অবেলায় ভালোবাসি পর্ব ১০

অবেলায় ভালোবাসি পর্ব ১০
সাবরিন জাহান

সকাল থেকে আকাশের অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না ।আয়ুশীর সাথে সাথে আকাশও পালাক্রমে বর্ষণ করছে।সীমা আর ইভা কি করা উচিৎ বুঝতে পারলো না।ইভার ফোন বেজে উঠায় ও উঠে ফোনের কাছে গেলো।দেখলো আয়ুশীর আব্বু কল দিয়েছে।

“আয়ু!আঙ্কেল!”
আয়ুশী নিজেকে সামলে নিলো।চোখ মুছে ধরা গলায় বললো,”হ্যাল্লো,বাবা!”
“এটা আপনার বাবার নাম্বার?”
আয়ুশী ভ্রু কুঁচকে নিলো।নাম্বার আরেকবার দেখে নিলো, নাহ ওর বাবারই নাম্বার ।
“কে বলছেন?”
“জি এই নাম্বারের ব্যাক্তি আপনার কে হয়?”
আয়ুশী বিরক্ত হলো।কে রে ভাই?
“আমার বাবা!”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“জি উনাদের গাড়ির এ’ক্সি’ডে’ন্ট হয়েছে,আপনি জলদি ** হসপিটালে চলে আসুন!”
হাত থেকে ফোন পড়ে গেলো ওর।চারদিক ঘুরছে ওর।কোনো কুল কিনারা না বুঝতে পেরে উঠেই দৌড় দিলো।ইভা আর সীমা কিছু বুঝার আগেই ও হাতের বাইরে চলে গেলো। ঝড় হচ্ছে বাইরে।কোনো গাড়ি রিকশা কিছুই পাচ্ছে না ও।অঝোর ধারায় কেঁদে চলছে ও। আশে পাশে গাড়ির খোজ করছে। বাট পাচ্ছে না।

ওদিকে গাড়ির ভিতর সিটে হেলান দিয়ে বসে আছে আয়ান।মূলত ওর কিছুই ভালো লাগছে না।ওখান থেকে আসার পর এভাবেই বসে আছে।এত অস্থিরতা ,কাতরতা কোনোটার মানেই ও বুঝে উঠতে পারছে না।অবশেষে ভাবলো বাড়ি ফিরা দরকার।গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ভার্সিটির গেট পেরোতেই দেখলো আয়ুশী আশে পাশে বিচলিত হয়ে কিছু খুঁজছে।ভিজে পুরো একাকার! শাড়ির আঁচল ও ঠিক নেই! আয়ান চোখ সরিয়ে নিলো।ভাবতে চায় না ও ওকে নিয়ে!আয়ানের গাড়ি দেখে আয়ুশী ছুটে এলো।

“স্যার আমাকে একটু সাহায্য করবেন প্লিজ!”
“আবার কোন নাটক শুরু করলে?”
আয়ুশী কোনমতে বললো,”স্যার প্লিজ!আমাকে একটু লিফট দিন!”
“প্লিজ,আয়ুশী!নতুন করে আর ড্রামা করো না!আমি যা বলার বলে দিয়েছি!”
বলেই গাড়ি টান দিয়ে চলে যাচ্ছে।আয়ুশী বেশ কিছুক্ষণ ডাকলো বাট শুনলো না ও।রাস্তার মাঝে বসে পড়লো ও।অঝোর ধারায় কাঁদছে।এদিকে আয়ান ব্যাক মিরোরে আয়ুশীকে এভাবে দেখে বেশ বিচলিত হলো।মেয়েটা এমন করছে কেনো?কিছুক্ষণ ভেবে দেখলো এভাবে একা রাস্তায় এভাবে রেখে যাওয়া ঠিক না ওর।গাড়ি ঘুরিয়ে আয়ুশীর কাছে চল আসলো।

“উঠে এসো!”
আয়ুশী কোনো রকম ভনিতা ছাড়াই উঠে পড়ল! আয়ান কিছু বলার আগেই ও বলে উঠলো,”** হসপিটাল চলুন প্লিজ!জলদি…”
আয়ান এবার চিন্তায় পড়লো।কি এমন হয়েছে?সোজা গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চললো হসপিটাল।পুরো রাস্তায় আয়ুশী মুখ চেপে কেঁদে যাচ্ছিলো। আয়ান কিছু জিজ্ঞেস করতে চেয়েও পারছে না!হসপিটালের সামনে আসতেই এক মুহুর্ত অপেক্ষা না করে বেরিয়ে গেলো।আয়ুশীকে এভাবে হন্তদন্ত হয়ে যেতে দেখে আয়ান ওকে একা ছাড়তে পারলো না।নিজেও গেলো পিছু পিছু।ভিজা অবস্থাতেই আয়ুশী রিসিপশনিস্ট এর কাছে গেলো।

“ম্যাম, হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ?”
আয়ুশীর মুখ দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছে না।ততক্ষণে আয়ান ও এসেছে!
“ম্যাম?”
“এ’ক্সি’ডে’ন্ট এর পেশেন্ট!”
আর কিছু বলা লাগেনি ওর!ততক্ষণে এক নার্স এসে বললো,”এ’ক্সি’ডে’ন্ট এর পেশেন্ট এর বাড়ির লোক কি এসেছে?”
আয়ুশী চট জলদি বলে উঠলো,”আমি!”
নার্স মুখ ভার করে বললো,”আসুন!”

আয়ুশী ধীর পায়ে তার পিছু পিছু গেলো। আয়ান বুঝে উঠতে পারলো না কার এ’ক্সি’ডে’ন্ট।নিজেও পিছু পিছু গেলো।কিছুদূর যেতেই আয়ুশীর পা থেমে গেলো।তিনটি মানুষ ,সাদা কাপড়ে তাদের মুখ ঢাকা!মেঝেতে শুইয়ে রেখেছে!নার্স এগিয়ে বললো,”এদের বাড়ির লোক এই মেয়েটা!”
এক ডক্টর বললো,”আপনার কে হন উনারা?”

আয়ুশী কিছু বলতে পারছে না।কোনমতে এসে প্রাণহীন মানুষদের পাশে বসলো।কাঁপা কাঁপা হাতে প্রথম মানুষটির কাপড় সরাতে অপরিচিত পুরুষ দেখে বড় নিঃশ্বাস নিলো।র’ক্ত মাখামাখি পুরো!আরেকটু সরে বাকি লা’শ দুটির মাঝে বসে কাঁপা কাঁপা হাতে কাপড় সরালো!মুহূর্তেই থমকে গেলো ওর পুরো দুনিয়া!কি রিয়েক্ট করা উচিত বা ঠিক কি বলা উচিত ওর সেসব হুশ নেই আর। আয়ান চমকে দু কদম পিছিয়ে গেলো।ওর বিশ্বাস হচ্ছে না।আয়ুশী আলতো করে ওদের মুখে হাত বুলালো!পাশেই নার্স বলে উঠলো,”স্পটেই মৃ’ত্যু হয়েছে উনাদের!”
আয়ুশী মৃদু স্বরে ওদের ডাকলো!

“মা!ও মা!”
মা নিরুত্তর!
“বাবা !”
তিনিও নিরুত্তর ।মায়ের এক হাত মুঠোয় নিয়ে,বাবার বুকে মাথা রাখলো ও…
“ইনারা আপনার বাবা মা হয়?”
আয়ুশী জবাব দিলো না!
“কি মুশকিল!আর কেউ কি নেই নাকি ?”
আয়ান এগিয়ে এলো।
“উনারা ওর বাবা মা হয়!”
“আপনি চিনেন?”
“জি!”

“কিছু ফর্মালিটি আছে!পূরণ করে ওদের নিয়ে যান!আরেকজন সম্ভবত ড্রাইভার!উনার ফ্যামিলিকেও খোঁজার ব্যাবস্থা করছি!”
আয়ান সম্মতি দিল।
“আয়ুশী!”
কারো মুখে আয়ুশীর নাম শুনে ঘুরে তাকালো আয়ান! ফাহিন বেশ অবাক হয় তাকিয়ে আছে। আয়ান ভ্রু কুঁচকে ভাবতে লাগলো ফাহিন আয়ুশীকে কিভাবে চিনে? ফাহিন আয়ানকে খেয়াল করেনি!ঝটপট এগিয়ে গেলো ওর দিকে!
“আয়ু?”
আয়ুশী নিরুত্তর!পাশে থাকা নার্সকে জিজ্ঞেস করতেই সে সব বললো। ফাহিন বুঝতে পারলো আয়ুশী ওর মাঝে নেই!ওর কাঁধে হাত রেখে মৃদু ধাক্কা দিলো।
“আয়ু!”
আয়ুশী ফাহিনের দিকে তাকালো।হালকা হেসে বললো,”আরে ডাক্তার!হুশ!এখন কথা বলো না…আব্বু আম্মু ঘুমাচ্ছে উঠে যাবে!”

ফাহিন কিছু বলার মধ্যে পেলো না!
“উঠে পড়!”
“উহু,বাবার বুকে শান্তি আর শান্তি!”
“আয়ু!”
“আহ,ডাক্তার!বললাম না আস্তে কথা বলো!ওরা উঠে যাবে তো!”
ফাহিন অসহায় চোখে তাকালো!
আয়ুশী আবার হেসে বললো,”ওহ সরি,ওরা তো আর উঠবে না!তাই না ডাক্তার?”
ফাহিন নিরুত্তর!
“ওরা আমায় একা ফেলে ঘুরতে চলে গেলো সারাজীবনের মত দেখলে ডাক্তার? কত স্বা’র্থ’প’র ওরা?”
“আয়ু!”

বাবার বুক থেকে মাথা উঠিয়ে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,”আর মা আমাকে ব’ক’বে না!বলবে না,” আয়ু তুই কিন্তু এবার মা’র খাবি!'”
ফাহিন নিরুত্তর!আয়ুশী ফাহিনের দিকে তাকিয়ে বললো,”আমায় কেন নিলো না ডাক্তার?আমি কি খুব খারাপ নাকি?”
“ওদের নিতে হবে আয়ুশী!”
মিষ্টি হেসে উঠে দাড়ালো!
“হুমম চলো চলো!”
সবাই ওর কাণ্ডে হতবাক!কিন্তু বুঝতে পেরেছে মেয়েটা অতি শোকে পাথর হয়েছে।

নিজের বাসার বাবা মায়ের দরজার সাথে হেলান দিয়ে হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে আছে আয়ুশী।রাত প্রায় বারোটার কাছাকাছি!মরিয়ম আর মোশাররফের জানাযা হয়ে গেছে!আয়ুশীর বাবা মা উভয়ই একমাত্র সন্তান ছিল পরিবারে!তাই তাদের তেমন আত্মীয় নেই! আয়ান ওর বাবাকে ফোন করে সবটা জানায়! ফাহিন এই অবস্থায় আয়ুশীকে ছাড়তে চায়নি! তাই সেও এসেছে ওর বাসায়!সীমা আর ইভা সব জেনে এখানে এসেছে।

সবাই মিলে উনাদের দাফন কাফনের ব্যাবস্থা করলো।এই পুরোটা সময় আয়ুশী নিশ্চুপ ছিল।একটুও কাঁদেনি ও!বেলাল আর দুইজন মুরুব্বী চেয়ারে বসে আফসোস করছে।”মেয়েটার এখন কি হবে?”,”বাবা মা ছাড়া তো ওর আর কেউ নেই!”,”ইস এই বয়সেই কত বড় আঘাত পেলো!”,আরো নানা কথা বলছে। আয়ান দূরে দাঁড়িয়ে সবাইকে দেখছিল।তখনই খেয়াল হলো পাশের ফ্ল্যাটের কিছু ছেলে আয়ুশীর দিকে তাকাচ্ছে।

আয়ান আয়ুশীর দিকে তাকিয়ে দেখলো,ওর অবস্থা একদম বিব্রতকর! শাড়ির আঁচল কোমর থেকে অনেকটা সরে গেছে,ফলে পেটের বেশ খানিকটা দেখা যাচ্ছে!আয়ানের রাগ হলো,এভাবে কেউ শাড়ি পড়ে?সামলে রাখতে পারে না?পরক্ষণে মনে হলো, ও এখন সেই অবস্থায় নেই!দীর্ঘশ্বাস ফেলে সীমাকে ডাকলো!ওকে বললো ওকে ভিতরে নিয়ে যেতে।তাছাড়া ভিজা শাড়ি পড়ে অনেকক্ষণ আছে ও।সীমা ওর কাছে গেলো।

“আয়ু?”
আয়ুশী নিরুত্তর।
“আয়ু!!”
তাও চুপ।
সীমা মৃদু ধাক্কা দিতেই নিচে পড়ে গেলো ও।ভয়ে চিৎকার দিলো ও,””আয়ু!”
আয়ান ওর কাছে যাবে তার আগেই ফাহিন চলে এলো।ওখানেই দাড়িয়ে গেলো ও। ফাহিন ওর হাত স্পর্শ করতেই বুঝলো জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে।সেই থেকে এত দখল,মেন্টাল স্ট্রেস সব মিলিয়ে সেন্সলেস!
“ওকে রুমে নিয়ে চলো!”(ফাহিন)
“আমি একা?”
ফাহিন ভাবলো।
“ওর শাড়ি টা ঠিক করে দেও!”

সীমা তাই করলো।পড়ে ফাহিন ওকে কোলে তুলে নিলো।তাই দেখে আয়ানের মনে কেমন একটা ফিল হলো।যা কেনো,কি কারণে ও জানে না!
ফাহিন ওকে বিছানায় শুইয়ে দিল। আয়ান দরজায় দাড়িয়ে সবটা দেখছে। হুট করেই ফাহিন বলে উঠলো,”ওর গালে এগুলো কিসের দাগ?”
সীমা আড়চোখে আয়ানের দিকে তাকালো!
“ও কিছু না!আমাদের দু’ষ্টুমির সময় এমন হয়েছে!”
“কিন্তু মনে হয় কেউ মে’রে’ছে!”
“ঐতো,ওর মাঝেই একটু হয়ে গেছিলো আরকি!”
“বরফ লাগিয়ে দেও!”

অবেলায় ভালোবাসি পর্ব ৯

আয়ান নিজের হাতের দিকে তাকালো!আফসোস হচ্ছে,ভীষণ আফসোস!কেনো ও নিজের রাগ কন্ট্রোল করতে পারে না?আজ আবারও ভুল করেছে ও! ও চাইলেই পারতো বুঝিয়ে বলতে।ভাবতেই নিজের উপর রাগ হলো।হন হন করে বেরিয়ে গেলো ও।নিজের কাছে নিজেই উত্তর খুঁজছে!কেনো করলো এমন?আয়ুশীকে এভাবে কষ্ট দিলো ও?

অবেলায় ভালোবাসি পর্ব ১১