অবাধ্য প্রেম পর্ব ৪৭

অবাধ্য প্রেম পর্ব ৪৭
নন্দিনী নীলা

মামি পুলিশের ভয়ে চলে গেল। সে বিশ্বাস করে নিয়েছে নিবিড় এর সাথে আমার বিয়ে হয়েছে। আর সে তো এটা জানেই নিবিড় আমাকে ভালোবাসে। যদি সুস্থ হয় সত্যি মামিকে জেলে পাঠায় সে ভয়ে আর আমার সামনে টিকতে পারেনি। থ্রেট দিতে পারেনি। মামি চলে যেতেই আমি একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেললাম।

অভিমানে চোখ দুটো আমার ছল ছল করে উঠলো। নিবিড় আমাকে টাকা দিয়ে কেনার চেষ্টা করছে ভাবতে আমার ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে। যাকে ভালোবাসে তাকে কেন টাকা দিয়ে কিনতে যাবে? মামীদের কেন টাকা দেবে আমার জন্য! আমি কি বিক্রি করার বস্তু!

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মামিকে তো বিয়ের নামে একটা মিথ্যে কথা বলে দিলাম‌। সেটা হয়নি আর কখনো সম্ভব হবে না। আমাকে যত দ্রুত সম্ভব এই শহর ছেড়ে পালাতে হবে। মনের ব্যথার অভিমান টুকু নিজের মনে চাপা রেখে আমি হসপিটালে এসে পৌঁছলাম।

আবির আমাকে দেখে এক গাল হাসলো, ‘ভাবি আমি বাইরে যাচ্ছি। কোন দরকার হলে আমাকে কল করবে। আর নার্সকে আমি বলে গেছি তোমাকে কেউ কিছু বলবেনা তুমি ভাইয়ার কাছে থাকো। ‘
‘নিবিড়ের পা কি ঠিক হবে না?’আমি মলিন মুখে জিজ্ঞেস করলাম।

আবির বলল, ‘টেনশন করো না। পা ভেঙে গেছে ঠিক কিন্তু ডাক্তার বলেনি যে পা আর ঠিক হবে না। পা ঠিক হবে কিন্তু সময় লাগবে অনেক। ভাইয়া হয়তো তিন মাসের মত হাঁটতে পারবে নিজের পায়ে। দাঁড়াতে পারবে না। কিন্তু ঠিক হবে।ভাই এখনও জানে না তার পা অচল হয়ে গেছে একটা।

মাথা আঘাত পেয়েছিল এজন্য প্রচুর ব্লিডিং হয়েছিল রক্ত লাগছে। মাথার আঘাতের জন্য ভাইয়া ২ দিন আইসিতে ছিল। মাথায় আঘাতের ফলে বেশিরভাগ ব্রেনের চাপ পড়ে স্মৃতিশক্তি হারায়। কিন্তু আল্লাহ রক্ষা করেছে এত আঘাতের পর ও ব্রেনে তেমন চাপ পড়েনি। স্মৃতিশক্তি ঠিক আছে আমরা সবাই তো এটা নিয়ে বেশি ভয় পাচ্ছিলাম।’

আমি ভাবছি স্মৃতিশক্তি চলে গেলেই মনে হয় ভালো হতো। সেই স্মৃতি তে আমি থাকতাম না খুব ভালো হতো। যখন জানতে পারবে সে আর হাঁটতে পারে না তখন নিবিড়ের অবস্থা কি হবে‌। সেটা ভেবে আমার ভেতরটা কেঁপে উঠছে।
আবির আবার বলল, ‘ ভাবি ভেতরে স্যুপ রাখা আছে ভাইয়াকে খাইয়ে দিও।’

‘ নিবিড় কি জেগে আছে?’
‘ ঘুম হয়ত কিন্তু ভেঙে যাবে খুব তাড়াতাড়ি।’
আমি নিবিড়ের কেবিনে গেলাম। অস্বস্তি লাগছে আজকে নিবিড় জেগে আমাকে দেখবে এটা ভেবে। কিন্তু তবুও আমি আজ থাকব। আজ নিবিড়ের পাশে বসলাম।

নিবিড় আমাকে ওর জন্য হসপিটালে দেখলে ভাববে আমি ওর প্রেমে পাগল হয়ে এসেছি‌। আমি নিবিড়ের পাশে বসে নিবিড়ের ব্যান্ডেজ করা কপালে আঙুল ছুয়ে দিলাম। সামনে থেকে পেছনদিকে ফিরে আমি নিবিড়ের ভাঙ্গা ব্যান্ডেজ করা পায়ের দিকে তাকিয়ে রইলাম ছলছল চোখে। চোখ মুছে আমি নিবিড় এর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে।
নিবিড় ঘুমিয়ে ছিল হঠাৎ ঘুমের মধ্যে ওর মনে হলো ওর পাশে কেউ বসে আছে। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে অপলক দৃষ্টিতে। ওর মাথায় স্পর্শ করছে

ও চোখ পিটপিট করে তাকালো। চোখের পাতা মেলতেই সামনে দৃশ্যমান হলো একটা পরিচিত প্রিয় মুখ। প্রিয় এক জোড়া চক্ষুদ্বয় অপলক চোখে ওর পানে তাকিয়ে আছে। কি গভীর সেই দৃষ্টি! চোখে কুলটিতে অশ্রু জমে আছে। মুখটা মায়াবী। ওকে ঘায়েল করা সেই শ্যামবর্ণ মেয়েটি। যে মেয়েটা ওকে সহ্য করতে পারেনা বলে সেই মেয়েটা ওর অসুস্থতায় ওর দিকে তাকিয়ে আছে হাজারো দুশ্চিন্তা নিয়ে। এই চোখ মুখ বলে দিচ্ছে এই মেয়েটার মনে ওর জন্য প্রবল ভালোবাসার আছে সেই জানান দিচ্ছে।

এদিকে নিবিড় কে আচমকা তাকাতে দেখে আমি অপ্রস্তুত হয়ে পরলাম। চোখ সরিয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালাম। তা দেখে নিবিড় নিচু স্বরে বলল, ‘ উঠলে কেন? বসে থাক আমার পাশে। ভাল লাগছিল ত।’
আমি আবার বসে পরলাম নিবিড় এর পাশে।আর বললাম,’ আপনার কথা বলা বারণ আছে তাই একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চেয়েও পারছি না। আমি চাচ্ছি না আমার জন্য আপনার ক্ষতি হোক‌!’

নিবিড় আমার কথা শুনে হাসল তারপর বলল, ‘ বাহ আমার জন্য এত চিন্তা। এবার অন্তত বলতে পারবে না তুমি নিবিড়কে ভালোবাসা না সহ্য করতে পার না।’
আমি বিরক্তিকর কন্ঠে বললাম,’ ফালতু কথা এবার দয়া করে অফ করেন। আপনার এত কথা বলা এখন ঠিক না।’
‘অসুস্থ হলে এত টেনশন করবা জানলে আগেও জেনে শুনে কয়টা এক্সিডেন্ট করতাম।’

আমি রাগান্বিত স্বরে বললাম,’ আপনি আর একটা কথা বললে আমি কিন্তু চলে যাব।’
নিবিড় অভিমান কণ্ঠে বললো, ‘আচ্ছা আর একটা কথা বলবো না। চুপচাপ শুধু তোমাকে দেখব।তুমি তবু যেও না। কতদিন পর প্রিয় মানুষটাকে দেখছি। তোমাকে দেখেই আমি যেন অর্ধেক সুস্থ হয়ে গেছি। এই কয়দিন কি অবস্থায় কেটেছে আমার চার দেয়ালে হসপিটালের বেডে।’

নিবিড়ের অসহায় মুখটার দিকে আমি এক নজর তাকিয়ে স্যুপের বাটে হাতে নিয়ে নিবিড়ের পাশে বসলাম। নিবিড় আমায় দিকে পলক হীন চোখে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। চোখের যেন পলক ফেলছে না। অস্বস্তি লাগছে কিন্তু নাও করছি না অসুস্থ মানুষ বলে আমি আজকে আর এই তাকানোটা সহ্য করছি দাঁতে দাঁত চেপে।

‘হা করুন। আমাকে দেখে তো আর পেট ভরবে না। খেতে হবে, সুস্থ হতে হবে।’
‘পেট না ভরলে ও মন তো ভরবে।’
আমি বললাম, ‘ মন ভরা দিয়ে কি সুস্থ হতে পারবেন। হা করুন। ‘

নিজের হা করল আমি ওর মুখে খুব সাবধান সহিত স্যুপ ঢেলে দিলাম। শুয়ে থাকায় হয়তো নিবিড়ের খেতে কষ্ট হচ্ছে। কিছু করার নেই এত বড় আঘাতের পর মাথা তুলে বসার অনুমতি নাই। আর এটা ঠিক হবে না। দাঁড়াবে কবে জানিনা কিন্তু বসার অনুমতি হয়তো আরো কয়েকদিন পর পাবে।

নিবিড়ের মুখ খালি হতে আমি ওর মুখে স্যুপ ঢেলে দিচ্ছি ও কিছু বলতে চাচ্ছে আমার মনে হয়। কিন্তু আমি মনে হয় কথা টা আঁচ করতে পেরেছি কি জিজ্ঞেস করবে। তাই আমি কথা বলার সুযোগ না দিয়ে খাবার দিয়ে মুখ দিয়ে আটকে দিচ্ছি তা দেখে নিবিড় এবার ডানহাতে আমার চামচ ধরে রাখা হাতটা চেপে ধরল।

নিবিড়ের স্পর্শ হাতে পেয়ে আমি চোখ বন্ধ করে একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেললাম। চোখ মেলে তাকালাম নিবিড় আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘শুনলাম তুমি নাকি আমাকে খুব মিস করেছ। আমার জন্য অনেক কেঁদেছো। আবির কে নাকি অনেক ধমকা ধমকি করেছো খবর দেয় নি বলে।’

আমি অপ্রস্তুত চোখে তাকালাম নিবিড়ের দিকে। নিবিড়ের মুখে দুষ্ট হাসি ছেলেটাকে হাসলে সুন্দর লাগে। প্রচুর রাগ হল আবিরের উপর এসব কথা বলার কি প্রয়োজন নিবিড় কে। আমি অস্বীকার করে বললাম, ‘মোটে না আমি আপনার জন্য কাঁদবো কেন? আমি তো খুব শান্তিতে ছিলাম এই কয়দিন। আপনার জ্বালা যন্ত্রনা সহ্য করতে হয়নি। খুব শান্তিতে ছিলাম কোন প্যারা ছিল না! ‘

‘মিথ্যা বলছো তুমি তো আমার চিন্তায় ঘুমাতেই পারোনি। এই যে তোমার চোখের এই কালো দাগ তো বলে দিচ্ছে। আমার প্যারাগুলো তোমার কাছে ভালোবাসা। আমার সামনে তুমি বিরক্ত নাক মুখ কুঁচকে থাকো রাগী রাগী করে তাকাও আমার দিকে। কিন্তু আমার আড়ালে তুমি ঠিকই মুচকি হাসো, আনন্দিত হও খুশি হও।’

কথা বলতে বলতে নিবিড় কে আমি অর্ধেকের বেশি স্যুপ খাইয়ে দিছি। নিবিড় একটা দুইটা করে কথা বলছে। আমি ২-৩ বার মানা করেছি কিন্তু নিবিড় কথা বলছেই।
হঠাৎ নিবিড়ের চোখ মুখ লাল হয়ে উঠলো। নিবিড় জানি কেমন ছটফট করতে লাগলো। নিবিড়ের ফর্সা মুখটা আচমকায় লাল হয়ে উঠলো। নিবিড় কষ্ট পাচ্ছে বোঝা যাচ্ছে কিন্তু কেন? আমি ব্যস্ত কন্ঠে নিবিড় কে জিজ্ঞেস করলাম,, ‘কি হলো আপনার? এমন করছেন কেন?’

নিবিড় কথা বলতে পারছে না তবু ও অনেক কষ্টে বলল, ‘ডাক্তার ডাকো মাথার ব্যথা করছে প্রচুর আমি সহ্য করতে পারছি না।’
আমি আঁতকে উঠলাম ভয়ের চোটে দৌড়ে আমি বেরিয়ে এসে ডাক্তারকে ডাকলাম অনেক কিন্তু কোন ডাক্তার বা নার্স কেউ এগিয়ে আসলো না। লাঞ্চ টাইম সবাই খেতে গেছে‌। আমি এক আয়া পেলাম।

তার থেকে জানতে পারলাম ডাক্তার নাকি ক্যান্টিনে আছে। তাকে পাঠালাম আমি আবার নিবিড়ের কাছে আসলাম। এখানকার নার্স গুলো কেমন অকৃতজ্ঞ এভাবে পেসেন্ট একা রেখে সবাই খেতে চলে গেছে। কাছাকাছি থাকা উচিত ছিল তাদের। দরকার কাউকে পাওয়া যায় না। আমি নিবিড়ের কাছে এসে কান্না করে দিলাম। নিবিড়ের কষ্ট সহ্য হচ্ছে না। কথা বলার জন্য এমন হচ্ছে হয়ত।

আমি কান্না গলায় বললাম, ‘ এত কথা কেন বললেন এখন কষ্ট পাচ্ছেন কত।’
ডাক্তার আসল দৌড়ে। ডাক্তার এর সাথে একটা নার্স এসেছে। ডাক্তার এসে নিবিড় কে একটা ইনজেকশন দিল। তারপর আশেপাশে তাকিয়ে দেখল আমি ছাড়া আর কেউ। ডাক্তার আয়াকে জিজ্ঞেস করল এই রুমের নার্স ক‌ই!
আয়া বলল জানে না। ডাক্তার বলল, ‘ পেশেন্ট এর খেয়াল না রেখে কোথায় হাওয়া হয়েছে উনি আসলে আমার কেবিনে পাঠাবি‌।’

আয়া মাথা নাড়াল। এবার ডাক্তার আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ উনি কি বেশি কথা বলেছিল?’
আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম, ‘ হ্যা। ডাক্তার নিবিড় কি সুস্থ আছে?’
‘ বেশি কথা বলার জন্য মাথায় চাপ পেরেছিল এজন্য ব্যাথা বেড়ে গেছিল। ঘুমের ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে কমে আসবে। এখনি এত কথা বলা উচিত নয়। তাহলে ক্ষতির সম্ভাবনা আছে।’

অবাধ্য প্রেম পর্ব ৪৬

‘ আমি মানা করতে ছিলাম শুনেনি। আমার জন্য এসব হয়েছে আমার এখানে আসা উচিত হয়নি সরি ডাক্তার।’
আমি হসপিটালের থেকে বেরিয়ে এলাম। আবিরের সাথে নিচে আমার দেখা হয়েছিল। ওকে বলেছি তোমার ভাইয়ার কাছে যাও তাকে ছেড়ে এক মিনিটের জন্য সরো না।

অবাধ্য প্রেম পর্ব ৪৮