আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ২৬

আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ২৬
লেখনীতে সালমা চৌধুরী

আবির মেঘের কাছে এসে শান্ত স্বরে বললো,
“তানভিরের আজকে কাজ আছে৷ কালকে পরীক্ষা দিয়ে তোর তা*ড় ছিঁ*ড়া বান্ধবীটাকে নিয়ে রিক্সা করে এখানে চলে আসিস৷ এখন চল । ”
মেঘ জিজ্ঞাসু চোখে চেয়ে শুধালো,
“কোথায়?”

আবির তাকাতেই মেঘ মাথা নিচু করে ফেললো৷ বুঝতে পারলো কথায় কথায় প্রশ্ন করাতে আবির ভাই রে*গে গেছেন। মেঘ লক্ষী মেয়ের মতো বাইকের পেছনে বসে আছে । ঘন্টাখানেক মেঘকে নিয়ে বাইকে ঘুরেছে, ফুচকা, আইসক্রিম থেকে শুরু করে যে যে স্ট্রিটফুড পেয়েছে, মেঘের পছন্দ মতো সবই কিনে খাইয়েছে আবির।
বিকেলের পর থেকে আবহাওয়া খা*রাপ হতে শুরু করেছে। পর্যায়ক্রমে মেঘের গ*র্জন শুরু হয়ে গেছে৷
মেঘ তখন আচার খেতে ব্যস্ত। আবির মেঘের দিকে চেয়ে উদ্বিগ্ন কন্ঠে শুধালো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“বৃষ্টি শুরু হয়ে যাবে তো। বাসায় যাবি না?”
মেঘ আচার খেতে খেতে আবির ভাইয়ের অভিমুখে চেয়ে আহ্লাদী কন্ঠে বলে উঠলো,
“বৃষ্টিতে ভিজতে খুব ইচ্ছে করছে । ”
আবির কপাল কুঁচকে চেয়ে আছে, অপলক সেই দৃষ্টি ।
মেঘ মনে মনে বলছে,

“এই গোধূলি আলোতে আপনার হাতে হাত রেখে বৃষ্টিতে ভিজতে চাই। বৃষ্টির প্রতিটা ফোঁটাকে চিৎকার করে বলতে চাই,
এই মানুষটাকে আমি বড্ড বেশি ভালোবাসি। আমার কল্পনার জগতে আবির ভাই শুধুই আমার। ”
আবির কপাল কুঁচকে তাকিয়ে থেকেই শক্ত কন্ঠে বললো,

“বৃষ্টিতে ভিজে নিজের কি হাল করছিলি মনে নেই?”
মেঘ একগাল হেসে উত্তর দিলো,
“এবার আর এমন হবে না। কারণ আপনি……”
আবির গম্ভীর কন্ঠে প্রশ্ন করলো,
“আমি কি?”
মেঘ মাথা নিচু করে মুচকি হেসে বললো,
” কিছু না। ”

ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পরা শুরু হয়ে গেছে। আবির আশপাশ দেখছে। মেঘ হাত থেকে ঘড়ি খুলে ব্যাগে রেখে আবির ভাইকে ব্যাগটা দিয়ে বলল,
” আবির ভাই, ব্যাগ টাকে রেইনকোট দিয়ে ঢেকে রাখবেন, প্লিজ৷ ”
মেঘের কথায় আবির নির্বোধের ন্যায় মেঘের দিকে চেয়ে ঠোঁটের কোণে হাসি রেখে বললো,
“রেইনকোট পড়া দরকার তোর আর তুই তোর ব্যাগকে রেইনকোট পড়াতে বলছিস! ”
মেঘ হাসিমুখে বললো,

” বই খাতা ভিজলে তো পড়তে পারবো না। আমি ভিজলে তো সমস্যা…. ”
এতটুকু বলতেই আবিরের চোখে চোখ পরলো মেঘের। আবির তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে, মেঘ আস্তে করে বললো,
“নেই..!”
আবির কন্ঠ দ্বিগুণ ভারি করে জানালো,
“ভিজতেছিস ভিজ, জ্ব*র যদি হয় তাহলে তোর খ*বর আছে বলে দিলাম৷ সমস্যা আছে কি নেই সেটা তখন বুঝাবো৷ ”

মেঘ বিড়বিড় করে বললো,
“আগে আপনার সাথে বৃষ্টি উপভোগ করে নেয়
তারপর প্রয়োজনে জ্বর – সর্দি উপভোগ করে নেব৷ ”
বৃষ্টি বাড়তে শুরু করেছে, মানুষ ছোটাছুটি করছে। আবির আর মেঘ দাঁড়িয়ে মানুষের ছোটাছুটি দেখছে, একসময় বারিবর্ষণ শুরু হয়েছে। দুজনের সর্বাঙ্গ ভিজে একাকার অবস্থা।কিন্তু কেউ যেনো একচুল নড়ছে না। মেঘ আকাশের পানে মুখ করে চোখ বন্ধ করে বৃষ্টি উপভোগ করছে, আর আবির সেই মায়াবী মুখের অভিমুখে নে*শাক্ত চোখে চেয়ে আছে ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসির ঝলক।

মেঘ আকাশের পানে চেয়ে, মনে মনে কতকিছু চেয়ে ফেলেছে তা আবিরের অজানা ৷ মেঘের খুব ইচ্ছে করছে আবির ভাইয়ের হাতে হাত রেখে বৃষ্টিতে হাঁটার৷ কিন্তু আবির ভাইয়ের হাত ধরার সাহস তো ছোট্ট অষ্টাদশীর এখনও হয় নি। তারপর ভাবলো, পাশাপাশি হাঁটতে পারলেই মনে শান্তি লাগবে।
মেঘ কিছু সময় পর স্বাভাবিক হয়েছে, তৎক্ষনাৎ আবির দৃষ্টি সরিয়ে কিছুটা নড়েচড়ে উঠলো৷
মেঘ আবিরের দিকে চেয়ে আহ্লাদী কন্ঠে বললো,

” চলুন না, হাঁটি । ”
মেঘের কথা শুনে আবির সহসা দু কদম এগিয়েছে, মেঘ তখনও আগের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছে৷ আবির নিজের বামহাত বাড়িয়ে বললো,
“হাতটা ধর নাহয় কখন আবার বৃষ্টিতে পা পিছলে পড়ে যাবি। ”
কথাটা বলতে দেরি হয়েছে, কিন্তু আবিরের হাত খপ করে ধরতে এক সেকেন্ড দেড়ি করে নি মেঘ। এমনভাবে হাত আঁকড়ে ধরা দেখে আবির সামনের দিকে চেয়ে মুচকি হাসলো।

অষ্টাদশী তো জানে না এই আবিরের মনে, অষ্টাদশীর চেয়েও হাজার গুণ বেশি প্রেমানুভূতি সর্বক্ষণ বিচরণ করে৷ ২৪ ঘন্টা আবিরের মাথায় শুধু মেঘই ঘুরপাক খায় । অষ্টাদশী কি ভাবে! কি চাই!
সবই আবির বুঝতে পারে। তবে কিছু প্রকাশ করে, কিছু অপ্রকাশিত রাখে।

রাজপুত্র আর রাজকন্যা হাতে হাত রেখে পাশাপাশি হাঁটছে। আবিরের দৃষ্টি সামনের দিকে থাকলেও, মেঘের সম্পূর্ণ দৃষ্টি আবিরে নিবন্ধ । ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা হাসি যেনো সরছেই না বরং ক্রমে ক্রমে বেড়েই যাচ্ছে৷ মেঘের বুকের ভেতরে থাকা সুপ্ত ভালোবাসা গুলো কোনো বাঁধা মানতে চাইছে না। এই বৃষ্টিসিক্ত গোধূলিতে প্রকৃতিকে সাক্ষী রেখে বলতে ইচ্ছে করছে,

“এই মানুষ টাকে আমার চাই৷ সম্পূর্ণ আমার করে পেতে চাই৷ ”
মেঘ হাবিজাবি ভাবতে ভাবতেই অকস্মাৎ রাস্তার পাশে থাকা গাছের শেকড়ের সাথে হোঁচট খেয়ে উপুড় হয়ে পড়তে গেলে, আবিরের বাম হাতে থাকা মেঘের হাতটা আবির শক্ত করে ধরে, সহসা ডান হাতে মেঘের পেট বরাবর আঁকড়ে ধরলো ৷ কয়েক সেকেন্ডের জন্য মেঘের মনে হয়েছিল পৃথিবীটা বুঝি থমকে গেছে।

আচমকা হোঁচট খাওয়ায় মেঘের স্বাভাবিক হতে কিছুটা সময় লেগেছে। নিজের উদরে আবির ভাইয়ের শক্তপোক্ত হাতের ছোঁয়া বুঝতে পেরে মেঘ বিষ্ময় চোখে উদরে রাখা হাতের দিকে চাইলো। বৃষ্টিতে ভিজে পড়নের সুতি জামাটা আগে থেকেই গায়ের সাথে মিশে ছিল৷ আবির ভাই জামার উপর দিয়ে ছোঁয়ার পরও, মেঘের মনে হচ্ছে উ*ন্মুক্ত উ*দরে হাত রেখেছে আবির ভাই। মেঘের সর্বা*ঙ্গ শিহরিত হলো, বুকের ভেতরে থাকা হৃ*দপি*ণ্ডটা বাহিরে বেড়িয়ে আসতে চাইছে,মেঘের নিঃশ্বাস গলায় আটকে যাচ্ছে । হোঁচটের ফলে পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলের কোণা উঠে র*ক্ত বের হচ্ছে, স্না*য়ুত*ন্ত্রে ক্রমাগত সি*গনাল দেয়ার ফলে মেঘ বুঝতে পেরে “উফফ” করে উঠলো।

নিজেকে কন্ট্রোল করে মেঘ দাঁড়িয়ে পায়ের দিয়ে চাওয়ার আগেই ব্য*থা বুঝতে পেরে ঠোঁট ফুলিয়ে কান্না শুরু করে দিয়েছে। আবির সঙ্গে সঙ্গে বসে পরলো আঙুল টা দেখতে, র*ক্ত যা বের হচ্ছে সবই বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে চলে যাচ্ছে। পকেট থেকে একটা ওয়ানটাইম ব্যা*ন্ডেজ বের করে আপাতত আঙুলে পেঁচিয়ে দিলো। আবিরের ছোঁয়াতে পায়ের ব্যথা সারলো কি না কে জানে, মেঘের মনের ব্যথা যেন এক সেকেন্ডেই সেরে গেছে। মেঘ বাকরুদ্ধ হয়ে চেয়ে আছে, তার চোখ দিয়ে শুধু পানি পরছে। আবির দাঁড়িয়ে দুহাতের উল্টো পিঠ দিয়ে,মেঘ গাল বেয়ে পড়া চোখের পানি তার সাথের বৃষ্টির পানি মুছে দেয়ার চেষ্টা করলো।

তারপর আবির তপ্ত স্বরে বললো,
“এত সামান্য ব্যথায় এভাবে কাঁদলে হবে?”
তৎক্ষণাৎ মেঘের ফুঁপানোও বন্ধ হয়ে গেছে। মেঘ কিছু বলার আগেই, আবির আচমকা মেঘকে কোলে তুলে নিলো৷ মেঘের চোখ কোটর ছেড়ে বেড়িয়ে আসতে চাইছে, নিজেকে সামলাতে সহসা একহাতে আবিরের শার্টের বোতামসহ কিছুটা অংশ চেপে চোখ বন্ধ করে ফেলছে। রাস্তার দুপাশে বড় বড় গাছ, বৃষ্টিতে ভেজা পিচঢালা রাস্তায় মেঘকে কোলে নিয়ে আবির হাঁটছে । কিছুটা সময় পর মেঘ চোখ খুলে, বৃহৎ চোখে আবিরের শ্যামবর্ণের চেহারায় চেয়ে আছে, আবিরের চুলে, নাকে,মুখে গালে পড়া বৃষ্টির ফোঁটার কিছুটা মেঘের মুখেও ছিটকে পরছে।
মেঘ ধীর কন্ঠে বললো,

“নামিয়ে দেন, আমি যেতে পারবো। ”
আবির ভাইয়ের এভাবে কোলে তুলে নেয়াতে মেঘের সর্বা*ঙ্গে কা*রে*ন্টের শ*ক খেয়েছে। এই মানুষটা কাছাকাছি আসলেই যেখানে মেঘের হৃ*দপি*ণ্ডের ধুকপুকানি বেড়ে যায়, সেখানে এভাবে কোলে তুলাতে তার সবকিছু যেনো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। তাই মন না চাইতেও আবিরকে বললো, নামিয়ে দিতে।
আবির নিরেট কন্ঠে বললো,

” চুপ করে থাক। ”
মেঘ নিশ্চুপ হয়ে আবির ভাইকে দেখছে। ধ*মক খেয়ে মন খারাপ হওয়ার বদলে তার ঠোঁটে মিষ্টি হাসি লেগে আছে। কিছুদূর যাওয়ার পর, একটা চায়ের দোকানের কাছে গিয়ে, পিচ্চি ছেলেকে ডেকে বললো চেয়ার দিতে, খোলা আকাশের নিচে ছেলেটা চেয়ার দিলো, আবির মেঘকে বসাতেই মেঘ বলল,
“আপনি তখন না ধরলে পড়ে নিশ্চিত আমার মা*থা ফা*টতো। ”
আবির শক্ত কন্ঠে জবাব দিলো,

“এত সহজে তোর কিছু হতে দিব না,
পরিস্থিতি যতই বেসামাল হোক,
আমি ঠিকই তোকে সামলে রাখবো।”
এই কথা শুনে মেঘ বিস্ময় চোখে আবির ভাইয়ের পানে চেয়েছে। কথার গভীরতা ঠিক কতটা, সেটা বুঝতে না পারলেও, কথাটা তার খুব মনে ধরেছে। বৃষ্টি কিছুটা কমে এসেছে, আবির শান্ত কন্ঠে বললো,
“চা খাবি?”

মেঘ ঘাড় কাথ করে সম্মতি দিলো। বেশিকরে আদা কুচি দিয়ে দু-কাপ লিকার চা নিয়ে আসছে। এককাপ মেঘকে দিয়ে আবির কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছে।
মেঘ চা খাওয়ায় মনোযোগ দিলো, বৃষ্টিতে বসে এভাবে চা খাওয়া এটায় জীবনে প্রথমবার । বৃষ্টির ছোট ছোট ফোঁটা চায়ে পরছে আর মেঘ আপন মনে চা খাচ্ছে ।
হঠাৎ মেঘের অভিমুখে আবির কেমন করে চাইলো, আবির মিহি কন্ঠে ডাকল,

“মেঘ!”
আচমকা আবির ভাইয়ের সুমধুর কন্ঠে নিজের নাম শুনে মেঘ বরফের ন্যায় জমে গেলো। আবিরের তপ্ত দৃষ্টি মেঘের হৃ*দপি*ণ্ডে ক্রমাগত ছু*রি চালাচ্ছে, এই বুঝি ছোট্ট অষ্টাদশীর প্রা*ণ টা দে*হ ছে*ড়ে বেড়িয়ে যাবে। মেঘ কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে জবাব দিল,

“জ্বি…!”
আবির তখনও শীতল চাউনিতে মেঘের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কয়েক সেকেন্ড পর প্রগাঢ় কন্ঠে শুধালো,
“যদি কখনো এমন হয়, তোর জীবনের সবচেয়ে প্রিয় দুটা জিনিস থেকে যেকোনো একটাকে বেছে নিতে বলা হয়। তখন তুই কি করবি?”

আবির ভাইয়ের বলা এত কঠিন কথার মানে মেঘ বুঝতে পারছে না। কপাল গুজিয়ে আবির ভাইয়ের দিকে চেয়ে কথাটা বুঝার চেষ্টা করছে। আবির কন্ঠ খাদে নামিয়ে পুনরায় প্রশ্ন করল,
“পারবি তো একটাকে বেছে নিতে? ”

মেঘ নির্লিপ্ত চোখে তাকিয়ে আছে। মেঘের মাথায় হাজারটা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। আবির ভাই তাকে এমন করে কেনো জিজ্ঞেস করছে, ওনি কোথাও গেলে তো আমার পছন্দের সবজিনিস না চাইতেও নিয়ে নেন, বেছে নিতে দেন না। তাহলে কি এমন জিনিস যা একটায় বেছে নিতে হবে। মেঘের নিরুত্তর পরিস্থিতি দেখে আবির মনে মনে বললো,
” যেদিন তুই দুটা প্রিয় জিনিস থেকে একটা বেছে নিতে পারবি, মন শক্ত করে বলতে পারবি এটায় আমার লাগবে, সেদিন তোকে এই প্রশ্ন টা দ্বিতীয় বার করবো। ”

আবির গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,
“বাদ দে এসব। আরেক কাপ চা দিতে বলছি তুই চা খা। আমি বাইক টা নিয়ে আসি। ”
আবির আশপাশ দেখে। চায়ের টাকা দিয়ে আরেক কাপ চা দিতে বলে বাইক আনতে চলে গেছে। ডাক্তার দেখিয়ে ঔষধ নিয়ে মেঘকে বাসার সামনে নামিয়ে দিলো।
বরাবরের মতো মেঘ আজও প্রশ্ন করলো,

“বাসায় আসবেন না?”
আবির মৃদু হেসে উত্তর দিলো,
“আসবো একটু পর। তুই সাবধানে রুমে যাস, আঙ্গুলে চাপ যেন না পরে। ”
মেঘ ধীর পায়ে হেঁটে বাড়িতে ঢুকে গেলো। আবির চলে গেলো অজানা গন্তব্যে।

আজ মেঘ ইচ্ছে করেই একটু সাজুগুজু করছে। চোখে গাঢ় করে কাজল দিলো, হালকা গোলাপি রঙের রঞ্জক লাগিয়েছে ঠোঁটে। আবির ভাইয়ের পছন্দের রঙ অনুসরণ করে একটা সাদা রঙের ড্রেস পরেছে সাথে সুন্দর হিজাবও পরে নিয়েছে। হুটহাট আবির ভাই কোচিং এর সামনে চলে আসে বিধায় সে সাদামাটায় ঘুরে। তবে আজ আবির ভাইয়ের সাথে ঘুরবে এটা সে আগে থেকেই জানে। তাই সেজেছে।

পরীক্ষা শুরুর আগেই বন্যাকে বলেছে তানভির ভাইয়ার ট্রিটের কথা তবে বন্যা কোনোভাবেই রাজি হচ্ছিলো না। মেঘ জোর করে রাজি করিয়েছে। যথারীতি পরীক্ষা শেষে দুই বান্ধবী রিক্সা করে নির্দিষ্ট জায়গাতে চলে এসেছে। আবির আর তানভির আগে থেকেই দাঁড়িয়ে ছিলো। মেঘ দূর থেকে আবিরকে দেখেই একগাল হাসলো৷
কাজল কালো সেই ডাগর ডাগর আঁখি আর অকৃত্রিম, মায়াবী হাসি দেখে আবিরের মন উতলা হয়ে উঠেছে। অন্তঃস্থলে শিহরণ জাগছে। বক্ষস্পন্দন জোড়ালো হচ্ছে, আবির ঢুক গিলে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু তার দৃষ্টি যেনো সরছেই না। আবিরের অশান্ত মনকে শান্ত করার সকল ক্ষমতা বিলীন হয়ে গেছে৷ আবির মনে মনে বিড়বিড় করে বলছে,

“আমায় ধ্বং*স করতে কেনো উঠেপড়ে লেগেছিস?”
মেঘ রা নামতেই তানভির রিক্সা ভাড়া দিয়ে দিলো।
শান্ত কন্ঠে শুধালো,
“আসতে সমস্যা হয় নি তো কোনো?”
দুজনেই মাথা নেড়ে না করলো।
তানভির বন্যার দিকে চেয়ে ছোট করে বলল,
“Congratulation ”
বন্যা হেসে উত্তর দিল,
“Thank You”
তানভির আবিরকে ডাকলো,
“ভাইয়া চলো..!”
তানভিরের ডাকে আবির স্বাভাবিক হলো। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“চল।”

কাছেই একটা রেস্টুরেন্টে গেছে খেতে। খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে আবির শুধু মেঘকে দেখছে, মেঘ তাকালেই দৃষ্টি সরিয়ে নিচ্ছে। এই চোখে জাদু আছে যা এই শ্যামবর্ণের, সু*ঠাম দেহি পুরুষকে মূহুর্তেই দূ*র্বল করে দিয়েছে। না পারছে দীর্ঘ সময় ঐ চোখে চেয়ে থাকতে আর না পারছে নিজেকে সংযত রাখতে। অন্যদিকে বন্যা আর তানভিরেরও কয়েকবার চোখাচোখি হয়েছে। তবে চোখে চোখ পরতেই দুজনেই সঙ্গে সঙ্গে চোখ নামিয়ে নিচ্ছে।

বন্যা সবুজ রঙের একটা ড্রেস পরেছে সাথে হিজাব পরা। এত সাজগোছ নেই, দেখতে খুবই সাদামাটা, গায়ের রঙ ফর্সা হলেও সেটা মেঘের তুলনায় কিছুটা চাপা৷ ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক আছে। উচ্চতায়ও মেঘের তুলনায় ১ ইঞ্চি কম হবে। হাসিটা মাত্রাতিরিক্ত সুন্দর । তবে সচারাচর মেয়েটা হাসে না। বেশিরভাগ সময় সিরিয়াস মুডেই থাকে৷ খাওয়া শেষে বেড়িয়েছে সবাই। মেঘ আর বন্যা দুজনেই তানভিরকে ধন্যবাদ জানালো ট্রিটের জন্য৷
আবির একবার তানভিরের দিকে চেয়ে চোখ দিয়ে কিছু ইশারা করলো। তারপর আবির গম্ভীর কন্ঠে বললো,
“তানভির আমি মেঘকে নিয়ে বাসায় যাচ্ছি। তুই বন্যাকে বাসায় পৌছে দিয়ে তারপর যেখানে ইচ্ছে যাবি৷ ”
তানভির স্বাভাবিক কন্ঠে জানালো,

“ঠিক আছে ভাইয়া।”
মেঘ বন্যাকে টা টা দিয়ে বাইকে বসলো৷ আবির দেরি না করে মেঘকে নিয়ে জায়গা ত্যাগ করলো। আবিররা যাওয়ার পর ই তানভির বাইকে বসে বন্যার দিকে চেয়ে বললো,
“উঠো”
বন্যা ঠান্ডা স্বরে জানালো,
“আমি রিক্সা করে চলে যেতে পারবো। ”
তানভির একটু রা*গী ভাব নিয়ে বললো,

“শুনো নি ভাইয়া কি বলছে? তোমায় বাসায় দেয়ার পর আমার দায়িত্ব শেষ হবে। উঠো। ”
বন্যা আর কথা বাড়ালো না হেলমেট পড়ে, মাঝখানে জায়গা রেখে বাইকে বসলো । পেছন দিকে ধরে রেখেছে৷ তানভির জীবনে প্রথম মেয়েকে নিয়ে বাইক চালাচ্ছে তাই কিছুটা ভ*য়ে আছে৷ এজন্য এত জোরে বাইক চালাচ্ছে না। কিছুটা যাওয়ার পর রাস্তার পাশে বাইক রেখে বললো,

” তুমি একটু দাঁড়াও আমি আসছি৷ ”
বন্যা সাইডে দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে তানভির একটা শপিং ব্যাগ বন্যার দিকে এগিয়ে দিলো,
বন্যা জিজ্ঞাসু চোখে চেয়ে বললো,

“কি এতে? ”
তানভির শান্ত স্বরে বলল,
“তোমার রেজাল্টের গিফট। ”
বন্যা কোনোভাবেই নিতে রাজি হচ্ছে না। বাধ্য হয়ে তানভির ধ*মক দিলো,
“বলছি নিতে, নাও ”
বন্যা ভ*য়ে কিছুটা কেঁপে উঠলো। কাঁপা কাঁপা হাতে ব্যাগ টা নিয়ে ছোট করে বলল,
“Thanks”

তানভির মৃদু হেসে আবার বাইকে বসলো। পিচঢালা রাস্তায় বাইক চলছে। বন্যা নিরব, শান্ত মেয়ের মতো চুপচাপ বসে আছে। নিরবতা ভেঙে তানভির বললো,
“গতকাল ভাইয়া আর বনু মিলে আমায় এই বাইকটা গিফট করেছে। কেমন হয়েছে বলো তো?”
বন্যা হাসিমুখে উত্তর দিলো,
“অনেক সুন্দর হয়েছে। ”

তানভির পুনরায় বলল,
“তারজন্যই আজকে ট্রিট দিলাম।”
বন্যা এবার মৃদুস্বরে শুধালো,
“আমায় ট্রিট দেয়ার কি প্রয়োজন ছিল। আমি তো…!”
এটুকু বলতেই তানভির বললো,

“তোমাকে দেয়ার প্রয়োজন ছিল। ঐদিন তোমাদের বাসায় খেয়ে আসলাম৷ তাছাড়া তুমি বনুর বেস্টফ্রেন্ড। আর আমাকে যেভাবে ভাইয়া ভাইয়া ডাকো আমি তো মাঝে মাঝে কনফিউজড হয়ে যায় যে আমি কার ভাই। ”
কথাগুলো শুনে বন্যা কিছুটা লজ্জা পেলো তারপরও স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলো। এরমধ্যে বন্যাদের বাসার গলি পর্যন্ত চলে আসছে। বন্যা তাড়াহুড়ো করে বললো,

“ভাইয়া এখানে নামিয়ে দেন, প্লিজ। ”
তানভির বাইক থামিয়ে বললো,
“আবার!”
বন্যা হেলমেট খুলতে খুলতে তপ্ত স্বরে বললো,
“সরি তানভির ভাই। এখান থেকে হেঁটেই যেতে পারবো। কেউ দেখলে সমস্যা হবে। ”
সমস্যা বুঝতে পেরে তানভির স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
“সাবধানে যেও৷ আর পড়াশোনা করো ঠিক মতো। আল্লাহ হাফেজ। ”

বন্যাও আল্লাহ হাফেজ বলে, শপিং ব্যাগ নিয়ে গলি দিয়ে হাঁটছে। তানভির কিছুক্ষণ স্থির দাঁড়িয়ে চেয়ে রইলো সেদিকে তারপর আবার বাইক স্টার্ট দিয়ে চলে গেলো।
আবির বাসার দিকে না গিয়ে অন্যরাস্তায় যাচ্ছে দেখে মেঘ চিন্তিত স্বরে বললো,

“বাসায় যাবেন না?”
আবির কঠিন স্বরে জবাব দিল,
“বাসায় যাওয়ার এত তাড়াতাড়ি কিসের তোর। ”
মেঘ আর কিছু বললো না। আবির ভাইয়ের কাছাকাছি তো সেও থাকতে চাই কিন্তু তানভিরের সামনে আবির বলেছে, বাসায় চলে যাবে এজন্যই মেঘ জিজ্ঞেস করেছিল। আবির মেঘকে নিয়ে একটা পার্কে এসেছে। পার্কে মানুষের ভিড় দেখে আবির কিছুটা ভী*ত হলো। মেঘের দিকে চেয়ে বললো,
“ঢুকবি নাকি অন্য কোথাও যাবো? ”
মেঘ একগাল হেসে উত্তর দিলো,
“এসেছি যখন তাহলে ঢুকি। ভালো না লাগলে চলে যাব নে। ”

আবির মেঘের হাত ধরে হাঁটছে৷ মেঘ আশেপাশে তাকাচ্ছে আর বার বার আবির ভাইয়ের শক্ত করে ধরে রাখা হাতের দিকে তাকাচ্ছে। এমনভাবে হাত ধরে রেখেছে যেন ছেড়ে দিলেই তার প্রেয়সী হারিয়ে যাবে বহুদূরে। মেঘ সেই হাত ধরা দেখে গতকালের ন্যায় বারবার লজ্জায় আড়ষ্ট হচ্ছে। মেঘ চারপাশে তাকিয়ে দেখছে, কত কত মানুষ, কেউ কেউ পরিবার নিয়ে এসেছে, ছোট বাচ্চা নিয়ে এসেছে, বন্ধুরা মিলে ছবি তুলছে, আড্ডা দিচ্ছে। বেশ কয়েকটা কাপল ও দেখেছে হাত হাত রেখে হাঁটছে।

সেসব দেখে মেঘেরও নিজেকে আবির ভাইয়ের প্রেমিকা মনে হচ্ছে। এটা ভাবতেই লজ্জায় দু গাল লাল হয়ে গেছে, ঠোঁটের মুচকি হাসি যেনো সরছেই না।
একটা ফাঁকা ব্র্যাঞ্চ দেখে আবির মেঘকে ইশারা দিলো বসার জন্য । আবির কিছুটা দূর থেকে একটা আইসক্রিম নিয়ে আসছে।মেঘকে আইসক্রিম দিয়ে মেঘের থেকে কিছুটা দূরে বসেছে আবির।
মেঘ আপন মনে আইসক্রিম খাচ্ছে একবার আবির ভাইকে দেখছে আবার আশপাশ দেখছে।
আবির আচমকা ডেকে উঠলো,

“তাকা এদিকে। ”
হঠাৎ ডাকায় মেঘ কিছুটা কেঁপে উঠেছে। তারপর স্বাভাবিক ভাবে ঘাড় ঘুরিয়ে আবির ভাইয়ের দিকে তাকালো।
আবির ভ্রু কুঁচকে চিন্তিত স্বরে বলল,
“এভাবে সেজেছিস কেনো?”
মেঘ মুভ ভোঁতা করে আবিরের দিকে তাকিয়ে আছে। কয়েক মুহুর্ত পর বললো,
“কই সাজছি। শুধু কাজল আর…!”
এটুকু বলতেই আবির বলল,

“শুধু কাজল টাও আর দিবি না। ”
আবির মনে মনে বলল,
” তোর এই চোখের মায়ায় আমি ছাড়া, আর কাউকে পরতে দিব না । ”
মেঘ আহ্লাদী কন্ঠে শুধালো,
“কাজল দিলে কি আমায় অনেক সুন্দর লাগে?”
আবির তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে বললো,

“ঐ যে দূরে গাছটা দেখা যাচ্ছে, ঐ গাছের ঢালে বসে থাকা পে*ত্নী টার মতো লাগে। এজন্যই বলছি কাজল পরে রাস্তাঘাটের মানুষকে ভ*য় দেখাইস না। ”
মেঘ নিচের ওষ্ঠ উল্টে আবিরের দিকে চেয়ে আছে, চোখ পানিতে টইটম্বুর হয়ে গেছে, পল্লব ঝাপটালেই গাল বেয়ে গরিয়ে পরবে। আবির কপাল কুঁচকে চেয়ে আছে।
বিরক্ত নিয়ে বলল,

“তোর সমস্যা কি মেঘ ? কিছু বলার আগেই কা*ন্না করে দেস কেন? এক মিনিট কাঁ*দলে ১ ঘন্টা মাথা ব্যথায় ভুগিস সেটা মাথায় থাকে না?”
মেঘ অবাক চোখ তাকিয়ে ভেজা কন্ঠে প্রশ্ন করল,

আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ২৫

“আপনি কিভাবে জানেন আমার মাথা ব্য*থা হয়?”
আবির ঢুক গিলে কন্ঠ দ্বিগুণ ভারি করে বলল,
” এটা জানা এমন কোনো কঠিন বিষয় না। দূরে ছিলাম মানে এই না যে সব ছেড়ে গেছিলাম। চল বাসায় যায়৷ ”

আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ২৭