অবেলায় ভালোবাসি পর্ব ১১

অবেলায় ভালোবাসি পর্ব ১১
সাবরিন জাহান

“আয়ুশী মামনি!”
বাড়ীওয়ালার আওয়াজে মুখ তুলে তাকালো ও।সেদিনের পর কেঁ’টে গেছে দুটো দিন!ইভা এই কয়দিন আয়ুশীর কাছেই ছিল। সীমাও থাকতো,কিন্তু হোস্টেলের ব্যাপার !একজনকে তো থাকতেই হবে!তার উপর ওর টিউশনি মিস গেলে টাকা কেঁ’টে রাখবে।সব মিলিয়ে ও ওর প্রিয় বান্ধবীর এই অবস্থাতেও সাথে থাকতে পারছে না।এর মাঝে বেলাল, আয়ান আর ফাহিন এসে দেখা করে গেলেও আয়ুশী প্রতিটা ক্ষেত্রেই চুপ ছিল।আয়ুশী সেভাবে প্রকাশ না করলেও দুইরাত নীরবে কেঁদে গেছে।তেমন কোনো আত্মীয় নেই যে ওকে সামলে রাখবে।আর না আছে নিজেদের বাড়ি!

আয়ুশী তাকাতেই তিনি ভীষণ অস্বস্থি নিয়ে বললেন,”এই মাসের ভাড়া বাকি!তার উপর তোমার নিজেরও কোনো ইনকাম নাই। এখনও মাসের ১০ দিন বাকি!তো কি ঠিক করলে?খরচ চালাতে পারবে বাসার?না মানে বুঝোই তো!এভাবে তো আর রাখা যায় না তাই না?”
আয়ুশী বেশ ভালোই এর মানে বুঝেছে।দীর্ঘশ্বাস ফেললো।তারই বা দোষ কি?সে তো বাসাতে টাকার বিনিময়েই থাকতে দেয়!

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“আপনি টুলেট লাগিয়ে দিন আঙ্কেল,আমি আর এত টাকা কোথা থেকে পাবো!বাবার তো আর সঞ্চয় ছিল না।তবে এই মাসের ভাড়াটা আমি দিয়ে দিবো!”
বাড়ীওয়ালা চলে গেলেন!ইভা আয়ুশীর কাছে বসলো!
“আয়ু,বাসা ছেড়ে দিলে থাকবি কোথায়?”
“না ছাড়লে ভাড়া দিবো কই থেকে?”
ইভা চুপ রইলো!আবার বললো,”হোস্টেলের সিট আছে কিনা দেখি?”
“ওখানে থেকেই বা কি করবো?পড়াশোনার খরচ কি উঠাতে পারবো?”

“দেখ হোস্টেলের ব্যাবস্থা হয়ে গেলে আর মাসে দুই থেকে তিনটা টিউশনি করলে তুই এমনেই খরচ চালাতে পারবি নিজের।একবার পড়াশোনাটা শেষ কর!তারপর আর কোনো সমস্যা হবে না!”
“দেখ, এমনিও আর করারই বা কি আছে?”
“আচ্ছা আমি তাহলে খোজ নিয়ে আসি,সীমা তো এখন টিউশনিতে!তুই খেয়ে নে আগে,তারপর আমি যাবো!”
“আমি খেয়ে নিবো,তুই যা!”
“তোর উপর বিশ্বাস নেই!বিকেল হয়ে গেছে।তুই কখন থেকে পরে খাবি পরে খাবি করছিস!”

“প্লিজ ইভা!যা না তুই,বললাম তো খেয়ে নিবো!”
“বেশ খেয়ে নিস!আমি জলদি চলে আসবো!”
ইভা রেডি হয়ে নিলো।
“দরজা লাগিয়ে দে!আমি আসছি…”
বলেই বেরিয়ে গেলো।

আনুমানিক সন্ধ্যা সাতটা!সাধারণত এখন বর্ষাকাল!যদিও শেষের দিকে। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে।বিছানা ছেড়ে উঠে বাবা মায়ের রুমে গেলো ও!বিছানার দিকে তাকাতেই চোখ ভরে উঠলো ওর।এই সময়টায় মা বসে বসে বাবার সাথে ঝগড়া করতো।আর ও মজা নিতো।ধীর পায়ে আলনার কাছে গেলো।সব ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছে।রুমে একটা ছোট ড্রয়ার আছে।ওইটা খুলতেই ওদের ফ্যামিলি অ্যালবাম চোখে পড়লো।ওটা নিয়ে বসে দেখতে লাগলো।কত শত স্মৃতি ওদের।মুখে হাসি ফুটলো ওর। হঠাৎ চোখ পড়লো ওদের ফ্যামিলি ফটো ফ্রেমের উপর।সাধারণত এইসব ছবি ওরা সাজিয়ে রাখেনা!ফ্রেমের ফটোতে আনমনে তাকিয়ে রইলো।ফোনের শব্দে ঘোর ভাঙলো ওর।ফ্রেম হাতেই গেলো নিজের রুমে!ইভার কল!

“আয়ু!”
“হুমম বল!”
“বাইরে তো ঝড় বইছে,তার উপর সন্ধ্যা অনেক।সীমাও নেই যে ওকে নিয়ে যাবো।আটকে গেছি আমি!”
“সীমা কোথায়?”
“ও বাড়িতে গিয়েছে,ওর বাবা নাকি অসুস্থ অনেক!”
“তুই থাক!আসা লাগবে না…”
“তুই একা থাকতে পারবি?”
“জীবনের প্রতিটা পদক্ষেপই এখন একা নিতে হবে,আর এটাই হয়তো তার সূচনা!চিন্তা করিস না…পারবো!”

ইভা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।ঝড় বৃষ্টির মাঝে হলেও সে যেতো।কিন্তু সন্ধ্যা একে তো।রাস্তা ঘাট যেমন শুনশান তেমন অ’মানুষের উৎপাত বেশি!আর এমনিও সে ভীতু ভীষণ! জুনাইদকে বলবে ভেবেছিলো।কিন্তু ও আপাতত এলাকার বাইরে।সব মিলিয়ে কুল কিনারা পাচ্ছে না!
“খেয়াল রাখিস,আমি সকালেই চলে আসবো!”

আয়ুশী কিছু না বলেই রেখে দিল।ওর এখন সব অসহ্য লাগে।সবার এত সিমপাথি ওর কাছে মনে হয় দয়া।অবশ্য কি আর করার!এখন ওর কোনো সম্বল নেই! ফটো ফ্রেম হাতে নিয়ে বারান্দায় গেলো।আগের তুলনায় বৃষ্টি বাড়ছে।পানি ছিটকে আসছে বাইরে থেকে।কিন্তু তাও বারান্দার গ্রীল ঘেঁষে বসে পড়লো।পানি ছিটা মুখে আসতেই পুরনো স্মৃতি ভেসে উঠলো।
ক্লাস এইটের কিশোরী আয়ুশী।টিনের চালের ঘর!বৃষ্টি পড়ার ঝুপঝাপ শব্দ হচ্ছে টিনের চালে!দু হাত পেতে গড়িয়ে পড়া জল হাতের মুঠোয় নিলো ও।বারান্দায় মাদুর পেতে বসে থাকা মোশাররফ সাহেবের কাছে গেলো ।

“আব্বু!”
মোশাররফ মেয়ের ডাকে তাকালেন।হাতের পানি বাবার মুখে ছিটিয়ে দিতেই খিল খিলিয়ে হেসে উঠলো আয়ুশী ।
“পাজি মেয়ে, দাড়া!”
বলে পিছু নিতে গেলেই আয়ুশী দিলো দৌড়।বাবার তাড়া করায় কোনো প্রকার ভাবনা চিন্তা ছাড়াই বৃষ্টির মাঝে উঠানে নেমে গেলো।
“আয়ু,বৃষ্টিতে ভিজে না মা!”

আয়ুশীর সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই।সে তো বাবার কাছে ধরা না দিতে ব্যাস্ত।মেয়েকে ধরতে তার পিছু ছুটলো মোশাররফ!কিন্তু উঠান ভিজা হওয়ায় স্লিপ কেঁ’টে পড়ে গেলেন!তাই দেখে আয়ুশী আবার হাসলো!
“আব্বু ব্যাথা পাইছি,এসে তোল আমায়!”
আয়ুশী বাধ্য মেয়ের মত বাবাকে তুলতে এলো।কিন্তু মোশাররফ মেয়েকেও নিজের সাথে পিচ্ছিল উঠানে ফেলে দিলেন!আর হাসতে লাগলেন।

“এটা কি করলে আব্বু!মা বকবে তো…পুরো মাটি লেগে গেছে!”
“আমি একা কেন বকা খাবো?তোকেও সাথে নিলাম!”
তখনই মরিয়ম এলেন!
“বাহ,বাপ বেটি মিলে বৃষ্টির মাঝে বসে মাটিতে মাখামাখি করছে।এই যে বৃষ্টিতে যে ভিজছেন!যদি জ্বর আসে,আমি কিন্তু একদম কোনো খেয়াল রাখতে পারবো না!”
আয়ুশী ঠোঁট উল্টে বললো,”মা এসে তুলো আমাদের!”
“আমি পারবো না বাপু!তোরা নিজেরা উঠ!”
“পারছি না তো!”

মরিয়ম উপায় না পেয়ে ওদের তুলতে গেলে নিজেও স্লিপ খেয়ে পড়ে গেলো। তা দেখো ওরা দুইজন হেসে দিল।
“সব দোষ তোমাদের!খালি অসুখ হোক!আমি কিচ্ছু টি করবো না বলে রাখলাম!”
আয়ুশী আবার হাতে বৃষ্টির পানি জমিয়ে ওর মায়ের মুখে মারলো!
“আয়ু কি করছিস?”

বাবাও সেম কাজ করলো।ওদের জন্য মরিয়মও এরকম করতে লাগলো।তিনজন মিলে হাসছে আর বৃষ্টিতে মজা নিচ্ছে।
পুরনো স্মৃতি মনে পড়তেই ফুফিয়ে কেঁদে উঠলো আয়ুশী। ও কারো সামনে কাঁদতে পারে না।কিন্তু একা থাকলে মন প্রাণ উজার করে কাঁদে।ওভাবেই বৃষ্টিতে বসে রইলো।বৃষ্টির গতি বাড়তে বাড়তে একটা পর্যায়ে অনেক বেশি করে ঝড় বইতে লাগলো।আয়ুশীর কোনো হেলদোল নেই! ও সেভাবেই বসে রইলো।পুরো রাত বৃষ্টি থামার কোনো নাম নেই।ভোরের দিকে কমে এলো।

সকাল ছয়টা!ইভা সকাল হতেই চলে এসেছে।আয়ুশীকে একা ছাড়ার মত কাজ কখনোই করতো না।কিন্তু কাল চেষ্টা করেও পারেনি আসতে!আয়ুশীদের বাসার সামনে আসতেই দরজায় নক দিলো।কেউ খুলছে না!ইভা একটু জোরে ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে গেল।কালকে এভাবেই দরজা চাপিয়ে গেছিলো ও।আয়ুশী কি তবে দরজা লাগায় নি?ভেবেই ভিতরে ঢুকলো।রুমে আয়ুশীকে না পেয়ে বারান্দায় যেতেই দেখলো আয়ুশী গ্রীলে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছে।জামার অনেক অংশই ভেজা! বারান্দাতেও পানি আছে এখনো!তবে কি আয়ুশী সারারাত এখানে ছিল?ভাবতেই দৌড়ে ওর কাছে গেলো।
“আয়ু..”

বলে ওর গালে হাত দিতেই দেখলো জ্বর এসেছে।এটাও বুঝলো আয়ুশী সেন্সলেস! ইভার হাত পা কাঁপছে।এখন কাকে ফোন করবে ভাবতেই ফাহিনের কথা মাথায় এলো।কিন্তু ওর কাছে তো ফোন নাম্বার নেই!অতঃপর আয়ানের কথা মাথায় আসতেই চট করে আয়ুশীর ফোন নিয়ে ওকে কল দিল।এক রিং হতেই রিসিভ হলো।যেনো জেগেই ছিল।ইভা কথা বলার আগেই আয়ান বলে,”আয়ুশী,তুমি ঠিক আছো?”..
ইভা কেঁদে দিল।

“ভাইয়া,আয়ু সেন্সলেস!আমি কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না ।তাই আপনাকে ফোন দিলাম!”
ওপাশ থেকে ফোন কেঁ’টে গেলো.।ইভা জানে আয়ান এখন আসছে।বহু কষ্টে আয়ুশীকে তুলে রুমে নিয়ে জামা পাল্টে দিলো।
আয়ুশীর মাথায় জলপট্টি দিচ্ছে ইভা।তার কিছু দূরেই দাড়িয়ে আছে আয়ান।আর বিছানার এক মাথায় বসে আছে বেলাল সাহেব! ফাহিন এসে দেখে গেছে ওকে।কিছু ওষুধ আনতে বাইরে গেছে ও।মূলত আয়ানই ওদের জানিয়েছে।বেলাল চিন্তিত অবস্থায় বললেন,”এভাবে মেয়েটাকে একা ছাড়া যাবে না!”

“আমি দুঃখিত,আসলে বাড়ীওয়ালা বাসা ছাড়তে বলেছে।এখন ও থাকবে কই,খরচ চালাবে কিভাবে..তাই এসব জোগাড় করতে গিয়েছিলাম!রাতে বৃষ্টিতে আটকে গিয়েছিলাম।কিন্তু ভাবিনি এর মাঝে এত কিছু হয়ে যাবে!”
“বেশ চিন্তার বিষয়!”
ফাহিন ততক্ষণে চলে এসেছে।
“ওর সাথে এখন কারোর সবসময় থাকা দরকার!”(ফাহিন)

অবেলায় ভালোবাসি পর্ব ১০

“আমি থাকবো!কিন্তু আপাতত ও কোথায় থাকবে?হোস্টেলের সিট পাইনি তো?”
ফাহিন চিন্তায় পড়লো।
ফট করে আয়ান বলে উঠলো,”বাবা ,ওকে আমাদের সাথে নিয়ে যাই?”
বেলাল সাহেব আয়ানের দিকে তাকালেন!কিছু একটা ভাবছেন।কিন্তু কি তা উনার জানা!

অবেলায় ভালোবাসি পর্ব ১২