আমার অবেলায় তুমি পর্ব ৩

আমার অবেলায় তুমি পর্ব ৩
সানজিদা বিনতে সফি(সাথী)

আধঘন্টার মধ্যেই বেপারী বাড়ি পুলিশে ঘিরে ধরেছে। এসপি এসে মাহতাবকে সালাম দিয়ে বিস্তারিত জানতে চাইলো। মাহতাব গম্ভীর মুখে জয়নাল বেপারীর দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলল,
— এ বাড়ির উপস্থিত প্রত্যেক টা মানুষ কে আমি থানায় দেখতে চাই এসপি সাহেব। এরা আমার স্ত্রীর গায়ে হাত তুলেছে। তাকে শারীরিক মানুষিক ভাবে নির্যা*তন করেছে। একজনকেও ছাড়বেন না।
এসপি সাহেব জয়নাল বেপারীর দিকে তাকিয়ে কর্কশ গলায় বলল,

— আপনার কিছু বলার আছে? স্যারের ওয়াইফের গায়ে কে হাত তুলেছে?
জয়নাল বেপারী ভয়ে কাচুমাচু হয়ে গেলো। ছেলেদের দিকে তাকিয়ে আলেয়া বেগমের দিকে নজর দিলো। সবাই ভয়ার্ত চোখে তার দিকেই তাকিয়ে। কেচো খুড়তে না আবার কেউটে বেরিয়ে আসে!
জয়নাল বেপারী সমস্ত দোষ স্বিকার করলেন। আড় চোখে ছেলেদের দিকে তাকিয়ে মিনমিনে গলায় বলল,
— আমিই মেরেছি স্যার। আমাদের বাসায় কাজ করতো। কাল আমার স্ত্রীর স্বর্নের কানের দুল চুরি করেছিল।তাই রাগের বসে গায়ে হাত তুলে ফেলেছি।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

— আপনি সিগারেট খান?
মাহতাবের কথায় থতমত খেয়ে গেল জয়নাল বেপারী। আমতা আমতা করে বলল,
— না মানে,আমি খাই না।
— আমি যতদূর জানি মধুরিমা আলেয়া বেগমের নিজের মেয়ে। আর আপনার সৎ মেয়ে। সে আপনার বাড়ির কাজের মেয়ে হয় কি করে? আর যদি কানের দুল চুরি হয়েও থাকে তবুও আইন হাতে তুলে নেয়ার কোন রাইট নেই আপনার। এসপি সাহেব,আমি এদের সবার নামে এটেম টু মার্ডা*রের মামলা করবো। বাকিটা আমার স্ত্রী সুস্থ হলে জবানবন্দি দিবে। আশা করি আপনি সামলে নিবেন।

— অবশ্যই অবশ্যই স্যার। চিন্তা করবেন না।সব কয়টা কে থার্ড ডিগ্রি দিলেই সত্যি টা বেড়িয়ে আসবে।
মাহতাব মধুর রুমে গিয়ে ময়না বেগম আর কুলসুম বেগম কে বাড়ি চলে যেতে বললো। লামিয়া,মেহরাব আর সে মধুকে নিয়ে হসপিটাল যাবে। এম্বুল্যান্স চলে এসেছে। তাই এখনই তাদের বেড়িয়ে পরতে বলে অচেতন মধুকে কোলে নিয়ে গটগট করে বেড়িয়ে গেল।
ময়না বেগম আহাজারি করে বলল,

— দেখলে মা দেখলে! তোমার ছেলে গিরগিটির মতো রঙ পালটে ফেললো! মেয়েটাকে এভাবে নিয়ে গেল কেন? আমরা তো বাসায় গিয়ে স্বস্তিতে থাকতে পারবো না। এই হারাম*জাদা তুই দাঁড়িয়ে আছিস কেন? আমাদের ও নিয়ে চল। আমি কিন্তু বাসায় যাবো না বলে দিলাম।
মেহরাব আড় চোখে লামিয়ার দিকে তাকালো। লামিয়া ঠোঁট কামড়ে হাসি আটকানোর চেষ্টা করছে। ময়না বেগম কথা শেষ করেই ছুটেছে মাহতাবের পিছনে। মেহরাব মায়ের হাত ধরে সাবধানে তাকে নিয়ে বের হলো। লামিয়া শ্বাশুড়ির পিছনে পিছনে আসছে।
— আপনি বাসায় চলে যান আম্মা। হাসপাতালে গিয়ে আপনার ভালো লাগবে না। অসুস্থ হয়ে পরবেন। আমরা ভাবিকে নিয়ে তারাতাড়ি ফিরে আসবো।

কুলসুম বেগম মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো। তাকে মাহতাবের গাড়িতে তুলে দিয়ে ড্রাইভারকে সাবধানে গাড়ি চালাতে বলে মেহরাব এম্বুল্যান্সে উঠে গেল। লামিয়া আর ময়না বেগম মেহরাবের গাড়িতে করে আসছে।
জয়নাল বেপারী আলেয়া সহ তার দুই ছেলে জয় আর সামির কে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে৷
মাহতাবদের হাসপাতালে পৌঁছাতে প্রায় একঘন্টা লেগে গেল। মধুর একবার জ্ঞান ফিরলেও বেশিক্ষণ তা স্থায়ী হয়নি। মেহরাব একটু পর পর চেক করে যাচ্ছে। হসপিটালে পৌছেই মধুর ট্রিটমেন্ট শুরু হয়ে গেলো। সিনিয়র ডাক্তার ড.কানিজ ফাতেমা মধুর ট্রিটমেন্ট করছে।

চেকআপ শেষে কেবিন থেকে বেরিয়ে মাহতাবের কাছে এসে আফসোসের গলায় বলল,
— মেয়েটাকে প্রচুর মা*রধর করেছে স্যার। সারা গায়ে কালসিটে দাগ পরে গেছে। কিছু নতুন আর কিছু পুরনো৷ পেসেন্ট প্রচন্ড অপুষ্টিতে ভুগছে। ঠিকভাবে খেতে দিতো না হয়তো। এভাবে কোন সমস্যা নেই। তবে আমার যতদূর মনে হচ্ছে মেয়েটা ট্রমাটাইজ হয়ে গেছে। তাকে খুব যত্নে রাখতে হবে।
— বুঝতে পেরেছি। ধন্যবাদ ডক্টর।
— আসছি স্যার।
— হুম।

মধুকে ঘুমের ইঞ্জেকশন দেয়া হয়েছে।দুই দিন এখানেই থাকতে হবে।
লামিয়া আর ময়না বেগম পৌছালো আরো বিশ মিনিট পরে। জ্যামে আটকা পরে তাদের দেড়ি হয়ে গেছে। মধুকে দেখেই ময়না বেগম আফসোস করে বলল,
— আহারে!কি পাষাণ মানুষ এরা! আজ আমরা যদি না যেতাম তাহলে মেয়েটাকে এভাবেই ফেলে রাখতো। আল্লাহ সহায়।
মাহতাব চুপ করে বসে আছে। রাত আটটা বাজতে চললো। মেহরাব কে ময়ানা বেগম আর লামিয়া কে নিয়ে বাসায় চলে যেতে বলল মাহতাব। হসপিটালে ভীড় করে লাভ নেই। আর কুলসুম বেগম ও বাড়িতে একা আছে।
ময়না বেগম গাট হয়ে বসে রইলেন। সুনা*মি এলেও সে এখান থেকে নড়বে না। মেহরাব হাজার বুঝিয়ে ও তাকে টলাতে পারলো না। মাহতাব শান্ত গলায় বলল,

— অসুস্থ হয়ে যাবে আপা। বাসায় গিয়ে বিশ্রাম নাও। সকালে এসো।
মাহতাবের বলতে দেড়ি হলো ময়না বেগমের সুয়ে পরতে দেড়ি হলো না। কেবিনের এক্সট্রা বেডে টানটান হয়ে ঘুমের প্রস্তুতি নিয়ে কাত হয়ে সুয়ে পরলেন। মেহরাব দুই দিকে মাথা নাড়াতে নাড়াতে লামিয়াকে নিয়ে চলে গেলো। মাহতাব থানায় কথা বলে আবার চুপ করে বসে রইলো। রিসিপশনে কল করে খোজ নিলো আর কোন কেবিন খালি আছে কিনা। ময়না বেগম এসির পাওয়ার কম হলে ঘুমাতে পারে না।
রিসিপশন থেকে জানালো কেবিন এবেইলেবল আছে।

— ঠিক আছে। কোন ইমারজেন্সি রোগী আসলে জানাবেন।কেবিন লাগলে আমরা সাথে সাথেই ছেড়ে দিবো।
— ওকে স্যার।
ময়না বেগমের চোখে পানি চলে এলো। তার ভাই এখনো তাদের সব দিকে নজর রাখে। তাদের একটু কষ্টও মাহতাব সহ্য করতে পারেনা। তার ভাইটাকে আল্লাহ এবার সুখি করুক।
— আপা,,ঘুমিয়ে গিয়েছো? কষ্ট করে একটু উঠে পাশের কেবিনে চলো। এখানে তুমি ঘুমাতে পারবে না।
মাহতাবের শান্ত গলা শুনে আস্তে করে উঠে বসলো ময়না বেগম। ভাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে তার হাত ধরে ধীর পায়ে পাশের কেবিনে চলে গেলো।

— দরকার হলে ডাকবি কিন্তু।
— আচ্ছা ঘুমাও।
মাহতাব ময়না বেগম কে রেখে মধুর কেবিনে চলে এলো। মেয়েটা শান্ত ভাবে ঘুমিয়ে আছে। স্নিগ্ধ মুখটায় কয়েক জায়গা নীল হয়ে আছে। মাহতাব চোখ সরিয়ে নিলো। শার্টের হাতা গুটিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো ফ্রেশ হতে। শরীর ক্লান্তিতে আর চলতে চাইছে না।
বেশ বেলা করে ঘুম ভাঙ্গলো মধুরিমার। পাশেই মাহতাব পেপার পড়ছে।
— শরীর ঠিক আছে?
মাহতাবের গম্ভীর গলায় ভরকে গেলো মধু।মিনমিনে গলায় বলল,
— জি।

— ফ্রেশ হয়ে ব্রেকফাস্ট করে মেডেসিন নিও। নার্স এসে সাহায্য করবে। আমার একটা জরুরি মিটিং আছে। হুট করে বিয়ে হওয়ায় সময় বের করতে পারিনি। আমি অফিসে যাচ্ছি। বড় আপা পাশের কেবিনে আছে৷ ঘুমাচ্ছে হয়তো। লুবানা আর মেহরাব ও চলে আসবে কিছুক্ষণ পর। কোন অসুবিধা হলে তাদের বলবে। ঠিক আছে?
মধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। মাহতাব এখনো শান্ত চোখে তাকিয়ে আছে। সোফা থেকে উঠে মধুর সামনে গিয়ে দাড়ালো। মাথায় হাত রেখে আস্তে করে বলল,

— একা ভয় করবে?
মধুরিমা চমকে তাকালো মাহতাবের দিকে। তাকে কেউ কখনো এই প্রশ্নটা করেনি। লোকটা এতো আদুরে স্বরে কথা বললে সে তো কেদেই ফেলবে।
— আমি বড় আপা কে ডেকে দিচ্ছি। নার্স ও থাকবে সারাক্ষণ। একদম ভয় পাবেনা। আমি কাজ শেষ করেই চলে আসবো। কাল বাসায় যেতে পারবে। হুম?
মধু মাথা নিচু করে ফেলল। তার মন হালকা লাগছে। ধীর গলায় বলল,

আমার অবেলায় তুমি পর্ব ২

— আপা কে ডাকতে হবে না। আমি ভয় পাবো না। আপনি নিশ্চিন্তে কাজ সেরে আসুন।
মাহতাব হাসলো। কেবিনে নার্স কে ডেকে দ্রুত বেরিয়ে গেল। সকালে ময়না বেগম কে দেখে এসেছে। কালকের দৌড়ঝাপে ক্লান্ত ছিল তাই একটু বেশি ঘুমাচ্ছে। অলরেডি দেড়ি হয়ে গেছে। জ্যামে না পরলেই হয়।

আমার অবেলায় তুমি পর্ব ৪