অবাধ্য প্রেম দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৭ শেষ অংশ

অবাধ্য প্রেম দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৭ শেষ অংশ
নন্দিনী নীলা

নিবিড় বিরক্তিকর চোখ রাত্রির থেকে সরিয়ে ওষুধ এগিয়ে ধরে থেকেই চোখ নিচু করে কোলের ওপর থাকা অজ্ঞান মেয়েটার দিকে তাকায়। ছোঁয়ার মুখের উপর থেকে তখন রাত্রির ওরনা সরে গেছে। মুখটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। নিবিড় স্পষ্ট মুখটা দেখতেই চমকে উঠে, ও শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে যায়।

ওর মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল সাথে সাথে। ও থমকানো চোখে চেয়ে আছে। পরিচিত প্রিয় সেই মুখ। ওর শিরায় উপশিরায় কাঁপছে উত্তেজনায়। হাতে রাখা ওষুধ ধরে রাখার শক্তি যেন নিমিষেই হারিয়ে ফেলল।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ওর হাত থেকে ওষুধ পড়ে গেছে ও হতবিহ্বল চোখে চেয়ে থেকে দুই পা পিছিয়ে যায়। এতোটাই শক খেয়েছে যে স্তব্ধ হয়ে গেছে। তৌহিদ ওর পেছনে ছিল নিবিড় কে এলোমেলো পায়ে পেছাতে দেখে দু’হাতে আটকে বলে,” কি হলো এমন করে পিছিয়ে আসছিস কেন? আমি সামনে যাব। অজ্ঞান মেয়েটাকে দেখব আর আমার সদ্য প্রেমে পড়া মেয়েটাকে দেখব সামনে থেকে সর শালা।”

নিবিড় পাথরের ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে। ওর মুখে কোন রা নাই যেন। মুহূর্তে যেন কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। নড়তেও পারছে না। নিবিড় কে ধাক্কিয়ে ইভা সামনে চলে এলো। কেউ নাই এখন সে
শান্তিতে সব জানতে ও দেখতে পারবে। তৌহিদ নিবিড়কে এমন খাম্বার মতো থাকতে দেখে রেগে ধাক্কিয়ে এগিয়ে নিয়ে নিজেও গেল।

ও কিছু বলবে তার আগেই ইভা চিৎকার করে উঠে।
তৌহিদ কানে হাত দিয়ে বলল,” এই ইভুর বাচ্চা ষাঁড়ের মতো চিল্লাচিল্লি করে কান খাচ্ছিস কেন?
ওর চিৎকার শুনে দ্বিতীয় বারের মতো ট্রেনের সবাই অবাক হয়ে তাকায়‌। ট্রেনের সবাই আবার এক‌ই জায়গা থেকে চিৎকার আসতে দেখে সবাই বলতে লাগল,” আজকে খালি সবাই চিৎকার করছে। ব্যাপার কি মনে হচ্ছে সিনেমা চলছে তাও ওই এক‌ই সিটে একেক সময় একেক জন ব্যাঙের মতো চিল্লাচিল্লি করছে।”

সবাই এখন মজা নিচ্ছে যেন তারা সার্কাস দেখছে। এই সার্কাসের মেইন ক্যারেক্টার ছোঁয়া, রাত্রি, এখন ইভা নিবিড় তৌহিদ।
ইভার চিৎকার শুনে বাকি তিনজন ও দৌড়ে এসেছে। ইভা ছোঁয়া বলে চিৎকার করছে। সবাই অজ্ঞান মেয়েটাকে দেখে থমকে যায়।
সবার মুখে অস্পষ্ট স্বরে একটা শব্দ উচ্চারিত হয়,” ছোঁয়া!!”

এই মেয়েটা যে ছোঁয়া হতে পারে ওরা কল্পনাও করেনি। কিন্তু সবাই খুব খুশি হয়েছে। ছোঁয়ার থেকে চোখ সরিয়ে সবাই নিবিড়ের দিকে তাকাল। নিবিড়ের চোখের কোনায় জল এই জল আনন্দের সেটা বন্ধু মহলের বুঝতে সমস্যা হলো। সবাই খুশি হলেও এক জন খুশি হতে পারল না সে আর কেউ নয় আফিয়া।
ছোঁয়ার দিকে তাকিয়ে কটমট সুরে বলল,” এই মরা ভূত ক‌ই থেকে টপকাইল। কৈ মাছের জান এখনো বেঁচে আছে। আমি তো ভাবছিলাম কবেই মরে ভূত হয়ে গেছে।”

আফিয়ার কথা শুনে সবাই অসন্তুষ্ট নজরে আফিয়ার দিকে তাকাল।
আফিয়া সেসবে পাত্তা না দিয়ে আরো খারাপ কিছু কথা বলল। যা শুনে নিবিড়ের মাথা গরম হয়ে গেল আর বন্ধু বলে আর ছেড়ে দিল না পেছনে ঘুরে ঠাস করে থাপ্পড় বসিয়ে দিল। আফিয়া গালে হাত দিয়ে বলল,” এই মেয়েটার জন্য তুই আমাকে মারলি?”

নিবিড় কঠিন গলায় বলল,” এই মেয়েটা, এই মেয়েটা করবি না। এই মেয়েটা আমার জীবন, আমার সুখ, শান্তি।”
বলেই নিবিড় কোন দিকে না তাকিয়ে অচেতন ছোঁয়া কে রাত্রি কাছ থেকে টেনে নিজের কোলে তুলে নেয়।‌ বুকের সাথে চেপে ধরে ছোঁয়ার শুকনো অসুস্থ মুখটার দিকে তাকাতেই বুকটা কেঁপে উঠে ওর।

ছোঁয়ার শরীরের তাপমাত্রা অতিরিক্ত বেশি। নিবিড়ের শরীর ছোঁয়ার শরীরের তাপে গরম হয়ে উঠেছে। নিবিড় নিজেদের সিটে এনে ছোঁয়া কে নিজের কোলে নিয়েই বসে পড়ে। ইভা দৌড়ে এসেছে আফিয়া হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে গালে হাত দিয়ে। আশে পাশের মানুষেরা ওর দিকে চোরা চোখে তাকিয়ে আছে। মিটিমিটি হাসছে। ও রাগে গজগজ করে চলে এলো সেখানে থেকে। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে মনে মনে বলল,” এই অপমানের প্রতিশোধ আমি নেব‌ই নিবিড়।”

রাত্রি হা হয়ে বসে আছে। কি হচ্ছে কিছুই ওর মাথায় ঢুকছে না। তৌহিদ রাত্রি হা করা মুখের সামনে ঝুঁকে বলল,” হাই সুন্দরী, আমি তৌহিদ তুমি?”
রাত্রি উওর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল,” এটা কি হলো। আমার ক্রাশ আমাকে কোলে না নিয়ে ওই মেয়েকে কোলে নিল কেন?”

তৌহিদ বলল,” কি তোমার ক্রাশ নিবিড়?”
রাত্রি বোকা চোখে তাকিয়ে বলল,” নিবিড় কে?”
তৌহিদ বলল,” তুমি কে?”
” আমি তো রাত্রি।”

” তোমার ক্রাশের নাম নিবিড়। আর যাকে কোলে নিয়েছে সেটা তার গার্লফ্রেন্ড। ওদের সিট বুকিং করা তুমি চাইলে আমার উপর ক্রাশ খেতে পার আমি এখনো বুকিং হয়নি।”
বলেই দাঁত কেলিয়ে হাসল। রাত্রি হা করে কথা গিলল তারপর কটমট চোখে তাকিয়ে বলল,” আমি গায়ে পড়া ছেলেদের উপর ক্রাশ খাইনা। আপনি ছেলেটা ক্রাশ খাওয়ার জন্য একটুও উপযুক্ত না।”

বলেই রাত্রি গটগট করে এগিয়ে এলো দেখার জন্য তার ক্রাশ ওই মেয়েটার জন্য কি করছে।
এসেই চোখ কপালে উঠে গেল। তার সদ্য ক্রাশ খাওয়া মানুষটা অন্য মেয়েকে জরিয়ে ধরে চুমু খাচ্ছে।

ছোঁয়ার সারা মুখে পাগলের মতো ওষ্ঠ ছুঁয়ে দিচ্ছে নিবিড়। আর মৃদু স্বরে ডাকছে। জ্ঞান ফিরছে না দেখে নিবিড় উত্তেজিত হয়ে উঠল। ট্রেন থামানোর জন্য হাঙ্গামা শুরু করতেই ছোঁয়া চোখ পিটপিট করে তাকানোর চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু পারল না কারণ জ্বরের জন্য মাথা ভার হয়ে আছে ওর। ও চোখ মেলতে পারছে না।‌

এইটুকু নড়া দেখেই যেন নিবিড়ের দেহ প্রাণ ফিরে এলো ও চিৎকার থামিয়ে ছোঁয়ার গালে আলতো হাতে স্পর্শ করে কোমল গলায় ডাকতে লাগল‌। ছোঁয়া উওর দিতে পারল না। নিবিড় ওইভাবেই ছোঁয়া কে ওষুধ খাওয়াতে চাইল। কিন্তু বাঁধ সাধলো ইভা।

রাত্রি চোখ বড়ো বড়ো করে দেখল তার ক্রাশের অন্য মেয়ের প্রতি কেয়ার ভালোবাসা ও গাল ফুলিয়ে তাকিয়ে আছে। তখন তৌহিদ কানে কানে বলল,” জ্বলে নাকি সুন্দরী?”
রাত্রি কটমট চোখ করে বলল,” আমি এতো বড়ো একটা ছ্যাকা খাইলাম। কষ্ট পাইতেছি। আপনি আসছেন মজা করতে? ভারী খারাপ তো আপনি!”

তৌহিদ বলল,” আমার প্রেমে পড়ে যাও মেয়ে। আমি খারাপ থেকে ঠুস করে ভালো হয়ে যাব।”
রাত্রি তৌহিদ কে বকতে বকতে নিজে সিটে এসে বসল।

ইভা বলল,”অসুস্থ হয়ে আছে। মনে হয় না কিছু খেয়েছে। কিছু খাইয়া না হয় ওষুধ খাওয়া। এখনতো জাগ্রত কিন্তু মনে হয় মাথা ব্যথায় তাকাতে পারছে না।”
নিবিড় ছোঁয়াকে নিজের পাশে বসিয়ে এক হাতে আবদ্ধ করে নিলো বুকের মাঝে।বহু প্রতীক্ষার পর প্রিয় মানুষটার সন্ধান পেল‌। তাকে বুকে টেনে নিতে পারল। এতদিন পর মনে হয় ওর ফাঁকা বুকটা ভরে উঠেছে। শান্তি লাগছে। কিন্তু প্রিয় মানুষটা কে খুঁজে পেলেও তার এই অবস্থা ওকে বড়‌ই যন্ত্রণা দিচ্ছে।

হাহাকার বুকে প্রশান্তি এলে ও প্রিয় মানুষের অসুস্থতা দেখে ওর ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে।
প্রিয় মানুষের মুখের কথা খুব মিস করছে। সেই কন্ঠটা শোনার জন্য ব্যাকুল হয়ে তাকিয়ে আছে। ওর চোখ দিয়ে না চাইতেও নোনা জল বেরিয়ে এলো। ছোঁয়া কে জড়িয়ে ধরে মনে হলো আগের থেকে ও অনেকটা শুকিয়ে গেছে বিড়াল ছানার মত আর বুকে মুখ গুঁজে রেখেছে।

ভ্রমণটা ওর জন্য এতটা লাকি ও জানলে আরো আগেই চলে আসতো ভ্রমণ করতে। মনে হচ্ছে আরো আগে এলে মনে হয় আরো আগে প্রিয় মানুষটাকে ফিরে পেতো। শুকনো খাবার এনেছিল ফ্রেন্ডরা সেখান থেকেই একটা কেকের প্যাকেট ছিড়ে কেক খাওয়াতে লাগল ছোঁয়া কে? দুর্বল শরীর হলেও ছোঁয়া খাবারটা খাচ্ছে।

ও যে ক্ষুধার্ত ওর মুখ নাড়ানো দেখে বোঝা যাচ্ছে। ছোঁয়ার এমন দুর্বল মলিন মুখটা দেখলেই ভেতরটা হাহাকার করে উঠছে নিবিড়ের। বেশি খেতে পারলো না কাটা কেকগুলর দুইটা খন্ড খেয়ে আর খাচ্ছে না মুখ দিয়ে না না করছে‌। বোতল দিয়ে পানি খাওয়ালো ওষুধও খাইয়ে দিল। অচেতন ছোঁয়া এবার যেন একটু শক্তি পেল। নিজের দুহাত দিয়ে নিবিড়ের সাদা শার্ট খামছে ধরে বুকে মুখ গুঁজে রইল। নিবিড় ছোঁয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। থার্মোমিটার বের করে রেখেছে ছোঁয়ার জ্বর মাপার জন্য।

এদিকে রক্ত লাল চোখে তাকিয়ে আছে আফিয়া ওদের দিকে। নিবিড়ের সাথে ছোঁয়ার এত মাখামাখি। নিবিড়ের ছোঁয়ার প্রতি এত কেয়ার, এত ভালবাসা দেখে ও জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে।
ওর ইচ্ছে করছে ছোঁয়া কে টেনে নিবিড়ের বুক থেকে তুলে ট্রেনের বাইরে ছুড়ে মারতে।

এই থার্ড ক্লাস মেয়েটা কেন আবার ফিরে এলো ওর কাছ থেকে নিবিড় কে কেড়ে নিতে কেন? ও মেনে নিতে পারছে না। সব কিছু ধ্বংস করে ফেলতে ইচ্ছে করছে। ক‌ই নিবিড় ত ওর সাথে কখনো এতো নরম আর এতো ভালোবাসা নিয়ে কথা বলে না কখনো ওর মাথা বুকে টেনে নেয় না‌। ওকে চুমু খায় না ওই ফালতু নোংরা মেয়েটাকে কেন এতো আদর করবে কেন?
ওর মেয়ে ত নখের যোগ্য ও না। না ওর মতো সুন্দরী আর না ওর মতো স্মার্ট, ধনী।

তাও কেন? এই সব কিছু ছোঁয়ার জন্য হয়েছে ওই মেয়ে নিবিড় কে বশ করেছে।
না হলে ওর মতো একটা মেয়ের জন্য নিবিড় কেন এতো পাগল হবে?
যেখানে এতদিনেও নিবিড়ের মনেও একটু জায়গা করতে পারল না। কয় দিনেই এই মেয়েকে নিবিড় চোখে হারায়?
রাগে আফিয়া বসে থাকতে পারল না।

ওর মনে হতে লাগল ছোঁয়ার জন্যই নিবিড় ওকে একসেপ্ট করেনি। অগ্নিশিখা ন্যায় তাকাল ছোঁয়ার দিকে। তারপর ফট করেই উঠে দাঁড়িয়ে ছোঁয়া কে টেনে নিবিড়ের বুকে থেকে উঠাল‌। রাগে ওর হাত গিয়ে পরল ছোঁয়া চুলে। ও চুল টেনে ধরে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে যাচ্ছে। যাতে স্পষ্ট বলা হচ্ছে নিবিড় আফিয়াকে পছন্দ না করার পেছনে ছোঁয়ার হাত আছে। সব দোষ ওর ওকে আজ মেরেই ক্ষান্ত হবে আফিয়া।

ঘটনা আকর্ষ্মিক নিবিড় হতভম্ব হয়ে গেছে ও বাধা দেওয়ার সময় অব্দি পেল না ঘটনা এত দ্রুত ঘটে গেল।
ইভা এসে আফিয়াকে থামানোর চেষ্টা করছে। ইভা ছোঁয়া কে আফিয়ার থেকে সরিয়ে নেয়। তৌহিদ আফিয়াকে টেনে সরিয়ে আনে।

” এসব কি করছিস পাগল হয়ে গেছিস?”
আফিয়া চিৎকার করে উঠল,” হ্যা পাগল হয়ে গেছি। এই মেয়েটা আমাকে পাগল করে দিছে। ওর জন্য নিবিড় আমার দিকে ফিরে তাকায় না। ওকে আজ আমি মেরেই ফেলব।”

নিবিড় বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। আফিয়ার দিকে রক্তবর্ণ চোখে তাকায়। কিন্তু তবুও খুব শান্ত গলায় বলে, ” আজ থেকে তোর সাথে আমার সমস্ত বন্ধুত্ব শেষ। তুই যে দুঃসাহস দেখালি তারপর তোর মত কারো সাথে আমি বন্ধুত্ব রাখবো না।

অবাধ্য প্রেম দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৭

আমি যেমন ভালোর ভালো তেমনি খারাপের খারাপ। শুধুমাত্র বন্ধু ছিলি বলে আজকে তোকে কিছু বলছি না। তুই আমার কলিজা আঘাত করার সাহস করেছিস কিন্তু তবু আমি তোকে ক্ষমা করে দিলাম লাস্ট বার।”

অবাধ্য প্রেম দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৮