অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৯

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৯
লেখিকা: অনিমা কোতয়াল

রুদ্রের কথা শুনে যেন দুনিয়া ঘুরতে শুরু করল রিপনের। কী বলছে কী রুদ্র? কীভাবে বলছে? ওনার এতো যত্নে গড়ে তোলা কোম্পানিটা অবশেষে হাতাতে চাইছে এই সন্ত্রাসী? রিপন হতভম্ব অবস্থায় বলল, ‘আপনার ধারণা আছে আপনি কী বলছেন?’
রুদ্র সোফায় হেলান দিয়ে রিপনের চোখে চোখ রেখে বলল, ‘আমি ধারণা না করে কিছু বলিনা চৌধুরী।’
‘ তাই বলে আপনি আমার কোম্পানিটা চেয়ে বসতে পারেন না। এই কোম্পানি আমার সব। আমি এটা দিয়ে দিতে পারবনা, কিছুতেই না।’ নিজের ক্রোধ সংবরণ করে বলল রিপন।
রুদ্র নির্বিকার কন্ঠে বলল, ‘ভেবে বলছেন?’

রিপন নিজের কন্ঠের দৃঢ়তা বজায় রাখার পূর্ণ চেষ্টা করে বলল, ‘এখানে ভাবার কোন প্রশ্নই নেই।’
‘ তাহলে আমিও আর কিছু ভাবতে গেলাম না। আমাকে সেটাই করতে হবে যেটা আমি মোটেও করতে চাইছিলাম না। আপনার এই এনার্জেটিক মুভিটা আমাকে রিলিজ করে দিতে হবে।’
রিপন চৌধুরীর চোখেমুখে এবার অসহায়ত্ত্বের ছাপ ফুটে উঠল। কিছুক্ষণ আগের সেই দৃঢ়তা আর নির্ভীকতায় অবশেষে সম্পূর্ণ ভাটা পড়ল। রিপন করুণ গলায় বলল, ‘আমি নিঃস্ব হয়ে যাব মি. রুদ্র। আমি একা নই। আমার স্ত্রী আছে, পাঁচ বছরের একটা মেয়ে আছে। বোঝার চেষ্টা করুন।’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘আমার লোকও আপনাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল চৌধুরী। কিন্তু আপনি বোঝেননি। নিমন্ত্রণ ছাড়াই বাড়ি বয়ে আসতে হল আমাকে। এখন আমি কীকরে বুঝি বলুনতো? আমার ঘাড়টা আপনার চেয়ে কয়েকগুন বেশি ত্যাড়া। নাথিং টু ডু নাও।’
অস্হির হয়ে উঠল রিপন চৌধুরী। সবকিছু হারানোর ভয়ে উন্মাদ হয়ে উঠল তার মন। ঘামে ভিজে গেছে বেচারা। উচ্ছ্বাস একটা উইল বের করে টি-টেবিলে রেখে বলল, ‘লক্ষ্মী ছেলের মতো সইটা করে দিন তো এবার। অনেক কথা হয়েছে। না করলে কী হবে সেটাতো রুদ্র বলেছেই।’

গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এলো রিপনের। আর কী কিছুই করার নেই? সব শেষ হয়ে যাবে? একটা ভুলের জন্যে নিমেষেই সব শেষ হয়ে যাবে তার? এতো অল্প সময়ে এই কোম্পানি দাঁড় করাতে অনেক অসৎ উপায় অবলম্বন করতে হয়েছে তাকে। অনেক অবৈধ রাস্তা ধরে তবেই দাঁড়িয়েছে এই ব্যবসা। সব শেষ? হঠাৎই কান্না পেল তার। রুদ্রের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে বুঝল রুদ্র নিজের সিদ্ধান্তে অনড়। তার কঠিন দৃষ্টিই বলে দিচ্ছে যে সই করার আগে তোমার নিস্তার নেই। রুদ্রের এই তেজের কাছে রিপন চৌধুরী এবার সম্পূর্ণ নিভল। নিজের হাত দুটো জোর করে করুণ গলায় বলল, ‘আমার ওপর দয়া করুন মি. রুদ্র। নইলে পথে বসতে হবে আমাকে। আগের করা ব্যবহারগুলোর জন্যে আমি সত্যি সত্যিই ভীষণ দুঃখিত।’

রুদ্র এবার সোজা হয়ে বসল। যেন এতক্ষণ এটা শোনার জন্যেই অপেক্ষা করছিল সে। কফির মগে শেষ চুমুকটুকু দিয়ে টি-টেবিলে রাখল মগটা। এরপর রিপনের দিকে তাকিয়ে চোখে হাসল। উচ্ছ্বাস ফিরিয়ে নিল উইল পেপারটা। তা দেখে রিপন চৌধুরী অবাক হল। রুদ্র বলল, ‘একটু দয়া হল আপনার ওপর। তাই আজকের মতো উইলটা ফিরিয়ে নিলাম। তবে আশা করবো কাল সকাল দশটার মধ্যে দু কোটি পৌঁছে যাবে আমাদের কাছে। শুধু তাইনা এরপর ভবিষ্যতে যখন যত টাকা চাইব ঠিক সময়মতো আমাদের হাতে এসে পৌঁছে যাবে।’

রিপন চৌধুরী কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে চেয়ে রইল রুদ্রের মুখের দিকে। শব্দগুলো গলায় আটকে গেল যেন। রুদ্র আবার বলল, ‘পৌঁছে যাবে তো?’
হুশ এল রিপনের। এখন আর সেই দাপট বা সাহস নেই তার। দ্রুত গতিতে মাথা নাড়ল সে। রুদ্র এবার উঠে দাঁড়ালো সাথে উচ্ছ্বাসও। রিপনের দিকে তাকিয়ে আরেকটা বিদ্রূপের হাসি হেসে বেরিয়ে এলো ওখান থেকে। রিপন তাদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে পকেট থেকে রুমালটা বের করে দ্রুত সারা মুখের ঘাম মুছে নিল। মানুষ নয় যেন সাক্ষাৎ প্রলয় বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে।

লিফট দিয়ে নিচে নামতে নামতে রুদ্র ভাবল লোকটাকে এতো নাকানিচুবানি খাওয়ানোর ইচ্ছা ছিলোনা তার। পরিকল্পনা ছিল টাকা দিতে রাজি হলেই চলে আসবে। কিন্তু ভদ্র লোকের করা ঔদ্ধত্য মোটেও পছন্দ হয়নি রুদ্রের। লোকটা যেই মুহূর্তে ওর সাথে উঁচু গলায় কথাগুলো বলছিল, তখনই ও ঠিক করে ফেলেছিল এই উঁচু গলা যতক্ষণ পর্যন্ত মিইয়ে না যাবে এবং লোকটার দাপট ভেঙ্গে ওর কাছে হাত জোড় করতে বাধ্য না করবে ততক্ষণ পর্যন্ত রুদ্র একে ছাড়বেনা। ব্যবস্থা তো আগেই করে নিয়ে গিয়েছিল। সেটা কাজে লেগে গেছে।

গুলশান উত্তর ক্লাব থেকে কিছুটা দূরে আমের ফাউন্ডেশনের অফিস। আমের পরিবারের তৈরী করা ফাউন্ডেশন এটা। এই ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে করা জনসেবামূলক কাজগুলোর জন্যেই রাশেদ আমেরকে সবাই এতো ভক্তি আর শ্রদ্ধার চোখে দেখে। ঐসব অসহায় মানুষরা যেকোন বিপদে পড়লেই ছুটে আসে তাদের রাশেদ বাবার কাছে। সেটা ঋণ হোক, কোন অন্যায়কারীর ওপর অভিযোগ হোক কিংবা কোন আর্থিক সমস্যার সমাধান। আজ অবধি তারা কেউই খালি হাতে ফিরে যায়নি এখান থেকে।

অপরদিকে তাদের ওপর নির্যাতনকারীরা অদ্ভুতভাবেই গায়েব হয়ে যায় হঠাৎ করে। কেউ গুলশান ছেড়ে চলে যায়, আর কেউ নিখোঁজ হয়ে যায়। কেন এরকম হয় তা তারা কেউ জানেনা। সে এক রহস্য। তবে এসব সরল মানুষগুলোর কাছে রাশেদ তাদের পিতা। তাদের মাথার ওপরের ছত্রছায়া। এই মানুষগুলোর মধ্যে এমন অনেকেই আছে যারা এক কথায় রাশেদের জন্যে নিজেদের প্রাণও দিতে পারবে।

নিজের চেয়ারে বসে আছে রাশেদ আমের। গম্ভীর চোখে ফাইলে তাকিয়ে হিসেবগুলো দেখছে। মাঝেমাঝে ছোটখাটো প্রশ্ন ছুড়ছে পাশে থাকা ছোট ভাই জাফরের উদ্দেশ্যে। হঠাৎ রুমের দরজার কাছে এক লোক এসে বলল, ‘রাশেদ বাবা, ইন্সপেক্টর আজিজ এসেছেন।’
ফাইল থেকে চোখ তুলে তাকাল রাশেদ। মুখভঙ্গি একদম নির্বিকার। যেন ইন্সপেক্টর আসা কিংবা না আসাতে তার কিছুই যায় আসেনা। জাফর বলল, ‘কী ব্যপার ইকবাল? হঠাৎ ইন্সপেক্টর এখানে?’
ইকবাল রাশেদের অন্যতম কাছের লোক। বয়স চল্লিশ। পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চির মেদহীন সুস্হ শরীর তার। টাকা পয়সার হিসেব রাখা এবং অন্যান্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ সে-ই করে। সে একবার বাইরে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, ‘ জানিনা। বলল রাশেদ বাবার সাথে কথা বলতে চায়।’

‘ আসতে বলো।’
আবার ফাইলে চোখ রেখে গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠল রাশেদ। কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে হাজির হলেন ইন্সপেক্টর আজিজ। আশেপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিল। আমের ফাউন্ডেশন! তাচ্ছিল্যের হাসি প্রকাশ পেল তার ঠোঁটে। আন্ডারওয়ার্ল্ড নিয়ন্ত্রণকারীদের প্রায় অনেকেরই এমন ব্যবসা, ফাউন্ডেশন থাকে। এসবতো কেবল নিজের অপকর্মগুলো আড়ালে রাখার মাধ্যম মাত্র। চোখের ধোঁকা। যেটা ধরা পড়ে যাওয়া অধিকাংশ সন্ত্রাসীর ফাইল ঘাটলেই বোঝা যায়। কী দারুণ পদ্ধতি!

এসব ভাবতে ভাবতে রাশেদের দিকে তাকাতেই কেমন থমকে গেল আজিজ। এতক্ষণ যেই তীব্র রাগ আর ঘৃণা নিয়ে এখানে প্রবেশ করেছিল, কোন এক জাদুর মতো করেই যেন উধাও হয়ে গেল সেই আক্রোশ। এই লোকটাকে দেখলে অকারণেই নিভে যায় সে। লোকটার অঙ্গভঙ্গি, কথা বলার ধরণ, ব্যক্তিত্ব কেমন নুইয়ে দেয় তাকে। ভীষণ শ্রদ্ধা জেগে ওঠে মনে। আজিজ একপ্রকার ভুলেই যায় সে একজন পুলিশ আর এই রাশেদ একজন সন্ত্রাসী। যাকে বাগে পাওয়ার কোন চেষ্টার-ই ত্রুটি রাখেনি সে। কিন্তু বরাবরই ব্যর্থ হয়েছে। ফাইল থেকে চোখ না সরিয়েই রাশেদ বলল, ‘ বসুন ইন্সপেক্টর। আজ হঠাৎ আমার এখানে পা পড়ল?’

আজিজের হুশ ফিরল। সঙ্গেসঙ্গে নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক করে গিয়ে বসল একটা চেয়ার টেনে। জাফর জিজ্ঞেস করল, ‘ চা খাবেন তো?’
আজিজ হাসল। নিজের গোঁফে আঙুল বুলিয়ে বলল, ‘খাওয়ার ইচ্ছেতো ছিল, কিন্তু সময় নেই। অন্য একদিন নিশ্চয়ই খাব। বলার জন্যে ধন্যবাদ।’

রাশেদ ফাইলটা বন্ধ করে পাশে রেখে এবার ভালোভাবে তাকাল আজিজের দিকে। এই স্বচ্ছ এবং বিজ্ঞ দৃষ্টি দেখে আজিজ আবার নুইয়ে পড়তে চাইল। কিন্তু নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে বলল, ‘কী বলে ডাকব? মি. রাশেদ আমের নাকি রাশেদ বাবা?’
হেসে ফেলল রাশেদ। নিজের চাপ দাড়িতে একবার হাত বুলিয়ে বলল, ‘ আমি কাউকে কিছুই ডাকতে বলিনা আজিজ সাহেব। যার যে নামে ভালো লাগে সেই নামেই ডাকে। যাই হোক, আপনি কেন এসেছেন সেটা বলুন।’

ভনিতা ছেড়ে এবার মূল প্রসঙ্গে এসে ইন্সপেক্টর বলল, ‘ সবুজের মৃত্যু সংবাদ পেয়েছেন নিশ্চয়ই। আজ বিকেলে আরেকটা লাশ পেয়েছি। আপনার দলেরই সে। তাছাড়াও আপনার দলের খোকনও নিখোঁজ। সেটাও শুনেছেন নিশ্চয়ই?’
রাশেদ বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বলল, ‘ শুনেছি। তবে ওরা আমার কোন দলের লোক নয়। আমার ব্যবসার কর্মচারী।’

আজিজ তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল। লোকটা তবুও স্বীকার করবেনা যে তার দল আছে! পুনরায় গোঁফে তর্জনী আর বৃদ্ধা আঙুল একসঙ্গে বুলিয়ে আজিজ বলল, ‘আচ্ছা বেশ। কিন্তু হঠাৎ আপনার চারজন কর্মচারীর ( টিককারি মেরে ) সাথেই এমন হল কেন?’
রাশেদ ঠোঁটে হালকা হাসি রেখে বলল, ‘কর্মচারীর ওরা। আসে, কাজ করে, কাজ শেষে সময়মতো চলেও যায়। বাকি সময়টা ওরা কী করে, কোথায় যায় সেটা দেখার দায়িত্ব মোটেও আমার নয়। খুন বা নিখোঁজ হলে সেটা নিয়ে আপনার ভাবার কথা। ভাবুন।’
স্হির চোখে চেয়ে রইল আজিজ। কী অদ্ভুত আত্মবিশ্বাস! এরপর একই ভঙ্গিতে হেসে মাথা দুলিয়ে বলল, ‘ঠিক বলেছেন। তা রুদ্র কোথায়?’

রাশেদ একবার হাতের ঘড়িটাতে সময় দেখে বলল, ‘জোয়ান ছেলে। নিজের ইচ্ছায় ঘুরে বেরায়। আছে হয়তো কোথাও। বাচ্চাতো নয় যে দেখে দেখে রাখব।’
‘ সেটাও ঠিক। কিন্তু জোয়ান ছেলে ফোন নিশ্চয়ই ব্যবহার করে? ফোন করে বলে একটু থানায় পাঠিয়ে দিলে খুশি হতাম। কিছু আলাপ আলোচনা ছিল।’
ইন্সপেক্টরের কথায় আবার হাসল রাশেদ। বলল, ‘ রাতেই পাঠাব?’

‘ তার প্রয়োজন নেই। কাল সকালের মধ্যে এলেই আমার উপকার হয়।’ কন্ঠে সামান্য বিদ্রূপ আজিজের।
মাথা নাড়ল রাশেদ। ইন্সপেক্টর আজিজ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আজ তাহলে আসি মি. আমের। সরি সরি, রাশেদ বাবা।’
রাশেদ মুখে সেই অসামান্য হাসি রেখেই তাকিয়ে রইল আজিজের দিকে। আজিজ চলে যেতে নিয়েও থেমে গেল। কিছু একটা চিন্তা করে পেছন ঘুরে বলল, ‘ অনৈতিকতার এই পথে ছেলেটাকে না ঠেলে দিলে হতোনা আমের সাহেব? উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ ছিল তার।’

রাশেদ একই দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আজিজের দিকে। তবে ঠোঁটের হাসিটা আর নেই। সোজা হয়ে বসে রাশেদ তার সেই দৃঢ় কন্ঠে বলল, ‘এটাকে কলি যুগ বলে ইন্সপেক্টর। দানব এখন মানুষের মধ্যেই বাস করে। দানব আমরা সকলেই। স্বার্থে ঘা লাগলে সবার ভেতর থেকেই দানব বেরিয়ে আসে। পার্থক্য একটাই যার অসুরত্ব সবার আড়ালে থাকে সে সাধু আর যারটা প্রকাশ পায় সে পশু। আমি জানি আমি কী করছি।’

ইন্সপেক্টর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কথার মারপ্যাঁচে এই অদম্য, দৃঢ়, অসাধারণ ব্যক্তিকে হারানো তার কর্ম নয়। একপলক রাশেদের দিকে তাকিয়ে বেরিয়ে গেলেন সেখান থেকে। রাশেদ হেলান দিয়ে গা ছেড়ে বসে রইল নিজের চেয়ারে। সিলিং এর দিকে স্হির দৃষ্টি নিক্ষেপ করে করে মেলাতে লাগলেন নিজের জীবনের হিসেব।

গুলশানের রোড-৫০ দিয়ে মাঝারি গতিতে চলছে রুদ্রর জিপটা। শিস বাজাতে বাজাতে স্টেয়ারিং ঘোরাচ্ছে সে। রাস্তায় খুব বেশি গাড়ি নেই, আশেপাশের বিল্ডিং থেকে আসা আলোতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে চারপাশ। আকাশটা মেঘলা, বাতাস বইছে স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা বেশি গতিতে। সম্ভবত রাতে বৃষ্টি হবে। অনেকক্ষণের নিরবতার পর উচ্ছ্বাস মুখ খুলল, ‘একটা কথা বলতো ভাই! তোর কাছে ঐ ভেজা বেড়ালের রাতের কিচ্ছার খবর এলো কীকরে? আর এই ভিডিওটাই বা পেলি কোথায়?’

রুদ্র কিছু না বলে আপন মনে গাড়ি চালাচ্ছে। উচ্ছ্বাসের করা প্রশ্নে তার কোন আগ্রহ নেই। উচ্ছ্বাস বিরক্তি নিয়ে বলল, ‘দেখ, সবসময় এতো সাসপেন্সে রাখবিনা, ভালোলাগেনা। শালা সাসপেন্সের চাপ সহ্য হয়না বলে থ্রিলার মুভি দেখিনা। বলনা রে ভাই।’
রুদ্র একপলক উচ্ছ্বাসের দিকে তাকিয়ে আবার রাস্তার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ তুই জেনে কী করবি?’

‘ তুই বলবি না?’
‘ বলব।’
‘ তাহলে বল?’
‘ যেই তিন কম্পানির কাছে চাঁদা চাওয়া হয়েছিল তাদের প্রত্যেকের খবরই আমার নখদর্পনে। তাদের স্ট্রেন্থ আর উইকনেস দুটোই জানা আমার। রিপন চৌধুরী আমার বন্দুককে ভয় পাবেন না জানতাম আমি। এটাও জানতাম তাঁর মেয়ের নেশা আছে। মাঝেমাঝেই হোটেল ওয়েস্টিন এ ঢোকেন তিনি। আর গতবার নিজের নতুন পিএ কে নিয়ে ঢুকেছিলেন। আর তার একদিন আগে আমি তার সেই পিএ এর সাথে দেখা করেছিলাম। ভিডিওটা ওনার পিএ নিজেই করেছে। আর সেটা অবশ্যই আমার কথায়।’

উচ্ছ্বাস এতক্ষণ মুখটা হাফ ইঞ্চি ফাঁক করে শুনছিল। রুদ্র থামতেই সে আবার বলল, ‘ মেয়েটা তোর কথায় রাজি হয়ে গেল? কেন?’
রুদ্র আরও একবার উচ্ছ্বাসের দিকে তাকিয়ে চোখ চিপ মারল। ব্যপারটা বুঝতে আর অসুবিধা হলো না উচ্ছ্বাসের। ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে হেসে ফেলল সে। মাথা দুলিয়ে বলল, ‘শালা হারামী!’

এরমধ্যেই ফোন বেজে উঠল রুদ্রের। ড্রাইভিং করতে করতে ফোনটা বের করে বাঁ হাতে কানে ধরল। ওপাশ থেকে আসা কথাগুলো চুপচাপ শুনে গেল রুদ্র। শেষে ‘ঠিক আছে’ শব্দ দুটো বলে কল কেটে যথা স্হানে রেখে দিল ফোন। এতক্ষণে নিশ্চিন্তে গাড়ি চালানো রুদ্র এবার সামান্য ভাবুক হল। সেটা খেয়াল করে উচ্ছ্বাস বলল, ‘ কী হয়েছে?’

‘ বাবার ফোন ছিল। ইন্সপেক্টর ডেকেছে আমায়। কাল সকলে যেতে হবে।’ স্বাভাবিক কন্ঠস্বর রুদ্রের।
উচ্ছ্বাস একটা শ্বাস ফেলে বলল, ‘ এটা আর নতুন কী? সবুজের মার্ডার কেস নিশ্চয়ই?’
‘ সেটা আমিও ভেবেছিলাম। কিন্তু বাবা বলল দলের আরও একজন খুন হয়েছে।’
‘ খোকন?’ অবাক হল উচ্ছ্বাস।
রুদ্র মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘ না, খোকনকে আমি শহরের বাইরে নিয়ে মেরেছি। এতো তাড়াতাড়ি লাশ আইডেন্টিফাই করে এই থানা অবধি কেস আসা সম্ভব না।’

‘ তাহলে?’
‘ আমিও সেটাই ভাবছি।’
উচ্ছ্বাস কিছু বলল না। রুদ্র জিপটা নিয়ে ইউনাইটেড হসপিটাল থেকে খানিকটা দূরে থামাল। জিপ থেকে বেরিয়ে জিপের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়াল সে। উচ্ছ্বাস দোকান থেকে দু প্যাকেট সিগারেট কিনে নিয়ে এসে এক প্যাকেট রুদ্রর দিকে ছুড়ে মারল। না তাকিয়েই ক্যাচ করে ফেলল সে। নিজের জিপের পেছন দিকে চড়ে বসল পা ওপরে তুলে। এরপর আপন মনে সিগারেট টানতে লাগল। রুদ্র ঠোঁটের মাঝে সিগারেট নিলেও এখনো জ্বালায় নি। ফোনে কিছু দেখছে সে। কিছুক্ষণ পর ফোনটা পকেটে রেখে লাইটার দিয়ে সিগারেটটা জ্বালাতেই উচ্ছ্বাস সাথে সাথে সিগারেটটা ফেলে দিল। জ্বলন্ত সিগারেট আরেকটু হলে রুদ্রের পায়ে এসে লাগত। রুদ্র রেগে বলল,

‘ শালা তুই_’
উচ্ছ্বাসের দিকে চোখ পড়তেই থেমে গেল রুদ্র। কারণ উচ্ছ্বাস আজব দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রাস্তার ওপাশে। রুদ্র ঠোঁটে সিগারেটটা ধরে রেখেই উচ্ছ্বাসের দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখল একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার ওপাশে। কালো থ্রি-পিস পরনে। চুলগুলো ওপরে কাঠি দিয়ে আটকানো। কাঁধে মাঝারি বড় একটা হ্যান্ড ব্যাগ। গোলগাল সুন্দর চেহারা। রিকশা থামানোর চেষ্টায় আছে সে। মেয়েটা উচ্ছ্বাসের দিকে তাকাতেই উচ্ছ্বাস হাসার চেষ্টা করল। কিন্তু হাসতে পারল না বেচারা। মেয়েটা বিরক্তি আর ক্রোধ মিশ্রিত চোখে তাকাল তাদের দিকে। একটা রিকশা থামতেই হনহনে পায়ে উঠে পড়ল তাতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই চোখের আড়াল হয়ে গেল রমনী। যতক্ষণ দেখা গেছে ততক্ষণ তাকিয়ে রইল উচ্ছ্বাস সেদিকে। মেয়েটা চলে যেতেই মুখ ফুলিয়ে হতাশ ভঙ্গিতে আরেকটা সিগারেট বের করল উচ্ছ্বাস। রুদ্র ঠোঁট থেকে সিগারেট নামিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে বলল, ‘মেয়েটা কে?’

ঠোঁটের মাঝে সিগারেট রেখে লাইটার হাতে নিয়ে উচ্ছ্বাস বলল, ‘নাজিফা।’
‘ কী করে?’
‘ নার্স। সামনের হাসপিটালেরই। এখান দিয়েই রোজ যায়-আসে। বাড়ি বেশি দূরে না।’
‘ এতো খবর? প্রেম করছিস নাকি?’
‘ করতে আর পারলাম কই। ভালো লাগে ওকে। কিন্তু ও হয়তো আমাকে পছন্দ করেনা।’
‘ করার কথাও না। পছন্দ করার মতো বিশেষ কোন কোয়ালিটি তোর মধ্যে নেই।’

উচ্ছ্বাস বিরক্তি নিয়ে তাকাল রুদ্রের দিকে। সিগারেটে আরেকটা টান দিয়ে বলল, ‘কোথায় বন্ধুকে সাহায্য করবি উল্টে মই হাতে নিয়ে আমার পাকা_ ও সরি পাকল আর কই? কাঁচা ধানের সামনেই দাঁড়িয়ে আছিস।’
রুদ্র নিজেও এবার জিপের ওপর পা তুলে বসে বলল, ‘দুঃখিত বৎস। বাবার কড়া নির্দেশ মেয়েদের দিকে কুনজর দেওয়া যাবেনা। সুতরাং তোমাকে কোনরকম সাহায্য করতে পারলাম না।’

উচ্ছ্বাস রুদ্রের পিঠে জোরে একটা চাপড় মেরে বলল, ‘ শালা, আমার শুদ্ধ ভালোবাসাটাকে ডিরেক্ট কুনজর বানিয়ে দিলি?’
রুদ্র আকাশের দিকে দৃষ্টি মেলে বলল, ‘ভালোবাসা বলে কিছু হয়না। সবটাই চোখের ভালোলাগা। শারীরিক আকর্ষণ। আজ আছে কাল থাকবেনা।’

উচ্ছ্বাস প্রচন্ড বিরক্ত হল। চোখ-মুখ কুঁচকে বিতৃষ্ণা নিয়ে বলল, ‘থামতো! তোর এই জন্মে প্রেম হবেনা। আর যদি ভুল করে হয়েও যায় তোর কপালে সেই প্রেম সইবেনা। সরল মনে অভিশাপ দিলাম। একশতে একশ মিলবে। দেখে নিস।’

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৮

রুদ্র হাসল। ওর দৃষ্টি এখন আকাশের দিকে স্হির। সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে এখন অন্য কথা ভাবছে সে। সবুজ আর খোকনকে ও নিজেই খুন করেছে। সবুজের মার্ডার নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। পুলিশ বুঝে গেলেও কোন প্রমাণ পাবেনা। খোকনের ক্ষেত্রেও তাই। কিন্তু এই তৃতীয় খুনটা কে করল? আর কেন? বাইরের দলের কেউ? নাকি দলের মধ্যেই কোন গোপন শত্রু আছে?

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ১০