আমার অবেলায় তুমি পর্ব ৭

আমার অবেলায় তুমি পর্ব ৭
সানজিদা বিনতে সফি(সাথী)

গোধুলির রক্তিম আভা আকাশের চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। মনে হচ্ছে সৃষ্টিকর্তা এক রাশ লাল রঙ আকাশের গায়ে মেখে দিয়েছে।
দুপুরের খাওয়া শেষ হতে হতেই আসরের আজান হয়ে গেলো। মাহতাব ঘড়ি দেখে ভ্রু কুচকাল। এতটা দেড়িতে সে কখনো খায়না। আজ একটু ভিন্নতা। ড্রয়িং রুমে এখন শুধু কয়েকজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে। ময়না বেগম নিজের রুমে রেষ্ট নিচ্ছেন।

মধু আড়ষ্ট ভঙ্গিতে গুটিশুটি হয়ে বসে আছে। অস্বস্তি হচ্ছে খুব। সবাই কেমন বাকা চোখে দেখছে তাকে। সারাদিনের ব্যস্ততায় লামিয়া ক্লান্ত। ঘন্টা ঘানেক শুয়ে থাকতে পারলে একটু ভালো লাগতো। কিন্তু মধুকে ছেড়ে উঠতে পারছে না সে। মেহরাবের মামাতো ভাইয়ের বউয়েরা ঘিরে রেখেছে মধুকে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

— মেহরাব কে ডেকে দাও বোন।নামাজের সময় চলে যাচ্ছে। আপনারা ও নামাজ পড়ে নিন। তোমারা যাবে তো?
মামাতো ভাইরা মাথা নেড়ে উঠে দাড়ালো। মাহতাব ব্যস্ত ভঙ্গিতে আরেকবার ঘড়ি দেখলো। পেটা হালকা ভারী ভারী লাগছে। নামাজের পর কিছুক্ষণ হেটে আসলে মন্দ হয়না।
মিনিট পাচেক পর মেহরাব আসলো। ফোলা ফোলা রক্তিম চোখ নিয়ে ভাইয়ের সাথে মসজিদের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পরলো।যাওয়ার আগে মাহতাব মধুর কাছে এসে নরম গলায় বলল,

— মধু,,,সম্ভব হলে নামাজটা পড়ে নিয়ো।আর নিচে আসার দরকার নেই৷ নামাজ শেষে রুমে গিয়ে রেষ্ট করবে। আমার আসতে লেট হবে। লামিয়ার সাথে যাও। আমি আসছি। ঠিক আছে? লামিয়া,, মধুকে নিয়ে নামাজের রুমে যাও। আম্মা আর আপা কেও ডেকে দিও বোন।
লামিয়া মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো। মাহতাব আসছি বলেও দাড়িয়ে রইলো।যেন মধু যাওয়ার অপেক্ষায় সে।পাছে কেউ তাকে কোন কটু কথা বলে ফেলে! সাহিদা সহ তার মামাতো ভাইয়ের বউরা মুখ কুচকে তাকিয়ে। সাহিদা চুপ থাকতে পারলো না। তাচ্ছিল্যের স্বরে বলেই ফেললো,

— কচি বউ নিয়ে মানুষের সামনে এত আদিখ্যেতা দেখাচ্ছো কেন মাহতাব? তোমার বউ কে কেউ গিলে খাচ্ছে না। বুড়ো বয়সে আর লোক হাসিয়ো না।
মধু মুখটা কালো করে ফেললো। মাহতাব লামিয়া কে ইশারা করতেই লামিয়া মধুকে নিয়ে নামাজের রুমের দিকে চলে গেলো। মাহতাব সাহিদার মুখোমুখি হয়ে দাড়ালো। সাহিদার চোখে চোখ রেখে বলল,

— কে হাসবে? কার এত সাহস সাহিদা আমাকে আর আমার বউকে নিয়ে হাসবে? আমার বউকে নিয়ে আমি আদিখ্যেতা করি বা তাকে কোলে নিয়ে বসে থাকি তাতে তোমার এতো জ্বলছে কেন? মুখে ব্রেক লাগাও সাহিদা। ব্রেকফেল হলে ভাঙ্গতে সময় লাগে না।হোক সেটা গাড়ি বা কারো মুখ। নামাজ পড়ে বিশ্রাম নাও।সন্ধ্যায় এসে একসাথে চা খাবো। রাতে তোমার বর আসবে তোমাকে নিতে। আমার লেইট হলে দেখা না করে চলে যেও না কিন্তু। অপেক্ষা করো।আসছি।
সাহিদার মুখ অপমানে থমথমে হয়ে গেলো। ভিতরে ভিতরে সে রাগে ফেটে পরছে। চক্তিম চোখে ছলছল করে উঠেছে। সব রাগ গিয়ে জমা হলো মধুর উপর। এই মেয়েটা আসতেই মাহতাব তার সাথে এতো খারাপ ব্যবহার করা শুরু করেছে। কই আগেতো কখনও এমন করেনি!

মাহতাবের মজো মামাতো ভাইয়ের বউ এসে স্বান্তনার বাণী শোনালেন। সাহিদার কাধে হাত রেখে দুঃখী দুঃখী গলায় বলল,
— রাগ করো না ভাই। এখনকি আর সে তোমার প্রেমিক আছে? বিয়ে করেছে,ঘরে সুন্দরী বউ আছে। তাকে ছেড়ে কি আর প্রাক্তন কে তোষামোদ করবে? তাও যে কিনা তার যোগ্যতার দোহায় দিয়ে তাকে ছেড়ে গেছে। বাদ দাও। এসো নামাজ পড়ে নেই।

বাড়ির সব মেয়েরা একসাথে নামাজ আদায় করে নিলো৷ মেহরাবরা আগেই মসজিদে চলে গিয়েছিল। মাহতাব কথা বলতে গিয়ে পিছিয়ে গেছে। যেতে যেতে জামায়াত শুরু হয়ে গেছে।
লামিয়া সবাইকে যার যার রুমে পাঠিয়ে নিজে মধুর সাথে মাহতাবের রুমে চলে গেলো। ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসছে। তার রুম বর্তমানে মামীদের দখলে।

— তোমার পাশে ঘুমালে তোমার অসুবিধা হবে ভাবি?
মামীরা আমার রুমে রেষ্ট নিচ্ছে। গেস্ট রুমে নাকি তাদের ভালো লাগে না। না করি কি করে বলো? আমি গেস্ট রুমে ঘুমাতে পারিনা। এখন তো ওখানে সাহিদা আপা আছে। কিছু মনে করো না প্লিজ।
মধু তড়িঘড়ি করে বলল,

— আরে কি বলছো আপু। এভাবে বলে আমাকে লজ্জা দিয়ো না। আমার পাশে এসে বসো।
মধু হালকা সরে লামিয়া কে বসার জায়গা করে দিলো। তার মধ্যে আড়ষ্টতা দেখে লামিয়া সন্দিহান গলায় বলল,
— এভাবে ইতস্তত করছো কেন ভাবী? কোন অসুবিধা হচ্ছে? কোথাও ব্যথা করছে? আমাকে বলো।(উদ্বিগ্ন হয়ে)
মধু ইতস্তত গলায় বলল,
— আসলে সব কিছু এমন সাজানো-গোছানো। আমার ভয় করছে।যদি কিছু এলোমেলো হয়ে যায়! উনি রাগ করবেন হয়তো।

লামিয়া শব্দ করে হেসে উঠলো। মধুর গাল টেনে দিয়ে হাসি মুখে বলল,
— শোন ভাবী,ভাইয়া গম্ভীর দেখে সবাই ভাইয়াকে খুব রাগী মনে করে। আসলে কিন্তু ভাইয়া রাগী নয়। রেগে গেলেও ঠান্ডা মাথায় সব কিছু সামলে নেয়। তার ধৈর্যশক্তি দেখলে তুমি অবাক না হয়ে পারবে না। তবে রেগে গেলে তাকে সামলানো যায়না।আমি কখনো ভাইয়াকে রাগতে দেখিনি। তোমার দেবর থেকে শুনেছি। সব সময় চুপচাপ শান্ত থাকা একজন মানুষ সে। তোমার বিয়ের পর থেকে বাধ্য হয়েই স্বভাবের বাইরে গিয়ে এতো কথা বলছেন। আমি যখন এ বাড়িতে থাকতাম,তখন সারাদিনে ভাইয়ার হাতেগোনা কয়েকটা কথা শুনতাম। ভাইয়া তার পরিবার কে প্রচন্ড ভালোবাসে। তার একমাত্র দুর্বলতা তার পরিবার। পরিবারের মধ্যে যাতে সম্পর্ক নষ্ট না হয় তাই আমরা দূরে। এতো বড় বড় ফ্ল্যাট থাকা সত্বেও ভাইয়া এই চার রুমের ছোট ফ্ল্যাট টা ছাড়ে না। কারণ মা এখান থেকে যেতে চায় না। এখানে বাবার স্মৃতি আছে।তাই ভাইয়াও যায় না।

একদমে কথা গুলো বলে থামলো লামিয়া। মধু অবাক হয়ে মনোযোগ দিয়ে সব শুনছে। লামিয়া থামতেই মধু অবাক গলায় বলল,
— তোমরা এখানে থাকো না? কিন্তু কেন?
প্রশ্নটা শুনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল লামিয়া। মধু নিজেও থতমত খেয়ে গেছে।এভাবে জিজ্ঞেস করা হয়তো ঠিক হয়নি।
— বিয়ের এতো বছরেও আমাদের কোন সন্তান নেই তাই মা কিছুটা মনঃক্ষুণ্ন। মাঝে মাঝে এসব নিয়ে ঝামেলা হতো। তাই ভাইয়া আমাদের গুলশানের ফ্ল্যাটে সিফট করিয়ে দিয়েছে।

— কিন্তু সন্তান তো আল্লাহর দান।এতে মানুষের তো কোন হাত নেই।তাহলে তোমার উপর রাগ করে কি হবে?
— এটা কেউ বুঝতে চায় না ভাবী। সবাই মনে করে আমার সমস্যা আছে। মেয়ে কি না! সব সময় দোষ টা মেয়েদের ই থাকে। জানো,আমরা অনেক ডাক্তার দেখিয়েছি। কারোর কোন সমস্যা নেই। তবুও কেন আল্লাহ মুখ তুলে চাইছেন না কে জানে?

লামিয়ার কথায় চাপা আর্তনাদ স্পষ্ট। মধু কি বলবে বুঝতে পারলো না। তাই চুপ করে লামিয়ার হাত ধরে বসে রইলো। সারা বিকেল আর দুজনের কারোর ই ঘুম হলো না। গল্প করতে করতে মাগরিবের আজান হয়ে গেলো। সাহিদার হাসব্যান্ড মুহিত এসেছে। সাহিদাই তাকে কল করেছে আসার জন্য। এতো অপমানের পর এখানে থাকার মানেই হয়না। মাগরিবের নামজ পরেই সাহিদা বর বাচ্চা নিয়ে বেড়িয়ে গেলো। মাহতাবের কথায় সে স্পষ্ট বুঝেছে মাহতাব এসে তাকে আর এ বাসায় দেখতে চায় না। কমদিন তো হলো না মানুষ টাকে চেনার৷
মাহতাব এলো আরো পরে। মেহরাব তার সাথেই ছিল।অনেকদিন পর দুই ভাই আজ একসাথে এতটা সময় কাটালো। কাল থেকে আবার ব্যস্ত জীবনে ছুটতে হবে৷

রাতের খাবার খেয়ে বাকি মেহমানরা ও চলে গেলো। মধু রুমে এসে বসতেই মাহতাব ও চলে এলো। মধু গুটিশুটি মেরে খাটের এক কোনায় বসে আছে। মাহতাব ধীর পায়ে এসে মধুর বিপরীত পাশে বসলো।
— শরীর ঠিক আছে?
— হুম।
— মন খারাপ?
মধু চোখ তুলে তাকালো। মাহতাবের শান্ত মুখটা দেখে আবার চোখ নামিয়ে মিনমিনে গলায় বলল,

আমার অবেলায় তুমি পর্ব ৬

— না।
— ভয় পাচ্ছো আমাকে?
মধু হচকচিয়ে গেলো। শুকনো ঢোক গিলে মাথা নাড়িয়ে না বোঝালো।
— পাওয়া উচিত।
মধু চমকে গেলো। মাহতাবের গলাটা কি অন্যরকম শোনালো?

আমার অবেলায় তুমি পর্ব ৮