অবাধ্য প্রেম পর্ব ৪৬

অবাধ্য প্রেম পর্ব ৪৬
নন্দিনী নীলা

তিনতলায় নিবিড়ের কেবিন। আমি লিফট থেকে বের হলাম আবিরের সাথে। চঞ্চল দুটি চোখ নিবিড় কে দেখার জন্য ছটফট করছে আমি হাঁটছি দ্রুত গতিতে আবির আমাকে পেছন থেকে বাধা দিল।

‘ভাবি! প্লিজ তুমি এখানে একটু দাড়াও। আমি একটু দেখি ভাইয়া রুমে কেউ আছে কিনা। আম্মু আছে। পাশের ওই কেবিনে নেয়া হয়েছে তাদের থাকার জন্য। তিন দিন ধরে আম্মু এখানে আছে ভাইয়ার সাথে ভাইয়ার কেবিনে তো কাউকে থাকতে দেওয়া হচ্ছে না। বাইরে আম্মুর সাথে আমি থাকি।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আমার একটা ফুপি আছে সে থাকে। তাদের সামনে তো তোমাকে নিয়ে যাওয়া যাবে না। আম্মু তোমাকে পছন্দ করে না। সেটা তো তুমি জানোই। তোমাকে এখানে দেখলে ক্ষেপে যাবে আমি দেখি তারা এখন কি করছে এখন তো দুপুরটা আমার মনে হয় তারা নিজের রুমে আছে।’

আমার পা থেমে গেল আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। ঠিকই তো আমার মনে ছিল না এখানে নিবিড়ের মা আছে। সে ত আমাকে দুই চোখে সহ্য করতে পারে না‌। আমি সিঁড়ির কাছটায় দাঁড়িয়ে রইলাম।
একটু পরে আবির এসে আমাকে বলল, ভাবি আসো আমি বাইরে থেকে আম্মুর কেবিনের দরজা আটকে দিয়ে এসেছি। ভাইয়া ঘুমাচ্ছে তুমি এখন যাও। নার্স নাই তুমি একটু দেখা কর গিয়ে।’

আবির আসলো না। আমি একাই নিবিড়ের কেবিন টার দিকে পা ফেলে এগোতে লাগলাম। কাঁপা কাঁপা পায়ে আমি কেবিনের দরজার সামনে এসে দাঁড়ালাম। বাইরে থেকে কাঁচ এর দরজা দিয়ে দেখা যাচ্ছে ভেতরে নিবিড় চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে।

মাথা ও পায়ে ব্যান্ডেজ করা। আমি আলতো হাতে দরজাটা আস্তে করে ধাক্কা দিয়ে কেবিনের ভেতরে গিয়ে দাঁড়ালাম। ছল ছল চোখে বেড এর দিকে তাকালাম। কেমন নিস্তেজ হয়ে শুয়ে আছে। মুখটা কেমন শুকিয়ে গেছে। তিন দিনেই গায়ের রংটা কেমন চাপা পড়ে গেছে রোগা হয়ে গেছে। কেমন বিধ্বস্ত লাগছে নিবিড় কে।

প্রাণবন্ত হাসিখুশি মুখটা এমন শুকিয়ে আছে দেখতে একটু ভালো লাগছেনা। আমি খুব সাবধানে পা ফেলে নিবিড়ের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। নিবিড়ের দিকে ঝাপসা চোখে তাকিয়ে আছি। কান্না দলা পাকিয়ে আসছে আমার কিন্তু এখানে কাঁদা যাবে না নিবিড়ের ডিস্টার্ব হবে। নিবিড়ের এক হাতে ক্যানেলা লাগানো।

এটা লাগালে যে ব্যথা করে প্রতিদিন হয়তো ইনজেকশন দেওয়া লাগে স্যালাইন দেওয়া লাগে এজন্য হয়ত রাখা হয়েছে। একবার আমার টাইফয়েড জ্বর হয়েছিল। মামা আমাকে হসপিটাল ভর্তি করেছিল হসপিটালে থাকতে হয়েছিল এক সপ্তাহ তখন আমাকে ইনজেকশন দেওয়া হতো প্রতিদিনের এজন্যই হাতে এই ক্যানেলা লাগানো ছিল ৭ দিনে। আমার হাতটা ফুলে গেছিল এত ব্যথা করত নিবিড়ের ও হয়তো অনেক কষ্ট লাগে। আমি কাঁপা কাঁপা হাতে নিবিড়ের হাতটা স্পর্শ করলাম।

আমার চোখ বেয়ে এক ফোটা অশ্রু নিবিড়ের হাতের উপর পড়ল। আমি তাড়াতাড়ি পানি মুছে নিলাম। নিবিড়ের হাতটা নড়ে উঠলো নড়াচাড়া করছে। আমি দ্রুত গতিতে রুম থেকে বেরিয়ে এলাম।
আমি রুম থেকে বের হতে একটা সুন্দরী মেয়ের সাথে দেখা হলো। পোশাক দেখে মেয়েটি নার্স বুঝলাম মেয়েটা আমার দিকে ব্রু কুঁচকে তাকাল আমি তাকে পাশ কাটিয়ে আসতে গেলে সে আমাকে কড়া গলায় বলল, ‘Who are you doing here?’

আমি নার্সের দিকে ঘুরে তাকালাম আশেপাশে আবিরকে দেখতে পারছেনা ও আমাকে রেখে কোথায় গেল। নার্সের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আমি এদিক ওদিক আবির কে খুঁজে যাচ্ছি।

এবার নার্স রাগান্বিত সুরে বলল, ‘বিনা পারমিশনে তুমি রুমে ঢুকেছো কেন? পেশেন্টের রুমে কারো ঢোকা নিষেধাজ্ঞা আছে আর তুমি লুকিয়ে ঢুকে পড়েছ। তোমার সাহস তো কম না। কে তুমি পেশেন্টের কি হও?’

এবার আমি কি বলবো? নিবিড়ের আমি কি হই? উনি আমার উত্তরের আশায় আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কিছু না বলাই উনি বিরক্ত হচ্ছেন। বিরক্তিকর মুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে আমার খুব নার্ভাস লাগছে কি বলব বুঝতে পারছিনা।

সেই মুহূর্তে আবিরের আবির্ভাব ঘটল সেখানে। আবির কে দেখে আমি চিন্তা মুক্ত হলাম। আবিরকে দেখেই নার্সটা অভিযোগ স্বরে বলল, ‘এই দেখুন কোথা থেকে একটা মেয়ে আসছে আপনার ভাইয়ের রুমে ঢুকে কি যেন করছিল। এখন বাইরে আমার কাছে হাতেনাতে ধরা পড়েছে। কথা বলছে না। মেয়েটার মধ্যে ঘাপলা আছে। একে জেরা করেন।’

আবির নার্স কে বলল, ‘সেসব আপনাকে দেখতে হবে না। আপনি এখান থেকে যান ওনাকে আমি ভালো করেই চিনি।’

হসপিটাল থেকে বাসায় আসতে আসতে আমার চারটা বেজে গেলো। লিলিদের বাসার সামনে এসে গাড়ি থেকে নামতেই লিলি আর রায়ানের সাথে দেখা হলো, দাঁড়িয়ে আছে রায়ানের সাথে বেড়াতে যাবে লিলি আমাকে গতকালই বলছিল।

আমাকে নিয়ে যেতে চাইছিল আমি রাজি হয়নি। দুজনের মাঝে আমি কাবাব মে হাড্ডি হতে চাই না। লিলি আমাকে দেখে এগিয়ে এসে বলল, ‘ ছোঁয়া এমন উদ্বিগ্ন হয়ে আছিস কেন? কেমন দেখা যাচ্ছে! কোথায় গিয়েছিলি! দুইবার তোর বাসায় গিয়ে কলিংবেল চেপে এসেছি। কিন্তু তুই তো নেই আমাকে একবার পর্যন্ত বলে যাস নাই কোথায় গেছিস!’

‘সরি রে, খুব তারাহুরার মাঝে বের হয়েছিলাম। এজন্য বলার সুযোগ পায়নি।’
‘এত তাড়াহুড়া করে কোথায় গিয়েছিলি? তোকে তো খুব চিন্তাগস্ত দেখা যাচ্ছে সারাদিন তো মনে হয় খাস নাই কিছু মুখটা কেমন শুকিয়ে আছে।’

‘এখন বেড়াতে যাচ্ছিস যা ইনজয় কর। পরে বলব সবকিছু।’
লিলি আচ্ছা বলল আমি ভেতরে চলে গেল এলাম।

নিবিড় কে নিয়ে আমার দুশ্চিন্তা সত্যি হয়ে গেল। দিনটা আমি আর ভাল কাটাতে পারলাম না। নামাজের পরে শুধু নিবিড়ের জন্য দোয়া করলাম। আর কিছু করার নাই ওর কাছে তো আর আমি থাকতে পারবো না সেটা সম্ভাবনা। আল্লাহ তায়ালা আমার ভরসা।

কিন্তু তারপরের দিন আমার জন্য কি অপেক্ষা করছিল আমি নিজেও বুঝতে পারি নাই। পরদিন সকাল সকাল আবির আমাকে কল দিয়ে জানায় হসপিটালে এখন আবির একা আছে। মা ফুপি নাকি বাসায় চলে গেছে একটানা এতদিন থাকার জন্য তারা খুব ক্লান্ত। বাসায় কি একটু রেস্ট নিয়ে দুপুরের পর আবার আসবে। আমি শুনেই তো খুশিতে লাফি উঠলাম। বললাম আমি তাহলে এখনি আসছি তুমি থাকো।

খুশিমনে আমি বাসা থেকে বের হলাম ঠিকই কিন্তু গেটের বাইরে আসতে আমার মুখ থেকে হাসিও উবে গেল আর ভয়ে দানা বাঁধলো। মামিকে বাসার সামনে দাঁড়ানো দেখে আমিতো থমকে গেলাম। মামীর মুখে বিশ্বজয়ের হাসি।

‘অনেক প্রেম করে বেড়ালি শান্তি মত ঘুরলি এবার তোর ডান কেটে আমি যদি না দিয়েছি তো….
আমি বললাম, ‘তুমি আমার খোঁজ কী ভাবে পেলে?’

মামি আমার মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, ‘তোর খোঁজ তো আমি সেই কবেই পেয়েছি। এতদিন ওই নিবিড়ের বাড়ি ছিলি। এখন আবার বান্ধবীর বাড়ি থাকিস। কিরে প্রেম করে কি বাড়ি ধরা খাইছিলি নাকি নাক কেটে বাসা থেকে বের করে দিছে মনে হয়।’

আমি জ্বলন্ত চোখে মামীর দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘কি বলতে চাও তুমি?’
‘শোন তোর খোজ আমি অনেক আগেই পেয়েছি কিন্তু এতদিন নিবিড়ের জন্য আমি তোর কাছে আসিনি। ”
‘মানে?’ নিবিড়ের জন্য আসেনি মানে কি আমি বিস্মিত চোখে তাকিয়ে আছে মামীর দিকে ।

‘ শোন তোকে আমি এতো মানে বলতে পারব না। তোরে আমি জসিমের সাথে বিয়ে দিতে চাইছিলাম টাকার জন্য কারণ জসিম আমাকে অনেক টাকা দিতো। ওর সাথে তোরে বিয়ে দিলে। কিন্তু সেই টাকা যখন নিবিড় আমাকে দিচ্ছিল। তখন আর আমি তোর আর ওর প্রেমে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি।

তোকে তোর মত ছেড়ে দিয়েছিলাম নিবিড় বলেছিল তাই। ও তোকে নাকি ভালোবাসে ওর প্রতি তোর ভালোবাসার সৃষ্টি করার জন্য সময় চেয়েছিল আমি বলেছিলাম আমাকে পাঁচ লাখ টাকা দিতে তাহলে ওর সাথে তোকে বিয়ে দেবো কিন্তু তা করবে না। আগে তোর মনে ওর জন্য ভালোবাসা সৃষ্টি করবে তারপর নাকি বিয়ে করবে।

তো মাসে মাসে যখন টাকা দিছিলাম আমি রাজি হয়ে যায় জসিমকে তোর খোঁজটা দেই না। কিন্তু ও শালা তো দুই মাস টাকা ঠিকই দিল কিন্তু এ মাসে এসেই ঘাপলা করেছে ৪-৫ দিন হয়ে গেল ওই ছোকরা আমারে টাকা দেয় না। আমার ফোন ধরে না।

নিশ্চিত তুই পটে গেছিস এজন্য এখন আর আমাকে টাকা দেবে না ভাবছে আমাকে ৫ লাখ টাকার জায়গায় ও আমাকে দুই মাসে 50000 করে এক লাখ টাকা দিছে। এত কম টাকায় ওর কাছে আমি তোরে দেব অসম্ভব ঐ জসিম আমাকে বলেছে ৭ লাখ টাকা দেবে আজকেই তোর সাথে জসিমের বিয়ে হবে। ওই শয়তান পোলার লাগে তোর বিয়া আমি দিতাম না। তুই আমার ভাগ্নি তোর উপর আমার অধিকার আছে তোরে আমি জসিমের সাথেই বিয়ে দিমু।’

আমার মাথা যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। পায়ের তলা মাটি সরে গেছে। নিবিড় তো কিছু করেছে আমি তার কিছুই জানি না। নিবিড়ের সাথে মামির আবার কন্টাক্ট হয়েছে। ও কিভাবে মামীকে টাকা দিতে পারলো? ও কি আমাকে কিনতে চাচ্ছে টাকা দিয়ে।

যে ভালবাসার ফুল ফুটতে যাচ্ছিল মনে সেটা যেন ধপ করে নিভে গেল। নিবিড়ের এহনো কাজে আমি খুবই আঘাত পেলাম‌। বুকটা আমার ছিড়ে যাচ্ছে কষ্টে কিভাবে পারল আমাকে না জানিয়ে মামিকে টাকা দিতে। আমি চোখ মুখ শক্ত করে মামীকে বললাম, ‘কে কি করেছে কার থেকে কিসের টাকা নিছ।

সেইসব আমি কিছু জানি না। আমি আগে বলেছি তোমার আমার উপর কোন অধিকার নেই। যা অধিকার সব আমার মামা আমার উপর ।মামা যেহেতু চায় না আমি তোমার ইচ্ছায় চলি তাহলে আমি তোমার ইচ্ছায় চলবো। একদম আদিখ্যেতা অধিকার আমাকে দেখাতে এসে আমাকে বলি দেওয়ার চেষ্টা করবে না।’

‘তোকে এখন আমি নিয়ে যাব। আজ জসিমের সাথে বিয়ে দেবো। কে আটকাবে আমাকে। তোর আপন বলতে কেউ নাই আমরা ছাড়া। যতটুকু অধিকার আমাদেরই আছে তোর বিয়ের সিদ্ধান্ত নেবার ও। আমাদের আটকানোর কারো ক্ষমতা নাই। যদি বিয়ে হয়ে যেত তাহলে হয়তো তোর স্বামীর অধিকার থাকতো কিন্তু যেহেতু এটা এখনো হয়নি এখনো তোকে আমি আমার ইচ্ছামত বিয়ে দিতেই পারি।’

আমার মস্তিষ্ক ফাকা লাগছে অধিকার কথাটা খুব যন্ত্রণা দিল আমাকে। এ অধিকার এর বড়াই করে মামী আমাকে বিক্রি করতে যাচ্ছে কোরবানির গরুর মত। এতটাই ফেললা না আমি। তার দেওয়া বলি আমি কেন গ্রহণ করব। অনেক কষ্ট করেছি আমি জসিমের মতো লম্পটকে বিয়ে করে সারা জীবন আর জ্বলতে পারবো না।
‘তোমার আমার উপর যেটুকু অধিকার মামি তার থেকেও অধিকারের মানুষ আমার জীবনে চলে এসেছে।’

মামী চমকালো তবু পাত্তা না দিয়ে বলল, ‘যত যাই বলিস আজকে তোকে আমার হাত থেকে কেউ বাঁচাতে পারবে না।’
‘সত্যি বলছি মামি। আমি এখন অন্য একজনের স্ত্রী। নিবিড়ের সাথে আমার বিয়ে হয়ে গেছে দুই মাস আগেই। তুমি যদি এখন আমাকে কারো সাথে বিয়ে দেওয়ার জন্য ফোর্স কর।

তাহলে আইনের হাত থেকে কেউ তোমাকে বাঁচাতে পারবে না। নিবিড় কে তো চেনো তোমাকে ছেড়ে দেবে না ওর বউকে যদি তুমি আরেকজনের হাতে তুলে দাও। গার্লফ্রেন্ড হিসেবে আমাকে এতটা দিছে আর এখন আমি ওর ব‌উ তাহলে তোমার কি অবস্থা করবে ভাবতে পারছ।

আর একজনের বউকে তুমি জোর করে আরেকজনের সাথে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছ তার বরের অনুপস্থিতিতে। নিবিড় এখন অসুস্থ তাই হয়তো তোমার সাথে যোগাযোগ করতে পারছে না। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না আমার উপর অধিকার থাকা সত্ত্বেও কেন তোমাকে টাকা দিয়েছে।

অবাধ্য প্রেম পর্ব ৪৫

তোমার থেকেও তো নিবিড়ের আমার উপর অধিকার বেশি। তুমি চাইলে ও এখন আর আমার কিছু করতে পারবে না। হাজবেন্ড ওয়াইফ কে তুমি যদি আলাদা করতে চাও তাহলে আইন তোমাকে ছেড়ে দেবে তো। আর শোনো মামি নিবিড়ের আমার উপর অধিকার থাকা সত্ত্বেও তোমাকে কেন টাকা দিয়েছে আমি জানিনা। হয়তোবা তুমি আমার মামি বলি তোমাকে দয়া করেছে। এসব আমি জানতাম না। একবার যেহেতু জেনে গেছি নিবিড় কে তোমাকে আর একটা টাকা ও দিতে দেবোনা।’

অবাধ্য প্রেম পর্ব ৪৭