অবেলায় ভালোবাসি পর্ব ২৫

অবেলায় ভালোবাসি পর্ব ২৫
সাবরিন জাহান

রাতে খাবার খেতে বসলো ওরা। টুকিটাকি কথা বলছে ওরা। হুট করেই বলে উঠলো,
“মামনি আয়ানের বিয়েটাও দিয়ে দেও আমার বিয়ের সাথে! “, ইহরার কথা শুনে আয়ুশীর নাকে খাবার উঠে গেলো। কাশতে লাগলো ও। আয়ান অড়াতাড়ি ওঠে ওর মাথায় মৃদু চাপড় দিয়ে পানি খাইয়ে দিলো।

“খাওয়ার সময় এই জন্যই কথা বলতে নেই,দেখলি তো মেয়েটার কি হলো?”(নাহার)
ইহরা মুচকি হাসলো।
সবাই চুপচাপ খেয়ে উঠলো!
রাতে বিছানা ঠিক করছিল এমন সময় ইহরা এলো।
“আপু তুমি?”
“আজকে তোমার সাথে ঘুমাবো । তাই চলে এলাম।”
হাসলো আয়ুশী। ইহরাও ওর সাথে বিছানা ঠিক করতে লাগলো।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“কি বলবে বলে ফেলো আপু?”
“তুমি কিভাবে বুঝলে ?”
“গোছানো বিছানা আবার ঠিক করার কি মানে ?”
ইহরা জিহ্বায় কামড় দিয়ে হাসলো।
“আয়ানের সাথে সব ঠিক করে নিলেই তো পারো।”
আয়ুশী চমকে তাকালো। ইহরা হেসে বললো,”আমি সবটা জানি শুরু থেকে।”
“কি জানো?”

“এই যে তোমার আর আয়ানের দেখা হওয়া ,ঝগড়া – ঝাটি সব!”
“কিভাবে?”
ইহরা আয়ুশীকে নিয়ে নিজের পাশে বসালো!
“যখন দেশের বাইরে ছিলাম,তখন আয়ান আমাকে সব বলতো!”
“কি বলতো?”
“তখন সেভাবে কিছু না বললেও,তুমি কি কি করেছো সব বলেছে।শুধু প্রপোজের ব্যাপারটা বলেনি!”
“তুমি তার ফিয়নসে,বলাটা স্বাভাবিক!”
“ফিয়নসে হিসেবে নয়,একজন ভালো বন্ধু হিসেবেই বলতো!”
“ওহ!”

“আয়ান আমাদের বিয়ে ঠিক হওয়ার পর থেকেই আমার সাথে ফ্রেন্ড এর থেকে বেশি কিছু হয়ে কথা বলতে চেষ্টা করতো!কিন্তু পারতো না।ওর মনে আমার জন্য কখনোই তেমন ফিলিংস আসেই নেই।আমি ব্যাপারটা বুঝতাম,তাই সব সময় অল্প কথা বলে কাজের বাহানা দিয়ে রেখে দিতাম।এতে আয়ান নিজেও স্বস্তি পেতো!”
“এসব হঠাৎ আমাকে কেনো বলছো?”
“আয়ান তোমারও আগে থেকে তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছিল। যেটা ও নিজেও জানতো না!”
আয়ুশী জিজ্ঞাশাসূচক দৃষ্টিতে তাকালো।

“এই যে তোমাদের আলাপ থেকে শুরু করে সবটা যখন ও আমাকে বলতো না?তখন ওকে কেমন খুশি খুশি লাগতো!আমি তখন ওর কথা মন দিয়ে শুনতাম। ও নিজেও তখন জানতো না যে ও তোমাকে ভালোবাসে!”
“জোক মা’রা বন্ধ করো!আলাপের শুরুতেই কেউ প্রেমে পড়ে নাকি?”
“লাভ এট ফার্স্ট সাইট বলে কথা আছে।এটা তুমি মানো বা না মানো!সেই থেকেই স্টোরি শুরু হয়!”
আয়ুশী চুপ রইলো!

“তুমি যেদিন বাড়ি ফিরতে দেরি করলে সেদিন ও পাগলের মত তোমার খোজ করেছে!এতটাই টেন্সড ছিল যে হিতাহিত জ্ঞান ভুলে রাস্তায় বসে ছিল। ফাহিন ভাইয়া গিয়ে নিয়ে এসেছে! সেদিনই ও ফিল করেছে ও তোমায় ভালোবাসে!”
“এখনও হবু জামাইকে ভাইয়া বলো?”
ইহরা ভরকে গেল।এই মেয়েকে বোঝাচ্ছে কি আর ও বলছে কি!
“তুমি আমার কথাটা এভাবে ইগনোর করছো কেনো?”
“যদি ভালোই বাসতো এনগেজমেন্ট তো করতো না কখনোই!”
“ভুল বুঝছো!”

“কিসের ভুল? হ্যাঁ মানছি তোমাদের বিয়ে আগে থেকে ঠিক ছিল,তাই বলে এভাবে সব মেনে নিবে?এটা ভাবলো না আরে যাকে ভালোবাসে তাকে না পাওয়ার আফসোস উনাকে সারাজীবন কাঁদাবে?”
“ওর কাছে ওর থেকেও ইম্পর্ট্যান্ট ওর মা বাবা!”
“মা বাবা সবার কাছেই ইম্পর্ট্যান্ট আপু!কিন্তু উনি আমাকে যেভাবে কষ্ট দিয়েছেন,যেভাবে অপমান করেছেন।সেখানে এসব আমি মানতে নারাজ!”
ইহরা হাসলো!
“তোমার রাগ করাটা স্বাভাবিক!কিন্তু একটা গল্প শুনবে?”
“গল্প?”

“আমি তখন ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারের স্টুডেন্ট!ক্লাস এইট থেকে ফাহিন ভাইয়াকে আমার ভালো লাগতো!উনিও আমাকে পছন্দ করতেন বেশ বুঝতাম!আমাদের মাঝে যেটা ছিল না সেটা হলো ভালোবাসি বলা!বিনা ভালোবাসি বলে,বিনা কোনো সম্পর্কে আমরা একে অপরের কেয়ার করতাম!কাজে কর্মে সব বুঝাতাম।এভাবেই বড় হাওয়া!আয়ানের থেকে বেশিরভাগ সময় ফাহিনের সাথেই থেকেছি আমি।

আস্তে আস্তে ভালো লাগা থেকে ভালোবাসা হলো।ইন্টারে কিছু দিন ছুটি পেয়েছিলাম!ওর মাঝেই মামনি আর বাবাই এর বিবাহ বার্ষিকী ছিল।তাই তিনজন আসলাম ছুটির নাম দিয়ে ওদের সারপ্রাইজ করতে!বাড়ি আসার পর এটাও ভেবেছিলাম মামনির সাথে ফাহিনের বিষয়টা শেয়ার করবো!কিন্তু তার কয়েকদিন আগেই আয়ানের এডপশন পেপার আয়ানের সামনে এসে পড়ে!”

“এডপশন?”
“হুমম!এটা আমি ছোট থেকেই জানতাম!যখন মা বাবা আকাশের তারা হয়েছিল তখন মামনিকে বলতাম,’ মা বাবা ছাড়া পরকে কেউ আপন করে নেয় না!’ সেই পরিপ্রেক্ষিতে মামনি একটা সত্যি বলেছিল!”
“কি সত্যি?”

“মামনি আর বাবাই এর কিছু কমপ্লিকেশন ছিল।ফলে মামনি মা হতে পারেনি কোনোদিন!বাবাই এর ফ্যামিলি নতি নাতনির জন্য প্রেসার দিচ্ছিল!তাই বাবাই আয়ানকে দত্তক নেয়!কিন্তু বাবাইয়ের ফ্যামিলির কেউ মেনে নেয়নি!মামনিকে নানা রকম কটু কথা শুনাতো!এক পর্যায়ে তারা বলে হয় মামনি আর আয়ান নয় বাবাই এর ফ্যামিলি যেকোনো একটা বেছে নিতে!মামনি ভেবেই নিয়েছিল বাবাই উনার ফ্যামিলিকে বেছে নিবে! হ্যাঁ!বাবাই ফ্যামিলিকেই বেছে নিয়েছে, তবে সেটা নিজের ছেলে আর স্ত্রীকে!বাবাই বাড়ি ছেড়ে শহরে এসে খেটে খুটে আস্তে আস্তে এই পর্যন্ত আসে!এর মাঝে আয়ানকে একবারও বুঝতে দেয়া হয়নি সে যে তাদের আসল ছেলে নয়! এডপশন এর বিষয় জানার পর আয়ান মামনি আর বাবাই এর কাছে সবটা জানতে চায় বলে ওদের কাছে যেতে নেয়!কিন্তু পথ আটকাই আমি!”

“কোথায় যাচ্ছো?”
“সত্যিটা জানতে!কেনো আমার থেকে এই সত্য লুকানো হলো সেটা জানতে!”
“কারণ তারা চায়না তুমি তাদের পর ভাবো!”
“তুমি সব জানো তাহলে?”
“হ্যাঁ জানি!মামনি বলেছে!”
“আমাকে কেনো বলেনি?”
“কারণ ওরা চায় না তুমি ওদের পালিত মা বাবা ভেবে সম্মান করো!”
আয়ান নিরুত্তর!

“এত বছর তোমার থেকে এই সত্যি লুকিয়েছে এই ভেবে,তুমি যদি জানো তুমি ওদের ছেলে নও,তখন ওদের পর ভেবে কিছু শেয়ার করবে না।বাবা মায়ের মত ভাববে না!”
আয়ান চুপচাপ বসে রইলো!
“প্লিজ আয়ান!ওদের এত বছরের কষ্ট এভাবে নষ্ট করো না!এগুলো ভুলে যাও!”
আয়ান পেপার গুলো ফেলে দিল! ইহরা মুচকি হাসলো!
“মামনি নিচে ডাকছে চলো!”
আয়ানকে নিয়ে নিচে যেতেই নাহার ওদের দুইজনকে পাশে বসালেন!
“ইহরা মা,তোর কাছে একটা প্রশ্ন করবো উত্তর দিবি?”

“কি মামনি?”
“আমার ছেলের বউ হবে?”
ইহরা ওখানেই থমকে গেলো।এক পলক ফাহিনের দিকে তাকালো! ফাহিন নিজেও বিস্মিত!
“কি হলো বলো?”
ইহরা নাহারের দিকে তাকালো!তার হাসি মুখটা দেখে নিজের সব ইচ্ছা বিসর্জন দিয়ে হ্যাঁ বলে দিলো!
“আয়ান তোমার কোনো আপত্তি আছে?”

আয়ান আর কি বলবে!যারা ওকে নিজের সন্তান না হওয়া সত্বেও নিজের সন্তান হিসেবে বড় করেছে।এমনকি ওকে জানতেও দেয় নি ও পালক সন্তান,সেখানে ওদের ইচ্ছে কেনো অবজ্ঞা করবে?তাই সেও সম্মতি দিলো।দুইজনার সম্মতি পেয়ে ঠিক হলো ওদের পড়াশোনা শেষে বিয়ে হবে!

“আয়ান রাজি হলো ওদের ইচ্ছে পূরণ করতে আর আমি হলাম ওদের হাসি মুখটা হাসিতে ভরিয়ে রাখতে!তারপর ওর জীবনে তুমি এলে আর সব ওলোট পালোট হয়ে গেলো।যদি এটা সেই ঘটনার কয়েকদিন পর হতো তাও আয়ান হয়তো ওর মা বাবাকে বোঝাতো!কিন্তু বিয়ে ঠিক হওয়ার এত বছর পর হুট করে ও কিভাবে বলতো?একদিকে ছিলাম আমি!ওর ধারণা ছিল আমায় এই মুহূর্তে না করলে আমার কি হবে?আরেকদিকে ওর মা বাবা!তাই ওর ইচ্ছে থাকলেও না করতে পারেনি ও!”
আয়ুশী নিরুত্তর।
“সব শোনার পরও যদি মনে হয় আয়ান না আটকিয়ে ভুল করেছে,তাহলে তুমি যা করবে তাই মেনে নিবো!”
“গুড নাইট আমার ঘুম পাচ্ছে!”

বলেই কাঁথা মুরো দিয়ে শুয়ে পড়লো। ইহরা হেসে লাইট অফ করে ওর পাশে শুয়ে পড়লো!
সকাল সকাল রান্নাঘরে এসে দাঁড়িয়েছে আয়ুশী। ও জানে এখন নাহার কফি বানাবে আয়ানের জন্য!যখন আয়ুশীকে দেখবে তখন ওকেই বলবে দিয়ে আসতে!যেই ধারণা সেই কাজ!নাহার আয়ুশীকে বললো কফি দিয়ে আসতে! আয়ুশীও খুশি মনে উপরে গেলো।দরজায় বেশ কয়েকবার নক করার পরেও ভিতর থেকে কোনো রেসপন্স আসলো না!রুমের ভিতরে উকি দিতেই দেখলো রুম ফাঁকা!

আয়ান বাথরুমে গেছে ভেবে কফি টেবিলে রেখে ঢেকে রাখলো যাতে ঠাণ্ডা না হয়!একটু ঘুর ঘুর করে অপেক্ষা করলো আয়ানের বের হওয়ার!কিন্তু না ওর কোনো খবর নেই!অবশেষে বেলকনিতে চোখ পড়তেই ,”আল্লাহ গো !” বলে বুকে থু থু দিলো!বুকে হাত গুজে বেলকনির দরজার একটু সাইডে দাড়িয়ে আছে আয়ান!ঠোঁট চেপে হাসি আটকে রেখেছে!আয়ুশী এখানে এসেছে যখন থেকে তখন থেকেই ও ওখানে দাঁড়িয়ে আছে।আয়ুশী কি করে দেখতে!আয়ুশী নিজের ভাবনায় এতটাই বিভোর ছিল যে বাথরুমের দরজা ছাড়া অন্য কোনো দিকে আর তাকায়নি! আয়ান ট্রাউজারের পকেটে হাত গুজে বললো,”মিস ঝামেলা!”

আয়ুশী ঢোক গিলে ,একটু হাসার চেষ্টা করে বললো,”ছোট আম্মু বললো কফি দিয়ে আসতে আরকি!”
“ও আচ্ছা!”
আয়ুশী বের হবার জন্য পা বাড়াতে নিলেই আয়ান বলে উঠলো,”তাহলে তো কফি রেখে চলে যাওয়ার কথা!বাথরুমের দরজায় উকি ঝুঁকি মা’রছিলে কেনো?”
“ও হ্যালো,এত জিজ্ঞাসার কি আছে?দেখছিলাম আপনি কখন বের হন!দেরি হলে তো কফি তো ঠাণ্ডা হয়ে যাবে তাই না?”
“তাই?”

বলেই আয়ুশীর সামনে আসলো ও!
“হ্যাঁ এছাড়া আর কি হবে?”
আয়ান ওর কানের কাছে ঝুঁকে বললো,”আমার খোজ করছিলেন!দেখতে এসেছিলেন আমাকে! এম আই রাইট,মিস ঝা’মেলা?”
আয়ুশী কিছুটা সরে গিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,”বয়েই গেছে আপনাকে দেখতে আসতে!আপনি কোনো সেলিব্রিটি নাকি?ভাগেন!”

অবেলায় ভালোবাসি পর্ব ২৪

“তাই!”
বলেই আরেক পা এগিয়ে আসতে নিলেই আয়ুশী ‘আম্মু ‘ বলে এক দৌড়ে বাইরে চলে গেলো।সেই দেখে আয়ান জোড়ে হেসে দিল!

অবেলায় ভালোবাসি পর্ব ২৬