আবেগময় সম্পর্ক পর্ব ১১

আবেগময় সম্পর্ক পর্ব ১১
লেখিনীতে মৃদু সুপ্রিয়া

মেহুল বাড়ির সবার উদ্দ্যেশ্যে বলে,“আপনারা আর দয়া করে আমার থেকে কিছু লুকাবেন না। এবার সত্যিটা বলুন আমায়। রায়ানের সম্পর্কে আপনারা এত উদাসীন কেন?”
আশিক কিছু বলতে চাইলে আমিনা আক্তার তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে,“আমরা মোটেই উদাসীন নই। ইতিমধ্যে পুলিশকে সবকিছু জানানো হয়েছে। যা করার এবার তারাই করবে। সেখানে আমরা এই বিষয়ে আর কি করব বলো।”

মেহুল বলে, “কিন্তু আপনাদের মধ্যে আমি তো চিন্তার লেশমাত্র দেখতে পাচ্ছি না। নিজের পরিবারের একজন সদস্য নিখোঁজ। অথচ আপনাদের কত স্বাভাবিক লাগছে। এতটা স্বাভাবিক থাকা কি সম্ভব বলুন?”
এমন সময় আকাশ বাড়িতে চলে আসে। আকাশ মেহুলকে বলে, “তাহলে তুমি কি বলতে চাইছ? রায়ান আমাদের কেউ নয়।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মেহুল আকাশের দিকে এক বার তাকায়। তারপর বলে, “হ্যাঁ আমার সেটাই তো মনে হচ্ছে এখন। সত্য মিথ্যা জানি না। সেটা তোমরাই ভালো বলতে পারবে। আমি শুধু এটুকু জানি যে, সবকিছুর পেছনে অনেক বড় কোন রহস্য লুকিয়ে আছে। আর এই সব রহস্যের মূলে রয়েছে অন্তরা। আর অন্তর চৌধুরী তার কথা আর কি বলব। অন্তর চৌধুরী যে কত ভয়ানক সেটা আমি ইতিমধ্যেই জেনে গেছি।”

আকাশ জিজ্ঞাসা করে, “তুমি অন্তর চৌধুরীর ব্যাপারে কি এমন জানো যে তোমাকে তার ভয়ানক মনে হচ্ছে?”
মেহুল তখন গত কয়েকদিনে ঘটা ঘটনাগুলো মনে করে। কয়েক দিন আগেই, অন্তর চৌধুরী মেহুলকে কিছু ছবি পাঠায়। যেখানে অন্তর চৌধুরী ও পিহুর অনেক ঘনিষ্ঠ মুহুর্তের ছবি ছিল। সেগুলো দেখিয়ে অন্তর চৌধুরী মেহুলকে বলে, “আমার সাথে দেখা করো। আমার কথা শুনে চলো। তাহলেই তোমার সব দিক থেকে লাভ হবে। ভুলে যেও না তোমার বাবার থেকে অনেক টাকা পাবো আমি, আর তাছাড়া তোমার বোনও আমার দখলে। আমার কথা না শুনলে লস হবে তোমারই।”

এমন কথা শুনে মেহুল খুব ভয় পেয়ে গেছিল৷ এরপর একদিন অন্তর চৌধুরীর সাথে দেখা করে। অন্তর চৌধুরী একটা সাদা পেপার মেহুলের হাতে দিয়ে বলে, “এখানে আকাশের সই নিয়ে আসবে।”
মেহুল অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেছিল, “এভাবে সাদা পেপারে আমি সই আনতে পারবো না। না জানি কি হবে। আমি করতে পারবো না।”

অন্তর চৌধুরী সেদিন মেহুলকে অনেক হুমকি ধমকি দিয়েছিল কিন্তু মেহুল সেসবে পরোয়া করেনি৷ আজ হয়তো সেসবেরই প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছে।
মেহুল অতীতের কথাগুলো মনে করে সবার সামনে বলে, “অন্তর চৌধুরী ভালো লোক নয়। সেদিন তিনি আমাকে একটা সাদা পেপার দিয়ে সেখানে আকাশের সই করে নিতে বলেছিলেন। আমার মনে হয় তার কোন খারাপ উদ্দ্যেশ্য আছে। এখন তো আমার সন্দেহ হচ্ছে, রায়ানের অপহরণের পেছনেও তার হাত নেই তো।”

আকাশ বলে, “আমার সবকিছু কেমন এলোমেলো লাগছে। অন্তর কোন পেপারে আমার সই নিতে বলবে কেন? আমার তো তেমন কোন সহায় সম্পত্তি নেই। এই বাড়িটাও আম্মুর নামে। আমার আছে বলতে চাকরিটা।”
আমিনা আক্তারের চোখে মুখে বিরক্তির ছাপ ফুটে ওঠে। তিনি বলেন, “এই ভাই বোন আমাদের আর শান্তিতে থাকতে পারলাম না। বোনটা তো আমাদের মান সম্মান সব শেষ করে একটা বোঝা গলায় ঝুলিয়ে দিয়ে চলে গেছে আর আমার বোকা ছেলেটাও সেই বোঝা বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আর এখন ভাইটাও…”

আমিনা আক্তারের পুরো কথা শেষ করার আগেই আকাশ তাকে থামিয়ে দেয়। আকাশ বলে, “যদি থানায় মামলা করা হয়ে গিয়েই থাকে তাহলে এখন আমাদের হাত গুটিয়ে বসে থাকা নিশ্চয়ই উচিৎ না। পুলিশ নিজের কাজ করুক, রায়ান যেহেতু আমাদেরই দায়িত্ব তাই আমাদেরও কিছু করতে হবে। আমি নিজের মতো ওকে খুঁজতে যাচ্ছি।”

আকাশ আর অপেক্ষা করল না। নিজের মতো চলে গেল রায়ানকে খুঁজতে। আকাশ যাওয়ার পর মেহুল আমিনা আক্তারকে জিজ্ঞাসা করেন, “আপনি তখন কি বলতে চাইছিলেন যা সম্পূর্ণ করতে পারেন নি? প্লিজ আমাকে সম্পূর্ণ কথাটা বলে দিন। আমার জানা দরকার।”

আশিক বলে, “ঠিক আছে আমি তোমাকে সবকিছু বলছি ভাব। অন্তরা ভাবিকে ভাইয়া পছন্দ করত। শুধুমাত্র অন্তরা ভাবির জন্য অনেক কষ্ট করে চাকরি যোগাড় করে নেয়। সেইসময় অন্তরা ভাবির বাবা বেঁচে ছিলেন। তারপর ভাবির বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যায়। অন্তরা ভাবির বাবা আমাদের বাবার বন্ধু ছিল৷ আমাদের পরিবার যে কতটা ভালো সেটা তিনি জানতেন, আর তাছাড়া ভাইয়াও যেহেতু চাকরি পেয়ে গিয়েছিল তাই তিনিও রাজি হয়ে যান। এরপর সবার সম্মতি ক্রমে ভাইয়া আর ভাবির বিয়ে হয়ে যায়।

বিয়ের পর সবকিছু স্বাভাবিক ছিল। বিয়ের একমাস পর আমরা জানতে পারি ভাবি প্রেগন্যান্ট। এটা জেনে আমরা সবাই খুব খুশি হই। আমাদের পরিবারে সেই সময় খুশির ঢেউ বয়ে যাচ্ছিল। ভাই আর ভাবিকে দেখে সবাই বলতো এরকম স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক খুব কম জনারই আছে। তাদের মধ্যে কত বেশি ভাব ছিল। আমাদের পরিবারের সবার সাথেও ভাবির অনেক ভালো সম্পর্ক ছিল। অন্তরা ভাবি আমাকে নিজের ভাইয়ের মতোই দেখত আর আমিও ওনাকে নিজের বড় বোনের মতোই সম্মান দিতাম।

আম্মু-আব্বুও অনেক ভালোবাসত ভাবিকে। কিন্তু ঐ যে কথায় আছে না অতি সুখ কপালে সয়না। ভাবির যখন প্রেগ্ন্যাসির আট মাস চলছিল তখন এক দিন কেউ একজন ভাইয়ার কাছে কিছু ছবি পাঠায়। যেখানে ভাবির সাথে অন্য একটা ছেলের ঘনিষ্ঠ মুহুর্তের ছবি ছিল। সেই ছবিগুলো দেখে ভাইয়া জানতে পারে অন্তরা ভাবির সাথে আকাশ ভাইয়ার বিয়ের আগে অন্তরা ভাবি অন্য একটা ছেলের সাথে সম্পর্কে ছিল।

এটা নিয়ে ভাইয়া ও ভাবির মধ্যে ঝামেলার সূত্রপাত হয়। ভাইয়া প্রথমবারের মতো ভাবির গায়ে হাত তোলে। ঝামেলার এক পর্যায়ে আকাশ ভাইয়া অন্তরা ভাবিকে বলে, “ তোমার উপর এখন কেন জানি আমার সন্দেহ হচ্ছে। সত্যি করে বলো, তোমার গর্ভে যে সন্তান বেড়ে উঠছে সেটা আমার কিনা। নাকি এটা অন্যকারো সন্তান। ভাবি সেদিন বলে ছিল, হ্যাঁ এটা তোমার বাচ্চা নয়।”

মেহুল হতবাক হয়ে বলে, “তার মানে রায়ান আকাশের সন্তান নয়?”
আমিনা আক্তার বলেন, “হ্যাঁ, জানো তুমি, ঐ মেয়ের জন্য আমার সোনার সংসারে কত অশান্তি নেমে এসেছিল। সুখ, শান্তির অস্তিত্ব ছিল না। এভাবে সময় যায়। সন্তান জন্ম দিয়ে দুই মাস পর ঐ অন্তরা তার প্রেমিকের সাথে পালিয়ে যায়। যাওয়ার আগে আকাশকে একটি চিঠি লিখে দিয়ে যায়।

যেখানে লেখা ছিল, “আমি আমার প্রেমিকের কাছে ফিরে যাচ্ছি। সে আমায় বলেছে, যদি তার কাছে ফিরে যাই তাহলে সে আবার সব ভুলে আমার সাথে সম্পর্ক শুরু করবে। কিন্তু সে বলেছে যে এই সন্তানের দায়িত্ব সে নিতে পারবে না। তাই আমি এই বাচ্চাটাকে তোমার হেফাজতে রেখে গেলাম। যদি পারো ওকে দেখে রেখ নাহলে ওকে চাইলে অনাথ আশ্রমেও রেখে আসতে পারো।”

এসব কথা শুনে মেহুলের মনে অন্তরার জন্য ঘৃণা জন্ম নেয়। একটা মা কত নিচু হলে এমন কথা বলতে পারে। আমিনা আক্তার বলেন, “জানো আমার ছেলেটা খুব বোকা আর ভালো মানুষ। তাই তো এতকিছুর পরেও সে ঐ অন্তরার ছেলেটাকে নিজের বাচ্চার মতো মানুষ করেছে।

আবেগময় সম্পর্ক পর্ব ১০

ভেবে দেখ ছেলেটা আমার কত কষ্টে ছিল৷ আমার ছেলের এই অবস্থা দেখে আমার স্বামীও একদিন স্টোক করেন। যার ফলে তার মৃত্যু হয়। এর কিছুদিন পর অন্তরার বাবাও একটা এক্সিডেন্টে মারা যান।”
মেহুল সব গুলো ঘটনার বর্ণনা শোনে। সব শুনে তার কাছে স্পষ্ট হয় রায়ানকে নিয়ে সবাই এত উদাসীন কেন।

আবেগময় সম্পর্ক পর্ব ১২