অবাধ্য প্রেম পর্ব ৪৮

অবাধ্য প্রেম পর্ব ৪৮
নন্দিনী নীলা

নিবিড় যখন সজাগ হয়েছে তখন চোখ মেলে ও আর ছোঁয়াকে দেখতে পায় নি। চোখ মেলেও উদ্বিগ্ন চোখে এদিক ওদিক তাকাতে থাকে। একটা মেয়ে নার্স নিবিড়ের সামনে দাঁড়ায় নিবিড় কে চোখ মেলে এদিক ওদিক তাকিয়ে কাউকে খুঁজতে দেখে জিজ্ঞেস করে, ‘আপনি কি আপনার বাড়ির লোককে খুঁজছেন?’

নিবিড় মাথা নেড়ে সম্মতি দিল। নার্স স্বীকারোক্তি পেয়ে বাইরে চলে গেল কাউকে ডাকতে। নিবিড় চিন্তায় মগ্ন কতদিন পর প্রিয় মানুষটাকে কাছে পেলাম, তার চোখে নিজের জন্য অজস্র ভালোবাসা দেখতে পাচ্ছিলাম। কি সুখ সে অনুভূতিতে ছিল। ভালোবাসা’রা ডানা ঝাপটে নিবিড়ের চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছিল!

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সময়টা কোথায় হারিয়ে গেল? নিবিড়ের চিন্তার মাঝে নিবিড়ের মা হন্তদন্ত হয়ে রুমে আসে। এসে ছেলের পাশে বসে জিজ্ঞেস করে, ‘ নিবি আব্বু আমার কি হয়েছে তোমার? কোন সমস্যা তুমি নাকি আমাদেরকে খুঁজতে ছিলে। তোমার বাবা বাইরে বসে আছে ভেতরে আসতে চাইছিল। আমি বলেছি আমার ছেলের সাথে আমি দেখা করবো আগে।

তুমি বাইরে বসে থাকা। ডাক্তার তো সবাইকে একসাথে ভেতরে আসতে দেয় না। জঞ্জাল হবে তোমার মাথায় চাপ পরবে।’
‘মম আবির কোথায়?’ নিবিড় সব প্রশ্ন সব কথা অগ্রাহ্য করে পাল্টা প্রশ্ন করল।
নিলাশা বেগম বলল, ‘আবির তো একটু বাইরে গেছে আসলে পাঠাবো নি। কোন দরকার আমাকে বলো!’
‘আবির কেই বলবো।’গম্ভীর স্বরে বলল।

নিলাশা বেগম আর নিবিড় কে কিছু জিজ্ঞেস করল না। ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে একটা চুমু দিয়ে বেরিয়ে এলো। তিনি জানেন নিবিড় কি জিজ্ঞেস করবে। মনে মনে ফুঁসলেও সামনে প্রকাশ করল না। গতকাল নিবিড় রে কাকা কাকি আত্মীয়-স্বজন অনেকে নিবিড়কে দেখে গেছেন। রাফসান কাকা ভিডিও কলে কথা বলেছে তারা আসতে চেয়েছিল কিন্তু ভিসা পাননি‌।

নিবিড়ের বাবা দেখা করে চলে গেল কথা বলেনি ছেলের সাথে। যত কথা কম বলা যায় ততই ভালো। আবির এলো আধা ঘন্টা পর আসতেই নিবিড় খুজেছিল খবর দিল। আবির নিবিড়ের কেবিনে এসে দেখলো নিবিড় চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। আবির ভেবেছে নিবিড় হয়তো ঘুমিয়ে আছে। তাই রুমে এসে আবার ফিরে চলে যাচ্ছিল। কিন্তু নিবিড় তখন পেছন থেকে আবির কে ডেকে ওঠে। ভাইয়ের ডাক শুনে আবির, ফিরে এসে নিবিড়ের পাশে দাঁড়ায় নিবিড় ওর দিকে চেয়ে আছে।

নিবিড় আবিরের দিকে উদ্দেশ্য করে খুব শান্ত গলায় বলল, ‘ ছোঁয়া কোথায়?’
আবির একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আবির জানতো ভাইয়া এই কথাই জিজ্ঞেস করবে। সেই মুহূর্তে ছোঁয়াকে ওইভাবে বের হতে দেখে আবির চমকে ওঠে। ছোঁয়া বলেছিল মম না আসা পর্যন্ত সে থাকবে আর ও নিচে এজন্যই ছিলাম যেন মম আসার আগে আমি তাদের সাবধান করে দিতে পারি। ওখান থেকে সরিয়ে ফেলবো। কিন্তু ঘন্টা খানিকের মাঝে ছোঁয়া বেরিয়ে যায়। আমি তার পিছু যায় জিজ্ঞেস করি কি হয়েছে?

‘কিন্তু সে একটা কথা বলে, ‘ তুমি তোমার ভাইয়ের কাছে যাও। তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। নার্সরা ঠিকমত কেয়ার করে না। আমাকে গাফিলতি জন্য তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন আমার সেখানে থাকা ঠিক হবে না। তুমি তার পাশে থেকো। এক মিনিটের জন্য ও এ ছেরে সরোনা।’

তারপর আর একটা কথা না বলে রিক্সা নিয়ে চলে যায় আবির মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে না পেরে হসপিটালে ফিরে আসে। উপরে এসে ডাক্তার থেকে জানতে পারে বেশি কথা বলার পরে নিবিড় অসুস্থ হয়ে পড়ছিল মাথায় টান লেগেছিল এজন্য ঘুমের ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে ২-৩ ঘণ্টা এখন নিবিড় ঘুমিয়ে থাকবে। আবির তখন বুঝতে পারে নিবিড়ের অসুস্থ হওয়ার জন্য ছোঁয়া নিজেকে দোষী করে চলে গিয়েছে।

ভাইকে আর কি বলবে সংক্ষেপে সবটা খুলে বলল সব শুনে নিবিড় চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলো। ওর বুকের ভেতরটা জ্বলছে সুখের অনুভূতি গেল যেন নিমিষে ই দুঃখে ভেসে যাচ্ছে।
মনটা হুট করে বলে উঠলো যদি তখন কথা বলার জন্য অসুস্থ হয়ে না যেত। তাহলে ভয় পেত না। নিজেকে দোষারোপ করত না। আর এভাবে আমাকে ফেলেও যেত না। ও ভেবেছে ওর আসার জন্য আমি অসুস্থ হয়ে গেছি। তুমি এত বোকা কেন ছোঁয়া?

ও বুঝতে পারছে না ও থাকলে আমি অসুস্থ হলে ও আনন্দে থাকি। মনটা আমার সুখে ছেয়ে যায়। নিশ্চিন্তে থাকি এই যে চলে গেছে এখন আমার বুকের ভেতরটা ব্যথা করছে। মন বলছে এই কষ্ট আমি সহ্য করতে পারবো না। না এখান থেকে উঠে আমি ওর কাছে যেতে পারবো।

আর না ওর হাত ধরে বলতে পারব তোমার জন্য আমি কষ্ট না শুধু সুখ সুখ ফিল হয়। সময়টাই ছোঁয়ার মনের লুকানো ভালোবাসা প্রকাশিত হতে আমি খুব খুশি হয়েছিলাম ভেবেছিলাম এক্সিডেন্ট হয়ে ভালো হয়েছে। প্রিয় মানুষটার চোখে মুখে নিজের জন্য দুঃচিন্তা দেখতে সুখ সুখ ফিল হচ্ছিল।

সুখের সাগরে ভাসছিলাম আমি এজন্যই এত এত ইমোশনাল কথা বলে ফেলেছি যে নিজেকে থামাতে পারিনি। বুঝতে পারিনি এটা আমার জন্য ক্ষতিকর। এখন ভুল বুঝে চলে এলো আর কি আসবে না আমাকে দেখতে। চোখ ভর্তি অশ্রু নিয়ে টেনশন ভীত নয়নে আমার পানে তাকিয়ে থাকবে কি?

আবির চলে যাচ্ছিল ভাই আর কথা বলছে না। হয়ত আর কথা বলতে চাচ্ছে না। তাই ও চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়ে ছিল তখনই নিবিড় বলে ওঠে, ‘ ছোঁয়া কে একবার কল করবি। দুটো কথা বলব।’
আবির বলে উঠলো, ‘ভাইয়া তোমার এখন এত কথা বলা ঠিক না! তখন কি হয়েছিল মনে আছে তো।’
‘তোকে ফোন দিতে বলেছি।’

ভাইয়ের চাঁপা ধমক শোনে আবির ফোন দিল কিন্তু নিবিড় এর ফোনের কানে ধরার আগে বলল ,,’ দুটোর বেশি কথা বলবে না।’

এ দিকে আমি বিষন্নমুখে বেলকনিতে বসে আছি নিবিড়ের কথায় ভাবছি । দুপুরের পর থেকে আর খাওয়া হয় না সেই সকালে কয়টা খেয়েছিল পেটে খিদের চাপ বাড়ছে কিন্তু কিছু করতে মন চাচ্ছে না ওর। চোখ বন্ধ করে বসে আছি তখন হাতের ছোট ফোনটা বেজে উঠলো। আবিরের নাম্বার থেকে কল এসেছে ও চোখ মুছে গলা খাকিয়ে ফোন রিসিভ করে কানে ধরল।

ওপাশ থেকে শব্দ আসার আগেও জিজ্ঞেস করলাম, ‘হ্যালো আবির, নিবিড় এখন কেমন আছে? উনার কি মাথা যন্ত্রণা এখনো আছে? ঘুম কি ভেঙেছে? ‘
ওপাশ থেকে কোন শব্দ এলো না‌। শুধু শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে। আবির কথা বলছে না কেন? প্রতিটা নিঃশ্বাসের শব্দে আমার বুকটা কেঁপে উঠছে। আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বলে ওঠি, ‘নিবিড়’

নিবিড় হয়তো হাসলো আমি না দেখেও বুঝতে পারলাম। নিবিড় খুব শান্ত ও নিচু স্বরে বলল, ‘কাল তুমি আসবে আমায় দেখতে। আমি অপেক্ষায় থাকব। আর কোন পাগলামি করবো না প্রমিস।’

আমি উত্তর দিতে পারলাম না তার আগেই ফোনটা কেটে গেল। ফোনটা কান থেকে নামিয়ে স্তব্ধ হয় গেলাম। কিন্তু নিবিড়ের কথা শুনে মনটা কিছুটা শান্ত হলো যে নিবিড় এখন ঠিক আছে । আমি আর যাব না এমনটাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। এজন্য আমার মনটা আরো বেশি উদাস হয়েছিল।

নিবিড়ের এই অবস্থা আর আমি ওকে দেখতে যেতে পারবো না। খুব খারাপ লাগছিল কিন্তু নিবিড়ের কথা শুনে আমি তো এখন নিজেই সিদ্ধান্ত অটল থাকতে পারছি না।
সন্ধ্যার পর এলো লিলি আমার কাছে ওদের বিয়ের আসতে ৫ দিন বাকি। লিলি এসেছে অনলাইনে বিয়ের পোশাক চয়েজ করতে ও নাকি অনলাইনে ড্রেস অর্ডার দিবে। রুমে এসে আগে আমাকে জিজ্ঞেস করল,’মুখটা এত শুকিয়ে আছে কেন? নিবিড় ভাইয়ের অবস্থা কি এখনো খুব খারাপ নাকি? ফোন দিয়ে একবার জিজ্ঞেস করেনে। আমি ভাবছিলাম তোর সাথে কাল দেখা করতে যাব‌।’

‘আছে কোনরকম আজকে কি হয়েছিল শুনলি ত। এজন্য আর যেতে চাইছিলাম না। কিন্তু এখন নিবিড় এমন ভাবে বলল আমি নাই গিয়ে থাকতে পারবো না রে।’
‘এতদিন পর ভাইয়া তোকে দেখে এক্সাইটেড হয়ে গেছিলাম এজন্য তিনি এত কথা বলছে। এখানে তোর কোন দোষ নাই। ভাইয়া যেতে বলছে এবার গিয়ে বলবি আপনি যদি এত কথা বলেন আমি আর কখনো আসবো না। তাহলে দেখবি ঠিক জব্দ হবে আর এমন পাগলামী করবে না। শান্ত থাকবে‌।’

আমি মনে মনে বললাম, আর কয়টা দিন তো আছি এই কয়দিন নিবিড়ের পাশেই থাকতে চাই।’
লিলি আমার কাঁধ ধাক্কা মেরে বলল, ‘ কিরে কি ভাবিস।’

‘ কিছু না তা এই সময়ে কি জন্য এলি।’
‘ কেন আসতে পারি না?’
‘ পারবি না কেন? কিন্তু তোর তো আজ কাল বিজি থাকি হবু জামাই নিয়ে তাই বললাম। দীপা কে বিয়ে খবর দিছিস?’
‘ হুম ও আসবে বলেছে।’

‘ সত্যি? অনেক দিন দেখা হয় না ওর সাথে ভালোই হবে। ‘
‘ হুম। এবার বল তোর মুখটা এমন শুকিয়ে আছে কেন খাসনি কিছু?’
আমি নির্বাক গলায় বললাম, ‘ রান্না করতে ইচ্ছে করছে না।’

লিলি বলল, ‘ আজকে তাহলে আর তা রান্না করতে হবে না। রান্না করতে ইচ্ছে করছে না আমাকে বললেই হতো আমাদের বাসায় খেয়ে নিতি এভাবে না খেয়ে বসে আছিস কেন? তুই ফোনে আমার জন্য বেনারসি চয়েস করতে থাক আমি তোর জন্য খাবার নিয়ে আসি।’
‘ লাগবে না।’

লিলি কপট রাগ দেখিয়ে বলল, ‘থাপ্পর খাবি এখন মানা করলে। চুপচাপ থাক আমি আসতেছি।’
লিলি সত্যি সত্যি নিয়ে আসলো খাবার। খাবার পেয়ে খিদে যন্ত্রণা ও বেড়ে গেল আমিও থাকতে পারলাম না। খাবারের উপর এক প্রকার হামলে পড়লাম।

লিলি ফোনে ৫০০ ছবি দেখালো আমি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলাম ভালো লাগছে না ঘুম থেকে চোখ বন্ধ আসছে। লিলি আমাকে ঝিমুতে দেখে বলল, ‘এই তুই দরজা আটকে ঘুমিয়ে পড় আমি চলে যাই। তোকে তো খুব ক্লান্ত লাগছে ইদানিং তো মনে হয় না ঘুমাতে পারিস। ঘুমিয়ে পড় দুশ্চিন্তা না করে।’
লিলি চলে গেলাম আমি দরজা আটকে ওইভাবে বিছানায় পেতে শুয়ে পড়লাম।
.
হসপিটালে গেলাম না যাওয়ার সুযোগ হয়নি যে কটা টিউশনি করায় সবার বাসায় গিয়েছি গিয়ে তাদের বলেছি দুই দিনের মাঝে টাকা দিতে। আর তিন দিন পর লিলির বিয়ে ওকে কিছু একটা গিফট দিতে হবে। সবাই বলছে দিয়ে দিবে আর আমি বলে দিয়েছি এই মাসটাই শেষ আমি আর পড়াতে পারবো না।

অবাধ্য প্রেম পর্ব ৪৭

রাতে আবির ফোন থেকে আমার কল আসে। আমি জানি এটা নিবিড় এর কল আমি রিসিভ করি না। একটা মেসেজ পাঠাই, ‘ আগামীকাল আমি আসবো কিন্তু আপনি যদি পাগলামো করেন, উত্তেজিত হোন তাহলে আমি আর আসবো না।’
একটু পরেই মেসেজের টুং বেজে উঠল, ‘ শুধু তোমাকে দেখবে। কোন পাগলামি করবো না আসো প্লিজ।’
আমি আর রিপ্লাই করলাম না। মেসেজটা আবির লিখে পাঠিয়েছে। নিবিড় বলে দিয়েছে কি লিখতে হবে।

অবাধ্য প্রেম পর্ব ৪৯