চেহারা জুড়ে কিছু একটু খুঁজতে খুঁজতে বলল, ‘আমিহ্, আমি বিশ্বাস করতে পারছিনা।’

‘স্বাভাবিক। ব্যপারটা বিশ্বাসযোগ্য হলে দুটো বছর আমি আমের ভিলার প্রিয় রানি হয়ে থাকতে পারতাম না।’
‘তোমার পক্ষে এসব করা সম্ভব না।’
‘অসম্ভব বলে পৃথিবীতে কিছু নেই।’
‘তারমানে! তারমানে, সত্যিই তুমিই সব করেছো? তখন ওরা যা যা বলল। কুহুর কিডন্যাপিং, রাশেদ বাবার খু/ন, সোলার সিস্টেমের ভেতরের সব তথ্য পাচার করা, দলটাকে এভাবে শেষ করে দেওয়া। সব!’
প্রিয়তা আরেকটু ঝুঁকে গেল ইকবালের দিকে। ফিসফিসে কন্ঠে বলল, ‘সব।’

ইকবাল চকিতে চাইল। কান ঝিঁ ঝিঁ করে উঠল প্রিয়তার অকপট স্বীকারোক্তিতে। প্রিয়তা সোজা হয়ে বসল। চেয়ারে হেলান দিয়ে বলল, ‘শুধু তাইনা। পুরো ব্যপারটা আপনার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে। সোলার সিস্টেমের কাছে আপনাকে মীরজাফর তৈরী করার পরিকল্পনাও আমারই ছিল। তারজন্যে ক্ষমা করবেন। আর কোন উপায় ছিলোনা আমার কাছে। বড্ড বেশি জেনে ফেলেছিলেন আপনি। এরচেয়ে বেশি জেনে গেলে ব্যপারটা আমার জন্যে ভালো হতোনা।’

ইকবাল কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছেনা। এতো বড় ষড়যন্ত্র! এতো বড় বিশ্বাসঘাতকতা! হঠাৎই উত্তেজিত হয়ে উঠল ইকবাল। ঝাঁকি দিয়ে নিজেকে মুক্ত করার ব্যর্থ এক চেষ্টা করে বলল, ‘কালনাগিনী! রুদ্র নিজের সঙ্গে কালসাপ এনে ঢুকিয়েছিল বাড়িতে। আর রাশেদ বাবা দুধকলা দিয়ে সেই কালসাপকে পুষেছে। ছিহ্! এতোটা নিচ তুমি! এতোটা_’
বলতে বলতে কেশে উঠল ইকবাল। শরীরের যন্ত্রণাগুলো আবারও তীব্রভাবে অনুভব করতে পারল। যার কারণে অবিশ্বাস্য মানসিক ধাক্কাটাও সামলাতে পারছেনা সে। কিন্তু ওর বলা তিক্ত বাণী শুনে রেগে গেল সম্রাট। ইকবালকে মারার জন্যে তেড়ে আসতে নিল।

‘সম্রাট!’
প্রিয়তার গম্ভীর ডাকে থেমে গেল সম্রাট। বিরক্তি নিয়ে প্রিয়তার দিকে তাকাল। কিন্তু প্রিয়তার জ্ব/লন্ত চোখ দেখে দমে গেল নিজের অজান্তেই। চোখের ইশারায় সম্রাটকে সাবধান করে আবার ইকবালের দিকে তাকাল প্রিয়তা। দেখল কাশতে কাশতে এখনো নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছে ইকবাল। প্রিয়তা হাঁক ছাড়ল, ‘জয়!’
সঙ্গে সঙ্গে দরজায় চব্বিশ-পঁচিশ বছর বয়সী এক ছেলে এসে উপস্থিত হল। ছিপছিপে গরন, শ্যামলা বরণ, ঝাকরা চুল। চরম অনুগত দাসের মতো বলল, ‘জি ম্যাডাম।’

‘এক গ্লাস পানি নিয়ে এসো।’ ইকবালের দিকে তাকিয়ে থেকেই বলল প্রিয়তা।
এক সেকেন্ডও অপেক্ষা না করে চলে গেল জয়। বিশ সেকেন্ডেরও কম সময়ে এক গ্লাস পানি নিয়ে এলো। প্রিয়তার কাছ থেকে দু হাত দূরে এসে থামল। মাথা নিচু করে এগিয়ে দিল গ্লাসটা। গ্লাসটা নিয়ে উঠে দাঁড়াল প্রিয়তা। ইকবালের কাছে এগিয়ে গেল। একহাত রাখল ইকবালের পিঠের ওপর। অপরহাত দিয়ে পানির গ্লাসটা ইকবালের মুখের সামনে ধরল।

‘খুব তেষ্টা পেয়েছে নিশ্চয়ই।’
‘দয়া দেখাচ্ছ?’
‘সেটা আমার মধ্যে নেই বলেই জানি।’
‘তোমার হাতে পানি খেতে রুচিতে বাধবে আমার।’

‘অনেক কিছুই করতে আমাদের রুচিতে বাধে ইকবাল ভাই। কিন্তু করতে হয়। বেঁচে থাকার ইচ্ছে আছে নিশ্চয়ই?’
প্রিয়তার দিকে নিষ্পলক কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল ইকবাল। প্রিয়তা ইকবালের ঠোঁটের কাছে গ্লাসটা ধরে চোখের ইশারায় বলল খেয়ে নিতে। ইকবাল তর্ক না করে খেয়ে নিল পানিটা। বেঁচে থাকা প্রয়োজন। পানি খাইয়ে ফাঁকা গ্লাসটা জয়ের হাতে দিল প্রিয়তা। মাথা নিচু করেই জায়গাটা ছাড়ল জয়।

প্রিয়তা আবার বসল সেই চেয়ারে। সম্রাটও আর দাঁড়িয়ে থাকল না। আরেকটা চেয়ার টেনে বসল। দীর্ঘসময় পর শুষ্ক গলায় পানি পড়াতে শরীর কেমন ছেড়ে দিল ইকবালের। ধীরে ধীরে শ্বাস নিল। তবে বুঝল কিছুটা শক্তি পাচ্ছে। ইকবালকে সামলে নিতে সময় দেয় প্রিয়তা। তবে বিষয়টা ভালো লাগল না সম্রাটের। মাথাটা প্রিয়তার দিকে এগিয়ে নিচু গলায় বলল, ‘এতো সময় নষ্ট করছো কেন? দুটো চড়-থাপ্পড় মেরে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলেই হয়।’

প্রিয়তা ইকবালের দিকে তাকিয়ে থেকেই দাঁতে দাঁত পিষে বলল, ‘তোমাদের কাজের ধারা নিয়ে কোন প্রশ্ন করিনি আমি। যা করেছো, নিজেদের মতো করেছ। সো, আমি যা করব, নিজের মতো, নিজের সিস্টেমে করব। এন্ড আই হোপ, তোমরা তাতে ইন্টারাপ্ট করবেনা। পেনড্রাইভটা পাওয়া অবধি ওর জীবিত থাকা প্রয়োজন সেটা ভুলে যেওনা।’
সম্রাট বলার মতো কিছু পেলনা। ভুল বলেনি প্রিয়তা। প্রায় দু মিনিট পর মুখ খুলল প্রিয়তা, ‘পেনড্রাইভটা কোথায় ইকবাল ভাই?’

ইকবাল ক্লান্ত, দুর্বল হাসি হেসে বলল, ‘তোমার সত্যিই মনে হচ্ছে আমি বলব?’
‘হচ্ছেনা। তবে কী বলোতো, একটু ফর্মালিটি করতে হয়। সেটুকুই করলাম। তবে বলে দেওয়াটা তোমার জন্যেই মঙ্গল।’
‘তুমি! সম্বোধনটা বদলে গেল দেখছি। যাই হোক, নিজের কোন মঙ্গলের আশা আমি আর করিনা প্রিয়তা।’
‘স্বার্থহীন হয়ে এ জগতে কোন লাভ হয়না ইকবাল ভাই। আমার কথা শোন। বলে দাও পেনড্রাইভটা কোথায় আছে। ব্লাক হোল বা ডার্ক নাইট কোনটাই জয়েন করতে হবেনা তোমাকে। আমাদের কাজটা হয়ে যাওয়ার আগ অবধি তোমাকে আটকে রাখব আমরা। তবে ওরা তোমার ওপর কোন টর্চার করবেনা। খাবার, শোবার জায়গা সবটাই পাবে। আরামে থাকবে। শুধুশুধু এতো কষ্ট সহ্য করে কী লাভ?’

‘সেটা বোঝার ক্ষমতা তোমার মতো বিশ্বাসঘাতিনীর নেই। একটুও অনুশোচনা নেই তোমার মধ্যে!’
প্রিয়তা ঠোঁট বাঁকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল, ‘আনুশোচনা! এথিকস! ক্রিমিনালদের মুখে এথিকসের কথা মানায় ইকবাল ভাই? আমরা দুটো দলই অপরাধী। অপরাধ জগতে কাজ করি। বিশ্বাসঘাতকতা করে পাপের ডিগ্রীটা একটু বাড়িয়েছি এই আরকি। কথায় আছেনা, এভ্রিথিং ইজ ফেয়ার ইন লাভ এন্ড অয়ার।’

ইকবাল অবাক হয়ে দেখল প্রিয়তার নির্লিপ্ততা। কিছু একটা চিন্তা করে বলল, ‘অনেক হিসেব আমার এখনো মিলছেনা প্রিয়তা। যদি ধরেও নেই তুমিই সবকিছুর পেছনে আছো। তবে এতোদিনেও রুদ্র বা রাশেদ বাবার কাছে ধরা পরলেনা কেন? এটাও সম্ভব? নিজেরই ঘরে একজন এতোকিছু করছে। অথচ তারা টেরটি পাচ্ছেনা! প্রথমত, তোমার সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার আগে রাশেদ বাবা নিজে গিয়েছিলেন সেই অনাথ আশ্রমে।

তোমার সমস্ত ব্যাকগ্রাউন্ড তার নখদর্পনে ছিল। যা আমিও দেখেছি। আর সেই রেকর্ড, ইনফরমেশন অনুযায়ী কোনভাবেই কোন দলের সঙ্গে যুক্ত থাকা সম্ভব নয় তোমার পক্ষে। দ্বিতীয়ত, আমের বাড়ির বউ তুমি। তোমার সুরক্ষার জন্যে কোনভাবেই তোমাকে একা ছাড়া হতোনা। ভার্সিটি বা মল যেখানেই বের হতে তোমার সঙ্গে গার্ড যেতো। আর দেখা সাক্ষাৎ ছাড়া এতো প্লানিং-প্লটিং কারো পক্ষে করা সম্ভব না। তুমি সেসব কীকরে করতে। কী দেখা করতে দলের লোকেদের সঙ্গে? কীকরে যোগাযোগ করতে?’

সম্রাট প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে হাসল। প্রিয়তা কৌতুকপূর্ণভাবে বলল, ‘ম্যাজিক!’
সম্রাট শায় দিয়ে বলল, ‘ঠিক রাশেদ আমেরের মৃত্যুর মতো।’
গা-পিত্তি জ্বলে উঠল ইকবালের। যখন মনে পড়ল সামনে বসে থাকা এই মেয়েটা রাশেদ আমেরের খু/নি। সবকিছু জ্বা/লিয়ে দিতে ইচ্ছে করল। রেগে গিয়ে বলল, ‘সত‍্যিই তুমি কালনাগিনী! কীকরে পারলে রাশেদ বাবাকে খু/ন করতে! আরে ঐ মানুষটা নিজের মেয়ের মতো আগলে রেখেছিল তোমাকে। ভালোবাসা দিয়েছিল। বিশ্বাস করে আমের ভিলার অন্দরমহল তুলে দিয়েছিল তোমার হাতে। ‘প্রিয়তা মা” বলে ডাকতো তোমাকে। একবারও হাত কাঁপলোনা তোমার। সর্বনাশিনী!’

সম্রাট আর চুপ থাকলোনা এবার। বিশ্রী এক গালি দিয়ে বলল, ‘তোর রাশেদ বাবাও জীবনে অনেককে খু/ন করেছিল। তার হাত কেঁপেছে, কু/ত্তারবাচ্চা!’
সম্রাটের গালিকে পাত্তা দিলোনা ইকবাল। ঘৃণাভর্তি চোখে তাকিয়ে প্রিয়তাকে বলল, ‘তখন ওরা বলছিল তুমি গর্ভবতী ছিলে। রুদ্রর সন্তান ছিল তোমার গর্ভে। নিজের স্বার্থে নিজের সন্তানকেও শেষ করলে? রাক্ষুসী নাকি তুমি!’
প্রিয়তার অনুভূতিহীন চোখে তাকিয়ে রইল ইকবালের দিকে। প্রায় একমিনিটের নীরবতার পর বলল, ‘পেনড্রাইভটা দিয়ে দিন ইকবাল ভাই। শেষবারের মতো ভালোভাবে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে আপনাকে।’

প্রিয়তার মুখের দিকে একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল ইকবাল। এতোটা অনুভূতিহীন এই মেয়ে! তার দেখা সবচেয়ে হার্টলেস মানুষ হল রুদ্র আমের। এই মেয়েটা কী তার চেয়েও বেশি? অনেককিছু খুটিয়ে ভাবার পর হঠাৎই কেঁদে ফেলল ইকবাল। অনুরোধের স্বরে বলল, ‘এমন করোনা প্রিয়তা। রুদ্র প্রচণ্ড ভালোবাসে তোমাকে। এই সত্যি যদি কোনভাবে ও জানতে পারে, ভেতর থেকে গুড়িয়ে যাবে। ছোটবেলা থেকেই প্রচুর কষ্ট পেয়েছে ও প্রিয়তা। ওর নিজের বলতে এখন কেবল তুমিই আছো। তোমাকে ওর খুব প্রয়োজন। এখনো সময় আছে। তুমি সব ছেড়ে রুদ্রর কাছে ফিরে যাও। ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখো ওকে। ছেলেটাকে এভাবে শেষ করে দিও না বোন। ভাই বলে ডেকেছো আমাকে। ছোট বোন হিসেবে অনুরোধ করছি।’

প্রিয়তা কাঠকাঠ গলায় বলল, ‘এজগতে সব সম্ভব হলেও “ফিরে আসা” ব্যপারটা সম্ভব না। সেটা আপনার চেয়ে ভালো কে জানে?’
‘একটা ছেলেকে অনবরত ঠকিয়ে যাচ্ছো। যে তোমার স্বামী। বিন্দুমাত্র কষ্ট হচ্ছেনা তোমার!’
‘ঐযে বললাম, এভ্রিথিং ইজ ফেয়ার ইন লাভ এন্ড অয়ার।’

তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল ইকবাল। বলল, ‘লাভ! তোমার কী মনে হয়? তোমার এই সত্যিটা জানার পর রুদ্রর মনে বিন্দুমাত্র ভালোবাসা থাকবে তোমার জন্যে? তোমার চেহারা দেখতেও ঘৃণা হবে ওর। ঘৃণা করবে তোমাকে।’
আচমকাই মুখভঙ্গি বদলে গেল প্রিয়তার। এতক্ষণের সেই শান্ত ভাব খসে পড়ল চেহারা থেকে। জ্বলে উঠল সম্মোহনী চোখদুটো। কিছুক্ষণ আগেও সম্রাটকে মারতে বারণ করেছিল। সেই প্রিয়তাই চেপে ধরল ইকবালের ক্ষতবিক্ষত হাতটা। গুঙ্গিয়ে উঠল ইকবাল। থুতনিতে হাত রেখে হাসল সম্রাট। এতক্ষণে ব্যপারটা উপভোগ করছে সে।
প্রিয়তা আরও শক্ত করে ইকবালের হাতটা চেপে ধরে ঝুঁকলো। হাতের পি/স্তলটা ঠেসে ধরল ইকবালের কপালে। ঘনঘন শ্বাস ফেলতে ফেলতে অস্থির কন্ঠে বলল, ‘এসব বলেনা ইকবাল ভাই! সব সহ্য হলেও এই কথাগুলো একদম সহ্য হয়না আমার। একদম না।’

অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে প্রিয়তার দিকে তাকাল ইকবাল। অদ্ভুত হিংস্রতায় জ্বলজ্বল করছে প্রিয়তার চোখজোড়া। মুখজুড়ে অদ্ভুত উন্মাদনা। এই সেই প্রিয়তা যার চোখে কেবল মায়া ছিল? যার সুন্দর মুখটা দেখলে প্রশান্তিতে বুক ভরে যেতো? এই মুহূর্তে সাক্ষাৎ উন্মাদ, বিনাশিনী মনে হচ্ছে ওকে। যে কেবল ধ্বংস করতে জানে। দুলতে থাকা বাল্বের আলোয় আরও ভয়ানক লাগছে সে দৃশ্য। দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথা সহ্য করছে ইকবাল। না চাইতেও গুঙ্গিয়ে উঠছে।
আস্তে করে হাত সরিয়ে নিল প্রিয়তা। পি/স্তল নামাল। লম্বা শ্বাস ফেলে নিজেকে সামলে নিল। থমথমে গলায় বলল, ‘তাহলে তুমি বলবেনা পেনড্রাইভ কোথায়?’

‘মরে গেলেও না।’ জেদ চেপে গেছে ইকবালের মাথায়।
প্রিয়তা উঠে দাঁড়াল। আফসোসের ভঙ্গিতে মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘বেশ। আমি তোমার কষ্টটা কমাতে এসেছিলাম। কিন্তু তোমার যখন সে ইচ্ছে নেই। আমিও আর সেই চেষ্টা করলাম না। আমিও দেখি ইকবাল ভাই আর কতটা কষ্ট সহ্য করতে পারে।’
সম্রাটও উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘তোমাকেতো আগেই বলেছিলাম ভালো কথায় শোনার লোক এ নয়। তুমিই শুনছিলে না আমার কথা।’

উত্তর দিলোনা প্রিয়তা। ইকবালের দিকে একপলক তাকিয়ে বেরিয়ে গেল ঘরটা থেকে। সম্রাটও প্রিয়তার পেছন পেছন বের হল। হতভম্ব হয়ে ওদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল ইকবাল। জুতোর শব্দ মিলিয়ে যেতেই মনে হল ভয়ানক কোন দুঃস্বপ্ন দেখে উঠেছে ও। খুব ভয়ানক। এটা সত্যিই প্রিয়তা ছিল? প্রিয়তা! সেই কোমল, সুন্দর, ফুলের মতো মেয়েটার আসল রূপ কি-না এতো হিংস্র, ভয়ানক! এতো নিঁখুত অভিনয়! যেখানে ওর নিজের এই নিষ্ঠুর সত্যিটা মানতে কষ্ট হচ্ছে। সেখানে রুদ্র কীকরে সহ্য করবে? কীকরে মানবে, তার ভালোবাসার মানুষটাই তার বিনাশের কারণ? কী ঘটবে, যখন প্রিয়তার আসল রূপ রুদ্রর সামনে আসবে?

ভাঁজ করা কাগজটা খুলে কিছুই পেলোনা রুদ্র। ব্যপারটা হজম হলোনা ওর। কিচ্ছু নেই! এতো পরিশ্রম করে, বালিশ কেটে ভেতরে একটা ফাঁকা কাগজ কেন রাখবে ইকবাল? নিশ্চয়ই এর পেছনে কিছু আছে। কোন সংকেত, কোন ক্লু। কিন্তু কিছুই তো নেই। কাগজটা আরও একবার নেড়ে দেখেও কিছু পেলনা। রাগ হল রুদ্রর। ধৈর্য্য হারালো। একটানে ছিড়ে ফেলল বালিশটা। তুলোগুলো এলোমেলো করে ছড়িয়ে ফেলল চারপাশে।

একদফা তান্ডব করে চাদরহীন তোষকের ওপর থম মেরে বসে রইল ও। মানসিকভাবে ক্লান্ত বোধ করছে এই মুহূর্তে রুদ্র। একা আর কত লড়বে ও? এমন কেউ নেই যাকে ও ওর মনের কথা বলতে পারে। নিয়তি ওকে এমন পরিস্থিতিতে এনে দাঁড় করিয়েছে যে আশেপাশের বাতাসকেও বিশ্বাস করে উঠতে পারছেনা। রাশেদ আমেরের কথা মনে পড়ছে ভীষণ। ঐ লোকটা বেঁচে থাকলে কতটা হালকা বোধ করতো রুদ্র আজ। ঐ মানুষটা ওর কতবড় ভরসার জায়গা ছিল সেটা এখন উপলব্ধি করতে পারে রুদ্র। লোকটা চলে যাওয়ার পর।

হাতের দিকে চোখ যেতেই ব্রেসলেটটা দেখল। প্রিয়তা উপহার দিয়েছিল এই ব্রেসলেটটা ওকে। প্রিয়তার কথা মনে পড়তেই বুকের মধ্যে খাঁ খাঁ করে উঠল রুদ্রর। ঐ মেয়েটা কাছে থাকলেও আজ এতো ভার লাগতোনা ওর। নির্দ্বিধায় মনের সব অশান্তির কথা বলতে পারতো নিজের প্রিয়কে। দু হাতে মুখ চেপে ধরে উঁবু হল রুদ্র। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘কোথায় আছো প্রিয়? আই নিড ইউ।’

পাবটা সম্রাটের নিজস্ব। করিম তাজওয়ার নিজের এই পাবটা লিখে দিয়েছিলেন সম্রাটের নামে। সেই পাবেরই আলাদা প্রাইভেট রুমে, নরম, দামি কাউচে বসে আছে প্রিয়তা। বসে আছে বলতে, গা ছেড়ে হেলান দিয়ে আছে বলা যায়। ফোন স্ক্রোল করে চলেছে নিরুৎসুকভাবে। পাশের রুমে গান বাজছে, নাচ হচ্ছে। ডিস্ক লাইটের আলোয় জাকজমক পরিবেশ।
হুইস্কির দুটো বোতল নিয়ে এলো সম্রাট। প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল। বোতলদুটো রাখল টি-টেবিলে। প্রিয়তার পাশে বসে আরেকবার তাকাল ওর দিকে। কিন্তু প্রিয়তার সম্পূর্ণ মনোযোগ মোবাইলে। সম্রাট দুটো গ্লাসে হুইস্কি ঢালতে ঢালতে বলল, ‘রুম বুক করব একটা?’

লম্বা একটা হাই তুলল প্রিয়তা। অলস ভঙ্গিতে ফোনটা নামিয়ে রাখল। ড্রিংকের গ্লাসটা হাতে নিয়ে বলল, ‘দরকার নেই। বাকি রাতটা এখানেই থাকবো।’
‘তোমাকে ক্লান্ত মনে হচ্ছে। আই থিংক ঘুম দরকার ছিল তোমার। রুম বুক করে দিতে পারি তোমাকে।’
‘শরীরটা আমার সম্রাট। আমি জানি আমার কী দরকার।’
‘তুমি কী আপসেট কোনকারণে?’ নিজের গ্লাসটা হাতে নিয়ে বলল সম্রাট।
বিরক্ত হয়ে সম্রাটের দিকে তাকাশ প্রিয়তা, ‘বেশি কথা বলছোনা?’

সম্রাট আর ঘাটালো না প্রিয়তাকে। গ্লাসে একটা চুমুক দিয়ে সিগারেটের প্যাকেট খুলল। দুটো সিগারেট বের করে একটা এগিয়ে দিল প্রিয়তার দিকে। প্রিয়তা দক্ষ হাতে ডান হাতের দু আঙ্গুলের মাঝে নিল সেটা। বাঁ হাতে চুমুক দিল ড্রিংকে। লাইটার দিয়ে নিজের আর প্রিয়তার সিগারেট জ্বালিয়ে দিল সম্রাট। বলল, ‘তুমি আজ সেভাবে জিজ্ঞেস করলেনা ইকবালকে।’

‘কোনভাবে জিজ্ঞেস করা বাদ রেখেছো কী? বলেনিতো। আর আমার মনে হয়না বলবে।’
‘না বললে পরিণতি কী হবে তোমার অজানা নয়। তবুও এতো নির্বিকার কীকরে?’
‘অযথা চিন্তা করে মাথা নষ্ট করতে চাইছিনা। এমনিতেও মাথা নষ্ট করার অনেক কারণ আছে। যেকোন সময় রুদ্র আমাকে খোঁজা শুরু করে দেবে। নিরাপত্তার জন্যে পেছনে লোক লাগাবে। সেটা কীকরে সামলাব আপাতত সেটা ভাবতে দাও।

বলে সিগারেটে টান দিল প্রিয়তা। চোখ-মুখ কুঁচকে ফেলল। সম্রাট বলল, ‘তার আগেই ওকে সরিয়ে ফেলছিনা কেন আমরা?’
প্রিয়তা কিছু বলল না। আরও দুটো টান দিয়ে সিগারেটটা গুঁজে রাখল অ‍্যাশট্রেতে। পানসে গলায় বলল, ‘সিগারেটের ব্র্যান্ডটা চেঞ্জ করবে। খুব বাজে। রুদ্রর সিগারেটের ব্র্যান্ডটা চমৎকার। ট্রায় করতে পারো।’
চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল সম্রাটের। কিন্তু সামলে নিল নিজেকে। জোরপূর্বক একটু হেসে বলল, ‘তোমাকে সত্যিই ক্লান্ত মনে হচ্ছে। আমরা একটা রুম বুক করি।’

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৬৮

প্রিয়তা একঢোকে ফাঁকা করল গ্লাসটা। উঠে দাঁড়াল। কপাল কুঁচকে বলল, ‘ড্রিংকের ব্রান্ডটাও ঠিকঠাক আনতে পারোনি। বাজে টেস্ট। আমি চেঞ্জ করে নিয়ে আসছি।’
বলে বোতল দুটো নিয়ে চলে গেল প্রিয়তা। প্রিয়তার যাওয়ার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সম্রাট। নিজের গ্লাসটাও ফাঁকা করল এক নিঃশ্বাসে। শব্দ করে গ্লাসটা টি-টেবিলে রেখে দাঁতে দাঁতে পিষে আনমনে বলল, ‘তোমার পছন্দের ব্র‍্যান্ডগুলো বড্ড বেশি পরিবর্তনশীল রানি!’

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৭০