আমার অবেলায় তুমি পর্ব ৮

আমার অবেলায় তুমি পর্ব ৮
সানজিদা বিনতে সফি(সাথী)

সকালে নাম না জানা পাখির ডাকে ঘুম ভেঙেছে মধুর। শহরে পাখির ডাক শুনতে পাওয়া দুষ্কর। একটা বড় আমগাছ আছে বাড়ির পেছনের দিকটায়। সেখানেই হয়তো কোন পাখি কিচিরমিচির করে ডাকছে। শব্দগুলো খুব কানে লাগছে। কোকিলের মতো মধুর গলায় ডাকলে হয়তো এত কানে লাগতো না। চোখ কচলে আড়ষ্ট ভঙ্গিতে উঠে বলল মধু। পাশের জায়গা টা খালি। এই পাশটায়ই রাতে মাহতাব শুয়েছিল। রাতের কথা মনে হতেই মুখকটা পাংশুটে হয়ে গেলো তার। লোকটা কিভাবে তাকে ভয় দেখাচ্ছিলো!তার ভয়ে চুপসে যাওয়া মুখটা দেখেও তার দয়া হয়নি। ভয় পেলেও মধুর মনের কোন এক জায়গায় মাহতাবের জন্য ভরসা আর বিশ্বাস ছিল।

মাহতাব বিছানার একপাশে শুয়ে গম্ভীর গলায় যখন বলল,
– শুয়ে পরো মধু। আমাকে ভয় পাওয়ার কারণ তুমি নিজেই ভুঝে যাবে একদিন। তার জন্য বাকি জীবন টা তো পরেই আছে।তুমি না বুঝলেও আমি তোমাকে আস্তে আস্তে বুঝিয়ে দিবো।এখন ঘুমাও।
মধু মুখটা কাচুমাচু করে শুতে গেলেই মাহতাব ঠান্ডা গলায় বলল,
— রাতের মেডিসিন গুলো খেয়েছো মধু?
— হুম।(হালকা স্বরে)
— আচ্ছা ঘুমাও।
মধু শ্বাস ছেড়ে বিছানা থেকে নামল।শরীরে এখনো হালকা ব্যাথা করছে। হাতের পোড়া জায়গায় টান ধরেছে। মাহতাব রুমের কোথাও নেই।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

মধু ফ্রেশ হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে ড্রয়িং রুমে এলো। ময়না বেগম টেবিলে বসে খালার সাথে কি নিয়ে যেন কথা বলছে। মধুকে দেখেই হাসিমুখে বলল,
— ঘুমা ভাঙলো? মাহতাব সকালেই বেরিয়ে গেছে।ও খুব সকা সকাল বেরিয়ে যায়।আমাকে বললো তুমি ঘুমাচ্ছ। কেউ যেন বিরক্ত না করে। তাই ডাকি নি। এসো নাস্তা করে নাও।
মধু হালকা হাসলো। টেবিলে বসে চারিদিকে চোখ বুলিয়ে ধীর গলায় বলল,
— আসলে কিভাবে যে এতো ঘুম এলো বুঝতে পারছি না। আপনারা খেয়েছেন? লামিয়া আপু কোথায় আপা?
— আরে এসব নিয়ে ভেবো না। আমাকে কি তোমার কূটনী ননাস মনে হয়? আমরা খেয়ে নিয়েছি। লুবানা তার রুমেই আছে। তুমি খেয়ে নাও। ওষুধ খেতে হবে তো নাকি!

মধু মাথা নাড়লো। ময়না বেগম খালা কে তাড়া দিয়ে বলল,
— খালা, রহিমারে বলো নতুন বউকে নাস্তা দিতে। মধু,,তুমি চা খাবে না কফি?
— চা খাবো আপা।
— ঠিক আছে।
খালা ছুটলো নাস্তা পাঠানোর জন্য৷ মধুর মন কিছুটা খারাপ হয়ে গেলো। মানুষ টা তাকে একটু বলেও গেলো না!
নিজের চিন্তায় নিজেই অবাক হলো সে।মাত্র তিনদিনের সম্পর্কে সে মাহতাবের উপর অভিমান করছে!আদোও কি তাদের মধ্যে কোন অভিমান করার মতো সম্পর্ক গড়ে উঠেছে?

নাস্তা শেষ করে মধু ময়না বেগমের সামনে গিয়ে কাচুমাচু করে দাড়ালো। গলায় অস্বস্তি ঢেলে মিনমিনে গলায় বলল,
— আজকে দুপুরের রান্নাটা আমি করি আপা?
ময়না বেগম চোখ তুলে তাকালেন। মধুর মায়াবী মুখের দিকে তাকিয়ে মনটা ভরে গেলো তার।
— নাহ মধু।তুমি অসুস্থ। আগে সুস্থ হও তারপর দেখা যাবে। রান্নার জন্য সেফ আছে। তুমি গিয়ে ওষুধ গুলু খেয়ে নাও। তারপর রুমেই রেষ্ট করো। মাহতাব দুপুরে খেতে আসবে। এই শরীরে রান্না করেছো শুনলে রাগ করবে।
— আমি একদম ঠিক আছি আপা। এভাবে শুয়ে বসে থাকতে ভালো লাগছে না। গা ব্যথা হয়ে গেছে। না করবেন না প্লিজ। আমার একটু ও কষ্ট হবে না। খুব ইচ্ছে করছে। প্লিজ আপা।

ময়না বেগম দ্বিধায় পরে গেলেন। এই শরীরে মধুকে রান্না করতে দিতে চাইছে না।আবার মধুর মুখের দিকে তাকিয়ে নিষেধ ও করতে পারছে না। ময়না বেগমের ভাবনার মাঝেই মধু আরো কয়েকবার অনুরোধ করে ফেললো। শেষ পর্যন্ত ময়না বেগম কে রাজি হতে হলো।ময়না বেগম রাজি হতেই মধু উৎফুল্ল গলায় বলল,
— আপনাদের কার কি পছন্দ আমাকে বলে ফেলুন আপা।আজ আমি সবার পছন্দ মতো রান্না করব।
— মাহতাবের বিভিন্ন রকমের ভর্তা আর টক ডাল পছন্দ। আমাদের সবার জন্য যেকোনো একটা আইটেম করলেই হবে। মায়ের ও ভর্তা আইটেম খুব পছন্দ। রহিমা আর খালা তোমাকে সাহায্য করবে।কিছু দরকার হলে সেফ কে বলবে। ঠিক আছে?

মধু প্রফুল্ল মনে কিচেনে চলে গেলো। চারিদিকে সাজানো গোছানো জিনিসপত্র দেখে মনটা আরো ভালো হয়ে গেলো। এমন রান্নাঘর পেলে সে সারাদিন রান্না করতে পারবে।
— রহিমা আপা,আপনি একটু লামিয়া আপুকে জিজ্ঞেস করে আসুন সে কি পছন্দ করে। আর আপনারা আজ কি খেতে চান বলুন। আপনাদের জন্যও আজ আমি রান্না করবো।
রহিমা চোখ গোল গোল করে তাকিয় রইলো। খালা মুচকি হেসে সব কিছু বুঝিয়ে দিচ্ছে মধুকে।কোথায় কি আছে সব নিজে বের করে দেখিয়ে দিচ্ছে।

রহিমা লামিয়ার রুমে গিয়ে দেখে লামিয়া ঘুমাচ্ছে। লামিয়া কে ঘুম থেকে ডেকে তুললে সে সারাদিন মাতবা ব্যথায় ভোগে এটা বাড়ির প্রায় সবাই জানে।তাই রহিমা তাকে না ডেকেই বেড়িয়ে গেল।
— ছোড ভাবি তো ঘুমায় ভাবি। হেতিরে ঘুমের থেইকা ডাইকা তুললে হেতির মাথা বেদনা করে।হেল্লাইগা ডাহি নাই। ছোড ভাবি গরুর মাংস ভুনা মেলা পছন্দ করে৷ আফনে হেইডা করতে পারেন বড় ভাবি।
— আচ্ছা ঠিক আছে। তোমরা কি খাবে বললে না তো।

— আমাগো লেইগা কিছু করা লাগবো না ভাবি। আমগো রান্দা আমি নিজেই কইরা ফেলমু।
আচ্ছা আমাকে এগুলু একটু ধুয়ে দাও। আর শুটকি গুলো ভালো করে ধুবে। ভর্তা করবো আজ।
— আইচ্ছা।আমি জরিরে ডাইকা লইয়া আহি।
— জরি কে?
— এইহানেই কাম করে। সব কছু ধোয়ামোছা করে ও। পুরা নাম জরিনা বানু।
মধু হালকা হেসে বলল,
— আচ্ছা যাও। (হালকা হেসে)

রহিমা খুশিমনে চলে গেলো। মধু হালকা হেসে রান্নায় লেগে পরলো। খালা ময়না বেগমের কাছে গিয়ে বসেছে।তার বেশিরভাগ সময় ময়না বেগম আর কুলসুম বেগমের সাথেই কাটে৷
দুপুরে মাহতাব আর মেহরাব একসাথে বাসায় ফিরেছে। মাহতাব আসার পথে মেহরাব কে হসপিটাল থেকে নিয়ে এসেছে। বাসায় ঢুকতেই শুটকি ভর্তা আর কালোজিরা ভাজার ঘ্রান নাকে এসে বারি খেলো। মাহতাব মুচকি হেসে কপাল কুচকালো। আজ বাসায় কে তার উপর সদয় হলো!
খাবার টেবিলে সবাই আজ আগেভাগেই বসে আছে। লামিয়া একটু পরপর ঢাকনা তুলে দেখছে। পারলে সে এখনই হামলে পরে।

— কি ব্যপার! আজকে এতো আয়োজন কার জন্য?
— ভাইয়া আজকে ভাবি সব রান্না করেছে। আমার তো জিভে পানি চলে এসেছে। শুটকি ভর্তা, আলু ভর্তা,কালোজিরা ভর্তা, মাছ ভর্তা, লাউশাক ভর্তা, ডাল,গরুর মাংস ভুনা সব করেছে।
— হ ভাইজান।আর আমাগো লেইগা বিরিয়ানির করছে। চুলায় আছে এহনো।এগুলা করতে একটু দেড়ি হইয়া গেছিলো। প্রায় হইয়া গেছে।
রহিমা আর জরির চোখ খুশিতে চকচক করছে। তাদের খুশি দেখে মাহতাব মুচকি হাসলো। মেহরাব দ্রুত পায়ে রুমে গেছে ফ্রেশ হতে।লামিয়া ও তার পিছু পিছু ছুটেছে।

— বসো তোমরা।আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।
কুলসুম বেগম মাথা নেড়ে সায় জানালেন। ময়না বেগম চোখ ঘুড়িয়ে ঘুড়িয়ে মাহতাব কে দেখছে।
মাহতাব রুমে চলে গেলো ফ্রেশ হতে। মধু রান্না শেষ করে ওয়াশরুমে ঢুকেছে শাওয়ার নিতে। তারাহুড়ো করছে সে। মাহতাব যে কোন সময় চলে আসবে।
মাহতাব রুমে ঢুকে চারিদিকে চোখ বুলালো।মধুকে না দেখে শ্বাস ছেড়ে গায়ের শার্ট খুলতে লাগলো। মেয়েটা অসুস্থ অবস্থায় রান্না কেন করতে গেলো! ওয়াশরুমে পানির শব্দ পেয়ে মাহতাব বারান্দায় চলে গেলো। মধু রুমে এসে তাকে দেখলে অপ্রস্তুত হতে পারে।
মধু শাওয়ার নিয়ে বেরিয়েছে। শাড়ি রুমে রেখেই গিয়েছিল। ওয়াশরুমে শাড়ি পড়তে পারে না সে। শাড়ি ভিজে একাকার হয়ে যায়।

শাড়ি দুইপেচ দেয়ার পরেই মাহতাব প্রকট হলো।মধুকে কিছু না বলেই ওয়াশরুমে চলে গেলো। মধুর হাতের শাড়ি আলগা হয়ে ফ্লোরে পরে গেছে। ঠোঁট দুটো হালকা ফাক করে চোখ বড় বড় করে সেভাবেই দাঁড়িয়ে আছে। মাহতাব তার দিকে তাকিয়েছিল! দেখেছে সে। তীক্ষ্ণ চোখে তার উপর চোখ বুলিয়েছে! কিছু না বলে, স্পর্শ না করেও এভাবে ছোয়া যায় তা সে স্বপ্নেও ভাবে নি। ওই ধারালো চোখ দিয়েই তাকে স্পর্শ করে গেছে লোকটা! কি সাংঘাতিক!
মাহতাব পাচ মিনিটে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়েছে। মধু নিজেকে সামলে কোন রকম শাড়ি পরে নিয়েছে। মাহতাব মধুর পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে বললো,

— বুঝেছো কেন ভয় পাওয়া উচিত?
মধু নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে। ঠোঁট কাপলেও কোন কথা মুখ থেকে বেরুলো না। ভয়ংকর লোক একটা।

আমার অবেলায় তুমি পর্ব ৭

(গল্প একদিন পর পর আসবে। সেজন্য আগেই ক্ষমা চাইছি।রিচেক করা হয়নি। বানান ভুল থাকতে পারে। )

আমার অবেলায় তুমি পর্ব ৯