অবাধ্য প্রেম দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৯

অবাধ্য প্রেম দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৯
নন্দিনী নীলা

বান্দরবানের ট্যুর ছিল চার দিনের কিন্তু দুইদিন পরেই ব্যাগপ্যাক গুছানো হলো নিবিড়ের জন্য। ও আর এক মুহূর্ত এখানে থাকবে না। দুই দিনে একবারও আফিয়ার সাথে কথা বলেনি নিবিড়। প্রথম দিন সহ্য করতে না পেরে তো কান্না করে দিয়েছিল। সরি বলছিল আমার সাথে আর রাগারাগি করবে না। আমাকে নিয়ে আর ঝামেলা করবে না। শেষে উপায় না পেয়ে আমার কাছে ও সরি বলছিল। আমি মুখ ঘুরিয়ে রেখেছিলাম।

সময় গুলো ভালো কাটছিল শুধু নিবিড়ই অভিমান করেছিল আমার উপর। কিন্তু তার অভিমান ভাঙানো কি খুব কষ্টের ? ছোঁয়ার জন্য অবশ্যই না। নিবিড়ের অভিমান ভাঙ্গানো ছোঁয়ার দু মিনিটের ব্যাপার।
এবার আমরা ফ্লাইট বুক করে ঢাকা ফিরে এলাম। দুই দিন বান্দরবানের কয়েকটি স্পটে ঘোরাঘুরি হয়েছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

এখানে স্বর্ণমন্দির ও ঝুলন্ত ব্রিজ ঘোরাঘুরি করেছি। স্বর্ণমন্দিরের এতো সিঁড়ি অতিক্রম করতে গিয়ে আমি হাপিয়ে গিয়েছিলাম। আর ঝুলন্ত ব্রিজে গিয়ে তো ভয়ে আমি শেষ। যাইহোক সব সময় ছায়ার মতো নিবিড় পাশে ছিল। এসব দেখে আমার মাঝের সময় গুলোর কথা মনে পড়ে শুধু কান্না পেয়েছে। না চাইতেও চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়েছে।

ফ্লাইট থেকে নেমে যে যার বাসায় দিকে চলে যায়। আমি ভয়ে নিবিড়ের হাত শক্ত করে ধরে আছি। নিবিড় আমাকে ওদের বাসায় নিয়ে যাবে। এসব যে ওর পরিবারের কেউ পছন্দ করবে না। বিশেষ করে নিবিড়ের মা।
নিবিড় আমার হাতের উপর হাত রেখে বলল,” ভয় পাচ্ছ কেন?”

” আমি আপনার সাথে যাব না।”
নিবিড় ভ্রু কুঁচকে বলে,” তাহলে কোথায় যাবে?”
” জানিনা। ওই বাসায় গেলে ঝামেলা করবে আপনার মা।”
” করুক আমি সামলে নেব।”
” আপনি বুঝতে পারছেন না।”

” আমি সব বুঝতে পারছি। তুমি আমার সাথেই যাবে। লেটস গো।”
ট্যাক্সি ভাড়া করে আমাদের বাসায় আসতে হলো কারণ নিবিড় তাদের জানায় নাই আজকে আসবে। এজন্য কেউ জানেনা। আর গাড়িও পাঠায় নাই।
গাড়ি চলছে নিবিড় ফোন টিপছে আর আড়চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছে আমি ভয়ার্ত চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছি। নিবিড় ফোন অফ করে পকেটে ঢুকিয়ে নিলো।‌ আমার দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি মিলিয়ে বলল,” তোমার বিরহে কি আমি খুব সুন্দর হয়ে গেছি?”

আমি অবুঝ গলায় বললাম,’ মানে?”
নিবিড় বলল,” অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছো। এই দৃষ্টি তো তৃষ্ণা দেখছি না ভয় দেখছি কেন?”
“ভয় পাচ্ছি না ঝামেলা সহ্য করতে চাইছি না।”

নিবিড় আমার দুই হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে শব্দ করে একটা চুমু খেল। আবেগী গলায় বলল,,” তোমাকে ছাড়া আমি এক মুহুর্ত থাকতে পারব না। আমি যেখানে যাব তোমাকেও সেখানে যেতে হবে।”
নিবিড়ের কথার প্রেক্ষিতে আমি আর কোন কথা বলতে পারলাম না।
নিবিড় নিজেই আবার বলে উঠলো,” তুমি আমাকে ছাড়া থাকতে পারবে? এতো দিন কষ্ট হয়নি?”

আমি থতমত খেয়ে গেলাম। আমি নিজেও তো নিবিড়কে ছাড়া থাকতে পারবো না। মনে প্রানে চাই আমিও তার সঙ্গে থাকতে। কিন্তু মুখে বলতে পারলাম না। সরাসরি নিজের আবেগ মাখানো ভালোবাসা দেখাতে আমি পারিনা।

আমার হাতের ছোট ব্যাগটা নিবিড়ের এক হাতে। অপর হাতে আমার হাত শক্ত করে ধরে গেটের ভেতরে প্রবেশ করল। দাড়োয়ান আমার দিকে হা ময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। আমি তার দিকে তাকিয়ে শুকনো মুখে একটু হেসেছি।
দরজা সমুক্ষে দাঁড়িয়ে আছি কলিংবেল চেপে। নিবিড় শার্টের হাতা গুটিয়ে থ্রি কোয়ার্টার করে রেখেছে। আমি ওর উন্মুক্ত হাত খামচে ধরে দাঁড়িয়ে আছি‌।

দরজা খুলতেই আমার কি হলো জানিনা আমি নিবিড়ের পেছনে লুকিয়ে পরলাম। দরজা খুলেছে নিবিড়ের মা। নিবিড়কে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চমকালো। নিবিড়দের আরো দুইদিন পর আসার কথা কিন্তু দুই দিন আগে চলে এসেছে তাই অবাক গলায় জিজ্ঞেস করল,” এই সময় তুমি তোমাদের তো আরো দুইদিন পর আসার কথা ছিল।”

নিবিড় নিলাশা বেগমের থেকে বিরক্ত দৃষ্টি ফেলে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। কোন উত্তর দিল না আমি পেছন থেকে নিলাশা বেগমের কথা শুনে বুঝতে পেরেছি নিবিড়ের মা দরজা খুলেছে।
নিবিড় এক হাত বাড়িয়ে টেনে আমাকে নিজের পেছনে থেকে সামনে টেনে আনলো।
আমাকে দেখেই তো নিলাশা বেগমের চোখ কপালে উঠে গেল। তিনি চোখ বড়ো বড়ো করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমিও তার দিকে তাকিয়ে আছি।

নিবিড় ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,” সামনে থেকে সরেন ভেতরে যাব।”
নিলাশা বেগম সরে দাঁড়াল। তিনি রাগ করার সময়টা অব্দি পাচ্ছে না। এই মেয়েকে নিবিড় কোথায় খুঁজে পেল? নানান প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। নিবিড় ভেতরে গিয়ে খুব খুশি মুখে মেজ চাচী বলে ডাকতে লাগলো।

মেজ চাচি তো তাহমিনা আপু। তাহমিনা আপুর কথা মাথায় আসতেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। একটু পরে রান্নাঘর থেকে ছুটি হলো তাহমিনা আপু। তিনি আমাকে দেখে ভয় পেয়ে গেল যেন। তার হাতে ছিল খুন্তি ঠাস করে সেটা ফ্লোরে পড়ে গেছে। আমি নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছি‌।
তাহমিনা আপু থ মেরে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। চিৎকার চেঁচামিতে মাহি, ছোট চাচি আবির সবাই বেরিয়ে এসেছে‌ । সকাল হ‌ওয়ায় সবাই বাসায় ছিল।

রাফসান কাকা এসে তাহমিনা আপুর পাশে দাঁড়িয়ে বলল,” এভাবে দাড়িয়ে আছো কেন? যাও ছোঁয়ার কাছে যাও‌।”
তাহমিনা আপু এসে আমাকে জরিয়ে ধরে বলল,” ছোঁয়া লক্ষি বোন আমার কাউকে কিচ্ছুটি বলিস না। আমার সংসার ভেঙ্গে যাবে।”

আমি তার থেকে ও নিচু স্বরে বললাম,” তোমার মত সম্পর্ক ভাঙতে আমি ওস্তাদ নয়।”
তাহমিনা আপু আমাকে ছেড়ে দাঁড়ালো আমার দিকে তাকিয়ে বলল,” কেমন আছিস ছোঁয়া?”
আমি বললাম,” ভালো আছি চাচি। আপনি কেমন আছেন?”

আমার মুখে চাচি ডাক শুনে যেন বিদ্যুতের কথা শক গেল। তাহমিনা কিছু বলার আগে রাফসান কাকা বলল,” ছোঁয়া তুমি তাহমিনা কে চাচি ডাকো কবে থেকে?”
আমি হেসে বললাম,” আজ থেকে কাকা। কেমন আছেন আপনি?”
” এতো দিন ভালো ছিলাম না। তুমি নিখোঁজ ছিলে, বাড়ির ছেলে আধ পাগল হয়ে ছিল। এখন মনে হচ্ছে সামনের সময় গুলো ভালো কাটবে।”

আবির এসে বলল,” কেমন আছো ভাবি?”
” আলহামদুলিল্লাহ তুমি?”
” আলহামদুলিল্লাহ। তোমাকে খুব মিস করেছি।”
” আমিও।
মাহি এসেও কথা বলল। আর মাহির মা মুখটা কালো করে দাঁড়িয়ে আছে নিবিড়ের মায়ের সাথে দুজনের মুখ দেখার মতো হয়েছে।

রাফসান কাকা আমাকে কিভাবে কোথায় পেলে সবকিছু জিজ্ঞেস করছে নিবিড় সবার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিল।
নিবিড়ের বাবা এগিয়ে এসে আমার মাথায় হাত দিয়ে বলল,,” আমার এই পাগল ছেলেকে ছেড়ে আর যেও না মা। ছেলেটার মুখের দিকে এতো দিন তাকানো যাচ্ছিল না। তোমাকে পেয়েই আবার মুখে তার হাসি ফিরে এসেছে। আমার ছেলের এই হাসি আমি সব সময় দেখতে চাই।”

“আপনারা পাশে থাকলে আমি এই হাসি মুখ থেকে সরতে দেব না বাবা।”
আমার মুখে বাবা ডাক শুনে উনি ইমোশনাল হয়ে গেল,” জানো আমার একটা মেয়ের খুব শখ ছিল। আবিরের বেলায় আমি চেয়েছিলাম আমাদের একটা মেয়ে হোক। মেয়ের সকল শখ আহ্লাদ পূরণ করব। মেয়েরা বাবাদের জোঁক থাকে। আর বাবারা মেয়ে কে মা বলে সম্বোধন করে। কিন্তু আল্লাহ সহায় ছিল না। দুই ছেলে থাকলেও একটা মেয়ের অভাব বোধ করেছি। তোমার মুখে বাবা ডাক শুনে শান্তি লাগছে। মনে হচ্ছে মেয়ে পেয়েছি একটা। আজ থেকে তুমি আমার মেয়ে। নিবিড়ের ব‌উকে আমি ছেলের ব‌উ না মেয়ে করে রাখব।”

” এটা তো আমার জন্য পরম সৌভাগ্য। আপনার মেয়ে হতে পারা। আমার বাবা মা নাই। এজন্য আপনাকে বাবা ডেকেছিলাম। আপনি মানুষটা খুবই ভালো। বাবা দের মত ভালো।”

সবার সাথে কম বেশি কথা হলেও নিবিড়ের মা আর নিবিড়ের চাচীর সাথে কোন কথা হলো না
তারা আমার দিকে তীক্ষ্ণ নজরে তাকিয়ে ছিল দূরে থেকেই। নিবিড় আমাকে ওদের একটা গেস্ট রুমে থাকতে দিল। আশা সবার মাঝে কিছু বলতে না পারলেও গেস্ট রুমে এসে জড়িয়ে ধরে কতক্ষণ কাঁদলো। ফ্রেশ হয়ে আসা মাত্র দেখলাম নিবিড় বিছানায় বসে আছে পায়ের উপর পা তুলে। পাশে দেখলাম একটা খাবারের প্লেট। আমি আসতেই বলল,,” খেয়ে নাও।”

” আপনি খেয়েছেন?”
“না সবার সাথে খাব। তুমি খাও আমি আশাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। কিছু লাগলো ওর কাছে চেয়ে নিও‌।”
“আমিও সবার সাথেই না হয় খেতাম!”
“খেয়ে রেস্ট নাও তোমাকে অনেক ক্লান্ত লাগছে। সবার সাথে খেতে হবে না এখন।”

নিবিড় উঠে আমার খুব নিকটে এলো। আর গালে দুই হাত রেখে ফট করেই কপালে অধর স্পর্শ দিল। আমি আবেশেই চোখ বন্ধ করে নিলাম। নিবিড় চলে গেল। খাবার খেয়ে আমিও শুয়ে ঘুমিয়ে পরলাম।
এদিকে খাবার টেবিলে মাহির মা ও নিবিড়ের মা বলছে,

” ওই নির্লজ্জ মেয়েকে বাসায় নিয়ে এলো নিবিড় আর সবাই তাকে নিয়ে আদিখ্যেতা করতে শুরু করে দিলে। ছেলের সাথে সাথে সবার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।”
মাহির মা বলল,” ঠিক বলছো ভাবি। মেয়েটাকে ও বলি হারি কি বেহায়া। প্রেমিকের হাত ধরে প্রেমিকের বাড়ি চলে আসছে। লজ্জা শরম নাই।”

নিলাশা বেগম,” ছোট ঘরের মেয়েরা এমনি হয়। এরা বিয়ের আগেই বয়ফ্রেন্ডের সাথে থাকতে শুরু করে দেয়। চরিত্রহীন মেয়ে। মা হয়ে এসব বলতেও লজ্জা লাগছে। নিজের ছেলে যে এতোটা অধঃপতনে যাবে কে জানত।”
পরিবেশ থমথমে হয়ে গেল নিমিষেই। সবাই মিলে দুজনকে থামাতে চেষ্টা করেছিল কিন্তু পারেনি। নিবিড় তাদের কথা অগ্রাহ্য করে খাচ্ছিল কিন্তু আর সহ্য করতে পারল না।

ছোঁয়ার চরিত্র নিয়ে কথা বলছে এটা শুনে আর নিজেকে শান্ত রাখতে পারল না। কাচের গ্লাস নিয়ে একদম ফ্লোরে ছুড়ে মারে। ভয়ে নিবিড়ের মা চাচি থেমে যায়। নিবিড় চিৎকার করে উঠল,,” ছোঁয়া কে নিয়ে একটা বাজে কথা বললে জিভ টেনে ছিঁড়ে ফেলবো তোমাদের। আমার ধৈর্যের পরিক্ষা নিও না।”

তারপর আর এক সেকেন্ড না বসে টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে গটগট করে চলে গেল।
নিবিড়ের বাবা রাফসানের দিকে তাকিয়ে বলে,,” রাফসান সবকিছু ঠিকঠাক করো। খুব শীঘ্রই বাড়িতে বড় ছেলের বিয়ের ধুম লাগবে।”

” অবশ্যই ভাইজান।” বলেই হাসলো।
নিলাশা বেগম চিৎকার করে উঠল,” ওই মেয়েকে আমি আমার ছেলের ব‌উ করব না।”
” আবিরের ব‌উ করতে বলি নাই। আমার ছেলে নিবিড়ের ব‌উ করব।”
” কি বলছো আবুল তাবুল। নিবিড় কি তোমার একার ছেলে?”
” ছেলের খুশি যার চোখে পড়ে না সে কেমন মা?”

” তুমি আমায় এতো বড় কথা বললে। ওদের খুশির জন্য আমি কি কিছুই করিনি।”
” করেছো। কিন্তু ওর সারাজীবনের আনন্দ কেড়ে নিতে চাচ্ছ কেন এখন?”
“ওই মেয়ে ওর যোগ্য না। ওর ছেলেমানুষী মন বুঝতেছে না। আবেগে বশবতি হয়ে ভুল করছে আমি মা হয়ে তা মেনে নিতে পারি না।”

অবাধ্য প্রেম দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৮ শেষ অংশ

” আমার ছেলে যথেষ্ট বড় হয়েছে। নিজের জীবন সঙ্গিনী নিজেই পছন্দ করে নিতে পারবে।”
বলেই তিনিও চলে গেলেন।

অবাধ্য প্রেম দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৯ শেষ অংশ