অবেলায় ভালোবাসি পর্ব ২

অবেলায় ভালোবাসি পর্ব ২
সাবরিন জাহান

হসপিটালের সামনে দাড়িয়ে আছে আয়ুশী,সীমা আর ইভা। ভেবেছিলো ছুটির পর আসবে,কিন্তু আজকে কোনো ক্লাসই ঠিক ভাবে হচ্ছে না।তাই আর না থেকে বেরিয়ে এসেছে।এমনিতেও ছুটি হতে হতে দুপুর !তাই আগে আগেই চলে এসেছে!আসার পথে একটা ছোট্ট ফুলের বুকেট নিয়ে এসেছে!ভিতরে গিয়ে রিসিপশনের মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বলল,

“মিস্টার বেলাল আহমেদ এর কেবিন নং টা বলা যাবে?”
রিসিপশনের মেয়েটি একটু ঘেঁটে বললো,”তিন তলায়, তিনশো চার নাম্বার কেবিন!”
“ধন্যবাদ!”
অতঃপর ওরা চলে গেলো কেবিন ৩০৪ এর উদ্দেশ্যে!
কেবিন তিনশো চারের সামনে এসে দাড়িয়ে রয়েছে ওরা! আয়ুশী দরজায় নক দিয়ে মাথা সামান্য ভিতরে ঢুকিয়ে বললো,”আসতে পারি স্যার?”
বেলাল সাহেব তখন সবে চিন্তা করতে বসেছেন স্টুডেন্টদের নিয়ে!কারোর আওয়াজ শুনে মাথা তুলে তাকালেন!
“আরে আয়ুশী মামনি!এসো এসো!”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ওরা তিনজন ভিতরে আসলো।
“কি ব্যাপার!তোমরা এখানে?ক্লাস তো এখনও শেষ হয়নি!”
সীমা তাড়াতাড়ি বলে উঠলো,”আসলে স্যার,আপনাকে দেখতে আসলাম!কেমন আছেন আরকি!”
এর মাঝেই ইভা বলে উঠলো,”আর আজকে ক্লাস গুলোও ঠিক করে হচ্ছে না,তাই ভাবলাম বাসায় চলে যাই।সামনে পরীক্ষা!”

“সেই সাথে আপনি এ’ক্সি’ডে’ন্ট করেছেন,তাই দেখতে এলাম আরকি!”
বেলাল সাহেব হাসলেন!
ওরা কিছুক্ষণ কথা বলে চলে গেলো! সীমা লিফটের কাছে যেতে নিবে তার আগেই আয়ুশী ওকে টেনে সিঁড়ির কাছে নিয়ে গেলো।
“কিরে তুই লিফটে উঠলি না কেনো আয়ু?”
“মাত্র তিন তলায় আমরা আর তুই এইটুকু পথের জন্য লিফটে উঠবি? তাও এত লম্বা লাইন ঠেলে!হাঁটতে শিখ!দেখ তোর পেট বাড়ছে !”

বলেই নামতে লাগলো নিচে ও!ইভা আগেই নেমে যাচ্ছে!আয়ুশীর লিফটে উঠতে ভালো লাগে না!তখন সীমা আর ইভার জন্য লিফট দিয়ে উপরে এসেছে!তাতেই মাথা কেমন ভন ভন করছে ওর!কিছুক্ষণের জন্য চোখ বুঝলো ও!কিন্তু এর জন্যই ঘটলো আরেক বিপত্তি!চোখ বন্ধ করে নামতে চেষ্টা করায় সিঁড়ির উপরে থাকা কলার খোসায় পা পড়তেই পড়ে যেতে নেয়!নিজেকে সামলানোর জন্য সামনে থাকা ইভাকে ধরতে যায়!কিন্তু ইভা হুট করে এমন হওয়ায় টাল সামলাতে না পেরে পড়ে যায়।আর আয়ুশী পড়ে যেতে নিয়েও কেউ সামনে আসায় তাকে ধরে নিজেকে সামলে নেয়!শেষের দুই সিড়িতে এমন হওয়ায় ইভা ব্যাথা না পেলেও আয়ুশীর পা মচকে গেছে!সীমা এতক্ষণে কি হলো কিছুই বুঝলো না।যখন বুঝলো তখন দৌড়ে আগে ইভাকে উঠালো!

“তুই ঠিক আছিস ইভা?”
ইভা মাথা নেড়ে ড্রেস ঝাড়তে লাগলো।ওদিকে আয়ুশী পায়ের জন্য দাড়াতে পারছে না!এতক্ষণ যে কাউকে ধরে দাড়িয়ে আছে এটা ওর খেয়ালে নেই!
“এক্সকিউজ মি!”
পরিচিত আওয়াজ কানে আসতেই চোখ তুলে তাকালো ও!চোখ গুলো আপনাআপনি ই বড় হয়ে গেলো।
“আপনি?”

আয়ান ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো।আয়ুশী তড়িঘড়ি করে ওকে ছেড়ে দাড়াতে যেতেই আবার পরে যেতে নিলে আয়ান ওর এক হাত টেনে ধরে!
“ই’ডি’য়ে’ট! আস্তে!”
সীমা আর ইভা এসে আয়ুশীকে ধরলো।
সীমা এবার খোঁচা মে’রে বললো,”লিফটে গেলে এসব কিছুই হতো না!”
আয়ুশী চোখ ছোট ছোট করে তাকালো!মানে কি?ওর এই মুমেন্টে এসব ভাবার ইচ্ছে হলো?সীমা আর ইভা ওকে ধরে সিড়ির এক কোণায় বসালো। আয়ান ওদের পাত্তা না দিয়ে উপরে চলে গেলো।

“এই আয়ু,পায়ে কি খুব ব্যাথা করছে?”,চিন্তিত কণ্ঠে বলল ইভা।
“মনে হয় পা ম’চ’কে গেছে,পা রাখতে পারছি না!”
“কে বলেছিল তোকে সিড়ি দিয়ে নামতে?লিফটে গেলে এমন কিছুই হতো না!এই সীমার কথা মাঝে মাঝে শুনা উচিত!”
আয়ুশী মুচকি হেসে সীমাকে বলল,”তোর ওই লিফটে উঠার জন্যই আমার এই অবস্থা!আর একটা কথা বললে এই হসপিটালের তোকে অ্যাডমিট হতে হয় এমন ব্যাবস্থা করে যাবো দেখিস!বক বক না করে আমায় ধরে উঠা! গেট পর্যন্ত যেতে পারলেই রিকশা নিবো!”

সীমা আর ইভার কাঁধে ভর করে উঠে দাড়ালো ও! পায়ে হালকা প্রেসার দিতে ব্যাথায় চোখ মুখ কুচকে এলো ওর!না এভাবে নামতে পারবে না!আবার ওকে বসিয়ে দিলো ওরা!
“আন্টিকে ফোন দিবো?”(ইভা)
“হ্যাঁ,ফোন দে আর এসে আমাকে নেয়ার বদলে হসপিটালে ব’কা’ব’কি শুরু করুক!”(আয়ুশী)
“তাহলে তুই যাবি কিভাবে?”,বলেই সীমা ওর পাশে বসে পড়লো।
হুট করেই কেও গম্ভীর গলায় বললো,”এটা কি আড্ডা দেয়ার জায়গা?”

সীমা আওয়াজ শুনেই তড়িঘড়ি উঠে দাড়ালো!একসাইড এ দাড়িয়ে তাকে যাওয়ার রাস্তা দিল!সাদা অ্যাপ্রন পরিহিত যুবকটি ভ্রু কুঁচকে আয়ুশীর দিকে তাকিয়ে রইলো। তার চোখের ভাষা বুঝতেই ইভা বলে উঠলো,”আসলে ও নামতে গিয়ে পা ম’চ’কে ফেলেছে!তাই দাড়াতে পারছে না!”
যুবকটি এবার নিচে নেমে আয়ুশীর পায়ের দিকে তাকালো।কিছু ভেবে ওর পায়ের কাছে বসলো। পায়ে হাত দিতে যাবে তার আগেই আয়ুশী বললো,”কি করছেন!”

লোকটি অভয় দিয়ে বললো,”আমি একজন ডক্টর।আমায় দেখতে দিন!”
“কিন্তু আমার কাছে তো টাকা নেই!”
লোকটি ভ্রু কুঁচকে তাকালো!
“হোয়াট?”

“আব.. আপনিই তো বললেন,আপনি ডক্টর! ভিজিট ছাড়া কি পেশেন্ট দেখবেন?”
লোকটি কিছু না বলে আবার পায়ে হাত দিল।একটু চাপ দিয়ে বললো,”ব্যাথা করছে?”
আয়ুশী মাথা নাড়লো,চাপ দেয়ায় কোনো প্রকার ব্যাথা হচ্ছে না যতটা দাড়াতে গিয়ে হয়!
“আচ্ছা,এবার আপনাকে বলি!এটা হসপিটাল..তো চিৎকার করে হসপিটালের পরিবেশ নষ্ট করবেন না!”
আয়ুশী ভ্রু কুঁচকে বললো,”মানে..”

আর কিছু না বলেই উনি পা টা উল্টো দিকে মোচড় দিলেন(সাধারণত জানি না ওটাকে কি বলে – লেখিকা)..আয়ুশী চিৎকার দিতে নিবে তার আগেই ইভা দৌড়ে গিয়ে ওর মুখ চেপে ধরে!
“আয়ু বেবি,এটা হসপিটাল!কুল কুল!”
লোকটি একজন নার্সকে বললো ব্যাথার স্প্রে নিয়ে আসতে।কিছুক্ষণ বাদেই নার্সটি এনে দিলো।লোকটি আয়ুশীর পায়ে স্প্রে করে দিলো।পুরোপুরি না কমলেও আগের তুলনায় অনেকটাই কম এখন!লোকটি চলে যেতে নিলেই আয়ুশী বলে উঠলো,”ফী নিবেন না?”

লোকটি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো।
“ফী দিতে চান বুঝি?”
“ফ্রীতে কেউ ডাক্তারি করে নাকি?”
লোকটি বুকে হাত গুঁজে বললো,”বেশ দেও দুই হাজার টাকা!”
আয়ুশীর চোখ বড় বড় হয়ে গেলো!
“দুই হাজার?”

“হুমম!আমার ভিজিট ফী পাঁচশো আর ব্যাথা দুর করার ফী পনেরশো!যান আপনি এক হাজারই দিয়েন!”
আয়ুশী এবার আস্তে করে উঠে দাড়ালো!চোখ ছোট ছোট করে বললো,”যদি না দেই?”
লোকটি মুচকি হেসে বললো,”জে’লে দিয়ে দিবো!”
“এক হাজার টাকার জন্য জেলে দিবেন আমায়?”
“ফী দিতে তো আপনিই চেয়েছেন,তাই না?”

আয়ুশী মাথা চুলকালো!লোকটি আবার মুচকি হেসে বললো,”ডোন্ট ওয়ারি!আমি এমনেই বলেছি!সব সময় টাকার জন্য কাজ করি এমনটা ভাববেন না!মানবতা বলতেও কিছু আছে!”
বলেই চলে গেলো।
আয়ুশী মনে মনেই আওড়ালো,”কি অদ্ভুত পৃথিবী!একই দিনে দুই ভিন্ন মানবের সাথে আলাপ হলো।একজন সামান্য ব্যাপারে মিসবিহেভ করলে!আরেকজন বিনা কারণে সাহায্য করলো!বোঝাই যায় ,পৃথিবীতে সব তো আর এক না!”
এক রাশ চিন্তা ভাবনা নিয়েই আস্তে আস্তে নেমে বাইরে আসলো ওরা!প্রথমে আয়ুশীকে নামিয়ে সীমা ওরা নিজেদের হোস্টেলের দিকে গেলো।

বাবার সাথে বসে টিভি দেখছে আয়ুশী।দেখছে কম ভাবছে বেশি!
“কি হয়েছে মামনি?আজ এত ভাবুক মেয়ে হয়ে বসে আছো যে?”
বাবার কথায় লাফিয়ে উঠলো ও।এখনই কথার ঝুড়ি নিয়ে বসবে টা মোশাররফ সাহেব ভালোই বুঝেছেন!তাই টিভি অফ করে দিলেন!সবার আগে তার মেয়ে…তারপর অন্য কিছু!
“জানো বাবা আজকে না আমি নতুন এক অভিজ্ঞতা নিলাম!”
“কি রকম?”

“পৃথিবীতে সবাই এক রকম হয় না ,এটাই!”
“তা তোমার কি দেখে মনে হলো?”
আয়ুশী বেখায়ালে সব বলে দিলো ওর বাবাকে!
“সব বুঝলাম,কিন্তু মামনি তোমার তো একটা ভুল হয়েছে?”
“আরও মাথায় তুলো ওকে!”,বলতে বলতেই ওদের কাছে এলেন মরিয়ম!
আয়ুশীর এবার নিজের গালে নিজেই মা’র’তে মন চাচ্ছে!বলবে না, বলবে না করেও সব বলে দিলো।এবার শুনো ব’কা!
“আহ..আমি কথা বলছি তো!”

“তুমি চুপ করো!এসব কি আয়ু?এভাবে রাস্তায় এমন করাটা কি তোর ঠিক হয়েছে?”
আয়ুশী নিশ্চুপ!মরিয়ম এবার তার সামনে বসে বললেন,”আমরা তোর বাবা – মা আয়ু!পরিবারের লোক..তোর দুরন্তপনা,দু’ষ্টু’মি,ম’জা, বাচ্চামো!সব আমাদের সামনে করিস,সমস্যা নেই!কিন্তু একটা কথা মাথায় রাখিস!বাইরে সম্পূর্ণ ভিন্ন হতে হবে তোকে!স্ট্রং থাকতে হবে তোকে।

আমাদের সামনে এসব করলে আমরা কিছু ভাববো না,কারণ আমরা জানি তুই কেমন!কিন্তু ভিন্ন লোকের সাথে ,যে তোকে চেনে না ,জানে না তার সাথে এমন করলে নির্ঘাত বে’য়া’দ’ব ভাববে!আর পারিবারিক শিক্ষা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে! মাঝ রাস্তায় তোর কথা অনুযায়ী ছেলেটাকে যেহেতু কোনো দিক থেকেই ফল বিক্রেতা লাগেনি!সেহেতু তাকে এমনটা বলে অপমান করা হয়! ভরা রাস্তায় তুই যেমনটা করলি সেও তেমনটাই ফেরত দিয়েছে!যদিও একটু বেশি কিন্তু তাও…ব্যাপারটা তোকে বুঝতে হবে!”

আয়ুশী মাথা নিচু করে রইলো।
“এখন তোর প্রথম কাজ তাকে আবার কখনো দেখলে সরি বলা!”
“আমি কেনো সরি বলবো?উনিও তো মিসবিহেভ করেছে!”
“দোষটা আগে কার ছিল?”
আয়ুশী নিরুত্তর!

“সরি বললে কেউ ছোট হয় না!আর তুই এমনটা না করলে সেও কিছুই বলতো না!তাই তোমার সরি বলা উচিত!বুঝলে?”
আয়ুশী সম্মতি জানালো!
“আর খবরদার আবার যদি কথা লুকিয়েছিস আমার থেকে!”
এবার মোশাররফ গলা ঝেড়ে বললেন,”ভাষণ শেষ হলে আমরা কি এবার ডিনার করতে পারি মহাশয়া!”

অবেলায় ভালোবাসি পর্ব ১

মরিয়ম বেগম তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো! তাই দেখে বাচ্চাদের মত বলে উঠেন,”খিদা লাগছে তো!”
আয়ুশী ফিক করে হেসে দেয়!মরিয়ম মুচকি হেসে খাবার আনতে যায়!আয়ুশী এবার বুঝতে পারে আসলেই সে যেমন অপমানিত ফিল করছিল উনিও তো করেছে!সরি উনার প্রাপ্য!সারাদিনের কথা ভেবেই আনমনে হাসলো!কি অদ্ভুত ছিল আজকের দিনটা!

অবেলায় ভালোবাসি পর্ব ৩