অবাধ্য প্রেম দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৮

অবাধ্য প্রেম দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৮
নন্দিনী নীলা

কানের কাছে ডিপ ডিপ শব্দে আমার তন্দ্রা ছুটে যায়। কারো শরীরে উত্তাপে আমি মুখ গুঁজে আছি। মনে হচ্ছে কেউ নিজের বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে রেখেছে আমার এই শরীরটা। আমি তার বুকের বা পাশে মাথা রেখে আছি। এজন্যই তার বুকের হৃদ স্পন্দনের শব্দ আমার কানে বাঁশির মতো দোল খাচ্ছে। চোখ পিকপিট করে তাকানোর চেষ্টা করি। পারিনা মাথাটা ভার হয়ে আছে। নরবার চেষ্টা করি পারছিনা শরীর অসার হয়ে আছে।

সাথে কেউ এমনভাবে নিজের বাহু বন্ধনে আবদ্ধ করে রেখেছে আমাকে যে আমি নড়াচড়া করার শক্তিটুকু পাচ্ছি না। এমনিতেই মনে হচ্ছে আগের তুলনায় আমার শরীরের শক্তি অনেকটাই কমে গেছে। তাই শক্তি প্রয়োগ করেও কাজ হচ্ছে না। আমি ছটফট করে যাচ্ছি। অনেক কষ্টে চোখ টেনে তাকালাম। চারপাশে কালো আবরণ যেন ঘুরে উঠলো। আমি দুই তিন বার চোখ বন্ধ করে তাকালাম। আসতে আসতে চোখটা ক্লিয়ার হলো।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

এমন ভাবে মানুষটার বুকে মিশে আছি উচু হয়ে তার মুখটাও দেখতে পাচ্ছি না। কিন্তু পরক্ষণে চমকে উঠলাম। এটা একটা পুরুষ। আমি কোন পুরুষালী বুকে লেপ্টে আছি ভাবতেই কেঁপে উঠলাম
নিজে থেকে তার বাহুবন্ধন থেকে সরতে না পারলেও ছটফট ঠিকই করতে পারলাম কথা বলে উঠলাম দুর্বল গলায়। ফট করেই নিবিড়ের ঘুম ছুটে গেল। বাঁধন আগলা হয়ে গেল। তাতেই ছোঁয়া ধাক্কা দিয়ে সরে আসল নিজের সিটে। আর সোজা হয়ে বসল। সামনে তাকাতেই নজরে এলো একটা পরিচিত মুখ। ইভা আপু!!

আমি চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে আছি। ইভা আপু আমার সামনের সিটে আমার মুখোমুখি বসে আছে। তার চোখ বন্ধ ঘুমিয়ে আছে বোধহয়। তার পাশেই বসে আছে আকাশ ভাই।
আমি তাকে দেখে আরো চমকালাম। এসব কি হচ্ছে পরিচিত মানুষের মুখ দেখছি কেন? আচ্ছা এটা কি স্বপ্ন আমি কি স্বপ্ন দেখছি। তাই হবে। আমি তো একটা অপরিচিত মেয়ের পাশে বসেছিলাম ট্রেনে। তার কথা ভাবতেই আমি নিজের পাশে তাকালাম। এবার আরেকটা ঝটকা গেলাম। নিবিড়?

না এ সম্ভব‌ই না এটা স্বপ্ন‌ই আমি বরংচ আরেকটু ঘুমিয়ে নেয় মাথাটা ও ভার হয়ে আছে কিসব আবুল তাঁবুল দেখছি।
আমি সত্যি চোখ বন্ধ করতে চাইলাম কিন্তু কেন জানি পারলাম না। এতো বাস্তবিক স্বপ্ন দেখে আমার মনে লোভ জাগল। বাস্তবে তো তার দেখা পাবোনা স্বপ্নে তাকে দেখেই একটু চোখের তৃষ্ণা মেটাতে সমস্যা কি‌?

আমি ছলছল নয়নে নিবিড়ের দিকে চেয়ে আছি। নিবিড় আড়মোড় ভাঙ্গে। তিনি ও আমার দিকে তাকায়। সেই গভীর দৃষ্টি! স্বপ্নেও এই দৃষ্টি আমার কাছে এতোটা বাস্তব লাগছে কেন? মনে হচ্ছে সত্যি নিবিড় আমার পাশে বসে আমার দিকে চেয়ে আছে। এতো সুন্দর স্বপ্ন মনে হয় আগে কখনো দেখিনি। এতো সুন্দর কেন স্বপ্নটা?

নিবিড়ের গভীর দৃষ্টির দিকে আমি তাকিয়ে থাকতে পারছি না। অজান্তেই কেঁপে উঠছি।
মন বলছে চাইলে ছুঁয়ে দিতে পারব নিবিড় কে।
স্বপ্ন কে কি ছুঁয়ে দেখা যায়? একবার চেষ্টা করতে ত বারণ নাই‌।

আমি নিজের কাঁপা কাঁপা হাত উঁচু করে নিবিড়ের দিকে বাড়িয়ে দিলাম। মনে মনে শুকনো ঢোক গিলছি। ছুঁয়ে দিলেই যেন স্বপ্নটা ভেঙে যাবে। এতো তাড়াতাড়ি স্বপ্ন টা ভেঙে যাক আমি চাইনা। স্বপ্নে হলেও আমি নিবিড়কে দেখতে চাই অনেকটা সময়।

নিবিড়ের গালে আমার হাত স্পর্শ করবে আর একটু এগুলেই আমি হাত গুটিয়ে নেবার কথা ভাবলাম।
সেই মুহূর্তে আমাকে চমকে দিল। কল্পনার নিবিড়। আমাকে অবাক করে দিয়ে নিবিড় নিজের পুরুষালী হাতে আমার হাত ধরে ফেলল। আমি চোখ বড়ো বড়ো করে ফেললাম।

নিবিড় আমার হাত টেনে নিজের ডান গালে স্পর্শ করতেই আমি অবিশ্বাস্য স্বরে বললাম,”এতো বাস্তবিক কল্পনার জগত ও হয় বুঝি? এই স্বপ্নে আমি আপনাকে ছুঁয়ে দিলাম কীভাবে নিবিড়‌? আগে তো শত কেঁদে ও আপনাকে একটু ছুঁতে পারতাম না। এমন মাজিক্যালি ঘটনা ঘটছে কেন? এতো সুন্দর স্বপ্ন দেখার পর। আমি আপনি ছাড়া থাকব কি করে? প্লীজ এমন সুন্দর স্বপ্নে আপনি আসবেন না। আমি সহ্য করতে পারি না।”

বলেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে ছোঁয়া। নিবিড় ছোঁয়া হাত নিজের গালে চেপে ধরে ছিল। গাল থেকে হাত সরিয়ে সামনে এনে হাতের উল্টো পিঠে ওষ্ঠ ছুঁয়ে দেয়। ছোঁয়া কান্নার মাঝেও কেঁপে উঠল। সাথে ওর কান্না ও কমে এলো। চোখ ভর্তি অশ্রু নিয়ে নিজের হাতের দিকে হা করে চেয়ে আছে। নিবিড় পর পর তিনবার ছুঁয়ে দিল।

তারপর মাথা তুলে ছোঁয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,” তুমি কোন স্বপ্ন দেখতেছ না ছোঁয়া।এটা বাস্তব। আমি তুমি কাছাকাছি আছি।”
কথা বলছে এমন কথা তো সব সময়‌‌ই বলে নিবিড় স্বপ্নে। আমি বিশ্বাস করলাম না। এখনো আমি সব কিছু আমার কল্পনা ভাবছি। নিবিড় আমাকে স্পর্শ করেছে তবুও বিলিভ করছি না। চুপ করে সময়টা উপভোগ করছি যে কোন সময় সব কিছুই মিলিয়ে যাবে হাওয়ায়। অন্য স্বপ্ন থেকে স্বপ্নটা যেহেতু গভীর আমি নিবিড় কে একটু ছুঁয়ে দেব।

নিবিড় ছোঁয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। ছোঁয়া গভীর মনোযোগ দিয়ে কিছু ভাবছে। নিবিড় আরেকটু এগিয়ে আসলো। ছোঁয়া কে কিছু বলতে যাবে তার আগেই ছোঁয়া ফট করে নিবিড়ের দুগাল নিজের হাত দ্বারা বেষ্টিত করল। নিবিড়ের কথা বলা অফ হয়ে গেল। ছোঁয়ার হাতের স্পর্শে নিবিড় শান্ত হয়ে গেল। ছোঁয়া কি তাহলে বুঝতে পেরেছে এটা স্বপ্ন না। ছোঁয়া কি করতে চাইছে দেখার জন্য ও চাতক পাখির মতো তাকিয়ে আছে।

ছোঁয়া নিবিড়ের দাড়িওয়ালা গালে হাত রেখে চাপ দিল।
তারপর বলল,” আপনি নিজেকে পরিবর্তন করে এসেছেন! এই দাড়ি ওয়ালা গালে আমি চুমু খেতে পারব না।” বলেই ছোঁয়া টেনে ধরল নিবিড়ের মাথা। নিবিড় অবাক হলেও টান পেয়ে মাথা নিচু করল। ছোঁয়া উঁচু হয়ে কপালে অধর পরশ দিল। নিবিড় আবেশেই চোখ বন্ধ করে প্রিয়তমার আদর স্পর্শ অনুভব করল।

ছোঁয়া নিবিড়ের গালে থেকে হাত সরিয়ে এবার জরিয়ে ধরে বুকে মুখ গুঁজে রইল। চিরচেনা সেই পারফিউম এর ঘ্রাণ নাকে আসতেই চোখ বুজে ঘনঘন শ্বাস নিতে লাগল। সময়টা এতোটা ভালোবাসা ময় আর এতোটা মধুর লাগছে কেন? হারিয়ে গেল আমি থাকব কি করে?

” আপনি যাচ্ছেন না কেন? সকাল হয়ে গেল অথচ আমার স্বপ্ন কাটছে না কেন?”
চোখ কচলাতে কচলাতে ছোঁয়া জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। ঘুটঘুটে অন্ধকার থেকে আলোর ঝিলিক দেখা যাচ্ছে কয়টা বাজে এখন? নিবিড়ের সাথে ফোন দেখতেই সেটা চাপ দিল। লেখা ভেসে উঠল,৫:০২ বাজে।

ফোনের স্কিনে নিজের একটা ছবি দেখতে পেয়ে চমকে উঠলো। এটা তো নিবিড়ের ফোনে ছিল।এই স্বপ্নে নিবিড়ের বন্ধু থেকে শুরু করে ফোন ও আমি দেখতে পাচ্ছি অদ্ভুত। মাথা চেপে ধরে বিরবির করছে ছোঁয়া। নিবিড় অনেক ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছে এটা স্বপ্ন না। এমনকি ছোঁয়া কে চিমটি পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে। স্বপ্ন সত্যি বলে বিশ্বাস করাতে কিন্তু পারছে না। ওর শুধুই মনে হচ্ছে এটা খুবই বাস্তবিক স্বপ্ন। এই স্বপ্নটা খুবই তীব্র যা বাস্তবকে গুলিয়ে ফেলা যায়।

ছোঁয়ার নিজেকে পাগল পাগল লাগছে এবার নিবিড় চিৎকার করে উঠল,” তুমি কি চাও না আমি তোমায় খোঁজে পাই। এজন্য এই সত্যি কি তুমি মানতে পারছো না। আমি তোমাকে পেয়ে গেছি এটা তুমি সহ্য করতে পারছ না।”

ছোঁয়া অবাক চোখে তাকাল নিবিড়ের দিকে। এদিকে চেঁচামেচি শুনে ইভা ও আকাশ ও উঠে গেল। দুজনে চোখ কচলে অবাক হয়ে তাকালো সামনে। নিবিড় রাগী গলায় কথা বলছে। আর ছোঁয়া হতবিহ্বল চোখে তাকিয়ে আছে। কি হচ্ছে ওরা দুজন কিছুই বুঝতে পারছেনা। আকাশ ও ইভা চোখে মুখে পানি দিয়ে এলো এবার ঘুম ছুটেছে।

আমি বিস্মিত নয়নে তাকিয়ে আছি নিবিড়ের দিকে। নিবিড় একের পর এক কথা বলে যাচ্ছে। যাতে স্পষ্ট রাগ দেখা যাচ্ছে।
” এতো ঘৃণা করো আমাকে যে। নিজের সামনে জলজ্যান্ত আমাকে স্বপ্ন বলে তাড়িয়ে দিতে চাইতেছ।” রাগে কাঁপছে নিবিড়‌।

ইভা এসে ছোঁয়ার মাথায় হাত দিয়ে জ্বর আছে কিনা দেখে বলল ,” কি হয়েছে ছোঁয়া নিবিড় এতো রেগে আছে কেন?”
এদিকে আকাশ নিবিড় কে শান্ত করার চেষ্টা করছে।‌পাশের কেবিন থেকে তৌহিদ রিসা বাকিরা দৌড়ে আসে। আফিয়া ওই কেবিনে থেকেই লক্ষ্য করছে কি হয়েছে।

আমি এবার নিশ্চিত হলাম এটা স্বপ্ন ছিল না। এটা বাস্তব। সত্যি আমি নিবিড়ের কাছেই আছি। নিবিড় আমাকে খুঁজে পেয়েছে‌। আচ্ছা কিভাবে পেল?
আমি তো একটা মেয়ের সাথে বসে ছিলাম সেখান থেকে এখানে আর ওরাই বা এখানে কি করছে? হাজারটা প্রশ্ন মাথায় এসে ভিড় করল। আর এদিকে নিবিড় রেগে ফায়ার হয়ে গেছে।

নিবিড় শান্ত হ‌ওয়ার আগে আমার দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,” তুমি খুশি হও বা না হ‌ও। আমার কাছে থাকতে চাও বা না চাও আই ডোন্ট কেয়ার বাট তোমাকে আমার সাথেই থাকতে হবে। আর আমাকে রেখে চলে যাওয়ার মাসুল ও দিতে হবে। মাইন্ড ইট।”

অবাধ্য প্রেম দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৭ শেষ অংশ

আমি আর কথা বলার মতো কিছু পেলাম না। চুপ করে নিবিড়ের কথা শুনলাম। সামনে কি ঝড় আসতে চলেছে আমি জানি না। কিন্তু এই মুহূর্তটা যে স্বপ্ন না ভেবে আমার বুকটা প্রশান্তিতে ভরে গেল। আনন্দে চোখ ছলছল করে উঠল।

অবাধ্য প্রেম দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৮ শেষ অংশ