আমার নিঠুর মনোহর গল্পের লিংক || জেনিফা চৌধুরী

আমার নিঠুর মনোহর পর্ব ১ 
জেনিফা চৌধুরী

স্কুলের স্যারকে বর বেশে দেখে ১৬বছর বয়সী তারিনের বুক কেঁপে উঠল। নিজের থেকে কমপক্ষে ১৩/১৪বছরের বড় বয়সী কাউকে জীবনসঙ্গী হিসেবে মেনে নিতে পারলো না কিশোরী মন। এই বিয়ে নাকোচ করার জন্য এক মুহূর্ত অপেক্ষা করতে পারল না। বরকে দেখামাত্র-ই উচ্চস্বরে বলে উঠল,

“আব্বা, এই বিয়া আমি করতে পারুম না।”
উপস্থিত সকলে বিস্ফোরিত চোখে তাকালো তারিনের দিকে। তারিনের বাবা আক্তার মিঞা মেয়ের কথা শুনে ধড়ফড়িয়ে উঠলেন৷ মেয়ের পাশে এসে বসে ধীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
“এডি কি কও, আম্মা? আমাগো সম্মান মাটিত মিশাইবা, আম্মা?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

তারিন এবার চারদিকে নজর দিলো। সবাই ওর দিকে চেয়ে আছে। তারিন চুপ হয়ে গেলেও আশেপাশের সবার মাঝে গুঞ্জন শুরু হয়ে গেলো। সবাই কানাকানি করছে। গ্রামের মানুষ একটা কথা পেলে সেটাকে দ্বিগুণ বাড়িয়ে বলার ক্ষমতা রাখে। এক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম কিছু হলো না। কেউ কেউ তো উচ্চস্বরেই বলছেন,
“মনে হইতাছে, মাইয়ার অন্য পোলার লগে পিরিত আছে।”

একটা আনন্দময় বিয়ে বাড়ি তারিনের এক কথায় হুড়োহুড়ি শুরু হয়ে গেলো। সবাই মিলে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ল___কেন বিয়ে করবে না সে কারণ খুঁজতে। তারিন এই মুহূর্তে ঠিক কি করবে বুঝতে পারলো না। ভয়ে গুটিয়ে গেলো। মাত্রই বর যাত্রীরা আসা শুরু করেছে। মুহূর্তেই পুরো বাড়ি জুড়ে ছেয়ে গেলো মেয়েকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আমজাদ সাহেবের কানে কথাটা যেতেই সে তড়িঘড়ি করে তারিনের কাছে ছুটে আসলেন। অবাক স্বরে তারিনের বাবাকে প্রশ্ন করলেন,

“কী ব্যাপার, আক্তার ভাই? আপনি তারিন মা কে জোর করে বিয়ে দিচ্ছেন?”
আক্তার মিঞা চুপ করে-ই রইলেন৷ কি উত্তর দিবেন ভাবতে লাগলেন। তার তো উত্তর জানা নেই। মেয়েকে তো সে জোর করে বিয়ে দিচ্ছে না। তারিন সজ্ঞানে এই বিয়েতে রাজি হয়েছিল। তাহলে এখন কেন অমত করছে সেই কারন খুঁজছেন। তারিনের ভিষণ কান্না পাচ্ছে। এই পরিস্থিতি দেখে আরো বেশি ঘাবড়ে গেলেন। চারদিকে তাকিয়ে মা কে খুঁজতে লাগল। সবাই প্রশ্নোত্তর চোখে তারিনের দিকে তাকিয়ে আছে। তামজিদের কানে এসব খবর যেতেই তামজিদ সেখানে এসে হাজির হলো তামজিদ কে দেখেই তারিন ভয়ে গুটিয়ে নিলো নিজেকে। তামজিদ সবার উদ্দেশ্য বলে উঠল,

“আপনারা সবাই বিয়ে খেতে আসছেন। খেয়ে দেয়ে চলে যাবেন। আমরা দুজন মানুষ একসাথে সারাজীবন থাকব। তাই আমাদের দুজনের ভালো, মন্দ আমাদের বুঝতে দিন। দয়া করে, কেউ আমার বা তারিনের বিষয় কোনো প্রকার মন্তব্য করবেন না।”

তারপর তারিনের ভাই তুষারকে বলল সবাইকে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করতে। তামজিদ তারিনের ভয় পাওয়া চেহারা পানে তাকিয়ে খুব শান্ত বাক্যে শুধাল,
“বাবা, আমার আমি তারিনের সাথে একা কথা বলতে চাই।”

কথাটা শুনে যেনো তারিনের কলিজা শুকিয়ে যাওয়ার উপক্রম। বাবার সম্মানের দিকে তাকিয়ে তারিন এবার আর মুখ খোলার সাহস পেলো না। তামজিদের কথা মেনে নিলো৷ তামজিদের তারিনের হাত ধরতেই তারিন কেঁপে উঠল। তবুও টু-শব্দ করল না। তামজিদ তারিনকে নিয়ে ফাঁকা একটা রুমে চলে আসল। এসেই দরজা লাগিয়ে দিয়ে সোজাসাপটা প্রশ্ন করল,

“এই বিয়েটা তুমি করতে চাও না?”
তারিন চুপ করে আছে। বার বার ঢোক গিলছে। কথা বলার জন্য কোনো শব্দ,বাক্য খুঁজে পাচ্ছে না। তারিনকে চুপ থাকতে দেখে তামজিদ খুব ব্যতিব্যস্ত স্বরে বলল,
“দেখো মেয়ে, এভাবে চুপ করে থাকার সময় এখন নেই। যা বলার সরাসরি বলো। বিয়েটা তুমি করতে চাও কি না?”

তারিন মাথা নাড়ালো। অর্থাৎ ‘না’। এবার তামজিদ জিজ্ঞেস করল,
“কেনো করতে চাও না?”
তারিন চঞ্চল প্রকৃতির একটা মেয়ে। মুখের উপর উচিত কথা বলার জন্য অনেকের চোখের বিষ। গ্রামের হাস্যজ্বল, চঞ্চল, দুষ্ট, মিষ্টি মেয়ে তারিন। যে কিনা সারাদিন হাসি ঠাট্টায় মেতে থাকে। সে মেয়ে শহরের গম্ভীর, অহংকারী ছেলেকে বর হিসেবে মানতে নারাজ। এতক্ষণ মানুষজনের ভীড়ে একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলো ঠিকই কিন্তু এবার আর ঘাবড়ে না গিয়ে সাহস সঞ্চয় করে কাঠকাঠ গলায় বলে উঠল,

“আপনেরে আমি কেন বিয়া করুম, মাস্টার মশাই? আপনে আমার থেইকা কত্ত বড়। আমার লগে কি আপনেরে মানায় না_কি? আপনে হইছেন শহুরে পোলা। আর আমি গ্রামের মাইয়া। আপনে গো ওইসব আদব কায়দার লগে আমি মানায় লইতে পারুম না, মাস্টার মশাই। আমি তো জানতাম না যে, আমার লগে যার বিয়া হইব সে আর কেউ না আপনে। আগে যদি জানতাম তাইলে এই বিয়াতে রাজি হইতাম না। পড়ালেখার থেইকা বাঁচতে এই বিয়াতে রাজি হইছিলাম। আব্বায়, যে আপনের গলায় ঝুলায় দিবো এইডা ক্যামনে কমু?

তামজিদের ভ্রু যুগল কুঁচকে এলো। তামজিদ ছোট থেকেই ঢাকায় বড় হয়েছে৷ শহুরে আদব কায়দায় বড় হলেও গ্রামের প্রতি ওর বেশ টান। তাই তো শহরের নামকরা স্কুলের চাকরি ছেড়ে গ্রামের স্কুলে এসে জয়েন করেছে। সবে মাত্র এক মাস হলো। এই এক মাসে তামজিদের জীবনটা সম্পূর্ণ বদলে গেছে৷

পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে নিজের থেকে এত ছোট বয়সের কাউকে বিয়ে করতে হচ্ছে। শুধু তাই নয়, নিজের ভালোবাসার মানুষটাকেও বির্সজন দিতে হচ্ছে। অজানা ব্যাথায় তামজিদের বুক চিনচিন করে উঠল। দমবন্ধকর পরিস্থিতি থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বের হওয়ার রাস্তা খুঁজতে লাগল। তাই এ বিষয় আর কথা বাড়ালো না। যে করেই হোক বাবাকে দেওয়া কথা ও রাখবে৷ এই বিয়েটা ও করবে। যে করেই হোক করবে_ই। নিজের রাগ, দুঃখ, কষ্ট সাইডে রেখে তামজিদ শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করল,

“তুমি তোমার বাবা কে ভালোবাসো?”
হুট করে এহেন প্রশ্ন করায় তারিন অবাক পানে চেয়ে উত্তর দিলো,
“এডি কি কথা জিগান? আমার বাপেরে আমি ভালোবাসুম না কেন? কোন মাইয়ারে দেখছেন বাপেরে ভালোবাসেনা?”

তামজিদ বিরক্তিকর স্বরে বলল,
“যা জিজ্ঞেস করছি সেটুকুর উত্তর দাও। ভালোবাসো কি না?”
“আমার বাপেরে আমি ম্যালা ভালোবাসি।”
“তাইলে তুমি কি চাও তোমার বাবার সম্মানহানি হোক? গ্রামের মানুষ নানা ভাবে অপদস্ত করুক, অপমানজনক কথা শুনাক, চাও?”

তারিন আঁতকে উঠল। বিস্ফোরিত স্বরে বলল,
“না! না! এইসব আমি কেন চাইমু? আমার বাপেরে কেউ কিছু কইলে ওইডা আমার সইয্য হয়না।”
তামজিদ পুনরায় বলল,

“এই বিয়েটা না হলে তোমার, আমার দুজনের পরিবারের সম্মানহানি হবে। গ্রামের লোকেরা নানা কথা বলবে। তোমার নামে বদনাম উঠবে। এইসব সহ্য করতে পারবে তো? তোমার বাবা সহ্য করতে পারবে তো? এই বিয়েটা যদি তুমি না করতে চাইতে তাহলে আগেই বারণ করতে। এখন বিয়ের আসরে বসে তুমি বিয়ে করবে না বলছো? পুতুল খেলা পেয়েছো নাকি এটা? দেখো মেয়ে, তুমি আমার থেকে বয়সে ও মেধায় দুই জায়গায় এই ছোট। আমার তোমাকে বিয়ে করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। হ্যাঁ, মানছি তুমি যথেষ্ট সুন্দরী। কিন্তু এটা ভুলে যেও না। সব ছেলেরা কিন্তু সৌন্দর্যে মগ্ন হয় না৷ আমাকেও তোমার সৌন্দর্যে টানে না। আ…।”

“তাহলে, বিয়াটা কেন করতাছেন?”
তামজিদ এক দমে কথা গুলো বলে যাচ্ছিলো এর মধ্যে তারিনের প্রশ্নে দমে গেলো। তারিনের দিকে চেয়ে দেখলো মেয়েটা অশ্রুসিক্ত নয়নে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে মুখে অসহায়ত্বের ছায়া দেখে যাচ্ছে। তামজিদ এক মুহূর্তের জন্য তারিনের চোখের মায়ায় হারিয়ে গেলো। খেয়াল করলো মেয়েটা বড্ড বেশি সুন্দর লাগছে! বিয়ের সাজে বুঝি মেয়েদের এমনই সুন্দর লাগে? পর মুহূর্তে কিছু মনে করে দৃষ্টি নত করে ফেলল। আলতো স্বরে উত্তর দিলো,

“বাবার জন্য।”
“শুধু আপনের বাবার লাইগ্যা?”
“হ্যাঁ। বাবার তোমাকে পছন্দ।”
“আর আপনের?”
তামজিদ থেমে গেলো। মেয়েটা বয়সে ছোট হলেও কথাগুলো বেশ ম্যাচুর ব্যক্তির মতো জিজ্ঞেস করছে৷ আগের ন্যায় বলল,

“আমার পছন্দ অন্য কাউকে।”
তারিনের বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। যতই হোক কোনো মেয়ের পক্ষে হবু বরের মুখ থেকে এই কথাটা সহ্য করার ক্ষমতা নেই। অসহায়ের মতো বলে উঠল,

“তাইলে আমারে বিয়া কইরা আমার জীবনটা নষ্ট কইরেন না। আমি গ্রামের মাইনসের কথা দাঁতে দাঁত আটকাইয়া সইয্য কইরা নিমু। যদি সইয্য করতে না পারি তাইলে এই গ্রাম ছাইড়া চইলা যাইমু। কিন্তু দহনের জ্বালা ক্যামনে সইমু, মাস্টার মশাই?”

আমার নিঠুর মনোহর পর্ব ২