আমার একটাই যে তুই পর্ব ৯ || সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি

আমার একটাই যে তুই পর্ব ৯
সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি

লিয়ার এমন কথায় উপস্থিত সকলেই অবাক হয়ে চেয়ে।ইউসুফ ভাইয়া লিয়ার দিক চোখ লাল করে চেয়ে আর আমি মাথা নত করে চোখের জল ফেলছি। সত্যি তো আমি কে? আমি তো তাদের বাসায় শুধু আশ্রিতা। শুধুই আশ্রিতা।আমার ভাবনার মাঝে ঠাসস করে একটা শব্দ হতেই চমকে তাকালাম সামনের দিক।এটা দেখার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না আমি। লিয়া গালে হাত দিয়ে দাড়িয়ে আছে। পাশেই চোখ মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে ইউসুফ।তখনি লিয়া ছল ছল চোখে কাঁদ কাঁদ হয়ে বলল,,

–“তুমি আমায় মারলে?”
—“হে মেরেছি! বেশ করেছি! বাংলা সিনেমার মত একদম ন্যাকা কান্না করবে না। আর হে ওই মটে কুহু আশ্রিতা না। এই বাড়ির মেয়ে এ বাড়ির সদস্য। আশ্রিতা কাকে বলে জানো? জানো তো? যাকে আমরা কিছুদিনের জন্য থাকতে দেই আমাদের বাসায়! যেমনঃ তুমি!!
ইউসুফ ভাইয়ার এমন কথা উপস্থিত সবাই বিস্মিত। লিয়ার চোখ বেড়িয়ে আসার উপ্রক্রম।
–” তুমি আমাকে…!”
লিয়ার কথার মাঝে আবার বলে উঠলো ইউসুফ ভাই।

–” কারো মাঝে এতটুকু মানুষত্ব বোধ থাকা উচিত যে যেখানে তার এত অপমান হচ্ছে সেখানে থাকতে নেই! সো ক্লিয়ারলি বলছি,, গেট আউট মাই হাউজ।তোমার এই রঙ চঙ মাখা ফেইসটা নিয়ে আর কখনো আসবে না আমার সামনে”
বলে ধপাধপ পায়ে উপরে চলে গেলেন। হল রুমে চলছে পুরো নীরবতা। তিথি, নুশরা, বুশরা সবাই হাসচ্ছে মুখ টিপে।তখনি লিয়া ছোট মামিকে বলল,,
–” খালা দেখলে তোমার ছেলে কি বলে গেল?”
তখনি ছোট মামি থম থমে আওয়াজে বলল,,
–“যা বলেছে ঠিক বলেছে! কুহু এ বাড়ির মেয়ে। ওকে এভাবে বলার অধিকার আমরা কাউকে দেই নাই। আর হে ড্রাইভার পৌঁছে দেবে তোমাকে!”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

মামীর কথায় তার দিক তাকালাম আমি।সত্যি ভাবতে অবাক লাগচ্ছে তিনি আমার জন্য তার আদরে ভাগ্নির সাথে এভাবে কথা বলবেন। কথা গুলো বলে আমি আমার দিক এক পলক তাকালেন তারপর মামী চলে গেলেন।তখন নুশরা বুশরাকে বলে উঠে,,
–” জানিস বোন একেই বলে,,
‘অতি বাড় বেড়ো না, ঝরে পড়ে যাবে,
অতি ছোট থেকো না, ছাগলে মুড়ে খাবে।’
বলে কটকটিয়ে হাসতে লাগলো তারা। তখনি তিথি বলল,,
–” জেসি কর্ণী ওয়াইসি ভার্ণী ”
এসব শুনে রাগী চোখ তাকালো লিয়া আর বলল,,
–” সব কটাকে দেখে নিব..!”
তখনি বুশরা বলল,,
–“আমরা ওয়েট করবো লিয়া পু… টা টা!”

বলে হাসতে লাগলো সবাই মিলে। আর আমি চলে আসলাম নিজের রুমে এসে বসে পড়লাম মাটিতে। দু হাটুতে মুখ গুজে কেঁদে উঠলাম আমি। মনে পড়ল সে বিষাক্ত দিনটির কথা যেদিন ছাড়তে হয়েছিল আমার নিজের বাড়ি। আর ঠাঁই পেলাম এ বাড়ি। শরীরে লেগে গেল আশ্রিতা নামের ট্যাগ!
সেদিন ছিল আমার মায়ের মৃত্যু বার্ষিকী। বাবা ফরিক খাওয়াতে চাইলেন সেদিন। সৎ মা না করে দেন। আর বলে উঠে,,
–” যে মরে গেছে তার জন্য এত খরচ করার কি আছে! মরা মানুষের জন্য টাকা কেন জলে ফেলবে? তার থেকে বরং টাকা গুলো দাও গহনা কিনে রাখি কাজে দিবে..!”

সেদিন তার এমন কথা সহ্য হয়নি আমার। এসেছে পর থেকেই সব লুটেপুটে খাচ্ছে সে। এখন আমার মার জন্য খরচ করবে তাও সহ্য হচ্ছে না তার? তাই রাগের মাথায় বলেছিলাম তাকে,,
–“মানুষ লোভী হয়! এতটা হয় আপনাকে দেখে বুঝলাম। মরা মানুষের জন্য খরচ করবে এটার লোভ সামলাতে পারলেন না! জাহান্নমেও জায়গা হবে না আপনার!”

কথাটা শেষ করতে দেড়ি হয়েছিল সেদিন। বিলাপ শুরু করতে দেড়ি হয়নি সৎ মার। সেদিন আমায় আকথা, কুকথা ও বিশ্রী গালি দিয়েছিলেন তিনি। বাসায় বাবা আসতেই বিচার দিলেন তিনি সত্য মিথ্যা অনেক কথা বলে ছিলেন তিনি বাবাকে। বাবা সেদিন রেগে এসে ভাঙ্গা কাঠের টুকরো এনে ইচ্ছে মতো মেরেছিলেন আমায়।আর বার বার বলেছিলেন,,

–” তুই অলক্ষি। তোর জন্য আমার সব শেষ! মরতে পারিস না! জান ছুটতো আমার? তুই হলি আমার জন্য উটকো ঝামেলা! বের হো বাড়ি থেকে আমার। তোর মা মরেছে মরেছে তোরে কেন নিয়ে গেল না? প্রতিদিনে আশান্তি আর ভাল লাগে না আমার।”
এসব বলে চুল ধরে টানতে টানতে দরজার বাহিরে ধাক্কিয়ে ফেলেদিলেন। সেদিন নিজেকে ময়লা আবর্জনার থেকে নিকৃষ্ট মনে হয়েছিল আমার। সারা শরীরে ছুলে, কেঁটে একাকার। রক্ত ঝড়ছে। সেদিন দেখেছিলাম সৎ মায়ের ঠোঁটে তৃপ্তির হাসি। চোখ মুছে মাটি থেকে উঠতে হাজারো ব্যর্থ চেষ্ট করি। সেদিন আমাদের বাসার কেয়ারটেকার তার ঘরে নিয়ে যান মাটি থেকে তুলে। আর ফোন করেন নানুমা কে! পরে দিন সকালে এক কাপড়ে সে অবস্থায় নিয়ে আসেন এ বাড়িতে আমাকে। তাদের কাছে আমি অনেক ঋনি। জানি না পারবো কি না এ ঋণ শোধ করতে জানি না আমি!এসব চিন্তা করতে করতে কখনো ঘুমিয়ে পড়েছি জানা নেই আমার।

ঘড়ির কাঁটা টিক টিক করে বাজচ্ছে। মাত্রই চোখ খুলেছে আমার। চোখ দু টা মরিচের মতো জলছে।তখন নিজেকে আবিষ্কার করলাম বিছানায়! গায়ে চাদর টানা।চোখ ঢলতে ঢলতে উঠে বসলাম আমি।মনে করার চেষ্টা করলাম কখন বিছানায় আসলাম আমিতো ফ্লোরে বসেছিলাম! এখানে কে আনলো! মনে পরছে না আমার।তখনি রুমে ঢুকলো তিথিহাতে ধোঁয়া উঠানো দুধের গ্লাস। আমার দিক তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে উঠলেন তিনি,,

–উঠে পরেছিস! নে এটা খেয়ে নে!
আমি বাধ্য মেয়ের মতো দুধ টুকু খেতে লাগলাম।তখন তিথি আবার বলল,,
–” এখন কেমন লাগচ্ছে তোর?”
–“আমার আবার কি হয়েছিল! ঠিক আছি!”
–“রাতে জ্বর এসেছিল কাঁপুনি দিয়ে! ”
আমি অবাক হলাম খুব!
–” আমার কিছুই মনে নেই! ”
তিথি আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,,
–” একটা কথা বলতো? তুই কি ইউসুফ ভাইকে পছন্দ করিস??”

আমি চুপ! কি বলবো বুঝতে পাড়ছি না। তখনি রুমে ঢুকলেন ইউসুফ ভাই। হাতে খাবারের প্লেট। তাকে এভাবে দেখে আমি অবাক হলো তবুও হাসলো আর ইউসুফ ভাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন,,
–” ভাল হয়েছে খাবার নিয়ে এসেছো আমি মাত্রাই যেতাম। দেও খাইয়ে দেই!”
ইউসুফ ভাই হাসলো। খাবারের প্লেট না এগিয়ে দিয়ে বললেন,,
–“না আমি খাইয়ে দিব। তুই যা!”

তিথি চলে গেল। ইউসুফ ভাইয়া আমার পাশে বসলেন! তার শরীর থেকে সেই মাতাল করা ঘ্রাণ নাকে বাড়ি খেল। আমি নিচের দিক তাকিয়ে। তার দিক তাকাবার সাহস আমার নেই! গাড়িতে বলা কথা গুলো মনে পরে লজ্জা লাগচ্ছে খুব!তখনি তিনি আমার খুব কাছে চলে এলেন। বাম হাতে থুতনি ধরে আমার মুখটা উপরে তুললেন! আমি চোখ খিঁচে বন্ধ করে আছি। তার ঠান্ডা হাতে স্পর্শ শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠলো! তখন তিনি ধীরে ধীরে বললেন,,

আমার একটাই যে তুই পর্ব ৮

–” এতো লজ্জা পাশ নে সুন্দরী! তোর গাল দুটো যে লাল লাল টমেটো হয়ে যায়! খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে লবন দিয়ে!”
তার এমন কথায় হেসে দিলাম আমি! লজ্জা বাড়লো দিগুন বৈ কমলো না।তিনিও হাসচ্ছেন।আর বললেন,,
–“হা কর এবার!বড় করে করবি মুখের ৩২ টা দাঁত যেন দেখা যায়!”
–“ভাইয়া আমার ২৬ টা দাঁত ৩২ টা হয় নি এখনো!”
তিনি ভ্রু কুচকে বললেন,,

–“তাই নাকি! ও মাই মিস্টেক! এবার হা কর!”
আমি হা করলাম। ভাইয়া ভাত মাখিয়ে এক লোকমা মুখে পুড়ে দিলো! আমি খেতে লাগলাম। তখন তিনি আমাকে বললেন,,
–” জানিস তুই প্রথম যাকে মুখে তুলে খাইয়ে দিচ্ছি আমি!”
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম,,
–“কেন দিচ্ছেন! রেকর্ড ভাঙ্গলেন শুধু শুধু!”
তিনি আমার দিকে তাকালেন।আবার চোখ নামিয়ে ভাত মাখাতে মাখাতে বললেন,,
–” মাঝে মাঝে ভাঙ্গতে হয়! আপন মানুষদের জন্য! তুই বুঝবি না! তোর ছোট মাথায এসব ঢুকবে কম!!”
তার কথায় তাকিয়ে রইলাম আমি। আমি তার আপন মানুষ। কথাটি শুনে মনে আনন্দের রং লেগে গেল। ভাল লাগতে লাগলো!

আমার একটাই যে তুই পর্ব ১০