অবেলায় ভালোবাসি পর্ব ১২

অবেলায় ভালোবাসি পর্ব ১২
সাবরিন জাহান

বাইরে মৃদু বাতাস বইছে।বৃষ্টি শুরুর আগে যেই মিষ্টি ঘ্রাণ আসে, তা গাড়ির জানালার পাশে বসে টের পাচ্ছে আয়ুশী।পাশেই বেলাল সাহেব।ড্রাইভিং সিটে ফাহিন আর আয়ান তার পাশে।সেন্স ফেরার পর আয়ুশীকে হসপিটালে কিছু টেস্ট করিয়ে আনলো ওরা।আয়ুশী কিছু বলেনি!বলার মন মানসিকতা বা শক্তি কোনোটাই অবশিষ্ট নেই। আয়ানের বাড়ির সামনে গাড়ি থামতেই কিছুটা অবাক হলো।বেলাল সাহেব আয়ুশীকে নামতে বললেন…

“আমাকে এখানে কেনো আনলেন?”
“আজ থেকে তুমি এখানে থাকবে!”
আয়ুশী মলিন চোখে তাকালো।
“আপনিও দয়া দেখাচ্ছেন আঙ্কেল!”
বেলাল সাহেব মন ক্ষুণ্ণ হলেন।
“এসব কি বলছো মামনি!”
“নাহলে এভাবে দয়া দেখাতেন না আমায়!”
আয়ান বলে উঠলো,”তুমি ভুল ভাবছো!”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আয়ুশী তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,”অনাথ মেয়েটাকে নিজের বাড়িতে আশ্রিতা হিসেবে রাখতে চাচ্ছেন স্যার?”
“কে বলেছে তুমি অনাথ?”,বলতে বলতেই নাহার বেরিয়ে এলো।আয়ুশীর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,”আমি তো তোমার আরেক মায়ের মত!”
“কিন্তু…”
“কোনো কিন্তু না,ভিতরে এসো!”

এক প্রকার টেনেই নিয়ে গেলো ওকে।বেলাল সাহেব আগেই বলে রেখেছে উনাকে!নাহার ওকে নিজের ঘরে নিয়ে বসিয়ে দিলেন! ফাহিন এসে নাহারকে ওর ওষুধ বুঝিয়ে দিতে লাগলো।তখনই প্রবেশ করলো আরেক মেয়ে।
“তুমি আয়ুশী,রাইট?”
আয়ুশী বিস্মিত চোখে তাকালো। কটি সহ কুর্তা,সাথে জিন্স পরিহিত মেয়েটির ঘন কালো কেশ তার কোমর অব্দি বিরাজ মান!ওর নিজের চুলও কোমর অব্দি!কিন্তু মেয়েটির এমন অপরূপ সৌন্দর্যে যে কেউ বিমোহিত হবে।ফর্সা হাতে কালো বেল্টের ঘড়িটা যেনো আরেক রূপ এনে দিয়েছে।মেয়ে হয়ে আয়ুশী নিজেও এক প্রকার মুগ্ধ হলো।

“কোথায় হারালে?”
“হুঁ?”
“তুমি আয়ুশী তো?”
“হুমম!”
“আমি ইহরা!এইযে এই মহিলাকে দেখছো(নাহারকে উদ্দেশ্য করে)ইনি আমার জ’ল্লা’দ মা লাগে!”
সাথে সাথেই নাহার ওর কান টেনে ধরলো।
“আহ,মামনি লাগছে!”
“আমি জ’ল্লা’দ?”
“না না,তুমি তো আমার কিউট মামনি!”

নাহার ওর কান ছেড়ে দিয়ে আয়ুশীকে ওষুধ দিলো।আয়ুশী অবাক হয়ে দেখছে।ওর জানা মতে আয়ানের কোনো বোন নেই!তাহলে এ কে?নাহার ওর চোখের ভাষা বুঝতে পেরে বললো,”ও আমার ছোট বোনের মেয়ে!”
আর কিছু বলার আগেই ইহরা বলে উঠলো,”আসলে কি বলোতো,ছোট বেলায় মা বাবা আকাশের তারা হয়ে গেছে।তখন থেকে এখানেই বড় হয়েছি।আমি যখন ক্লাস ফাইভে পড়ি তখন আয়ানের সাথে আমিও বিদেশ চলে যাই!আয়ানের পড়াশোনা শেষ হলে ও ফিরে আসে।কিন্তু আমার শেষ হয়নি,তাই তখনও ওখানে!আর কিছু জানার নেই।নেও আমি সব বলে দিলাম!”

ফাহিন মাঝে বলে উঠলো,”আরেকটা জিনিস বলতে ভুলে গেছো!আয়ানের হবু বউ হও সেটা তো বললে না!”
ইহরা আড়চোখে তাকালো।আয়ুশী এবার অবাকের চরমের পর্যায়!
“হবু বউ?”
নাহার হেসে বললো,”হুমম।আর কিছুদিন পর এ বাড়ির বউ করে ওকে ঘরে তুলবো!শুধু আয়ানের একটু সেটেল হওয়ার অপেক্ষা!”
ইহরা মাথা নিচু করে বসে আছে।আয়ুশীর এখন সব শূন্য শূন্য লাগছে।আর কত জখম সহ্য করবে ও।

“আচ্ছা, আন্টি আমি আসি!হসপিটালে কাজ আছে !”
“আচ্ছা,সময় করে এসো কিন্তু আবার!”
ফাহিন মাথা নেড়ে সম্মতি দিয়ে বের হয়ে গেলো।তার পিছু পিছু ইহরা বের হলো!
“সব সময় আয়ানের হবু বউ বলে খোচান কেনো আমায়?”
ফাহিন ভ্রু কুঁচকে বললো,”আমি আবার কিভাবে খোচালাম?”
“কথাটা আপনি খোঁচা মে’রেই বলেছেন!”
“আমি জাস্ট সত্যটা বলেছি!”

ইহরা হন হন করে চলে গেলো।তাই দেখে ফাহিন তাচ্ছিল্যের হাসি দিল।
“আয়ু মা!”
“জি আন্টি!”
“এসব আন্টি বান্টি বাদ দে!ছোট আম্মু ডাকবি আমায়!আমি কিন্তু কাউকে তুই করে বলি না!তোকে বলছি…তোর আম্মুও তো এভাবে ডাকে তাই না?এখন থেকে আমিও তোর আম্মু হওয়ার সব রকম চেষ্টা করবো! কিরে মেনে নিবি তো?”
আয়ুশীর চোখে পানি এলো।

“এসব দয়া না আয়ু,জানিস তুই তখন খুব ছোট!আমরা শহরে থাকতাম আর তোরা গ্রামে।তোর তখন ভীষণ জ্বর। অত রাতে কোনো ডাক্তার ছিল না তখন গ্রামে!শহরে এত রাতে কিভাবে আসবে ভেবে পাচ্ছিল না।তখন তোর আঙ্কেল ডাক্তার নিয়ে তোদের বাড়ি গিয়েছিল।তখনের পর থেকে তারা আরো ভালো বন্ধু হলো।জানিস যখন তোর আঙ্কেল চলে আসছিল,তোর বাবা অশ্রুসিক্ত চোখে বলেছিল,’কখনো আমি না থাকলে বা আমরা না থাকলে আমার মেয়েটাকে একটু আগলে রাখিস!’,তখন তোর আঙ্কেল বলেছিল,’এটা আবার বলা লাগে? ও তো আমার আরেক মেয়ে।তোরা থাকলেও বা না থাকলেও ওকে আগলে রাখার দায়িত্ব আমার!’,আর সেই থেকে তোকেই নিজের আরেক মেয়ে ভাবতো!তার ভালোবাসাকে দয়া বলে অপমান করিস না রে মা!”

কয়েক ফোঁটা পানি চোখ থেকে গড়িয়ে পড়লো। ও নিজেও জানে বেলাল আঙ্কেল ওকে অনেক বেশি ই ভালোবাসে।আর কিছু বলার পেলো না ও!রাতে খাবার খেতে সবাই বসলেও আয়ুশী এলো না। আয়ান উসখুস করছে ওর খবর নেয়ার জন্য।কিন্তু এভাবে সবার সামনে কিভাবে নিবে?তখনই ইহরা বলে উঠলো,”আয়ুশী কই?”
নাহার বলে উঠলেন,”ওকে খাইয়ে ঘুমাতে দিয়ে এসেছি।ঘুমিয়েও পড়েছে হয়তো!”
আয়ান আর কিছু না ভেবে খেয়ে উঠে গেলো।

রাত বারোটা!সবাই গভীর ঘুমে থাকলেও আয়ুশী ছাদে!আগে রাতে একা একা ছাদে আসতেও ভয় পেতো!আর এখন? যার জীবনের এখন কোনো মাইনে রাখে না,তার আবার ভয়!প্রিয় মানুষগুলোকে তো হারালোই!সেই সাথে প্রথম ভালোবাসার মানুষকেও পেলো না।আর বাঁচার আশাই রাখে না।কিন্তু সৃষ্টিকর্তার দেয়া এই সুন্দর জীবন নিজের হাতে নষ্ট করতে পারে না ও।নাহার আর বেলালের জন্য হলেও নতুন করে বাঁচবে ও।চোখ বন্ধ করে হালকা বাতাস অনুভব করছিল ও।তখনই কারোর পায়ের আওয়াজে ঘুরে দরজার দিকে তাকালো। আয়ানকে দেখে বুক মোচড় দিয়ে উঠলো ওর। আয়ান আয়ুশীকে দেখে অবাক হলো।

“তুমি এখানে?”
“ঘুম আসছিলো না তাই আরকি!”
বলেই যেতে নিলে আয়ান ডাকলো!
“কোথায় যাচ্ছো?”
“রুমে!”
“কেনো আমি এসেছি বলে?”
আয়ুশী নিরুত্তর।
“কিছু কথা ছিল তোমার সাথে!”

আয়ুশী আবার নিজের জায়গায় দাড়ালো! ও চাইলেও এভাবে চলে গিয়ে আয়ানের অপমান করত পারে না।
আয়ান বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,”সরি!”
আয়ুশী নিষ্প্রাণ চোখে তাকালো!
“আই এম রিয়েলি সরি!আসলে আমি রাগ উঠল কন্ট্রোল করতে পারি না।একমাত্র মা ছাড়া কারোর কথা তখন শুনি না!নিজে কি করি তখন হুশে থাকি না!আমি তোমাকে চাইলেই বুঝিয়ে বলতেই পারতাম,কিন্তু আমার রাগ ওরকম অস্বাভাবিক আচরণ করতে বাধ্য করলো।আমি এই রকম আচরণের জন্য নিজের উপর ভীষণ বিরক্ত!আমি বুঝি না এমনটা কেনো করি!আমি সত্যি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত!”

“আমি কিছু মনে করিনি!”
আয়ান তাকালো।
“আমারই ভুল ছিল আপনার দায়িত্ব , মানবিকতাকে অন্য চোখে দেখা!আসলে নারীদের মন ভীষণ আবেগী।হয়তো আপনার এই দায়িত্ব,মানবিকতাকে ওই আবেগী মন অন্য কিছু ভেবে নিয়েছে।আর তাছাড়া আমি এমন ভাবে আপনাকে ডেকেছি আপনার রাগ হওয়াটা স্বাভাবিক!আর আমারও উচিত ছিল আপনার সম্পর্কে জানার!যদি জানতাম আপনার উড বি আছে তাহলে হয়তো এমন কিছুই হতো না!”

“যাই হোক,আমার এভাবে হাত তোলা উচিত হয়নি!”
“ইটস ওকে স্যার!”
বলে চলে আসতে নিলেই,
“আয়ুশী!”
“জি!”
“যা হয়েছে সব ভুলে আমরা আগের মত স্বাভাবিক হতে পারি না?”
“স্বাভাবিক হয়েছি স্যার!আপনি চিন্তা করবেন না!সব আগের মতোই চলবে!”
আয়ান আর কিছু বলল না!আয়ুশী চলে গেলো।

অবেলায় ভালোবাসি পর্ব ১১

নিজের রুমের বারান্দায় দাড়িয়ে সিগারেট টানছে ফাহিন। হাতে তার সেই মায়াবতীর ছবি!
“কেনো তোমাকে দেখলেই আমার সব ওলোট পালোট লাগে মায়াবতী!তোমার চাহুনি,মায়াবী মুখখানা আমার হৃদয়টাকে যে ক্ষত বিক্ষত করে মায়াবতী!তোমার মায়া কাটানো যে আমার জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে অসাধ্য জিনিস!জানি না এই দহনে আর কত দিন জ্বলবো আমি!তবুও ভালোবাসি মায়াবতী!ভীষণ ভীষণ ভালোবাসি!আমার অস্তিত্ব জুড়ে কেবল তুমি!অবেলায় ভালোবাসি!”

অবেলায় ভালোবাসি পর্ব ১৩