আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ২৭

আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ২৭
লেখনীতে সালমা চৌধুরী

সময় চলে যাচ্ছে নিজস্ব গতিতে। মাঝখানে কেটে গেছে বেশকিছুদিন৷ আবিরের ব্য*স্ততম দিন কাটছে। এই সপ্তাহে নির্বাচন তানভিরেরও ব্য*স্ততা বেড়েছে তিনগুণ। নির্বাচনের কাজে এতটায় ব্য*স্ত, কখনো রাত ২-৩ টায় বাসায় ফিরে, কখনো বা ফিরেও না। নিজস্ব বাইক থাকাতে এখন তেমন একটা সমস্যা হচ্ছে না। বাইক কেনার পর বাসায় টুকিটাকি সমস্যা হলেও সবকিছু আবির ই সামলে নিয়েছে৷

আগামী মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডমিশন টেস্ট। তার কিছুদিন পর মেডিকেল পরীক্ষা। কোচিং এর ক্লাস শেষ, এখন শুধু মডেল টেস্ট পরীক্ষা চলছে। ১০ টা থেকে ১২ টা পর্যন্ত কোচিং এর পরীক্ষা হয়, পরীক্ষার পড়া, জান্নাত আপুর পড়া তার সাথে নিজস্ব পড়ার চাপ তো রয়েছেই। তবে সবকিছুর মাঝেও আবির ভাই যেনো মেঘের সমস্ত পৃথিবী ঘিরে রয়েছে। সকাল আর রাতে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আবিরকে দেখা এখন মেঘের অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। শুক্রবারটা শুধু ব্যতিক্রম। তবে শুক্রবারে মেঘ নাস্তা খেতে যাওয়ার আগে চুপিচুপি আবির ভাইয়ের দরজা পর্যন্ত এসে আবির ভাই কে দেখে যায়। ধ*রা পরার ভ*য়ে রুমের ভেতরে ঢুকে না।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আজ আবিরের অফিসে মিটিং আছে। রেডি হয়ে কোনো রকমে হালকা নাস্তা করেই বেড়িয়ে পরেছে। প্রথমে বাবার অফিসের কাজ শেষ করতে হবে৷ ১২ টায় মিটিং টাইম দিয়েছে। ১১.৫০ নাগাদ আবির নিজের অফিসে পৌঁছেছে। রাকিবের পার্সোনাল সমস্যার জন্য এখনও অফিসে আসতে পারে নি।
আবির রাকিবকে কল দিয়ে জিজ্ঞেস করছে,
“কই তুই? আমি কি ওয়েট করবো নাকি মিটিং শুরু করবো?”
রাকিব জ্যামে আঁটকে আছে। ঢাকা শহরের জ্যাম মানে লাগছে তো লাগছেই শেষ আর হবে না। রাকিব ঠান্ডা স্বরে বলল,

“তুই শুরু কর। আমি কাছাকাছি আছি। আসতেছি। ”
আবির আর কথা বাড়ায় নি। জাস্ট ১২ টায় মিটিং শুরু করেছে, ২ মিনিটও হয় নি কথা শুরু করেছে। এর মধ্যে টেবিলে রাখা মোবাইল ফোনে ভাইব্রেশন হচ্ছে৷ বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে ফোনের দিকে তাকাতেই রীতিমতো আশ্চর্য হয়ে গেলো। কাঙ্ক্ষিত নাম্বার থেকে অনাকাঙ্ক্ষিত সময়ে কল চলে আসছে। সহসা আবিরের ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠেছে। সামনে বসে থাকা স্টাফ রাও অবাক চোখে সেই হাসি দেখছে। কারণ এই মানুষ টা অফিসে থাকাকালীন ভুল করেও হাসে না। প্রয়োজন ছাড়া কারো সাথে কোনো কথা বলে না। গোমড়ামুখো মানুষের হাসি এত সুন্দর হয় তারা হয়তো সেটা ভেবেই চেয়ে আছে৷ আবির ফোন হাতে নিয়েছে, ফোনের স্ক্রিনে নাম ভেসে উঠেছে –

💘হৃদয়হরনী💘
সাথে একটা হাস্যোজ্জল ছবি। নাম্বার টা আরও ১ বছর আগে থেকেই সেইভ করা ছিল আবিরের ফোনে৷কিন্তু এই প্রথমবার কল আসছে।
আবির সবার উদ্দেশ্যে “Excuse me” বলে কল টা রিসিভ করে। বুকের ভেতর হৃ*দপিণ্ড টা খুশিতে ধুকপুক করছে।

আবির কিছু বলার আগেই ওপাশ থেকে কান্নার শব্দ ভেসে আসছে। এক সেকেন্ডেই আবিরের হাসি গায়েব হয়ে গেছে। বুকের ভেতরটা মো*চড় দিয়ে উঠেছে।
ফোনের ওপাশ থেকে কান্নাজড়িত কন্ঠে ডাকলো,
“আবির ভাই! ”
এই ডাকে আবিরের হৃদয় ভেঙে বিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। কপাল কুঁচকে পুরো কন্ঠে প্রশ্ন করল,
“কি হয়েছে তোর? ”
কান্নার তোপে কথা বলতে পারছে না। ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছে৷ আবির পুনরায় ডাকলো,

“এই মেঘ, কি হয়েছে তোর?”
মেঘ কোনোরকমে বলল,
“একটা ছেলে আমার হাত ধরে…”
এটুকু বলতেই আবার কান্না শুরু করেছে।
আবিরের বুকের ভেতর তান্ডব চলছে, তীব্র যন্ত্রণা শুরু হয়েছে বুকে৷ সেই যন্ত্রণা বুক খুঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। হৃদয়ের তোলপাড় চোখে ভাসতে বেশি সময় লাগে নি। চোখের বর্ণ পরিবর্তন হতে শুরু করেছে, ক্ষণিকের ব্যবধানে র*ক্তবর্ণ ধারণ করেছে চোখ৷ রুমে ৩ টা এসি চলছে তারপরও আবির ঘেমে একাকার হয়ে যাচ্ছে।
আবির উদ্বিগ্ন কন্ঠে প্রশ্ন করলো,

“কোথায় আছিস?”
মেঘ কাঁদতে কাঁদতে জায়গার নাম বললো।
আবির শক্ত কন্ঠে বলল,
“আমি আসছি এখনি। ”
“মিটিং অফ” কথাটা বলেই আবির ভীষণ তাড়াহুড়োতে মিটিং রুম থেকে বেড়িয়ে গেছে। সবাই আশ্চর্য বনে গেছে। আবিরের চোখ টকটকে লাল হয়ে গেছে। পড়নের ব্লেজার খুলে নিজের রুমের দরজা থেকে ভেতরে ছুঁড়ে ফেলে বের হয়ে যাচ্ছে।

আবিরের PS ছুটে এসে ডাকছে,
“কোথায় যাচ্ছেন স্যার, আজকের মিটিং টা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ”
আবির অ*গ্নিদৃষ্টিতে চেয়ে বলল,
“আমার যাওয়াটা এর থেকেও অনেক বেশি দরকার। আটকিয়ো না আমায়। ”
কথায় রাগের তীব্রতা স্পষ্ট।
PS চিন্তিত স্বরে বলল,
“স্যার, ওখানে একটু পরে গেলে হয় না? অথবা অন্য কেউ গেলে মিটিং টা আপনি করতে পারতেন। ”
আবির রাগান্বিত কন্ঠে হুঙ্কার দিয়ে উঠলো,
“কার বুকে এত সাহস, যে আমার কলিজায় হাত দিছে। ঐ কু*ত্তা*র বা*চ্চারে না মা*র*লে আমার শান্তি হবে না। ”

এরমধ্যে রাকিব অফিসে ঢুকছে। আবিরের চিৎকার শুনে ছুটে আসে৷ আবিরের এত ভ*য়ং*কর রূ*প দেখে ভী*ত স্বরে প্রশ্ন করে,
“মেঘের কিছু হয়ছে? ”
আবির কোনো কথা না বলে রা*গে ক*টমট করতে করতে চলে যাচ্ছে। রাকিব পিছন থেকে ডেকে বলল,
“আমি কি যাব তোর সঙ্গে? ”
আবির শক্ত কন্ঠেই বলল,
“লাগবে না। ”
আবির এক প্রকার দৌড়ে বেড়িয়ে গেছে অফিস থেকে। রাকিব এবার PS এর দিকে চেয়ে শুধালো,
“কি হয়ছে? ”

ছেলেটা শান্ত স্বরে সব বর্ণনা করলো। রাকিব স্বাভাবিক কন্ঠে শুধালো,
“কোনো কথায় মেঘ নাম শুনছো?”
ছেলেটা উপর-নিচ মাথা নাড়লো।
রাকিব দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে গম্ভীর কন্ঠে বলল,
“ভাই, আজ প্রথমবার আবিরের পথ আটকাইছো তাই তোমায় কিছু করে নি। ভবিষ্যতে আর কোনোদিন আবিরকে আটকানোর চেষ্টা করো না। তাহলে ওর সম্পূর্ণ রা*গ তোমার উপর ঝা*ড়বে। আবিরের পৃথিবীর ৯৯.৯৯% জুড়ে শুধু মেঘ। বাকি ০.০১% তার পরিবার, আমরা,অফিস সবকিছু। যা বলছে তাই করো মিটিং অফ রাখো। ”
ছেলেটা ভী*ত কন্ঠে প্রশ্ন করলো,

“মেঘ কি স্যারের গার্লফ্রেন্ড? ”
রাকিব মৃদু হেসে উত্তর দিলো,
“শুধু গার্লফ্রেন্ড হলে বোধহয় এতকিছু করতো না। আবির বেঁচে আছেই শুধু এই মেঘের জন্য। না হয় কবেই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যেতো। ”

ছেলেটা কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে রাকিবের দিকে। রাকিব তা বুঝতে পেরে স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
“সেসব বাদ দাও। কিন্তু ভবিষ্যতে এমন কাজ আর করো না। অন্ততপক্ষে মেঘের ব্যাপারে তো কোনোদিন নাক গলাবাই না, তাহলে দেখবা তুমি আছো কিন্তু তোমার নাক নেই। সো বি কেয়ার ফুল। যতটা কুল আর শান্ত আবিরকে দেখো সে এতটাও শান্ত নয়। ”
রাকিব চিন্তিত স্বরে বিড়বিড় করে নিজের কেবিনে যাচ্ছে,
“আল্লাহ জানে কোন বি*পদে আছে। ”

জ্যামের জন্য মেইন রোড দিয়ে যাওয়া অসম্ভব, অনেকটা রাস্তা ঘুরে আবির ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছেছে ।
মেঘ একটা ব্রেঞ্চে বসে কাঁ*দছিল । আশেপাশে ২-৩ টা লোক দাঁড়িয়ে আছে। আবিরকে বাইক থেকে নামতে দেখে মেঘ দৌড়ে গিয়ে আবিরকে জরিয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না শুরু করেছে। একটা মেয়ের মনের বিরুদ্ধে কোনো কিছু ঘটলে সেটার বহিঃপ্রকাশ ঘটে আপন মানুষের সামনে৷ মেঘের ক্ষেত্রেও এমনটায় ঘটেছে। আবিরকে দেখে যেনো নিজের প্রাণ ফিরে পেয়েছে। তাই সব শক্তি ঢেলে কাঁদছে । আবির একহাতে হিজাবের উপর দিয়ে মেঘের মাথা আঁকড়ে ধরে রেখেছে। অন্য হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দাঁতে দাঁত চেপে আছে।
নিজের সবটা রাগ হজম করে শান্ত স্বরে বললো,

” কিছু হবে না আমি আছি তো। একটু শান্ত হ, প্লিজ। ”
কয়েক মুহুর্ত চলে এই বাঁধহীন কান্না৷ কিছু সময় পর মেঘ বুঝতে পারে, এভাবে আবির ভাইকে জরিয়ে ধরা ঠিক হয় নি । সঙ্গে সঙ্গে মেঘ নিজে থেকে সরে দাঁড়ায়৷ মেঘের কান্না জরিত মুখ আবিরের সত্ত্বাকে নাড়িয়ে দিয়েছে। মেঘের চোখ মুখ ফুলে গেছে, সারা মুখে র*ক্তচা*প বেড়ে গেছে যার ফলে গাল, নাক, থুতনি সব লাল হয়ে আছে।
আবির দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে, দু হাতে মেঘের চোখ মুছে ভারী কন্ঠে শুধালো,

“কোন ছেলেটা?”
মেঘ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। আবিরের চোখ ও সেদিকে পরেছে। একটা ছেলে গাছের দাঁড়িয়ে আছে। তাকে ঘিরে ৪-৫ জন লোক দাঁড়িয়ে আছে। আবির কোনো কথা না বলে, ছেলের কাছে গিয়ে এলোপাতাড়ি ঘু*ষি, লা*ত্থি শুরু করেছে। আচমকা আক্রমণে ছেলেটা বেসামাল হয়ে গেছে। আশেপাশে থাকা ৪-৫ জন ভ*য়ে কিছুটা দূরে সরে গেছে। আবিরের রা*গান্বিত চাউনি আর মুখ দেখে তারা যেনো আটকাতেও সাহস পাচ্ছে না।

মেঘ বিষ্ময় চোখে আবির ভাইয়ের পানে চেয়ে আছে, আবির ভাইয়ের এই রূপ জীবনে প্রথমবার দেখছে। বাসায় কয়েকবার শুনেছে আবির ভাই মা*রপি*ট করেছে কিন্তু আজ তা নিজের চোখে দেখছে। থ*রথ*র করে কাঁপছে অষ্টাদশীর ছোট দেহ। ছেলেটার নাক-মুখ দিয়ে র*ক্ত গরিয়ে পরছে, কিন্তু আবির এক সেকেন্ডের জন্যও থামছে না। ছেলেটা প্রথম কয়েকবার আটকানোর চেষ্টা করলেও এখন তার নিথর দেহ পরে আছে। এই সময় পুলিশে গাড়ি এসে থামে। দুজন কনস্টেবল গাড়ি থেকে নেমে দ্রুত এসে আবিরকে আটকানোর চেষ্টা করছে। ৪-৫ জন লোকের মধ্যে একজন এসপি স্যারের কাছে গিয়ে বলে,

“স্যার আমিই আপনাকে কল করেছিলাম। কিন্তু হুট করে এই ছেলে এসে এভাবে মা*রতে শুরু করেছে। ”
এসপি স্যার দ্রুত আবিরের কাছে গিয়ে বলে,
“থামুন আপনি। এভাবে মারছেন কেনো? আমাদের বিষয়টা দেখতে দিন। ”
দুই কনস্টেবলের সাথে আরও কয়েকজন লোক আবিরকে টেনে হিঁচড়ে ছেলেটার থেকে দূরে সরিয়ে নেয়। এসপি স্যার ছেলেটাকে একটু দেখে তারপর আবিরের দিকে তাকায়। সঙ্গে সঙ্গে কপাল কুঁচকে প্রশ্ন করে,
“তুমি ইকবালের ভাইপো না?”

আবির তখনও রাগে ফুঁ*সতে। দাঁতে দাঁত চেপে রা*গ হজম করার চেষ্টা করছে তার সাথে ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিচ্ছে । এসপির কথা শুনে, ওনার দিকে তাকিয়ে রাগান্বিত কন্ঠে উত্তর দেয়,
“জ্বি। ”
এসপি এবার স্বাভাবিক কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
“তুমি বিদেশ ছিলে না এতবছর? আবির ই তো নাম তোমার? ”
আবির কপাল কুঁচকে পুনরায় উত্তর দেয়,
“জ্বি। ”
এসপি মৃদু হেসে বলে,

“আমি ইকবালের কলেজ ফ্রেন্ড। ছোট বেলায় তোমাদের বাসায় অনেকবার গিয়েছি। এখনও ইকবালের সাথে মাঝে মাঝেই কথা হয় আমার।
তা তুমি এই ছেলেকে এভাবে মা*রছিলে কেন?”
আবির ঘাড় ঘুরিয়ে মেঘের দিকে তাকিয়েছে, মেঘ নিশ্চুপ, বাইকের পাশে দাঁড়িয়ে বৃহৎ চোখে চেয়ে আছে, শরীরের কম্পন এখনও তীব্র। আবিরের সাথে সাথে এসপি ও ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো মেঘকে৷
আশেপাশের লোক বলছে,

“স্যার ঐ মেয়েটার সাথেই অস*ভ্যতা করেছে ছেলেটা৷ ”
এসপি আবিরের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল,
” তোমার বোন?”
আবির মেঘের দিকে চেয়েই উত্তর দিল,
“চাচাতো বোন। ”
এসপি একবার ছেলেটাকে দেখছে, আশেপাশে মানুষের কথা শুনছে। তারপর আবিরকে কিছুটা সরিয়ে সাইডে নিয়ে বলল,

“তোমরা আমার পরিচিত। আমি চাই না এই বয়সে তোমরা কোনো কেইসে ফেঁ*সে যাও। সামনে তোমাদের ভবিষ্যৎ আছে। আর ওরা নে*শাখো*র, ওদের বড় বড় লোক আছে। আমরা ঐ গ্যাং টা ধরার চেষ্টা করছি। তাদের ধরতে পারলে, এরা কিছুই না। তাই বলি তুমি তোমার বোনকে নিয়ে চলে যাও। বিষয়টা আমি দেখছি। ”
আবি কথাগুলো শুনলো, দুহাত এখনও মুষ্টিবদ্ধ করে ক*টম*ট করছে। বুঝতে পারলো এখানে কিছু বলে লাভ নেই। তাই কথা না বলেই মেঘের কাছে চলে গেছে। এসপি আর দুই কনস্টেবল আহত ছেলেটাকে নিয়ে থানায় চলে যাচ্ছে ।

আবিরের এলোমেলো চুল, ঘামে ভেজা শার্ট শরীরের সাথে চেপে আছে, চোখ মুখে ঘাম আর রা*গ দুটায় জ্বলজ্বল করছে। চোখ এখনও লাল রঙা হয়ে আছে৷ কয়েক সেকেন্ড মেঘের কাঁপা কাঁপি দেখে আবির চলে গেলো। দোকান থেকে একটা পানির বোতল কিনে নিজের চোখে মুখে পানি দিলো,সাথে মাথায় কিছুটা পানি ঢেলে রাগ কমানোর চেষ্টা করছে।
মেঘের কাছে গিয়ে তপ্ত স্বরে বলল,

“নে পানি খা। ”
মেঘ আবিরের দিকে চেয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে বোতল টা নিলো। আবিরের চুলের পানি মুখে পরছে, মুখ থেকে পানি শরীরে, নিচে টুপটুপ করে পরছে। । মেঘ নির্বোধের ন্যায় চেয়ে আছে। আচমকা আবির একটু নিচু হয়ে মেঘের ওড়নার মাথা টেনে নিজের মুখ আর চুল মুছতে শুরু করেছে।
আবিরের এমন কান্ডে মেঘ যেনো আশ্চর্য বনে গেলো । আবির চোখ মুখ মুছে পুনরায় মেঘের দিকে চেয়ে শান্ত কন্ঠে বলল,

“মনে কর তুই কিছু দেখিস নি। এখন একটু পানি খা। ”
মেঘ ঢকঢক করে কিছুটা পানি খেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ছেলেটার আচরণে যতটা ভ*য় পেয়েছিল তার থেকেও তিনগুণ ভ*য় পেয়েছে আবির ভাইয়ে পে*টা*নো দেখে। তখনই রাকিব কল করেছে, আবির কল রিসিভ করে ঠান্ডা ক*ন্ঠে বলল,

“বল!”
রাকিব চিন্তিত স্বরে শুধালো,
“ঝা*মেলা কি বেশি? আমি আর রাসেল কি আসবো?”
আবির ভারী কন্ঠে বলল,
“না আসতে হবে না। আমি চলে আসবো। ”
রাকিব,

“তাহলে কি মিটিং ডাকবো?”
আবির মেঘের দিকে চেয়ে ২ সেকেন্ড ভেবে জানালো,
“হ্যাঁ৷ আসতেছি আমি।”
রাকিব চিন্তিত স্বরে পুনরায় প্রশ্ন করলো,
“মেঘ কোথায়?”
আবির জবাব দিল,

“আছে, এখানেই।”
রাকিব মৃদু হেসে প্রশ্ন করলো,
“মেঘকে নিয়ে আসবি অফিসে?”
আবির
“হ্যাঁ , রাখছি। ” বলে কল কেটে দিয়েছে।
আবির ফোন পকেটে রাখতে রাখতে স্বভাব-সুলভ ভারি কন্ঠে শুধালো,
“এখন বাসায় না গেলে কি খুব সমস্যা হবে? আমার একটা মিটিং আছে। মিটিং শেষ করে তোকে বাসায় দিয়ে আসলে চলবে?”

মেঘ ঘাড় কাথ করে সম্মতি দিলো। তারপর অফিসের উদ্দেশ্যে চলে গেছে। অফিস গেইটের সামনে আসতেই রাকিব আর রাসেল একটা তাজা ফুলের তোড়া নিয়ে হাজির হলো,
মেঘের দিকে চেয়ে, তোড়া এগিয়ে দিয়ে হাসিমুখে রাকিব বলল,
“ওয়েলকাম, ম্যাডাম। ”
মেঘ কপাল কুঁচকে তাকিয়ে বলল,

“আমি ম্যাডাম হলাম কিভাবে? আমি তো… ”
এতটুকু বলতেই আবির ধমকে উঠলো,
” যা দিচ্ছে নে। এত কথা বলতে হয় কেন?”
মেঘ আর কথা বাড়ালো না চুপচাপ ফুলের তোড়া নিলো। তারপর আবিরের পেছন পেছন আবিরের কেবিনে চলে গেলো। আবির কেবিনের দরজা আটকে বলল,
“হিজাব খুলে ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে আয়৷ ”
মেঘ কিছুক্ষণের মধ্যে হাতমুখ ধৌয়ে, হিজাব খুলে চুল ঠিক করে বেড়িয়ে এসেছে। আবির টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে ল্যাপটপে কিছু একটা চেক করছিলো৷ মেঘ রুমে আসতেই আবির নিজের চেয়ার দেখিয়ে বলল,

“বস এখানে। ”
মেঘ বিড়বিড় করে বলল,
“এটা তো আপনার চেয়ার। ”
আবির চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই মেঘ মাথা নিচু করে চুপচাপ আবিরের চেয়ারে বসে পরলো। আবির ২ মিনিট ল্যাপটপে কাজ করে, ভারী কন্ঠে বলল,
“আমি শাওয়ার নিতে যাচ্ছি। কেউ ডাকলে দরজা খুলার দরকার নেই। তুই নিজের মতো রেস্ট নে। ”

আবির ৫ মিনিটে শাওয়ার নিয়ে কোমড়ে টাওয়েল জড়িয়ে ওয়াশরুম থেকে তাড়াহুড়ো করে বেড়িয়েছে। চোখে মুখে চি*ন্তার ছাপ। আচমকা আবিরকে এভাবে দেখে মেঘের বুকটা কেঁ*পে উঠলো। উন্মুক্ত শরীর, শুধু কোমড় থেকে হাঁটুর নিচ পর্যন্ত ঢাকা। মেদ হীন পেটে সিক্স প্যাকের হালকা চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। শরীরে থাকা বিন্দু বিন্দু পানির কণাগুলো চিকচিক করছে। তা দেখে মেঘের হৃৎস্পন্দনের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে, নিঃশ্বাস ভারি হয়ে আসছে। আবির এসে চেয়ারের দু হাতল চেপে মেঘের ঘনিষ্ঠ হয়ে মেঘের দিকে তাকালো। মেঘও বিস্ময় চোখে চেয়ে আছে আবিরের চোখের দিকে। এই চোখের ক্রো*ধ এখনও কমে নি। এত কাছে আসাতে, আবিরের নিঃশ্বাস ছুঁয়ে দিলো মেঘের লালিত মুখমণ্ডল। মেঘের রক্তসঞ্চালন বেড়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে মেঘের শিরা-উপশিরায় তু*ফান চলছে।
আবিরের দৃষ্টি মেঘের নেত্রে নিবদ্ধ। কন্ঠ চারগুণ ভারি করে শুধালো,

“ঐ ছেলে তোর হাত ছাড়া অন্য কোথাও ছুঁয়েছিল?”
আবিরের প্রশ্ন মেঘের কর্ণপাত হলো কি না কে জানে, খানিকটা সময় সময় পর মেঘ চিবুক নামাতে নিলে, আবির দু আঙুলে আটকে দেয়। মেঘ পুনরায় আবিরের মুখের পানে তাকায়, চোখে মুখে ক্রো*ধ স্পষ্ট। আবির পুনরায় রা*গান্বিত কন্ঠে প্রশ্ন করলো,

“বল শুধু আর কোথায় ছুঁয়েছে, ঐ কু*ত্তা*র বা*চ্চা*রে জ্যা*ন্ত ক*ব*র দিয়ে আসবো। ”
আবির ভাইয়ের মুখে ভ*য়ংক*র কথা শুনে মেঘের শরীর কেঁপে উঠলো । ঢুক গিলে, কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল,
“আর কোথাও ছুঁয় নি। ”
আবির ভারী কন্ঠে প্রশ্ন করলো,
“সত্যি তো?”
মেঘ আস্তে করে বলল,
“সত্যি”
এরমধ্যে দরজায় রাসেল ডাকছে,
“আবির, মিটিং এর সময় হয়ে যাচ্ছে। ”

আবির এবার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মেঘের থেকে দূরে সরে দাঁড়ালো । টেবিলের উপর রাখা ফোনে টাইম দেখে নিলো। একটা শার্ট আর প্যান্ট পরে রেডি হয়ে চলে যাচ্ছিলো, দরজা পর্যন্ত গিয়ে থমকে দাঁড়ালো। মেঘের দিকে চেয়ে বলল,
“দরজা টা ভেতর থেকে ব*ন্ধ করে রাখ। কফি আর নাস্তা দিতে বলে যাচ্ছি। দরজা থেকেই নিবি,কেউ ভেতরে যেনো না ঢুকে। আমি মিটিং শেষ করে আসছি। ”

আবির চলে গেছে কিছুক্ষণের মধ্যেই আবিরের PS কিছু খাবার আর এক কাপ কফি নিয়ে আসছে। মেঘ নাক পর্যন্ত ওড়না টেনে, মাথা নিচু করে খাবার গুলো নিলো। তারপর দরজা বন্ধ করে। ওড়না সরিয়ে রুমটা ভালোভাবে দেখছে । দেয়ালে কিছু কিছু মোটিভেশন লেখা, তার সাথে একটা দেয়ালে দুটা হাতের ছবি আঁকা। যে ছবিটা আবির ভাইয়ের ফোনে মেঘ দেখেছিলো। একটা বড় হাতের উপর একটা পিচ্চির হাত শক্ত করে ধরা৷ নিচে দুটা লাইনও লেখা,

আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ২৬

“আমার দেহে প্রাণ আছে যতদিন,
এই হাত ছাড়বো না আমি ততদিন।”
তার নিচে 🖤D🖤 এভাবে লেখা।
অক্ষর দেখে মেঘ কপাল কুঁচকে চেয়ে আছে। মাথায় কিছুই ঢুকছে না। D দিয়ে কার নাম হতে পারে। মেঘের নাম M দিয়ে, জান্নাত আপুর নাম J দিয়ে। মেঘ বিড়বিড় করে বলল,
“তাহলে কি জান্নাত আপুর অন্য নাম আছে?”

আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ২৮