যেদিন তুমি এসেছিলে সারপ্রাইজ ২

যেদিন তুমি এসেছিলে সারপ্রাইজ ২
মুন্নি আক্তার প্রিয়া

আকাশে কালো রঙের মেঘের ভেলা এদিক-সেদিক ছুটে বেড়াচ্ছে। কোত্থাও যেন শুভ্র মেঘের ছিটেফোঁটাও নেই, এমনটিই বোধ হচ্ছে অর্ষার। জানালার গ্রিলে গাল ঠেকিয়ে ভারী মন নিয়ে সে আকাশের এরূপ পরিবর্তন লক্ষ্য করছিল। কালো মেঘের মতোই অন্ধকারে তার মনটা ছেঁয়ে আছে। আকাশ থেকে বৃষ্টি পড়া আর চোখ থেকে পানি পড়া; এইটুকুরই অপেক্ষা যেন এখন! আকাশের মেঘের কারণ অর্ষার জানা নেই।

তবে তার মন খারাপের অবিচ্ছেদ্য কারণ হলো আহনাফ। আজকাল তার চতুর্দিকে এত মানুষজন, এত প্রিয় মানুষ ও শুভাকাঙ্ক্ষী থাকা সত্ত্বেও তার সকল আনন্দ, সুখ-দুঃখ কেবল মাত্র আহনাফকে ঘিরেই। এরকম হওয়ার কারণ কী অর্ষা সেটা জানে না। শুধু এতটুকুই সে জানে, দিনকে দিন সময়ের গতির সাথে পাল্লা দিয়ে তার ভালোবাসাও বেড়ে চলেছে। অপর পাশের মানুষটি কি একটুও বুঝে না? এতটা অবুঝ তো সে নয়!

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আহনাফ সুইজারল্যান্ড চলে গিয়েছে দুই মাসেরও বেশি হবে। অফিসের কাজের ব্যস্ততা কমেছে, কাজও কম তাই আহনাফ জানিয়েছিল এই মাসেই সে বাংলাদেশে ফিরবে। আর অর্ষাকে নিয়ে এক সঙ্গেই সুইজারল্যান্ড ব্যাক করবে। কিন্তু কিছুক্ষণ আগেই আহনাফ ফোন করে জানাল, নতুন কাজ আসায় সে এই মাসে বাংলাদেশে আসতে পারবে না। পরের মাসের প্রথমদিকেই অর্ষার ফ্লাইট। আহনাফ আসতে পারবে না শুনে রাগে, দুঃখে, ক্ষোভে সে আহনাফকে বলেছে,
‘আপনার তাহলে আর আসার দরকারও নেই। আমি একাই চলে যেতে পারব।’

আহনাফ আদুরেকণ্ঠে বলেছিল,’আহা! রাগ করছ কেন বলো তো? তুমি সুইজারল্যান্ড আসার পর আমি এয়ারপোর্ট থেকে তোমায় রিসিভ করে বাড়িতে নিয়ে আসব।’
‘নিকুচি করেছি আপনার এয়ারপোর্টে আসার! পাসপোর্ট, ভিসা করতে অনেকগুলো টাকা খরচ হয়েছে বলেই আমি সুইজারল্যান্ডে আপনার কাছে যাব। নতুবা যে কথা দিয়ে কথা রাখে না, তার কাছে আমি কক্ষনো যেতাম না।’
আহনাফ হেসে ফেলে। মুচকি হেসে জবাব দেয়,’তাও ভালো আমার কাছে আসার কথা বললে। আমি তো ভেবেছিলাম, তুমি বোধ হয় পড়াশোনা করার জন্যই এখানে আসবে।’

এ কথা শোনার পর অর্ষা তেলে-বেগুনে আরো জ্বলে ওঠে। এই কথা আহনাফ কী করে বলতে পারল? শুধুমাত্র পড়াশোনা করার জন্য সে সুইজারল্যান্ড যেতে চায়? আহনাফের প্রতি যে তার এত ভালোবাসা এগুলো সে দেখে না? অনুভব করে না? ক্ষোভে এবার সে কথা বলার ভাষা-ই হারিয়ে ফেলেছে। কোনো রকমে দাঁতে দাঁত চেপে ‘আপনি একটা পাষাণ, নিষ্ঠুর লোক।’ বলেই ফোন কেটে দিয়েছে অর্ষা। এরপর বারংবার আহনাফ কল করা সত্ত্বেও সে কোনো প্রকার রেসপন্স করেনি। এখন মন খারাপ করে তাই জানালার কাছে বসে আছে।

বৃষ্টি পড়া আরম্ভ হয়েছে। মুষলধারায় বৃষ্টি হচ্ছিল। অর্ষা অন্যমনস্কভাবে জানালা দিয়ে নিচে তাকাতেই দেখতে পায় আশিক আর দিদার বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে বাড়ির মেইন গেইট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করছে। অথচ দুজনের হাতেই কিন্তু ছাতা রয়েছে। সাথে ছাতা থাকা সত্ত্বেও গাধা দুটো যে কোন সুখে বৃষ্টিতে ভিজছে অর্ষা সেটা কিছুতেই বুঝতে পারছে না। তার ভাবনার প্রহরের অন্তিম সময়ের পূর্বেই ওরা দুজন রুমের ব্যালকোনির সামনে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে অর্ষার নাম ধরে ডাকছিল। অর্ষা ছুটে যায় ব্যালকোনিতে। ওপর থেকে চেঁচিয়ে বলে,

‘হয়েছে কী?’
বৃষ্টির জন্য ওপরে ঠিকমতো তাকাতে পারছিল না ওরা। আশিক কপালে হাত রেখে বৃষ্টি থেকে চোখ দুটোকে আড়াল করে বলল,
‘জলদি আহিলকে নিয়ে নিচে নাম।’
‘নিচে নামব মানে কী? বৃষ্টি হচ্ছে তো।’
দিদার পকেট থেকে চকোলেট বের করে মুখে পুরল। বিরক্তিকর চাহনী মেলে বলল,
‘তাতে কী হয়েছে? খেয়ে ফেলবে তোকে? আমাদের খেয়ে নিয়েছে?’

‘ফালতু না বকে ভেতরে আয় তোরা। শুধু শুধু বৃষ্টিতে ভিজছিস কেন? তাও আবার হাতে ছাতা নিয়ে।’
‘খুশিতে। খুশির ঠ্যালায় ভিজতেছি।’ বলল আশিক।
অর্ষা বুঝল এ দুটোর কাছ থেকে সহজ উত্তর প্রত্যাশা করা ভুল। দিদার রাজশাহী চলে গেছিল রেশমির বিয়ের প্রায় পনেরো দিন পরেই। আবার ঢাকায় এসেছে এক সপ্তাহ্ হবে। কিছুতেই তার মন ওখানে টেকে না। সে এবার অর্ষাকে নরমস্বরে বলল,

‘ওহে অর্ষা রানি, নিচে এসে কি ফেলবেন আপনার পদধ্বনি?’
সঙ্গে সঙ্গে আশিক দিদারের মাথায় গাট্টা মেরে বলল,
‘কবিতা বলার ক্যারেক্টার আমি। তুই বলতেছিস কেন? তুই শুধু খাবি।’
দিদার আঘাত করা মাথায় হাত বুলিয়ে মিনমিন করে বলে,’তাই তো!’
ওদের কাণ্ড দেখে অর্ষা হেসেই খু’ন। কোনো রকম হাসি থামিয়ে বলল,’দাঁড়া তোরা। আমি আহিলকে নিয়ে আসছি।’
আহিলের রুমে গিয়ে দেখতে পায় কাঁথা-বালিশ মুড়ি দিয়ে আহিল আরামসে ঘুমাচ্ছে। এই আরাম অবশ্য বেশিক্ষণ টিকেনি। অর্ষা তাকে টেনেটুনে ঘুম থেকে তুলে বাইরে নিয়ে এসেছে। আহিলের ঘুমের রেশ তখনো কাটেনি। শরীরে বৃষ্টির পানি পড়তেই সে আঁৎকে উঠে বলে,

‘অর্ষা! পাগল হলি নাকি? বৃষ্টিতে ভেজার জন্য আমায় নিয়ে এসেছিস? এসব রোমান্টিসিজম আমার সাথে চলবে না। খবরদার! একদম আমাকে দেবর ভেবে ট্রিট করবি না বলে দিচ্ছি। বৃষ্টিবিলাস করতে ইচ্ছে করলে সুইজারল্যান্ড গিয়ে ভাইয়ার সাথে কর।’
আহিলের কথা শেষ হতে দেরি, পিঠে দুমদাম কিল দিতে এক সেকেণ্ড সময়ও নষ্ট করেনি অর্ষা। কিল দেওয়া শেষ হলে আহিলের কান মুচড়ে দিয়ে বলল,

‘আমার কি আর খেয়ে-দেয়ে কাজ নেই? ভালো করে চোখ মেলে দেখ।’
আশিক আর দিদার লনে ছিল। ওরা লন থেকে ধীরপায়ে আহিল আর অর্ষার দিকে এগিয়ে আসছে।
‘ওরে শালা! তোরা এখানে কী করছিস?’ অবাক হয়ে বলল আহিল।
আশিক দাঁত কেলিয়ে হেসে বলে,’আমরা তো তোমার শালা নই বন্ধু! তবে হ্যাঁ, এখন তোমার শালার বাসাতেই যাচ্ছি আমরা।’

আহিল কিছু বুঝতে না পেরে বোকা বোকা দৃষ্টিতে অর্ষার দিকে তাকায়। অর্ষা নিজেও কিছু বুঝতে পারছিল না। তাই সেও ঠোঁট উল্টিয়ে আহিলের দিকে দৃষ্টিপাত করল।
দিদার তখন বুঝিয়ে দিয়ে বলল,’আরে রেশমির বাসায় যাচ্ছি সবাই।’
‘কোন দুঃখে? তাও এই অসময়ে বৃষ্টির মধ্যে।’ বলল অর্ষা।

উত্তরে আশিক বলল,’দুঃখে না হোক সুখে যাব। আজকে সবাই বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে লেকে ঘুরব রিকশায় করে। অফারটা রেশমি করেছে। আমাদের পছন্দ হয়েছে তাই বেরিয়ে পড়েছি। তোদেরকে নিয়ে এখন লামিয়া আর জুঁইকে পিক করব। তারপর রেশমির শ্বশুরবাড়ি থেকে ও’কে নিয়ে সবাই লেকে যাব। আজকের দিনটা শুধু আমাদের বন্ধুদের।’

বন্ধুরা সবাই মিলে বৃষ্টিবিলাস করবে, এই প্রস্তাব তো কখনো অগ্রহণযোগ্য হতেই পারে না। আজ কেউই সাথে ফোন নেয়নি। বৃষ্টির মধ্যে অযথা ফোন নিয়ে কেউ মুশকিলে পড়তে চায় না। দারোয়ানকে খবরটা জানিয়ে দিয়ে আহিল, অর্ষা ওদের সঙ্গে বেরিয়ে পড়ে। দুটো রিকশা নিয়ে আগে যায় লামিয়া আর জুঁইদের এপার্টমেন্টে। ওদেরকে আগেই সব বলে রেখেছিল। তাই ওরা যাওয়া মাত্রই লামিয়া আর জুঁইকে নিয়ে রেশমির শ্বশুরবাড়িতে যাওয়ার জন্য বের হয়। এরপর একসঙ্গে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে যায় লেকে। একসঙ্গে সকলের কণ্ঠে গানে গানে মুখরিত হয়ে ওঠে আড্ডার আসর। সবাই পাশাপাশি বসে আছে। ওদেরকে দেখে কিছু পথশিশুও এগিয়ে আসে। মূলত ওরা ফুলের মালা বিক্রি করছিল। সবগুলো ফুল ওরা কিনে নেয়। একটা বেলী ফুলের মালা অর্ষা খোঁপায় গুঁজে নেয়। এই সুন্দর সময়টিতে মনে মনে সে আহনাফকে ভীষণ মিস করছিল।

আড্ডার ফাঁকে দিদার একটু উদাসীন হয়েই বলে,’জানিস কখনো ভাবিনি, আলাদা হয়েও আমরা সবাই আগের মতো এক হতে পারব। অর্ষার বিয়েটা তো হুট করেই হয়ে গেল। আহিল ছিল বলেই অর্ষাকে নিয়ে অত ভাবিনি। কিন্তু যখন লামিয়া আর জুঁইয়ের বিয়ে হয়ে গেল, রেশমির বিয়েও হয়ে গেল তখন ধরেই নিয়েছিলাম আমাদের বন্ধুত্বের ইতি সম্ভবত খুব শীঘ্রই ঘটতে চলেছে। কেননা বিয়ের পর একটা মেয়ের লাইফ তো আর পাঁচ, দশটা অবিবাহিত মেয়ের মতো চলে না। চাইলেই তখন ওরা যখন তখন বাড়ি থেকে বের হতে পারে না। অনেক ফ্যামিলি ছেলে বন্ধু এলাউ-ও করে না। এদিক থেকে আমাদের তিন মেয়ে বান্ধবীই অনেক ভাগ্যবতী এটা আমাদের মানতেই হবে। যেমন স্বামী পেয়েছে, তেমনই পেয়েছে শ্বশুরবাড়ি।’

দিদারের এমন আবেগপ্রবণ কথার স্রোতে সকলে ইমোশোনাল হয়ে পড়ে। বৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে কয়েক ফোটা অশ্রুও নির্গত হয়ে বৃষ্টির পানিতে মিলে যায়। খুব শক্ত করে একে অপরের হাত ধরে কিছুক্ষণ বসে থাকে। আশিকের উলটা-পালটা কবিতা শুনে সকলে হাসতে হাসতে প্রায় লুটিয়ে পড়ে। এদিকে হাসতে গিয়ে নাকি পেটুক দিদারের প্রচণ্ড খিদেও পেয়ে যায়। সকলে একসঙ্গে আইসক্রিম, ফুসকা খায়। বৃষ্টিতে খুব বেশি ভিজলে জ্বর আসার সম্ভাবনা রয়েছে বলে অন্যদিনের তুলনায় আজ আড্ডার সময়টা সকলেই কম করে নিয়েছে। খাওয়া শেষে খুব একটা সময় আর বৃষ্টিতে ভিজেনি। সকলে আলাদা রিকশা নিয়ে ওখান থেকে নিজেদের বাড়ি চলে যায়।

আহিল একটু পরপর-ই হাঁচি দিচ্ছিল। ওর চোখ-মুখ এখনই লাল হয়ে গেছে। অর্ষা আ’ত’ঙ্কিত হয়ে বলে,
‘জ্বর আসবে মনে হয় তোর!’
‘কিছু হবে না। বাসায় গিয়ে মেডিসিন খেয়ে নেব।’ কথা বলতে বলতেই তিনটা হাঁচি একসাথে দিয়ে ফেলেছে আহিল।
‘তোদের দুই ভাইয়েরই বৃষ্টিতে ভিজলে সাথে সাথে জ্বর এসে যায় নাকি?’
‘আমার জ্বর তেমন আসে না। ঠাণ্ডা লাগে বেশি।’
‘আম্মু বকবে দেখিস।’

আহিল হেসে বলে,’বকুক। আমরা কানে না নিলেই হবে।’
এ কথাতে অর্ষাও হেসে ফেলে। বাড়িতে পৌঁছে দুজনে ভয়ে ভয়ে দরজায় নক করে। রেণু আপা দরজা খুলে কিছু বলতে যাবে তার আগেই দ্রুত দুজনে হাত নেড়ে বলে,
‘চুপ! চুপ! কাউকে ডেকো না। কিছু বোলো না।’
‘আমি তো…’

অর্ষা রেণুকে থামিয়ে দিয়ে বলল,’তোমার কথা পরে শুনব রেণু আপা। আগে কাপড় পাল্টিয়ে নিই।’
কথাগুলো বলেই আহিল আর অর্ষা দৌঁড়ে ভেতরে চলে যায়। ভেজা পা টাইলসে রাখায় কয়েকবার পিছলে পড়তে যেয়েও দুজনে সামলে নেয় আবার। রেণু আপা হেসে ফেলে এই দৃশ্য দেখে।

রুমে গিয়ে দেখে কারেন্ট নেই। অর্ষা দরজা লাগিয়ে ভেজা ওড়নাটা খুলে ওয়াশরুমে রাখতে যাবে তখন হাতে টান পড়ে। উষ্ণ স্পর্শে ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে অর্ষা। এমনিতেই সে ভূত-প্রেতে ভীষণ ভয় পায়। তার ওপর আবার কারেন্ট নেই, বৃষ্টি হচ্ছে। ষোলো কলা পূর্ণ একেবারে! ভীতসন্ত্রস্ত দৃষ্টিতে সে সামনে তাকাতেই দেখতে পায় আহনাফকে। ততক্ষণে সে আহনাফের বাহুবন্ধনে আবদ্ধ। ঠিক দেখছে নাকি ভুল দেখছে বুঝে ওঠার আগেই আহনাফ অর্ষাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। উষ্ণানুভে অর্ষার শরীর আরো শীতল হয়ে পড়ে। হৃদস্পন্দন দ্রুত চলছে।

নিঃশ্বাস হয়ে উঠছে ভারী। আনন্দে সে পুলকিত হয়ে ওঠে। মানুষটা হুটহাট এভাবে কী করে সারপ্রাইজ দিতে পারে? কেন জানিনা, খুশিতে অর্ষার চোখে পানি এসে পড়ে। ভেজা ওড়নাটি ফ্লোরে ফেলে দিয়ে দু’হাতে সে আহনাফকে জড়িয়ে ধরে। গভীর আবেশে কাঁধে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে অনুভব করে আহনাফের গায়ে মিশে থাকা মিষ্টি ঘ্রাণটি। অন্যদিকে অর্ষার খোঁপায় মুক্তর মতো বৃষ্টিভেজা বেলী ফুলের সুবাসে আহনাফ মাতোয়ারা। সে যখন দিশেহারা হয়ে অর্ষার চুলের বাঁধন খুলে ফেলছিল অর্ষা তখন কাঁপান্বিত কণ্ঠে বলে,

‘আপনি ভীষণ খারাপ!’
আহনাফ অর্ষার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে,’তাই? এতটুকুতেই আমি খারাপ হয়ে গেলাম?’
অর্ষার শরীর শিউরে ওঠে। সে থমকে যায়। ঠোঁট কাঁপছে অনবরত। তবুও সে নিচুস্বরে বলে,
‘এজন্য বলিনি হুহ! আপনি আসতে পারবেন না বলেও এসেছেন। এভাবে সারপ্রাইজ দেন ঠিক আছে। কিন্তু যখন বলেছিলেন আসবেন না, জানেন কত কষ্ট পেয়েছিলাম আমি?’
অর্ষার মুখটা এবার আহনাফ তার দু’হাতের মাঝে ধরে বলে,’তবে চলে যাই?’
অর্ষা সঙ্গে সঙ্গে জড়িয়ে ধরে বলে,’না! ম’রে যাব।’

আহনাফ তখন আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,’আমায় ছেড়ে যেতে দিলে তো।’
অর্ষা তৃপ্তির হাসি হাসে। কিছুক্ষণ কেউই কোনো কথা বলল না। এরপর অর্ষা নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে বলল,
‘হয়েছে। এখন ছাড়ুন। আপনি তো নিজেও ভিজে যাচ্ছেন।’
‘না, হয়নি। এখনো তো কিছুই করলাম না।’ বলে অর্ষার ঠোঁটে আঙুল দিয়ে স্পর্শ করতেই দরজায় কড়া নাড়ে আমেনা বেগম।

সঙ্গে সঙ্গে দুজন দু’দিকে ছিটকে পড়ে। অর্ষা তড়িঘড়ি করে ওয়াশরুমে ঢুকে যায়। আহনাফ নিজেকে সামলে নিয়ে দরজা খুলে দিলো। আমেনা বেগম রণমূর্তি ধারণ করে ভেতরে প্রবেশ করতে করতে বলেন,
‘কই? কই? অর্ষা কই? কোথায় গেল? আজ ওর কপালেও মাইর আছে। বৃষ্টিতে ভিজেপুড়ে নাকি বাসায় ফিরেছে। জ্বর আসলে তখন কী হবে? কোথায় গেল রে?’
আহনাফ চুপচাপ পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। অর্ষাকে না পেয়ে আমেনা বেগম আহনাফের দিকে তাকান। তারা স্বামী-স্ত্রী দুজনেই শুধু ছেলের দেশে ফেরার কথা জানতেন। আহনাফ আর কাউকে জানাতে বারণ করেছিল বলে তারাও কাউকে জানায়নি।
আমেনা বেগম পূর্ণদৃষ্টিতে আহনাফের দিকে তাকিয়ে বলেন,’কীরে? তোর শার্ট ভেজা কেন? আর তুই ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?’

আহনাফ দীর্ঘশ্বাস নিয়ে ফুলের মালাটি আমেনা বেগমের হাতে দিয়ে বলে,’আমার না হওয়া অপ্রেমিকা এখন আমার বউ। আর ফুলটাও তার-ই। আর কিছু বলতে পারব না।’
আমেনা বেগম কিছুই বুঝতে না পেরে ছেলের চলে যাওয়ার পথে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন। পরক্ষণে মুচকি হেসে বললেন,’পাগল ছেলে!’
এরপর তিনি ওয়াশরুম থেকে পানির শব্দ পেয়ে নক করে বলেন,’আজকে তুই শুধু একবার বের হ। লাঠি নিয়ে অপেক্ষা করছি আমি।’
দরজা না খুলেই অর্ষা কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে,’আর হবে না আম্মু! স্যরি।’
‘ওসব স্যরি-ফ্যরি আমি শুনব না। তোকে আর আহিলকে কান ধরে আজ দাঁড় করিয়ে রাখব। গোসল সেরে ড্রয়িংরুমে আসবি।’

ড্রয়িংরুমে অপরাধীর মতো মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রয়েছে অর্ষা এবং আহিল। দুজনের ভাবভঙ্গিই কাচুমুচু অবস্থা। আহিলের হাঁচি এখনো বন্ধ হয়নি। সামনের সোফায় মাঝখানে বসে আছেন আমেনা বেগম। তার দু’পাশে বসেছে আহনাফ এবং জহির চৌধুরী।
আমেনা বেগম রাগান্বিত কণ্ঠে বলেন,’কান ধর দুজনেই।’

আহিল একটু বাচ্চাদের মতো করেই বলল,’কী বলো এসব মা? এখন কি আর আমরা বাচ্চা আছি?’
‘খুব বড়ো হয়ে গেছিস বুঝি? তোদের নাটক দেখার সময় নেই এখন আমার। জলদি কান ধর।’
অর্ষা আড়দৃষ্টিতে একবার আহনাফকে দেখে নেয়। স্বামীর সামনে নাকি কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। এরচেয়ে লজ্জাকর ঘটনা আর কী হতে পারে এই মুহূর্তে। জহির চৌধুরীর বোধ হয় একটু মায়া হলো। তিনি মেঘমন্দ্র কণ্ঠে বললেন,
‘আহা! বাচ্চা দুটো না হয় একটু ভুল করেই ফেলেছে। তাই বলে এভাবে শাস্তি দেবে? এবারের মতো মাফ করে দাও।’
এতক্ষণ আহনাফ সাফাই গাইতে ভয় পেলেও এবার বাবার কারণে সে নিজেও মনে মনে সাহস পায়। বাবার সুরে সুর মিলিয়ে বলে,

‘হ্যাঁ, মা। এবারের মতো মাফ করে দাও।’
আমেনা বেগম এবার বক্রদৃষ্টিতে তাকান ছেলে এবং স্বামীর দিকে। চিবিয়ে চিবিয়ে দুজনের উদ্দেশ্যে বললেন,
‘বেশি সাফাই গাইলে তোদের বাপ-ছেলে দুজনকেও কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখব।’
এরকম অপ্রীতিকর লজ্জাজনক পরিস্থিতি থেকে চারজন নিরীহ মানুষকে বাঁচাতে যেন আফরিনের উদয় হলো। আহনাফ আজ এসেছে শুনেই সে সাথে সাথে তার স্বামীকে নিয়ে রওনা দিয়েছে। রেণু উল্লাসিত কণ্ঠে চেঁচিয়ে বলে,
‘খালাম্মা! দেহেন আফায় আইছে।’

আমেনা বেগম উঠে এগিয়ে গেলেন। আর যাই হোক, মেয়ে-জামাইয়ের সামনে তো আর ছেলে, ছেলের বউকে শাস্তি দেওয়া যায় না। তাই এই যাত্রায় ওরা বেঁচে গেল। আফরিন দৌঁড়ে এসে আগে আহনাফকে জড়িয়ে ধরে। আদুরেকণ্ঠে বলে,
‘আমার জন্য চকোলেট এনেছ তো?’
আহনাফ হেসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,’এনেছি।’
আফরিন এবার আহিলকে দেখে কিছুটা আঁৎকেই ওঠে। গালে হাত রেখে বলে,’কী হয়েছে?’
সঙ্গে সঙ্গে হাঁচি দেয় আহিল। নাক টেনে বলে,
‘ঠাণ্ডা লেগেছে।’

আফরিন অর্ষার দিকে একবার দৃষ্টিপাত করে বলল,’তোরা বৃষ্টিতে ভিজেছিস?’
ভয়ে ভয়ে মাথা নাড়ল অর্ষা। আফরিন অসহায়কণ্ঠে বলল,’জানিস কতদিন আমি বৃষ্টিতে ভিজি না। বিয়ের আগে তো মা একদম বৃষ্টিতে ভিজতে দিতো না। অথচ তোদেরকে কিছুই বলে না।’
আহিল বিড়বিড় করে বলে,’বলে নাকি না বলে সেসব পরে বলবনে!’

সবাই খাওয়া-দাওয়া শেষ করে গল্প করছিল। আহিল আর অর্ষার দু’চোখে ঘুম জড়ো হয়ে আসছিল তখন। এদিকে আহনাফও জার্নি করে এসে ক্লান্ত। ছেলে-মেয়েদের মুখ দেখেই আমেনা বেগম সব বুঝতে পারেন। তাই সবাইকে সবার রুমে পাঠিয়ে দেন রেস্ট নেওয়ার জন্য। আহনাফ অবশ্য যায়নি এখনো। অর্ষা পারমিশন পাওয়া মাত্রই রুমে গিয়ে শুয়ে পড়েছে। কিছুক্ষণ বাদে আমেনা বেগম রুমে গিয়ে অর্ষার শরীরের তাপমাত্রা মাপে। জ্বর এসে পড়েছে। সে চটজলদি অর্ষাকে ওষুধ খাইয়ে দিয়ে আহিলকেও ওষুধ খাইয়ে দিয়ে আসে। দুজনকে একটু বকাঝকা করেছেন বলে এখন তার নিজের কাছেই খারাপ লাগছে।

আফরিনদের সাথে কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে আহনাফ রুমে আসে। অর্ষা তখন গভীর নিদ্রায় বিভোর। সে পাশে বসে অর্ষার ভেজা চুলে হাত বুলিয়ে দেয়। আলতো করে কপালে চুমু খায়। শরীর বেশ গরম। কেন যে মেয়েটা এমন দলবেঁধে বৃষ্টিতে ভিজতে গেল! আজকাল সে অর্ষাকে একদম বকতে পারে না। চোখ রাঙিয়ে একটা ধমকও পর্যন্ত দিতে পারে না। ঐ মলিন, বিষন্ন মুখটার দিকে তাকালেই তার সম্পূর্ণ পৃথিবী যেন স্থির হয়ে যায়। থমকে যায় তার সময়গুলো। জাগতিক কোনো কিছুই তখন আর তাকে স্পর্শ করতে পারে না।

রাগ, ক্ষোভ শব্দগুলো তার স্মৃতি থেকে মুছে যায়। কেউ কি কখনো এভাবেও প্রেমে পড়তে পারে? এতটাও মুগ্ধ, আবদ্ধ, ভালোবাসায় পাগল হয় কেউ? আহনাফের এরকম পাগলাটে ভালোবাসার কথা সম্পর্কে কতটুকুই বা অবগত অর্ষা? খুব বেশি হলে সে ষাট পার্সেন্ট অর্ষার সামনে প্রকাশ করে। বাকি চল্লিশ পার্সেন্ট ভালোবাসা সে নিরবে রাখে। আড়ালে ভালোবাসে। ভালোবাসা অদ্ভূত সব কাণ্ডকারখানা করায় যা ভালোবাসায় বা আটকে থাকা ব্যক্তিটিও বোধ হয় কখনো আঁচ করতে পারে না। নির্নিমেষ দৃষ্টিতে অর্ষাকে দেখতে দেখতেই পাশে ঘুমিয়ে পড়ে আহনাফ। তার বুকে ছোট্ট বিড়ালছানার মতো আশ্রয় গ্রহণ করেছে অর্ষা। তার সকল নিশ্চিন্ত চিন্তাভাবনা, নিরাপত্তার স্থান কেবল মাত্র তো এই মানুষটি, তার প্রশস্থ বুক এবং ভরসার কাঁধ।

সন্ধ্যায় অর্ষার আগে আহনাফের ঘুম ভাঙে। ওষুধের ডোজের জন্যই অর্ষার ঘুম এত গাঢ় হয়েছে। আজান দিচ্ছে বলে আহনাফ জোর করেই অর্ষাকে তুলে দেয়। আমেনা বেগম এসে জেনে গেছে জ্বর কমেছে কিনা। যতই বকাঝকা করুক না কেন, তার সকল চিন্তা তো ওদেরকে ঘিরেই। অর্ষা যখন ওয়াশরুমে ছিল তখন রেণু নাস্তা আর সাথে অন্য একটি সারপ্রাইজ নিয়ে আসে; যেটা আহনাফ সুদূর সুইজারল্যান্ড থেকে এনে রেণুর ঘরে লুকিয়ে রেখেছিল।

ফ্রেশ হয়ে রুমে এসে সে বিছানায় বসে। তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে হুট করে তার দৃষ্টি পড়ে ঘরের সিঙ্গেল সোফাটির ওপর। তুলতুলে একটা আদুরে বিড়াল যেন ঘাপটি মেরে সেখানে বসে আছে। একটিবার শুধু অর্ষার দিকে তাকিয়েছিল। বিড়ালের চোখেমুখে একরাশ অভিমান। অর্ষা বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকায় আহনাফের দিকে। আহনাফ মুচকি হেসে বলে,
‘ক্যাথিওন!’

এক লাফে অর্ষা সোফার সামনে গিয়ে হাঁটু মুড়ে বসে। ক্যাথিওনের দিকে সে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। কতদিন পর সে ও’কে দেখছে! অন্যদিকে ক্যাথিওন ফিরেও তাকাচ্ছে না। সে উলটোদিকে মুখ করে বসে আছে। অর্ষা কিছুটা সাহস করে গায়ে হাত রাখতে গেলে ক্যাথি লাফ দিয়ে বিছানায় চলে যায়। অর্ষা আহত দৃষ্টিতে আহনাফের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘ও এমন করছে কেন?’
‘হয়তো রাগ করেছে।’
‘রাগ করেছে? কিন্তু কেন? আমি তো কিছু করিনি।’
সে ক্যাথিওনের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে,’তুই রাগের কী বুঝিস রে? আর কেন-ই বা তুই আমার ওপর রাগ করবি? আমি কী করেছি?’

উত্তরে আহনাফ বলল,’অনেকদিন দেখা করো না হয়তো এজন্য।’
‘তো এখানে কি আমার দোষ? আপনার দোষ সম্পূর্ণ। আপনি আমাকে একা রেখে গেছেন কেন?’
‘যাহ্ বাব্বাহ্! এখন সব দোষ আমার হয়ে গেল।’
‘হু, আপনারই। ওকে নিয়ে আমার কোলে দিন।’
‘তুমি ভয় পাবে না?’

‘আপনি আছেন তো সাথে। পাশে বসে থাকবেন।’
আহনাফ হাসল। ক্যাথিওনকে কোলে নিলো তো ঠিকই তবে অর্ষার কাছে কিছুতেই দিতে পারল না। ওর নড়াচড়াতে অর্ষা ভয় পেয়ে বলে,

‘থাক, থাক! জোর করিয়েন না। পরে যদি আবার খামচি দেয়।’
ক্যাথিওনকে আহনাফই কোলে রাখল। অর্ষা আলতো করে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,’আমি তোদেরকে অনেক মিস করি।’
একটু থেমে আহনাফকে জিজ্ঞেস করল,’অ্যানিওনকে আনেননি কেন?’
‘একসঙ্গে দুজনকে কী করে আনতাম? ও’কে আনতেই যা ঝামেলা পোহাতে হয়েছে!’
‘অ্যানি তাহলে কার কাছে?’

‘হানির কাছে।’
অর্ষা আর কিছু না বলে চুপচাপ ক্যাথিওনের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। চা এরমধ্যে ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। তাই সে চায়ের কাপগুলো নিয়ে রান্নাঘরে চলে যায়। আফরিন ড্রয়িংরুমে বসে টিভি দেখছিল। পেছন থেকে সে বলে,
‘ওমা! ক্যাথি দেখি তোমার পিছু পিছু ঘুরছে।’
অর্ষা পিছু ফিরে অভিমানি ক্যাথিওনকে দেখে হেসে ফেলে।

ভোরের কুসুম রাঙা সূর্য উদিত হওয়ার মুহূর্তটুকু সুনিপুণ দৃষ্টিতে উপভোগ করছে রাত জাগা নিশাচর দুজন মানব-মানবী। অর্ষা রয়েছে আহনাফের বাহুবন্ধনে আবদ্ধ। একটুখানি সময়ের জন্যও যেন সে অর্ষাকে ছাড়তে নারাজ। পারলে সে সারাজীবন এভাবেই তাকে বুকের মাঝে যেন আগলে রাখে।
‘অর্ষা?’
আহনাফের মেঘমন্দ্র কণ্ঠে নিজের নাম শুনে একটুখানি চমকাল অর্ষা। মৃদুস্বরে প্রত্যুত্তর করল,
‘হু?’
আহনাফ অর্ষার গালে গাল ঘষে বলল,’কিছু না।’
অর্ষা হেসে ওঠে। কিছুক্ষণ দুজনে নিরব ভূমিকা পালন করে ঘুমাতে চলে যায়।

সকাল আটটা নাগাদ আহিল ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নিয়েছে। ঠাণ্ডায় এখনো তার ঘুমের রেশ কাটেনি। কিন্তু সকালকে সে কথা দিয়েছিল আজ স্কুলে নিয়ে যাবে। কথা যখন দিয়েছে তখন কথা তো অবশ্যই রাখতে হবে। পরনের টি-শার্ট বদলে নিয়ে গায়ে কালো রঙের একটা শার্ট পরে সবার অগোচরে বেরিয়ে গেছে। নতুবা এমন অসুস্থ অবস্থায় কোনো মতেই বাড়ির বাইরে কেউ যেতে দেবে না। বিশেষ করে আমেনা বেগম!

বাইক চালানোর মতো শক্তিটুকু সে শরীরে পাচ্ছিল না বলে রিকশা নিয়েছে। সকাল তার বাড়ি থেকে একটু দূরে গলির মোড়ে অপেক্ষা করছিল। দূর থেকে আহিলকে দেখামাত্র ঠোঁটের কোণে স্ফীত হাসি ফুটে ওঠে। সেই সঙ্গে একটু একটু করে উদ্বিগ্নতাও বাড়তে থাকে, যতটুকু করে আহিলের মুখ দৃশ্যমান হচ্ছিল। সকালের সামনে এসে রিকশা থামে। আহিল সরে বসতেই সকালও উঠে পড়ে।

রিকশাওয়ালার উদ্দেশ্যে আহিল মোটা ভারী স্বরে বলল,’মামা যান।’
উৎকণ্ঠার সহিত পূর্ণদৃষ্টি মেলে সকাল আহিলের মলিন মুখের দিকে তাকাল। তার বুকটা হুহু করে ওঠে। অমন সুন্দর মুখটিতে সে এই প্রথম যেন একটু কষ্টের ছাপ দেখল। আর এতটুকুতেই সকালের মনে হতে লাগল, পুরো পৃথিবীটা তার থমকে গিয়েছে। আহিল ভ্রুঁ কুঞ্চন করে সকালের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
‘কী?’

তৎক্ষণাৎ সকাল কোনো কথা বলতে পারল না। তার কণ্ঠস্বর যেন রোধ হয়ে গেছে। মনে হচ্ছিল কান্নারা দলা বেঁধে গলার মাঝে আটকে রয়েছে। এমনটা কেন হচ্ছে? আহিলের ঐ ক্লেশমিশ্রিত চেহারা দেখে? তাই বলে এভাবে কষ্ট হবে তার! কেন হয় এমন? তার বয়স কম, আবেগ বেশি এজন্য? নাকি ভালোবাসার মানুষটির কষ্টে প্রতিটা মানুষেরই সমপরিমাণ কষ্ট হয়। হতে পারে, সেই কষ্টটা প্রিয় মানুষটিকে বোঝানো যায় না। ব্যস এইটুকুই শুধু তফাৎ।

সকাল চোখে আজ কাজল দিয়েছে। সচরাচর সে হালকা লিপস্টিক ব্যতীত অন্য কোনো প্রসাধনী প্রত্যহ ব্যবহার করে না। তবে আজ কাজলে তাকে পরিপূর্ণ মায়াবিনী নারী বলে মনে হচ্ছিল আহিলের কাছে। হালকা সাজে কাজল দিলে মেয়েদের বুঝি এতটা মায়াবী লাগে? এরা কি মায়াবিদ্যা জানে? প্রশ্ন জাগলেও উত্তর নেই আহিলের কাছে। সে শুধু নিষ্পলক কয়েক সেকেণ্ড সকালের ঐ আরক্ত চক্ষুদ্বয়ের দিকে তাকিয়ে রইল। সময়ের ব্যবধানে আঁখিদ্বয়ে জড়ো হয়েছে নোনাজল। সকালের শিশিরের মতোই যেন ফোঁটায় ফোঁটায় গড়িয়ে পড়বে এক্ষুণী।

আহিল সকালের গাল আলতো করে ছুঁয়ে বলল,’কী হয়েছে?’
ব্যস, এইটুকু সময়েরই যেন অপেক্ষা ছিল। চোখ থেকে গড়িয়ে পানি পড়া মাত্র আহিলও অস্থির হয়ে পড়ে। সংকুচিত হয়ে পড়ে সকাল। সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলে,
‘কিছু হয়নি।’
‘কিছু হয়নি তবে কাঁদছ কেন?’

‘আপনার শরীর এত গরম কেন? জ্বর এসেছে?’
‘হ্যাঁ। ভেবেছিলাম শুধু ঠাণ্ডা লাগবে। সকালে দেখছি জ্বরও চলে এসেছে।’
‘অসুস্থ শরীর নিয়ে কেন আসলেন আপনি?’
‘তোমাকে দেখার লোভ সামলাতে পারিনি তাই।’
‘সবসময় এমন উলটা-পালটা কথা বলবেন না। কাল রাতে কি এজন্যই ফোনে কথা বলেননি? কেন জানাননি, আপনি যে অসুস্থ?’

‘তুমি রাগ করছ কেন?’
‘রাগ করছি না আমি।’
‘তেমন সিরিয়াস কিছু হয়নি। মেডিসিন নিলেই ঠিক হয়ে যাবে।’
সকাল বিস্মিত নয়নে তাকিয়ে জানতে চাইল,’আপনি এখনো মেডিসিন নেননি?’
আহিল অপরাধীর মতো তাকিয়ে দীর্ঘনিশ্বাস নিয়ে বলল,’সকালে তো না খেয়েই বেরিয়ে পড়েছি।’
সকাল আহিলকে আর কিছুই বলল না। রিকশাওয়ালাকে বলল,’মামা, কোনো ফার্মেসীর সামনে রিকশা থামিয়েন তো।’
‘আরে তোমার দেরি হয়ে যাবে তো।’ বলল আহিল।

সকাল শক্তকণ্ঠে বলল,’হবে না। সময় আছে এখনো অনেক।’
আহিল ঐ রণমূর্তি ধারণ করা মেয়েটির দিকে তাকিয়ে হাসল মৃদু। ওর এই হাসিটুকু দৃষ্টি এড়াল না সকালের। সে থমথমে কণ্ঠে জানতে চাইল,
‘হাসির কিছু বলেছি আমি?’
আহিল মুচকি হেসে দু’দিকে মাথা নাড়াল। এক হাতে সকালের কাঁধ জড়িয়ে কপালে চুমু খেয়ে বলল,
‘ভালোবাসি।’

রুহুল গতকাল থেকে বারবার ফোন করে বলে দিয়েছে আহনাফকে নিয়ে যেন ঐ বাড়িতে যায়। দশটা নাগাদ আহনাফ ঘুম থেকে উঠেছে। রেডি হয়ে দুজনে ক্যাথিওনকে নিয়ে অর্ষাদের বাড়ি যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়। আমেনা বেগম অর্ষাকে কাছে টেনে এক হাতে জড়িয়ে ধরে বললেন,
‘বেশিদিন কিন্তু থাকা চলবে না। কালকের মধ্যে চলে আসবি।’
‘আসব না। তুমি শুধু বকো।’ কথাটা বলে মুখ ঘুরিয়ে মিটিমিটি হাসছে অর্ষা।

আমেনা বেগম কিছুটা বিচলিত হয়ে বললেন,’শুধু বকি ওটাই দেখিস। ভালোবাসি যে সেটা দেখিস না?’
আহনাফ গাড়ি বের করে হর্ণ বাজিয়ে অর্ষাকে ডাকছে। অর্ষা আমেনা বেগমকে জড়িয়ে ধরে হেসে বলে,
‘বুঝি আর জানিও। এবং আমিও যে তোমাকে কতটা ভালোবাসি তা তুমি জানো না। আসছি আমি।’
আমেনা বেগম আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠে। আফরিন অর্ষার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,’তাড়াতাড়ি চলে এসো কিন্তু।’
‘তোমাকে কত করে বললাম আমাদের সাথে যেতে। তুমি তো কথাই শুনলে না! চলো না যাই?’

আফরিন মৃদু হেসে বলল,’মায়ের কাছ ছাড়তে ইচ্ছে করছে না ময়না। আমি অপেক্ষা করব। জলদি চলে আসবে।’
আহনাফ বারবার তাড়া দিচ্ছিল। তাই কথা আর বেশি বাড়ল না। অর্ষা চলে যায় বিদায় নিয়ে। আহনাফের পাশে বসে কাঁধে মাথা রাখে অর্ষা। ক্যাথিওন আহনাফের কোলের ওপর চুপটি করে বসে আছে। অর্ষার প্রতি অভিমান তার এখনো কাটেনি। সারাটা পথ ভালো গেলেও বিপত্তি বাঁধল অর্ষাদের বাড়ির সামনে গিয়ে। গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির দিকে দৃষ্টি পড়তে প্রথমেই কেয়াকে দেখতে পেল অর্ষা।

অতি আনন্দ ও উত্তেজনায় তড়িঘড়ি করে রাস্তা পার হতে গিয়ে অপর পাশ থেকে আসা একটা সাইকেলের সাথে ধাক্কা লেগে মাটিতে পড়ে যায়। সাইকেল তার পায়ের ওপর দিয়ে উঠে সামনে গিয়ে পড়েছে। আহনাফ সাইডে গাড়ি পার্ক করছিল। চোখের পলকে এমন দৃশ্য ঘটে যাওয়ায় সে থমকে যায়। দৌঁড়ে গাড়ি থেকে বেরিয়ে এগিয়ে যায় অর্ষার কাছে। রাস্তায় থাকা লোকজন তার আগেই এগিয়ে এসেছে। কেয়া আর কুসুমও চলে এসেছে ততক্ষণে। ব্যথায় জর্জরিত অর্ষা নিরবে কেঁদে চলেছে। আহনাফ ও’কে পাঁজাকোলা করে গাড়িতে নিয়ে বসিয়েছে আর বাইরের লোকদের বলেছে ঐ আহত ছেলেটিকেও যেন গাড়িতে তুলে দেয়। দুজনকে নিয়ে বাড়ির সামনে থাকা বাজারের হাসপাতালে নিয়ে যায় আহনাফ। কুসুমের থেকে খবর পেয়ে রুহুলও ছুটে গেছে হাসপাতালে।

শক্ত আবরণে আটকে থাকা আহনাফ যেন ভঙ্গুরের ন্যায় বেঁকিয়ে যাচ্ছে। তার বুকের পাঁজরে অসহনীয় ব্যথা হচ্ছে। অর্ষার কান্না, কষ্ট এগুলোর কোনোটাই সহ্য হচ্ছে না। ডাক্তার এসে ড্রেসিং করে পা ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে। হাতের অনেকখানি ছিলেও গিয়েছে। আহনাফ আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। এক্ষুণী কেঁদে ফেলবে কিনা! সে কান্না আর লুকাতে না পেরে বাইরে চলে যায়। ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে আহত ঐ ছেলেটিরও খবর নিয়ে আসে। ওর হাতে অনেকটা কেটে গেছে। বয়স বেশি নয় ছেলেটির। ষোলো কি সতেরো বছরের মতোন হবে। আহনাফকে দেখেই ভয়ে ভয়ে ছেলেটি বলল,

‘আমি ইচ্ছে করে কিছু করিনি ভাইয়া। বুঝতে পারিনি এমন কিছু হবে।’
আহনাফ ছেলেটির মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,’তুমি ভয় পেও না। কিছু হয়নি।’
‘আপু ঠিক আছে?’
‘আলহামদুলিল্লাহ্‌, পায়ে লেগেছে বেশি। তুমি এখন কেমন বোধ করছ?’
‘ভালো।’
‘বাসায় জানিয়েছ?’

‘না, ভাইয়া। শুধু শুধু মা চিন্তা করবে। তাছাড়া আমি এখন চলে যাব।’
আহনাফ ওয়ালেট থেকে কিছু টাকা বের করে জোর করেই ছেলেটির হাতে তুলে দিলো। আপাতদৃষ্টিতে ছেলেটির তো আর কোনো দোষ ছিল না! ছেলেটিকে বিদায় দিয়ে আহনাফ অর্ষার কেবিনে যায়। সেখানে সুদর্শন একজন ডাক্তারও ছিল। আহনাফকে দেখামাত্র সে হেসে বলল,
‘হেই! আপনিই মিস্টার আহনাফ?’

আহনাফ অর্ষার দিকে একবার তাকিয়ে ডাক্তারকে বলল,’জি। ওর অবস্থা এখন কী রকম?’
‘ঠিক হয়ে যাবে শীঘ্রই। চিন্তা করবেন না।’
এরপর সে নিজের পরিচয় দিয়ে জানাল তার নাম রিদিদ। রুহুলের স্কুল ফ্রেন্ড ছিল। সময়ের ব্যবধানে রিদিদ আজ ডাক্তার হলেও; দারিদ্রতার কবলে পড়ে রুহুলের পড়াশোনা বেশিদূর অব্দি গড়ায়নি। সবটা শুনে আহনাফ বিশেষ পুলকিত অনুভব করল না। বরঞ্চ অর্ষার প্রতি রিদিদের অতিরিক্ত কেয়ার এবং কথার ফুলঝুরি দেখে হিংসায় জ্বলে যাচ্ছিল সে। অর্ষার মুখটা ব্যথাতুর ছিল। তবে রিদিদের সাথে আলাপচারীতার পর অনেকটা সহজ ও স্বাভাবিক হয়ে গেছে।

তার মুখটাও এখন হাস্যোজ্জ্বল। অন্য সময়ে এমনটা হলে আহনাফের চেয়ে বেশি খুশি কেউ হতো না। কিন্তু এখন সময়, পরিস্থিতি দুটোই ভিন্ন। অর্ষার হাসির কারণ সে ব্যতীত অন্য কোনো পুরুষ; এটাই তাকে বারংবার ভেতর থেকে আঘাত করছিল এবং পীড়া দিচ্ছিল। বুকের ভেতর অসহ্য রকম জ্বলন অনুভব করছিল সে। দাঁতে দাঁত চেপে অনেকক্ষণ যাবৎ সহ্য করার চেষ্টা করলেও এবার তার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। সে না পারছিল অর্ষাকে রিদিদের সাথে একা রেখে কেবিন থেকে বের হতে, আর না পারছিল নিরবে দুজনের কথাবার্তা শুনতে। সে এতক্ষণ অব্দি দাঁড়িয়ে ছিল। এবার সে একটা টুলে বসে ফোনে মনোযোগ দেওয়ার বৃথা চেষ্টা করল। বৃথা চেষ্টা বলছি এ কারণেই যে, তার সমস্ত মনোযোগ ছিল অর্ষা এবং রিদিদের দিকে। সেই সময়ে রুহুলের আগমন ঘটে।

রিদিদ রুহুলকে দেখে এক গাল হেসে বলল,’আজকাল তো তোর দেখাই পাওয়া যায় না। অন্তত অর্ষার জন্য হলেও তোর সাথে আজ দেখা হলো।’
রুহুল সংকুচিত হয়ে বলল,’এখন কি আর তোর সাথে আমার মেলামেশা চলে?’
‘বাজে বকিস না তো! চল ক্যান্টিনে যাই।’
একটু থেমে সে আহনাফের উদ্দেশ্যে বলল,’আপনিও চলুন একসাথে কফি খেয়ে আসি।’
আহনাফ ভদ্রতার সঙ্গে সুন্দর করে হেসে বলল,’অন্য এক সময়। আমি বরং অর্ষার কাছে থাকি।’
রিদিদও মুচকি হাসি দিয়ে রুহুলকে নিয়ে চলে যায়। আহনাফ সেভাবেই চুপ করে বসে রইল।

‘এসি-টা একটু ছেড়ে দেবেন?’ বলল আহনাফ
নিরুত্তর আহনাফ এসি ছেড়ে আবার সেভাবেই বসে রইল। অর্ষা কিছু বুঝতে না পারলেও রোষানলে ফেটে পড়া আহনাফের চোখ-মুখ দেখে আন্দাজ করতে পেরেছে যে, সে এখন ভীষণ রেগে আছে।
‘একটু এদিকে আসবেন?’ ভয়ে ভয়ে বলল অর্ষা।
আহনাফ চোখ তুলে তাকাল। থমথমে কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,’কিছু লাগবে?’
‘হ্যাঁ।’

আহনাফ উঠে কাছে গেল,’কী লাগবে?’
‘আপনাকে লাগবে।’
আহনাফ কোনো রকম প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে আবার চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই অর্ষা পেছন থেকে হাত টেনে ধরে।
‘কী সমস্যা?’ জানতে চাইল আহনাফ।
‘আপনি রাগ করে আছেন কেন? আমি বুঝতে পারিনি এক্সিডেন্ট হয়ে যাবে।’
‘তুমি অনেক কিছুই বুঝতে পারো না। আমি রাগ করিনি।’
‘তাহলে অমন মুখ ঘুরিয়ে চলে যাচ্ছেন কেন?’
আহনাফ কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। চলেও যেতে পারল না। এগিয়ে গিয়ে অর্ষার মাথাটা বুকে শক্ত করে চেপে ধরল শুধু। হঠাৎ করে এমন করাতে অর্ষা কিছুটা হকচকিয়ে যায়।
রুহুল আর রিদিদ তখনই চলে আসায় কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে দুজনে। ওরা চলেই যাবে আহনাফ তখন রুহুলকে ডেকে বলল,

‘আসুন ভাইয়া।’
রুহুল ফিরে এসে বিচলিত কণ্ঠে বলল,’তাহলে এবার বাসায় চলো।’
‘ঠিক আছে।’
রিদিদ নার্সকে ডেকে হুইল চেয়ার আনতে বললে আহনাফ বাধা দিয়ে বলল,
‘লাগবে না।’
রুহুল এবং রিদিদ দুজনেই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। আহনাফ তার কথা শেষ হওয়া মাত্র অর্ষাকে কোলে তুলে নিলো। ভাইয়ের সামনে তখন অর্ষা কিছুটা লজ্জা পেলেও মনে মনে ভীষণ খুশিও হয়েছে। রুহুল ও রিদিদ পিছু পিছু যাচ্ছিল। গাড়ি অব্দি রিদিদ গিয়ে অর্ষাকে বলল,

‘নিজের যত্ন নিও আর ঠিকমতো মেডিসিন নিও।’
অর্ষা প্রত্যুত্তরে হাসলেও আহনাফের কাছে এত কেয়ার সহ্য হচ্ছিল না। তার কাছে এসব খুব বেশিই বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছিল। রুহুলের বাসায় পৌঁছেও আহনাফ অপ্রসন্ন মুখ করে বসে ছিল। কোনো খাবারই ঠিকমতো খাচ্ছিল না। কেয়াও বিষয়টা লক্ষ্য করে। তবে অর্ষাকে যে কিছু জিজ্ঞেস করবে সেই সুযোগটাও পাচ্ছিল না। ওদেরকে রেস্ট করতে গিয়ে সবাই চলে যাওয়ার পর আহনাফ অর্ষাকে বলল,
‘এখন একটু ঘুমাও।’

‘ঘুম আসছে না এখন।’
‘কেন? ডাক্তার কি ঘুমাতে বারণ করেছে?’ আহনাফ আর নিজের রাগ সংবরণ করে রাখতে না পেরে খোঁচা মেরে কথাটি বলেই ফেলল।
আহনাফের মুখে এমন কথা শুনে অর্ষা হতবাক।
‘মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। চুপ করে ঘুমাও।’ বলে অর্ষাকে বালিশে শুইয়ে দিয়ে মাথায় হাত বুলাতে লাগল আহনাফ।
অর্ষায় ঘুমায়নি। জেগেই ছিল। আহনাফ ডাকল,’অর্ষা?’
‘হু?’

‘ঐ ডাক্তার কি তোমার ভাইয়ার অনেক ক্লোজ ফ্রেন্ড?’
‘এক সময় ছিল। পড়ালেখা বন্ধ হওয়ার পর ভাইয়াই দূরত্ব বাড়িয়ে দিয়েছিল। এ কথা কেন জানতে চাচ্ছেন?’
‘এমনিতেই। সে কি বিয়ে করেছে?’
‘মনে হয় করেনি। করলে তো জানতাম।’
‘তোমার প্রতি দেখলাম খুব টান তার। খুব কেয়ার দেখাচ্ছিল।’
ঘটনা এবার সম্পূর্ণ বুঝতে পেরে অর্ষা হেসে ফেলে। আহনাফের দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে বলে
‘ওহ! এই তাহলে রাগ করে থাকার কারণ?’
‘রাগ করব কেন?’

‘আপনি যে এমন হিংসুটে সেটা তো জানতাম না। অযথাই এমন হিংসা করেন কেন? সে তো জানে আমি বিবাহিত।’ বলেই অর্ষা শব্দ করে হাসতে শুরু করে।
আহনাফের জেলাসি যখন প্রকাশই হয়ে গেছে তখন আর রাগও সে আটকে রাখতে পারল না। দু’হাতে অর্ষার গাল চেপে ধরে বলল,
‘হাসবে না একদম! খুব মজা লাগছে তাই না? হ্যাঁ, আমি হিংসুটে। আমার ভালোবাসা শুধু আমারই। আমার স্ত্রী শুধু আমারই। যত কেয়ার, ভালোবাসা দরকার আমি দেখাব, আমি করব। বাইরের পুরুষের এত দরদ কেন থাকবে?’
‘ব্যথা লাগে তো!’

গাল ছেড়ে দিলো আহনাফ। বুকের সাথে অর্ষার মাথাটা চেপে ধরে বলল,’স্যরি। খুব ব্যথা লেগেছে?’
‘না! এমনিই বললাম।’
‘ভালোবাসি বোঝো না?’
অর্ষা চাপাস্বরে বলল,’বুঝি।’
ঘরে এবার পিনপতন নিরবতা। আহনাফের বাহুবন্ধনে থেকে খুব সহজেই তার হৃদস্পন্দন শুনতে পাচ্ছে। প্রতিটা হৃদস্পন্দনই যেন ভালোবাসার কথা বলে দিচ্ছে। ভালোবাসার মানুষকে নিজের করে পাওয়া এবং কাছে পাওয়ার মতো আনন্দ ধরিত্রীতে যে সব আনন্দের চেয়েও শ্রেষ্ঠ আনন্দ বোধ করি এই অনুভব সবার তরে হবে না। কেবলমাত্র ভালোবাসায় যুগলবন্দী দুটো মানুষই বুঝতে পারবে। ভালোবাসা; সে তো ভোরের সূর্যের মতো উদিত হওয়া প্রস্ফুটিত গোলাপের ন্যায় যার সৌন্দর্য দু’চোখ ভরে শুধু উপভোগই করতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে, সময়টা এখানেই থেমে যাক, এখনই থেমে যাক। এই সময়টুকু শেষ না হোক। প্রিয় মানুষটা সর্বক্ষণের জন্য এভাবেই পাশে থেকে যাক সর্বদা, সর্ব সময়ের জন্য। ভালোবাসা অনিন্দ্য। স্বর্গীয় সুখ যে ভালোবাসায়ও নিবদ্ধ!

(সমাপ্ত)

[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।
লেখালেখিতে অনেক বড়ো একটা গ্যাপ পড়ে গেছে। ‘আমার একলা আকাশ’ শেষ করতে হবে। তার আগে ভাবলাম, ‘যেদিন তুমি এসেছিলে’র একটা সারপ্রাইজ পর্ব দেই। তিনদিন সময় নিয়ে এই পর্বটা লিখেছি। কোথাও ছন্দপতন হলেও হতে পারে। এছাড়া ভুলত্রুটি মার্জনীয়।]

যেদিন তুমি এসেছিলে সারপ্রাইজ ১