অবাধ্য প্রেম পর্ব ৪৫

অবাধ্য প্রেম পর্ব ৪৫
নন্দিনী নীলা

আজ তিন দিন হতে চলল নিবিড় পরীক্ষা শেষ হয়েছে। শেষ পরীক্ষার দিন যাওয়ার সময় ও আমাকে কলে বারবার করে বলে গিয়েছিল।

‘ছোঁয়া আজকে থেকে আমি স্বাধীন হব। তোমার শর্তগুলো শেষ হবে। আর তোমাকে জ্বালানো শুরু হবে। যতই বিরক্ত হওয়ার নাটক কর না কেন? আমি কিন্তু জানি মনে মনে তুমি আমাকে ভালোবাসো। এবার আমার জ্বালানো অতিষ্ঠ হয়ে তুমি না আবার ভালোবাসি বলেই দাও।’

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘আপনি আপনার আজাইরা ভাবনা নিয়ে থাকেন। এটা কখনোই সম্ভব না। আর আপনার মনে একটা ভুল ধারণা সৃষ্টি হয়েছে। আমি আপনাকে ভালোবাসি। এটা সম্পূর্ণ ভুল। জানি না এই ভুল ধারনা আপনার কি দেখে তৈরি হলো। কিন্তু আপনি যে ভুল সেটা আর কয়দিন গেলেই বুঝতে পারবেন। যাইহোক এখন আপনার সাথে ফালতু পেচাল পারতে চাই না আপনার একটু পর পরীক্ষা ভালো ভাবে পরীক্ষা দি‌ন।’

‘তুমি যেহেতু বলছো তাহলে তো ভালো করেই পরীক্ষা দিতে হবে। আচ্ছা, পরীক্ষা দিয়ে এসে ইচ্ছামত জ্বালাবো রাখি এখন বাই।’
সেই যে কথাটা বলেই গেল এটাই ছিল নিবিড়ের সাথে আমার লাস্ট কথা। তারপর দেখতে দেখতে তিনটা দিন চলে গেল নিবিড় না কল করেছে না বাসার আশেপাশে এসেছে।

বুঝতে পারলাম না যে ছেলে আমাকে বলে গেল আমাকে জ্বালিয়ে অতিষ্ঠ করে ফেলবে। সে ছেলে জালানো তো দূরে থাক তার পাত্তাই পাওয়া যাচ্ছে না। এতে অবশ্য আমার খুশি হওয়া উচিত। কারণ আমি তো এটাই চাচ্ছিলাম নিবিড় যেন আমার থেকে দূরে থাকে, আমাকে না ডিস্টার্ব করে। হচ্ছে ও সেগুলোই তিনদিন নিবিড় আমাকে একটু ডিস্টার্ব করেনি।

নিবিড়ের ডিস্টার্ব গুলোকে যতটাই আমি প্যারা ভাবে নিয়েছি। যতটাই বিরক্ত হয়েছি। নিবিড়ের এরকম নিস্তব্ধ হওয়া টাতে আমি ততটাই শঙ্কিত হয়েছি। অজান্তেই নিবিড়কে ভেবে সারা দিন চলে যায়। ফোনের দিকে আনমনে চেয়ে থাকি এই বুঝি আবার কল করল ভালোবাসি ভালোবাসি বলে আমার কান ঝালাপালা করে দিল।

কিন্তু তেমন কিছুই হচ্ছে না। নিবিড় যেন একদম নীরব হয়ে গেছে, শান্ত হয়ে গেছে। আমাকে জ্বালাবে না বলেই পণ করে নিয়েছি। কিন্তু আমি তো এটা মেনে নিতে পারছি না। হঠাৎ করে নিস্তব্ধতা আমাকে যেন অনেক পীড়া দিচ্ছে। শঙ্কিত হচ্ছি নিবিড় ঠিক আছে তো? নিবিড় এর আবার কিছু হলো না তো?

নানান ভাবনা চিন্তা মাথায় এসে ঘুরপাক খায় কিন্তু নিবিড় কে নিজে থেকে কল দেওয়ার সাহস পায় না। কিভাবে দেব নিবিড় কে কল; দিলেই তো আমাকে খোঁচা দিবে। ও বলবে আমি ওর জন্য পাগল হয়ে গেছি‌। এমনিতেই তো সারাদিন এই কথা বলে। এখন নিজে থেকে কল দিলে তো আর বেশি করে বলবে।

কিন্তু আমিও তো থাকতে পারছি না আমার মনে হচ্ছে নিবিড়ের কিছু একটা হয়েছে। নিবিড় ঠিক থাকলে আমাকে না জালিয়ে থাকতে পারবেনা। তাহলে তিন দিন ও কিভাবে আমার সাথে কথা না বলে আছে। আজকে আমি আর এই প্যারা মাথায় নিয়ে থাকতে পারলাম না।

আজেবাজে কথা ভেবে আমি দুশ্চিন্তায় আতকে আছি। অনেক ভেবেচিন্তে নিবিড়কে একটা কল দিয়েই ফেললাম কিন্তু ফোন সুইচ অফ। আমার মেরুদন্ড সোজা হয়ে গেল বুকের ভেতর ভূমিকম্প হচ্ছে মনে হয়‌। ফোন সুইচ অফ দেখে যেন মনে বাসা বাধা ভয়ে দানা গুলো আরো পাকাপোক্ত হলো।

এবার আমি নিশ্চিত নিবিড় কোন বিপদে হয়েছে না হলে ফোন কেন সুইচ অফ থাকবে। ভয়ে আমার কান্না পেয়ে গেল। নিবিড়ের কোন বিপদ হলে আমি কিভাবে বাঁচবো সেটা ভেবে পাগল লাগছে নিজেকে। আমি কাকে কল করব। তাহমিনা আপুকে তো বলতে পারব না। আবির নাম্বারটা থাকলে ভালো হতো। ও ছাড়া আমাকে এই মুহূর্তে কেউ হেল্প করতে পারবে না।

তবুও তাহমিনা আপুকে কল দিলাম আপুর সাথে আমার কথা হয় না এক সপ্তাহ ধরে। তখন আমাকে জানিয়ে ছিল তারা নাকি হানিমুনে যাবে মালদ্বীপ। এজন্য আমি আর তাকে কল করিনি তারা কি ফিরে এসেছে নাকি এখনো রয়েছে। আপুর ফোন অফ দেখে বুঝতে পারলাম তারা এখনো ফিরে আসেনি।

টেনশন মাথায় নিয়ে কতক্ষণ থাকবো তিনদিন তো ধৈর্য ধরেছি এবার আর থাকতে পারলাম না। আমি দুপুর বেলায় কড়া রোদ মাথা বাসা থেকে বেরিয়ে এলাম। উদ্দেশ্য নিবিড় দের বাসায় যাব। আপুর সাথে দেখা করতে এসেছি সেই কথা বলব।

এখান থেকে নিবিড়দের বাসার দূরত্ব একঘন্টা আমি একটা অটো নিয়ে চলে এলাম। বাসার সামনে এসে আমি এক নজর বাসার দিকে তাকালাম। মাথা উঁচু করে তাকাতে আমার চোখে মুখে রোদের ঝিলিক এসে লাগলো। হাত দিয়ে কপাল ঢেকে সামনেই গেলাম। দাড়োয়ান চাচা আমাকে দেখেই তো একগাল হেসে বলল, কেমন আছ ?
আমি, জি ভাল আছি। আপনি কেমন আছেন চাচা?’

চাচা বললেন, ‘এইতো আছি কোনরকম। অনেকদিন পর আসলে বাসায় সেই যে গেল আর তা আসো নাই।’
‘কি প্রয়োজন আসবো কাকা এখানে তার আমার কেউ নাই। আর যারা আছে কেউ তো আমাকে পছন্দ করে না। সেটা জানেন‌ই। আজকে আবার আসলাম ভাবলাম একটু আপুর সাথে দেখা করে যায়। তাহমিনা আপু বাসায় আছে নাকি চাচা? তারা তো শুনছিলাম বেড়াতে গেছে!’

‘না তারা তো এখনো ফিরে নাই শুনলাম আর দুইদিন পর আসবো।’
‘ও তাহলে আর কি করব বাসার ভিতরে গিয়ে। আপু যেহেতু ফিরে নাই। আচ্ছা চাচা বাসার সবাই কেমন আছে?’
বাসার সবার কথা জিজ্ঞেস মুখটা কালো হয়ে গেল মলিন মুখে বলল, ‘সবাই তো ভালোই আছে কিন্তু নিবিড় বাবাজি তো ভালো নাই। ‘

নিবিড় ভালো নাই কথাটা শুনতে আমার বুকটা ছ্যাৎ করে উঠলো। আমার ভয় কি তাহলে সত্যি হল!
আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম, ‘ কি হয়েছে নিবিড়ের, চাচা?’
চাচা বললেন, ‘ এক্সিডেন্ট করেছে। বিরাট বড় এক্সিডেন্ট। পোলা টার লিগা কষ্ট লাগে অবস্থা ও নাহি ভাল না। সবাই তো খালি হসপিটালে দৌড়াদৌড়ি করছে। দোয়া করিস মা।’

বলতে বলতে চোখ মুছলেন। আমি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। মাথা ফাঁকা লাগছে আমার‌। এক্সিডেন্ট করেছে নিবিড় কবে কখন? আমি জানতেও পারলাম না। আমি কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলাম না। তারপর টেনে টেনে বললাম, ‘ এসব কবে হয়েছে চাচা।’

‘ শনিবার পরিক্ষা দিতে গেছিল সেইদিন হ‌ইছে। পরিক্ষা পর্যন্ত দিতে পারে নাই।’
চোখ দিয়ে আমার ও গলগলিয়ে পানি পরছে। চোখের পানি আটকাতে পারিনি আমি।
‘ কোন হসপিটালে আছে?’

চাচার থেকে হসপিটালের ঠিকানা নিয়ে আমি হসপিটালের উদ্দেশ্যে র‌ওনা দিলাম। কান্না আটকাতে পারিনি আমি গাড়িতে উঠেই ঝরঝর করে কেঁদে উঠি। গাড়ির বাকি লোকরা অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। আমি কোন দিকে লক্ষ্য করিনি। মুখে হাত চেপে কেঁদেছি। এজন্যই নিবিড় আমাকে আর কল করেনি। করবে কি করে লোকটা কি কল করার মত অবস্থা ছিল। এতো খারাপ অবস্থা মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে আর আমি বাসায় বসে ছিলাম।

হসপিটালের সামনে সে ভাড়া মিটিয়ে গুটিসুটি পায়ে হসপিটালে ভেতর আসলাম। এত বড় হসপিটাল কোন কেবিনে আছে নিবিড় কোন ফ্লোরে আছে কিছুই তো আমি জানিনা। উদ্দেশ্যহীন ভাবে আমি কিভাবে খুজবো। চিন্তিত মুখে এক কনে দাঁড়িয়ে আছি নিচ তলায়। কতক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে থাকবো। কাউকে জিজ্ঞেস করলে কি জানতে পারবো? কাউন্টারে একবার কি খোঁজ নিয়ে দেখব! জিজ্ঞেস করলে তারা বলবে কেন?

হঠাৎ দেখলাম বাইরে থেকে আবিরকে হাতে একটা বড় ব্যাগ নিয়ে হসপিটালে ঢুকতে। আবির কে দেখে আমার চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠলো। আমি ছুটে গিয়ে আবিরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। আবির আমাকে দেখে চমকে গেল।
এখানে হয়তো আমাকে প্রত্যাশা করেনি। অবাক গলায় বলল, ‘ভাবি তুমি এখানে কি করছো?’

ভাবি বললে সব সময় আবিরকে আমি ধমকা ধমকি করি। কিন্তু আজকে কিছুই করলাম না।‌আমি উত্তেজিত গলায় বললাম,, ‘তোমার ভাই এখন কেমন আছে? তিনি এমন একটা অবস্থা আছে। আমাকে একটা খবর পর্যন্ত দিলে না। এমনিতে তো ভাবি ভাবি বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলো!’

‘ সরি ভাবি। মাথায় ছিল না। ভাইয়া আগের থেকে এখন একটু বেটার।’
‘মনে ছিল না! তিন দিন চলে গেছে একবারও কি মনে পড়েনি। নাকি আমাকে মানুষ মনে করে না আমার কি টেনশন হয় না?’

‘সত্যি বলছি ভাবি মনে ছিল না। আর তাছাড়া তুমি এত টেনশন করবে সেটা ভাবি নি। তুমি তো ভাইয়াকে পছন্দই করো না। ভাইয়া তোমাকে ডিস্টার্ব করে তুমি তো বিরক্ত হও। তাহলে কেন তুমি টেনশন করেছ। ভাইয়া তোমাকে কয়দিন জালায় নি এতে তোমার তো খুশি হওয়া উচিত।

ভাইয়া দুই দিন আইসিইউ ভিতর ছিল গতকাল বিকেল থেকে কেবিনের শিফট করা হয়েছে। রাতে জ্ঞান ফিরেছে। আজকে সকাল থেকে তিনি কিছুটা সুস্থ। ভাইয়া তোমার কথা জিজ্ঞেস করেছিল আমাকে। আমি বলেছি তুমি কিছুই জানো না। আজকে ভেবেছিলাম বিকেলে তোমাকে খবর দেবো কিন্তু আমি খবর দেওয়ার খবর দেওয়ার আগেই তুমি খবর নিতে চলে এসেছ।’

অবাধ্য প্রেম বোনাস পর্ব

‘এসব বাদ দাও। আমাকে কোন ভাবে নিবিড়ের কাছে নিয়ে চলো। আমি এক নজর তাকে দেখতে চাই।’ অনুরোধ গলায় বললাম।আবির হাসল আমার কথা শুনে।

অবাধ্য প্রেম পর্ব ৪৬