আমার নিষ্ঠুর ভালবাসা পর্ব ৪২
সালমা খাতুন
আনজুমা বেগমের নীরব আত্মসমর্পণে সবাই হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। আয়ান উত্তেজিত হয়ে এগিয়ে এলো আরমানের কাছে।
আয়ান— “ভাইয়া!! ভাইয়া তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে। এটা! এটা কিছুতেই হতে পারে না। আম্মু কেনো এমন কাজ করবে?”
আরমান গম্ভীর গলায় বলল— “সেটা তো তোর আম্মুই ভালো জানবে আয়ান।”
এতোক্ষণে আনজুমা বেগমের হাতে হাতকড়া পড়ানো হয়ে গেছে। উনি তখনো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। নিশ্চুপ ভঙ্গিতে। আয়ান ওর আম্মুর কাছে গেলো, ওর আম্মুর হাতের দুই বাহু ধরে ঝাঁকিয়ে বলল, “ও আম্মু! তুমি কিছু বলছো না কেন? বলো না প্লিজ যে তুমি এমন কাজ করো নি।”
আনজুমা বেগমের অনুভূতি হীন গলায় বললেন— “আমি এটা করেছি আয়ান।”
আনজুমা বেগমের কথা টা শুনে আয়ান চমকে উঠে দুই পা পিছিয়ে গেলো। অবাক চোখে তাকালো ওর আম্মুর দিকে।
সামিরা ছুটে এলো আরমানের দিকে। দুই চোখ অশ্রুতে টইটম্বুর— “নাহ ভাইয়া! এটা হতে পারে না। কোথাও একটা ভুল হচ্ছে। ছোট আম্মু এমন কাজ করতে পারে না, ছোটো আম্মু তো ভাবী মনিকে নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসে।”
আরমান কিছু বললো না শুধু ইশারা দিলো আবিরের দিকে। আবির আগেই রুবিকে দিয়ে আরমানের ল্যাপটপ আনিয়ে রেখেছিল। সেটা নিয়েই আবির কিছু ঘাটাঘাটি করে একটা ফুটেজ বের করে চালিয়ে দিলো। যেখানে দেখা যাচ্ছে আনজুমা বেগম কিছু একটা মিশিয়ে দিচ্ছে দুধের সাথে। এই রকম অনেক ফুটেজ আছে একেক দিনের।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
রুবি কিছুটা আমতা আমতা করে বলল— “আসলে, ভাবী মনি প্রথমবার যখন অসুস্থ হয়ে পড়েছিল উনার বাবা মারা যাওয়ার পর, তখন উনাকে হসপিটাল থেকে আনার পর স্যার আমাকে অর্ডার দিয়েছিল ভাবী মনি কে যেনো প্রতিদিন দুধ নিজে দাড়িয়ে থেকে খাওয়াই। ছোট্ট আম্মুও জানতেন বিষয়টা, উনিই প্রতিদিন দুধ গরম করে দিতেন আমাই। আমি একদিন দেখেছিলাম ওই ওষুধ টা মিশাতে, ছোটো আম্মুকে জিজ্ঞাসা করলে উনি বলেন এই ওষুধ নাকি ডক্টর দিয়েছে ভাবী মনি কে খাওয়ানোর জন্য।”
বাড়ির সবাই মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। আরমানের বিয়ে উপলক্ষে আসা, ওদের কাছের আত্মীয় গুলো এখনো রয়ে গেছে। সবার জানামতে এই বাড়ির মধ্যে ছোটো আম্মুই সব থেকে বেশি মায়াকে ভালোবাসতো, আর উনিই এমন ক্ষতি করলেন মায়ার সেটা বিশ্বাসই করা যায় না।
একজন অফিসার বললেন, “উনার রুম টা একটু সার্চ করতাম। নিশ্চিত ওই ড্রাগস উনার রুমেই পাওয়া যাবে।”
কিছু জন সাই জানালো অফিসারের কথায়। আবির পুলিশ অফিসার গুলোকে নিয়ে গেলো আনজুমা বেগমের রুমে। পিছু পিছু বাড়ির মানুষ গুলোও গেলো কৌতূহল দমাতে না পেরে। আর সার্চ করতেই সেই ড্রাগস পাওয়া গেলো আনজুমা বেগমের বেডের পাশে রাখা টেবিলের ড্রয়ারে।
মিসেস সাবিনা বেগমের চোখেও পানি চলে আসলো, “যেই দিন থেকে তুই এই বাড়িতে বউ হয়ে এসেছিস, সেই দিন থেকে তোকে নিজের বোনের চোখে দেখেছি। এতো কিছুর পরও বিশ্বাস করতে পারছি না যে তুই এই কাজ করেছিস। প্লিজ সত্যি টা বল বোন আমার, কেনো করলি এমন?”
আনজুমা বেগম মুখ তুলে তাকালেন সাবিনা বেগমের দিকে। মুখে নেই কোনো অনুতাপের ছাপ। বললেন— “মায়া! যাকে আমরা আরমানের বিয়ের আগে চিনতামও না। সেই মায়ার নামে বাবা এই শাহরিয়ার পরিবারের সমস্ত সম্পত্তির ভাগ দিয়ে গেছে। ঠিক যতটা ভাগ আরমান, আয়ান, সামিরা পাবে ঠিক ততটা মায়াও পাবে। মারা যাওয়ার আগে এই উইল করে গেছেন উনি। তাহলে আমার ছেলের হবু বউ কি দোষ করলো? তার নামে কেনো সম্পত্তির ভাগ দেওয়া হলো না? উইল এ এটাও উল্লেখ আছে, আরমান যদি মায়াকে ডিভোর্স দেয় তাহলে আরমান এই বাড়ির সম্পত্তিতে কোনো ভাগ পাবে না। আর হ্যাঁ আমি জানতাম মায়াই সেই মেয়ে যাকে আরমান পাগলের মতো খুজে বেড়াচ্ছে। তাই চেয়েছি মায়া সব কিছু ভুলে যাক। আরমান যেনো মায়াকে কখনো না পাই। সবকিছু আমি করেছি, হ্যাঁ সবকিছু আমি আমি করেছি। নিজের স্বার্থের জন্য এই সবকিছু করেছি আমি। আরমান এই সম্পত্তির ভাগ না পেলে পুরো সম্পত্তি হবে আমার ছেলের, আর আমি চেয়েছিলাম মায়ার সাথে আয়ানের বিয়ে দিতে।”
কথা গুলো বলে শেষ করতেই, আয়ানের বাবা মানোয়ার সাহেব সজোরে একটা থাপ্পড় মারলেন মিসেস আনজুমা বেগমের গালে। তবুও উনি নির্জীব পাথরের মতো শক্ত হয়ে দাড়িয়ে আছে।
আনজুমা বেগমের কথা গুলো, ড্রয়িং রুমে থাকা প্রতিটা মানুষের কানে ঝঙ্কার তুললো যেনো। সামনের মানুষ টি যেনো আনজুমা বেগম নয়, উনার রুপে থাকা অন্য কেউ। সাবিনা বেগম ধপ করে বসে পড়লেন সোফায়। চোখে মুখে এখনো বিস্ময়। আর আয়ান সে নিশ্চুপ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে, মাথা নিচু করে।
মানোয়ার সাহেব— “জীবনে এই প্রথমবার তোমার গায়ে আঘাত দিলাম। বিশ্বাস করো একটুও খারাপ লাগছে না। তুমি এতোটা স্বার্থপর কবে হলে আনজুমা? তুমি তো এমন ছিলে না।”
আরমানের ফুপি বলে উঠলো, “সত্যি ভাবী, তোমার মনে এই ছিল? এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না। ছিঃ তোমার মন মানসিকতা যে এতোটা নিচু কখনো ভাবতেও পারিনি। আরে শুধু তো উইল করা আছে এখনো সম্পত্তি ভাগ হয়ে যাইনি, বললেই পারতে যে তোমার আয়ানের বউয়ের নামেও ভাগ লাগবে, তাহলেই তো হয়ে যেতো।”
আরমানের দূর সম্পর্কের এক চাচী বলে উঠলো, “ আরে আনোরা, তুমি বুঝতে পারছো না। ভাবী তো নিজের মুখেই বলল, উনি তো আরমানকে নিঃস্ব করতে চেয়েছিল। ভাবী তো চেয়েছিল আরমান আর মায়াকে আলাদা করতে, এতে আরমানের এই বাড়ির সমস্ত সম্পত্তি থেকে অধিকার উঠে যাবে।”
(আনোরা আরমানের ফুপির নাম। আনোয়ার আর মানায়োর শাহরিয়ার এর মেঝো বোন আনোরা শাহরিয়ার)
এইভাবে অনেকেই অনেক কিছু বলে আনজুমা বেগমকে কথা শুনাতে লাগলেন। কিন্তু উনি নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। উনার মুখে না আছে অনুশোচনার ছাপ আর না আছে কষ্টের ছাপ।
একজন অফিসার বলে উঠলেন— “মিস্টার শাহরিয়ার! অনুমতি দিলে আমরা উনাকে নিয়ে যেতাম। আমাদের দেরি হচ্ছে।”
কেউ কিছু বলার আগেই আনোয়ার সাহেব বলে উঠলেন, “নিয়ে যান, নিয়ে যান। প্লিজ তাড়াতাড়ি ওকে এখান থেকে নিয়ে যান। সহ্য হচ্ছে না আর, ওর মুখটাও দেখতে ইচ্ছে করছে না। যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব ওকে এখান থেকে নিয়ে যান, আর চেষ্টা করবেন যেনো অনেক কঠিন শাস্তি হয়।”
উনার কন্ঠে ছিল এক অজানা কষ্ট। মুখে রাগ থাকলেও চোখে ছিল পানি। আর সেই পানি আড়াল করতে উনি আর এখানে দাঁড়ালেন না। নিজের ঘরে চলে গেলেন।
অফিসার তাকালো আরমানের দিকে, আরমান তার চোখের ভাষায় অনুমতি দিলো। অফিসার ও মেয়ে কনস্টেবল টিকে আদেশ দিলেন আনজুমা বেগম কে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কনস্টেবল টি উনার এক হাত ধরে এগিয়ে গেলো, উনিও কনস্টেবল টির সাথে পা মিলিয়ে এগিয়ে গেলেন নির্দ্বিধায়। এরপর বাড়ির মেন দরজাটার কাছে গিয়ে উনি হঠাৎই থেমে গেলেন। পিছনে ঘাড় ঘুরিয়ে এক বার পুরো বাড়ি এবং বাড়ির মানুষ গুলো কে দেখে নিলেন, কেউ অসহায় চোখে তাকিয়ে তো কেউ ঘৃণার চোখে। এতোক্ষণে উনার দুই চোখ দিয়ে দুই ফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো। সেই চোখের পানি লুকাতে উনি তাড়াহুড়ো করে সামনে ফিরে হাঁটা ধরলেন।
আবির আরমানের হুইল চেয়ার ঠেলে এগিয়ে গেলো লিফটের দিকে। শাহরিয়ার ম্যানশনে লিফটের ব্যাবস্থাও আছে, তাই আরমানের কোনো অসুবিধা হবে না উপরে নিজের রুমে যেতে।
আবির আরমানকে নিয়ে দোতলায় একটা রুমের সামনে দাঁড়ালো। রুমের দরজাটা হালকা ভেড়ানো ছিল, রুবি সেটা ধীরে ধীরে খুলল, নিঃশব্দে। আর আবির আরমানকে নিয়ে প্রবেশ করলো সেই রুমে। আর সামনের দৃশ্য দেখে আরমানের বুকের ভিতরটা মুচড়ে উঠলো। মনে হচ্ছে ওর হৃদয়ে কেউ যেনো আগুন ধরিয়ে দিয়েছে, আর সেই আগুনে জ্বলে পুড়ে ছাই হচ্ছে ওর হৃদয়।
মায়া শুয়ে আছে ফ্লোরে, হাত পা গুটিয়ে। চুল গুলো এলে মেলো। পরনের জামাটা কিছু জায়গায় ছেঁড়া। শরীরে কিছু জায়গায় আঘাতের দাগ।
আরমানের মাথা ঘুরে উঠলো যেনো মায়ার অবস্থা দেখে। আরমান কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “আ..আমার মায়ার এ..এই অবস্থা কেনো? তোরা ওর খেয়াল রাখিসনি? আঘাত করেছিস তোরা আমার মায়াবতীর শরীরে?”
শেষের কথটা রাগী কন্ঠে জিজ্ঞেসা করলো আরমান।
তৎক্ষণাৎ সামিরা বলে উঠলো, “না ভাইয়া তোমার বুঝতে ভুল হচ্ছে। মাঝে মাঝে ভাবী মনি চিৎকার করে, নিজেকে নিজেই আঘাত করে, আর আজ সকালেই আমি আর রুবি আপু ভাবী মনির জামা টাও পাল্টিয়ে দিয়েছিলাম, ভাবী মনি নিজেই আবার জামাটা ছিঁড়েছে। আর আমরা ভাবী মনিকে বিছানাতেই শুয়েই দিয়ে গিয়েছিলাম।”
সবার গলার আওয়াজে মায়া চমকে উঠলো। ধরফর করে উঠে বসে দেওয়ালের এক কোণে গিয়ে লেগে গেলো। মুখ লুকালো হাঁটুর ভাঁজে।
এই দৃশ্য দেখে আরমানের বুকের ভিতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। ওর মায়াবতী ওকে দেখে ভয় পাচ্ছে। এটা ওর একদমই সহ্য হচ্ছে না।
মায়া ভয়ে ভয়ে মুখ তুলে একবার করে সবার দিকে তাকাচ্ছে, তারপর আবার মুখ লুকাচ্ছে। আরমান নিজেই ওর হুইল চেয়ার এর চাকাটা এক হাত দিয়ে ঘুরিয়ে এগিয়ে গেলো মায়ার কাছে। তারপর ওর কাঁপা কাঁপা হাতটা রাখলো মায়ার মাথার উপর। আর সাথে সাথে মায়া আরমানের হাত টা ঝটকা দিয়ে ফেলে দিলো।
আরমান নিচু কন্ঠে অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করলো, “মায়াবতী!”
আরমানের কথাটা হয়তো মায়ার কানে গেলো। ও আরমানের দিকে মুখ তুলে তাকালো। মায়াও বিড়বিড় করে উচ্চারণ করলো, “মায়াবতী।”
আরমান অবাক হলো, ওর উচ্চারণ করা শব্দ মায়াও উচ্চারণ করলো এটা শুনে। সামিরা এগিয়ে এলো ওদের দিকে। বলল— “ভাবী মনি মাঝে মাঝেই একদম একটা স্বাভাবিক মানুষের মতো আচরণ করে। আবার হঠাৎ করেই ভীষণ অস্বাভাবিক আচারণ করে। নিজের চুল দুই হাতে খামচে ধরে, নিজেকে আঘাত করে। কিন্তু কখনো অন্য কাউকে আঘাত করে না। স্বাভাবিক আচরণ করার পর আবার সেই ঘটনা গুলো ভুলেও যাই। মনে রাখতে পারে না কিছু।”
আরমান তাকালো আবিরের দিকে। আবির বুঝে গেলো আরমানের মনের কথা। আবির বলল, “ডক্টর ক্যামেলিয়া ডিসুজা হয়তো আর কিছুক্ষনের মধ্যেই পৌঁছে যাবেন। অনেক কষ্টে রাজি করিয়েছি উনাকে। উনি স্পেশালি মায়ার জন্যই এই দেশে আসছেন, নিজের সমস্ত সিডিউল চেঞ্জ করে।”
মিসেস সাবিনা বেগম এগিয়ে এলেন মায়ার দিকে। উনি মায়ার গায়ে থাকা ওরনাটা নিয়ে ভালো করে জড়িয়ে দিলেন। তারপর বললেন, “ আম্মু! উঠো, চলো।”
মায়া ফ্যালফ্যাল চোখে চাইলো উনার দিকে। বোকার মতো তাকিয়ে থেকে প্রশ্ন করলো, “কোথায় যাবো?”
সাবিনা বেগম— “ওয়াশরুমে আম্মু। জামাটা পাল্টাতে হবে তো, দেখো এগুলো ছিঁড়ে গেছে।”
মায়া আবারও বোকা বোকা গলায় প্রশ্ন করলো, “কিভাবে ছিঁড়ল?”
সাবিনা বেগম মিথ্যা রাগ দেখিয়ে পাশে থাকা সামিরাকে মারতে মারতে বলল, “এই যে, এই দুষ্টু মেয়েটাই ছিঁড়ে দিয়েছে।”
সামিরাও ওর মমের সাথে সাই দিয়ে মিথ্যা অভিনয় করলো। “আহ! মম লাগছে তো। উফ! ব্যাথা পাচ্ছি আমি।”
মায়া সামিরাকে মারতে দেখে খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো, “হ্যাঁ ও দুষ্টু। আম্মু ও দুষ্টু।”
সাবিনা বেগম থমকে গেলেন, মায়ার মুখে আম্মু ডাক শুনে। সেই সাথে রুমে থাকা সবাইও অবাক হলো। সবাই মায়ার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। আর মায়া সে তো নিজের মনে হেসে যাচ্ছে।
সাবিনা বেগম— “তুমি আমাই আম্মু ডাকলে মায়া?”
নাহ মায়া যেনো উনার কথা শুনতেই পেলো না। মায়াতো নিজের দুনিয়ায় ব্যাস্ত। এদিকে সাবিনা বেগমের চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়লো। মনে পড়ে গেলো সেই দিন গুলোর কথা, উনি কতই না খারাপ ব্যাবহার করেছিলেন এই মেয়েটার সাথে। আর মায়া সব মুখ বুজে সহ্য করেছে। উনি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছেন, অনেক বার মাফ চেয়েছে মায়ার থেকে। কিন্তু উনি হয়তো ক্ষমার অযোগ্য, তাই তো ভাগ্যের এই নিষ্ঠুর খেলায় মায়া বুঝেইনি, মাফ চাওয়া, মাফ করা, এগুলো কাকে বলে। সৃষ্টিকর্তা ওদের মা ছেলেকে মায়ার থেকে ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ টাই দিলো না। মায়া এখন এক অবুঝ বাচ্চার মতো। আর এই মেয়েটাই হচ্ছে আরমানের প্রাণ ভোমরা।
হঠাৎই করেই পাল্টে গেছে সাবিনা বেগম। সবাই উনার এমন পরিবর্তনে ভীষণ অবাক, সেই সাথে খুশিও। মায়ার সাথে উনি এখন নিজের মেয়ের মতোই ব্যবহার করে। এই দুই দিন উনি নিজ দায়িত্বে মায়ার সমস্ত খেয়াল রেখেছে। মায়ার দুই হাত ধরে চোখের পানি ফেলে অনেক বার ক্ষমা চেয়েছে ওর থেকে, নিজের করা ভুল গুলোর জন্য। কিন্তু অবুঝ মায়া কিচ্ছু বুঝেনি। শুধু ফ্যালফ্যাল চোখে চেয়ে থেকেছে উনার দিকে।
সাবিনা বেগম নিজের চোখের পানি মুছে বললেন, “আবির! যাও আরমানকে ওর রুমে নিয়ে যাও। ওকে ফ্রেস হতে সাহায্য করো। আমি মায়াকে ফ্রেশ করিয়ে দিই, তারপর দুজনকেই খেতে দেবো। আর আরমানের জন্য রাখা নার্স ও চলে আসবে এতোক্ষণে।”
আরমান বিরক্ত গলায় বলল, “নো মম। আমার কোনো নার্স লাগবে না। আবির আছে, রুবি আছে, তোমারা তো সবাই আছো। আমার এমনিতেই ভালো লাগে না নিজের রুমে অন্য কারো উপস্থিতি।”
সাবিনা বেগম বললেন, “কিন্তু আব্বু! তোমাকে তো বুঝতে হবে, তুমি এখন স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। তুমি অসুস্থ।”
আরমান বিরক্ত গলায় বলল, “তবুও মম, আমার কোনো নার্স লাগবে না। আবির আমি যেনো ওই নার্স টার্স আমার রুমে না দেখি।”
হঠাৎ করেই মায়া নিজেকে সাবিনা বেগমের পিছনে লুকিয়ে নিলো। তারপর উঁকি দিয়ে তাকালো আরমানের দিকে। সবাই বুঝলো মায়া হয়তো আরমানকে দেখে ভয় পাচ্ছে। মিসেস সাবিনা বেগম মায়াকে ধরে বলল, “চলো আম্মু।”
মিসেস সাবিনা বেগম মায়াকে নিয়ে এগিয়ে গেলেন ওয়াশরুমের দিকে। মায়া যেতে যেতে একবার করে ভয়ে ভয়ে তাকাচ্ছে আরমানের দিকে।
তা দেখে আরমানের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। কিন্তু হাসিটা খুশির ছিল না ছিল দুঃখে কষ্টে ভরা।
সময়টা সন্ধ্যার দিকে…
আরমান ওর রুমের ব্যালকনিতে বসে আছে। ব্যালকনিটা অন্ধকারে আবৃত। ঠিক যেমন আরমানের জীবনটা।
পাশের রুম থেকে মায়ার আর্তনাদ ভেসে আসছে। পাগলের মতো চিৎকার করছে মায়া। সামিরা, রুবি, সাবিনা বেগম সবাই চেষ্টা করছে মায়াকে শান্ত করার।
আরমান আজ সবকিছু পেয়েও হারালো যেনো। আরমানের চোখে অশ্রু, হ্যাঁ! এই শক্ত পোক্ত গম্ভীর কাঠখোট্টা মানুষটার চোখ এখন যখন তখন ভিজে উঠে। কিছুতেই বাঁধ মানতে চাই না। নিজের এই পরিবর্তনে তাচ্ছিল্য হাসে আরমান, নিজের উপরেই। মনে পড়ে যাই সেই আগে মায়ার সাথে করা খারাপ ব্যাবহার গুলো, ওকে দেওয়া কষ্ট গুলো। কিন্তু ওই বা কি করবে? ও যে নিজের অনুভূতি কিভাবে প্রকাশ করতে হয় জানত না। শুধু মনে হতো, মায়া ওর। মায়ার উপর শুধু ওর অধিকার। আর তাই তো সব সময় শুধু মায়ার উপরে জোড় খাটাতো।
ডক্টর ক্যামেলিয়া ডিসুজা, একজন বিখ্যাত নিউরোলজিস্ট। উনি এসে মায়ার চেকআপ করে গেছে, অনেক গুলো টেস্ট করাতে দিয়েছে। কাল মায়াকে নিয়ে যাওয়া হবে টেস্টের জন্য। মায়ার এই আর্তনাদের কারণ ওর প্রচন্ড মাথা ব্যাথা করছে, আর সেটা ও সহ্য করতে না পেরে নিজেই নিজেকে আঘাত করছে, পাগলের মতো ব্যাবহার করছে।
মায়ার রুমে…
মায়া ওর মাথার দুই পাশের চুল খামচে ধরে চিৎকার করছে। মাঝে ছুটে যাচ্ছে দেওয়ালের কাছে, মাথা ঠুকার জন্য। সামিরা, রুবি ছুটে গিয়ে মায়াকে আটকাচ্ছে। মায়া ওদেরকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিচ্ছে। মায়ার গলা থেকে বেরিয়ে আসছে, কষ্টে ভরা এক আর্তনাদ। সাবিনা বেগম, সামিরা রুবি সবাই চেষ্টা করছে মায়াকে শান্ত করার। কিন্তু কিছুতেই শান্ত হচ্ছে না মায়া। আরমান নিজের রুমের ব্যালকনিতে বসে শুনতে পাচ্ছে মায়ার এই কষ্টে ভরা আর্তনাদ। মায়ার প্রতিটা চিৎকার যেনো আরমানের হৃদয়ে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে।
হঠাৎ মায়ার চিৎকার থেমে গেলো। ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে গেলো ও। ওর রুমে একটা গানের আওয়াজ ভেসে আসছে, খোলা ব্যালকনি হয়ে। এক ব্যার্থ প্রেমিকের মনের হাহাকার, যেনো গানের মধ্যে নিজের কষ্ট প্রকাশ করতে চাইছে—
(গান)
ওরে পোড়া মন, ওরে পোড়া মন
পুড়ে পুড়ে যায় যখন তখন।
ওরে পোড়া মন, ওরে পোড়া মন
জ্বলে পুড়ে ছাই নিজের মতন।
তোকে ছাড়া চলে না, রাতে রাত ঢলে না,
কোনো কথা বলে না এ মন।
আমায় ডুবাইলি রে আমায় ভাসাইলি রে
অকুল দরিয়ার মাঝে কুল নাই রে।
আমায় ডুবাইলি রে আমায় ভাসাইলি রে
অকুল দরিয়ার মাঝে কুল নাই রে।
মন রে, মন রে, মন রে, মন রে,
মায়া হঠাৎ পাগলের মতো পুরো রুমে ছুটে বেড়াচ্ছে। যেনো খুঁজে বেড়াচ্ছে আওয়াজ টা কোথা থেকে আসছে। সামিরা ওর কাঁধে হাত রাখলো, মায়া থেমে গেলো। এরপর সামিরা মায়ার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো আরমানের রুমে। তারপর ব্যালকনির কাছে গিয়ে ওর হাতটা ছেড়ে দিলো।
মায়া এখন স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে সেই গানের আওয়াজ। আরমান খালি গলায় গাইছে সেই গান। ব্যালকনির হালকা ড্রিম লাইট টা জ্বালিয়ে দিলো সামিরা। আর সেই আলোতেই মায়া দেখতে পাচ্ছে আরমান শুয়ে আধ শোয়া হয়ে শুয়ে আছে কাউচে, ভাঙ্গা পা টা মেলে দিয়ে।
(গান)
সে রোদের আসমানী নীলে,
বেসামাল তুমিও তো ছিলে।
তোকে ছাড়া চলে না, রাতে রাত ঢলে না,
কোনো কথা বলে না এ মন।
আমায় ডুবাইলি রে আমায় ভাসাইলি রে
অকুল দরিয়ার মাঝে কুল নাই রে।
আমায় ডুবাইলি রে আমায় ভাসাইলি রে
অকুল দরিয়ার মাঝে কুল নাই রে।
মায়া ধীরে পায়ে এগিয়ে গেলো আরমানের দিকে। তারপর একদম আরমানের গা ঘেঁষে বসে পড়লো ফ্লোরেই, কুঁকড়ি হয়ে। কিন্তু আরমান ওর ভালো হাতটা দিয়ে মায়াকে উঠালো গাইতে গাইতেই। তারপর নিজের ভালো পায়ের উরুর উপর বসিয়ে নিলো মায়াকে। ওই পা টা না ভাঙলেও আঘাত লেগেছে, তাই কিছুটা ব্যাথাও অনুভব করলো। কিন্তু এই ব্যাথাই ওর কিচ্ছু যায় আসে না।
ও মায়াকে নিজের কোলে বসিয়ে, এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে, মায়াকে নিজের বুকে চেপে ধরে হেলিয়ে শুয়ে পড়লো কাউচের উপর।
মায়াও আদুরে বিড়াল ছানার মতো আরমানের বুকে লেপ্টে রইলো।
(গান)
সে ঘুমের অতল গভীরে,
আমি চাই তুমি এসো ফিরে ফিরে।
ও.. তোকে ছাড়া চলে না, রাতে রাত ঢলে না
কোনো কথা বলে না এ মন।
আমায় ডুবাইলি রে আমায় ভাসাইলি রে
অকুল দরিয়ার মাঝে কুল নাই রে।
আমায় ডুবাইলি রে আমায় ভাসাইলি রে
অকুল দরিয়ার মাঝে কুল নাই রে…
আরমানের চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়লো। মায়ার মাথায় ঠোঁট ছুঁইয়ে স্নেহের পরশ দিলো। মায়া ঘুমিয়ে পড়েছে। একটা অবুঝ শিশুর ন্যায় আরমানের বুকের সাথে লেপ্টে শুয়ে আছে। আরমানের চোখে পানি থাকলেও হৃদয়ে প্রশান্তি।
আমার নিষ্ঠুর ভালবাসা পর্ব ৪১
মায়ার শরীরের পুরো ভর এখন আরমানের উপর। আরমানের আঘাতে ভর্তি শরীরে কষ্ট হলেও, আরমানের কাছে এই কষ্টই যেনো সুখের।
দূর থেকে এই দৃশ্য দেখলেন সাবিনা বেগম ও সামিরা। ওদের চোখেও পানি। সামিরা জড়িয়ে ধরলো ওর মাকে। সাবিনা বেগমও মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন। নিজের চোখে পানি মুছে নিলেন। তারপর মেয়ের চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে, রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন মা মেয়ে।