আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ২৯

আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ২৯
লেখনীতে সালমা চৌধুরী

আবির আকাশের পানে চেয়ে মনে মনে বলল,
” তোর চোখে চোখ রেখে মি*থ্যা বলার সা*ধ্যি আমার নেই। কিন্তু তোর ভালোর জন্য এই মি*থ্যাটা বলতে হয়েছে। আমি চাই না আমার কারণে তুই তোর জীবনের লক্ষ্য থেকে সরে যাস। তোকে মা*নসিক ভাবে শ*ক্ত হতে হবে, এর থেকেও কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে তোকে।”

মেঘ সারা রাস্তা কাঁ*দতে কাঁ*দতে এসেছে। প্রতিদিন আবির ভাইয়ের কাঁধে হাত রাখলেও আজ ইচ্ছে করেই দূরে সরে বসেছে। বাইকের পেছনে হাত রেখেছে তবুও আবির ভাইকে ছোঁয়েও দেখেনি। এই অনূ*ভুতিহীন মানুষটা কোনোদিন মেঘের অনূ*ভুতি বুঝবে না। যেখান থেকে মেঘকে নিয়ে গেছিলো ঠিক সেখানেই মেঘকে নামিয়ে দিয়েছে আবির।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মেঘ হেলমেট রেখে একবারের জন্যও তাকায় নি আবিরের দিকে৷ যথারীতি বাড়ির উদ্দেশ্যে হাঁটছে। বুকের ভেতর অসহনীয় য*ন্ত্রণা হচ্ছে তার। এই যন্ত্রণার এক অংশ যদি আবির ভাই বুঝতো। মেঘ কাঁ*দছে আর বাড়ির দিকে হাঁটছে । গত ১৭ বছরেও সে এত কা*ন্না করেনি, এই আবির ভাই দেশে ফেরার পর যতবার কা*ন্না করেছে।
আবির বাইক থেকে দুর্বোধ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেঘের হাঁটার দিকে, কয়েক মুহুর্ত নিশ্চুপ থেকে অকস্মাৎ বলে উঠলো,

“তোকে প্র*তিশ্রু*তি দিবো না মেঘ,
বউ করে Direct প্রমাণ করে দিবো।
এই আবির কথা দিচ্ছে, তোর এই কা-ন্না
চিরতরে মুছে দিবো সেদিন,ইনশাআল্লাহ। ”

নির্বাচনের ঝামেলার পর থেকে তানভির বেশ শান্তিতে আছে। আপাতত কাজের এত চাপ নেই। এমপিও বিভিন্ন কাজে ব্য*স্ত, প্রয়োজন হলে মিটিং ডাকে, তখন উপস্থিত থাকতে হয় সেখানে। কয়েকমাসের কার্যক্রমে তানভির এমপির কাছের লোকদের মধ্যে একজন হয়ে উঠেছে। কোনো পোগ্রাম কিভাবে করলে ভালো হবে তা ম্যানেজ করার দায়িত্ব বেশিরভাগ টায় তানভিরের থাকে। নিজে না পারলে আবির তো আছেই। এমপির বাড়িতে দৌড়াদৌড়ি আর কাজ করতে করতে ধীরে ধীরে এমপির মেয়ের সাথেও তানভিরের সুসম্পর্ক হয়ে গেছে। মেয়েটাও তানভিরকে আপন ভাইয়ের মতোই দেখে। তানভিরদের একটা কাজের দায়িত্ব দিয়ে এমপি কোনো এক জায়গায় চলে গেছেন। তানভির আরও কয়েকজন মিলে কাজ করতেছিলো। হঠাৎ এমপির মেয়ের আগমন হয়। মেয়েটা হাসিমুখে বলে,

“তানভির ভাইয়া, একটু বসি এখানে?”
একে এমপির মেয়ে তারউপর নিজের বাড়ি তানভিরের তো না করার ক্ষমতা নেই। তাই ধীর কন্ঠে বলল,
“বসো। ”
মেয়েটা বসে আস্তে করে বলল,
“আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে এসেছি। জিজ্ঞেস করবো?”
“কি কথা?”

মেয়েটা আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো তারপর ধীর কন্ঠে বলল,
“ঐদিন পোগ্রামে আবির ভাইয়ার সাথে একটা মেয়ে আসছিলো। ঐ মেয়েটা কে?”
তানভির কপাল কুঁচকে শুধালো,
“কেন?”
মেয়েটা মৃদু হেসে উত্তর দিলো,
“মেয়েটা মাশাআল্লাহ অনেক কিউট । আমি ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করছিলাম মেয়েটা কে, ভাইয়া বলছে কাজিন। আপনি আর ভাইয়াও তো কাজিন তাহলে মেয়েটা কি আপনার বোন?”
তানভির স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,

“হ্যাঁ। আমার একমাত্র বোন মাহদিবা খান মেঘ। এখন বলো ঘটনা কি?”
মেয়েটা আমতা আমতা করে বলল,
“আসলে আপনার বোনকে আমার অনেক পছন্দ হয়ছে। আমার ভাইয়া UK তে পড়াশোনা করে। আমার মনে হচ্ছে আমার ভাইয়ার সাথে মেঘকে খুব ভালো মানাবে৷ ”

এটুকু বলেই থামলো। তানভির কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে। পুনরায় মেয়েটা বলা শুরু করলো,
” না না৷ এখন বিয়ে দিতে হবে না। ভাইয়া ২-১ বছরের মধ্যে ছুটি নিয়ে দেশে আসবে। তখন যদি….”
তানভির দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রা*গ কন্ট্রোল করে মৃদু হাসলো, তারপর শক্ত কন্ঠে উত্তর দিল,
“আমায় বলেছো, এখানেই থামো। ভাইয়া যদি এগুলো শুনে, তো আল্লাহ জানে কি করবে। ভাইয়ার যার সাথে বিয়ে ঠিক সে আর কেউ না, আমার একমাত্র বোন মেঘ। ভাইয়ার পৃথিবী জুড়ে শুধু মেঘের অস্তিত্ব । না ভাইয়া কারোর হবে আর না মেঘকে কারোর হতে দিবে। ”

মেয়েটা বিষ্ময় চোখে চেয়ে বিড়বিড় করে বলল,
“ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করেছিলাম গার্লফ্রেন্ড কি না, ওনি তো না করেছেন, বললেন কাজিন। ”
তানভির হাসিমুখে উত্তর দিলো,
“গার্লফ্রেন্ড না, তাই না করেছে। বউ কি না জিজ্ঞেস করতা তাহলে ঠিকই হ্যাঁ বলতো। ভাইয়া মেঘকে কখনো গার্লফ্রেন্ড ভাবে না, সবসময় বউ ভাবে আর বউ হিসেবেই পরিচয় দেয়। সে যাই হোক এই বিষয় নিয়া আর কথা বাড়িয়ো না। যাও এখান থেকে।”

মেয়েটা মন খারাপ করে চলে যাচ্ছে। আবিরকে ভালো লাগছিলো আবির অন্য কারো মালিকানায় বন্দি, এখন মেঘকে নিজের ভাইয়ের জন্য পছন্দ করছে এই মেঘও আবির ভাইয়ের দখলে। বিড়বিড় করে আবিরকে বক*তে বক*তে বাসার ভেতরে চলে গেছে। তানভির কাজ শেষ করে দুপুরে বাইক নিয়ে বের হইছে৷ মেঘদের কোচিং এর সামনে ওয়েট করছে। কিছুক্ষণের মধ্যে কয়েকজনের সাথে বন্যাও বেড়িয়ে আসছে৷ বন্যাকে দেখে তানভির বাইক থেকেই জোরে ডাকল,

“এই মেয়ে, এদিকে আসো। ”
বন্যা অবাক চোখে তাকালো। মেঘ তো কোচিং এ আসে না। ঐদিন ঝামেলার পরে মেঘ ই কল দিয়ে বন্যাকে সব বলেছে। তাহলে তানভির ভাইয়া কোচিং এর সামনে কেনো আসছেন?
বন্যা গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে আসলো তানভিরের কাছে। তানভির স্বাভাবিক কন্ঠে শুধালো,
“আজকের পরীক্ষা কেমন হয়েছে?”
বন্যা মৃদু হেসে উত্তর দিল,
“জ্বি ভালো। ”
তানভির গলা খাঁকারি দিয়ে ধীর কন্ঠে শুধালো,

“তুমি নাকি অসুস্থ ছিলা, সুস্থ হইছো?”
বন্যা বিষ্ময়কর দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। বন্যা অসুস্থ ছিল এটা তানভির ভাই কিভাবে জানে, অবশ্য জানবে না ই বা কেন। মেঘ ই নিশ্চয় বলেছে৷ বন্যা উপর নিচ মাথা নাড়লো। তানভির বাইকের সাইড থেকে একটা হেলমেট খুলে বন্যার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
“এটা পড়ে বাইকে বসো। ”
বন্যা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
“কেনো?”
তানভির কিছুটা শক্ত গলায় বললো,
“উঠতে বলছি উঠো। ”

বন্যা তানভির ভাই সম্পর্কে খুব ভালো করেই জানে। তাই ত্যা*ড়া*মি না করে চুপচাপ বসছে। তানভিরের পেছনে নিজের ব্যাগ রেখে তারপর বসেছে, যেনো গায়ে না লাগে। তানভির বন্যাকে নিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে এসেছে। বন্যার পছন্দ মতো খাবার অর্ডার দেয়া হয়েছে।
আগে একদিন মেঘ সাথে ছিল বলে বন্যার এতটা অস্বস্তি লাগে নি। তবে আজ একা তানভিরের সাথে খেতে এসে নিজের হাত-পা স্থির রাখতে পারছে না।
বন্যার অস্বাভাবিকতা দেখে তানভির স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,

“এত ভ*য় পাচ্ছো কেন? আমি তো অপরিচিত কেউ না। আর আশেপাশের মানুষ যদি তোমার এই কাঁপা-কাঁপি দেখে তাহলে নিশ্চিত ভাববে আমি তোমাকে কি*ড*না*প করে নিয়ে আসছি। প্লিজ স্বাভাবিক হও। ”
বন্যা কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে, কোমল কন্ঠে শুধালো,
“আমায় আবারও ট্রিট দেয়ার কারণ কি?”
তানভির উত্তর দিল,

“আমাদের এমপি জিতেছে সেই খুশিতে খাওয়াচ্ছি। আরও আগেই খাওয়াবো ভাবছিলাম কিন্তু সময় পাই নি।মাঝখানে এমপির বাড়িতে পোগ্রাম ছিল, অবশ্য ঐখানে তোমাকে যেতে বলতাম কিন্তু তুমি তো সেখানে যাবে না, তাই আর বলি নি। আজ একটু ফ্রী আছি এজন্য তোমাকে নিয়ে আসলাম৷ ”
বন্যা কিছু একটা ভেবে পুনরায় প্রশ্ন করলো,
“তাহলে মেঘকেও নিয়ে আসতেন!”

তানভির সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল,
“বনুকে নিয়ে আসতে চাইছিলাম, কিন্তু ভাইয়া নি*ষেধ করলো। ”
কথাটা বলেই ভাবনায় পরে গেছে তানভির। যদি বন্যা কিছু বুঝে ফেলে। যেই কথা সেই কাজ, বন্যা প্রশ্ন করে উঠলো,
“আপনি মেঘের আপন ভাই, তাহলে ওনি নি*ষেধ করবেন কেন?”
তানভির আমতা আমতা করে বলল,

” ঐদিনের কোচিং এর ঘটনা তো তুমি নিশ্চয় শুনেছো। আসলে ঐ ঘটনার পর থেকে বনু একটু চিন্তিত। এই অবস্থায় এদিকে আসলে যদি ভ*য় পায়, তাই ভাইয়া না করছে। আর কিছুই না৷ অবশ্য ওদের সবাইকে নিয়ে ঘুরতে যাবো। অনেকদিন ধরেই মীম আর আদি খুব করে ধরছে ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার জন্য। এতদিন নির্বাচনের ঝামেলার জন্য পারি নি। এখন না নিয়ে গেলে বাসায় ঝামেলা হয়ে যাবে। ”

বন্যা মৃদু হাসলো। বাসার ঝামে*লার ভ*য়ে ভাই বোনদের ঘুরতে নিয়ে যাবে। তানভির যে কোনো কিছুকে ভ*য় পায় এটা শুনেই বন্যার হাসি পাচ্ছে। বন্যার অপরূপ হাসি দেখে তানভিরও হেসে ফেললো। তানভিরের উচ্চতা ৫ ফিট ৯” গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যামলা, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী, বলতে গেলে কিছুটা গুলুমুলু টাইপের, তানভিরের দাঁড়িও আবিরের মতোই ছোট করে কা*টা। ফুল হাটার টিশার্ট কনুই পর্যন্ত উঠানো,সাথে জিন্স প্যান্ট, হেলমেটের কারণে গুছানো চুলগুলো অগোছালো হয়ে গেছে। বন্যা তানভিরের মুখের দিকে কিছুক্ষণ দেখলো। এমনিতে খুব মু*ডি মনে হলেও হাস্যোজ্জল মুখ দেখলে মনেই হয় না এই মানুষ টা এত রা*গী। দুজনেই খাওয়া শেষ করলো। তারপর বন্যাকে বাসার গলি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে বাসায় ফিরেছে তানভির।

দিনটা বৃহস্পতিবার ছিলো। মেঘ সন্ধ্যাবেলা সোফায় বসে নুডলস খাচ্ছিলো। এমনিতেই ইদানীং মেঘের মন ভালো নেই। আবির ভাইয়ের মুখে সেদিনের না শব্দ শুনার পর থেকে মেঘ আর আবির ভাইয়ের সাথে কথা বলে না। আবিরও আগ বাড়িয়ে কথা বলতে আসে না। মেঘের নুডলস খাওয়ার মাঝে মালিহা খান হুট করে এসে মেঘের পাশে বসলেন। মেঘ অবাক চোখে চাইলো বড় আম্মুর দিকে, তারপর ঠান্ডা কন্ঠে শুধালো,

“কি হয়েছে বড় আম্মু?”
মালিহা খান উত্তেজিত কন্ঠে বলা শুরু করলেন,
“হ্যাঁ রে মেঘ, মেয়েটা যে তোকে পড়ায় কি যেনো নাম?”
মেঘ ভ্রু কুঁচকে উত্তর দিল,
“জান্নাত আপু, কেনো?”
মালিহা খান উত্তেজিত কন্ঠে পুনরায় বললেন,

“জান্নাত মেয়েটাকে তোর কেমন লাগে? আমার তো বেশ ভালো লাগে, খুব ঠান্ডা, মন মানসিকতাও ভালোই মনে হলো। আমার মাথায় একটা চিন্তা ঘুরতেছে। আবিরের তো বিয়ের বয়স হয়েই গেছে, জান্নাতের সঙ্গে তোর আবির ভাইকে মানাবে ভালো। তাই না?”

মেঘের মনে হচ্ছে মাথার উপরে অবস্থিত ছাদ টা অকস্মাৎ মেঘের মাথায় ভেঙে পরেছে৷ মেঘের বুকটা কেঁপে উঠলো। যেই মেয়েকে নিয়ে নিজেই আ*তঙ্কে আছে সেখানে বড় আম্মু ঐ মেয়েকেই বউ করার কথা বলছে। এ যেনো কা*টা গায়ে নুনের ছিটা দেয়ার মতো৷ মেঘ ঢুক গিলে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু চাইলেই কি সবকিছু লুকানো সম্ভব! যেই মানুষটার জন্য বুকের ভেতর এক আকাশ সমান ভালোবাসা সেই মানুষটার বিয়ের কথা শুনছে তাও অন্য মেয়ের সাথে। মেঘের চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। বড় আম্মুকে কি করে বুঝাবে,

“তিন মাসেই আবির ভাইকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবেসে ফেলেছে। ”
মালিহা খান পুনরায় প্রশ্ন করলেন,
“এই মেঘ, জান্নাত কে জিজ্ঞেস করিস তো কাউকে পছন্দ করে কি না! পছন্দ না থাকলে ভাবছি আবির আর তোর বড় আব্বুর সাথে এই বিষয়ে কথা বলবো। ”

কথা শেষ করে মালিহা খান উঠে রান্না ঘরে চলে গেছেন, এদিকে মেঘের গলা দিয়ে নুডলস নামছে না৷ বুক ফেটে কা*ন্না আসছে৷ নুডলস এর প্লেট রেখে নিজের রুমে চলে গেছে৷ ফ্যান ছেড়ে, লাউড স্পিকারে গান চালিয়ে ইচ্ছে মতো কেঁ*দে*ছে। মনের কষ্ট প্রকাশ করার মতো কেউ নেই মেঘের জীবনে। তাই কান্না ই তার একমাত্র সঙ্গী৷
ঘন্টাখানেক পর জান্নাত আপু পড়াতে আসছে। মেঘ হাতমুখ ধৌয়ে ফ্রেশ হয়ে নিচে পড়তে আসছে৷ জান্নাত আপুকে দেখে মেঘের মাথায় শুধু বড় আম্মুর কথা গুলোই ঘুরছে। পড়ানো শেষে মেঘ বলল,

“আপু একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”
জান্নাত মিষ্টি করে হেসে বলল,
“হ্যাঁ অবশ্যই। ”
মেঘ শীতল কন্ঠে প্রশ্ন করলো,
“আপু আপনি কি কাউকে পছন্দ করেন?”
মেঘের এমন প্রশ্নে জান্নাতের ওষ্ঠদ্বয় আরও বেশি প্রশস্ত হলো। শান্ত স্বরে উত্তর দিলো,
“হ্যাঁ।”

মেঘ যেই না প্রশ্ন করতে যাবে “কে সে” তার আগেই জান্নাতের ফোনে কল আসছে। কল রিসিভ করে কথা বলতে বলতে মেঘের থেকে বিদায় নিয়ে জান্নাত বেড়িয়ে গেছে৷ অষ্টাদশীর মনের ভেতর তোলপাড় চলছে। বড় আম্মুর বলা কথাগুলো মাথায় ঘুরছে, জান্নাত আপুর বিষয়ে আবির ভাইয়ের কেয়ার, কিছুদিন আগে মেঘকে কাজিন বলে পরিচয় দেয়া, আজ জান্নাত আপুর পছন্দের মানুষ আছে জানতে পারা। সবকিছু যদি এক সুতোয় বাঁধা হয় তাহলে মেঘের কি হবে! মেঘের চোখ টলমল করছে, দু ফোঁটা পানি গরিয়ে পরতেই মেঘ হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে চোখ মুখে, শক্ত কন্ঠে নিজেকে শাঁসালো,

“একদম কাঁদবি না। যে মানুষটা কোনোদিন তোর হবেই না। তাকে নিয়ে কেনো কাঁদছিস?”
মেঘ রাতে খায় নি, সবাই অনেক ডেকেছে কিন্তু তাতেও মেঘ রুম থেকে বের হয় নি৷ আবির বাসায় ফেরার পর থেকে ছাদে ছিল। রুমে এসেছে শেষরাতের দিকে। তাই সে এসবের কিছুই জানে না৷

শুক্রবারে সকাল থেকে মেঘের কোনো হদিস নেই। তানভির পর্যন্ত ডেকে আসছে কিন্তু মেঘ আসে নি। আবির ঘুম থেকে উঠেছে ১২ টার দিকে, শাওয়ার নিয়ে রেডি হয়ে নামাজে গেছে৷ মেঘ তখনও রুমে। শাওয়ার নিয়ে নামাজ পরে আবার শুয়ে পরেছে৷ বের হয়ে আবির ভাই বা বড় আম্মুর মুখোমুখি হওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই তার৷ আবির নামাজ থেকে এসে খেতে বসেছে, বাকিরাও খেতে বসতেছে।
আকলিমা খান হালিমা খানকে উদ্দেশ্য করে আস্তে করে বললেন,

“মেজো আফা, মেঘ তো এখনও খেতে আসলো না। ”
এই কথা আবিরের কান পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। খাবার মুখে দিতে গিয়েও থেমে গেলো, সহসা তানভিরের দিকে তাকিয়ে ইশারা দিলো। তানভির সঙ্গে সঙ্গে উঠে গেছে৷ মেঘকে ডেকে,ধ*ম*কে নিয়ে আসছে। মেঘের চোখমুখ ফুলে আছে, চুলগুলো এখনও ভেজা, চুল থেকে টুপটুপ করে পানি পরছে৷ মাথা নিচু করে খেতে বসেছে। চুল দিয়ে বেশ অর্ধেক মুখ ডেকে রেখেছে। কিন্তু আবির মেঘের বিপরীতে বসায় স্পষ্ট মেঘের চোখ, নাক, মুখ দেখতে পাচ্ছে । আবির খাওয়ার মাঝখানে বেশ কয়েকবার মেঘের দিকে তাকিয়েছে৷ ভেবেই পাচ্ছে না “হলো কি?” কিন্তু মেঘ ভুল করেও একবার মুখ তুলে তাকায় নি৷

মেঘের হাবভাব দেখে মোজাম্মেল খান রে*গে গেলেন, কঠিন স্বরে বললেন,
“পরীক্ষা যত কাছে আসছে তোমার অমনোযোগিতা ততই বাড়ছে। যা যা চাইতেছো সবই তোমাকে দেয়া হচ্ছে তারপরও তোমার পড়াশোনা তে এত অবহেলা। শুনলাম ইদানীং কোচিং এও যাচ্ছো না, অবশ্য যাবেই বা কিভাবে, যাই হোক বাড়িতে অন্তত ঠিকমতো পড়াশোনা করো। ”
আবির খাওয়া বন্ধ করে দাঁতে দাঁত চেপে বসে আছে, আবিরের অন্য হাত টেবিলের নিচে তানভির চেপে ধরে রেখেছে। আবির প্লেটের খাবার শেষ করে সবার আগেই উঠে গেছে। কোনোদিকে না তাকিয়ে সোজা রুমে চলে গেছে৷

১-১.৩০ ঘন্টা পর তানভির মীমকে আর আদিকে ডেকে বলেছে রেডি হওয়ার জন্য, ঘুরতে নিয়ে যাবে।৷ দুই ভাই বোন খুশিতে গদগদ হয়ে রেডি হতে চলে গেছে৷ জীবনে প্রথমবার বাইকে ঘুরতে যাচ্ছে। আবির আগে থেকে রেডি হয়েই সোফায় বসে আছে। শুক্রবার মানেই আবিরের পাঞ্জাবি পড়ার দিন, বেগুনি রঙের একটা পাঞ্জাবি পরেছে, সাথে সাদা রঙের প্যান্ট, বেলি ফুলের সুগন্ধ যুক্ত তীব্র পারফিউম দিয়েছে গায়ে, সাথে একটা সুন্দর ডিজাইনিং ঘড়ি, চুল গুলোও সুন্দর করে স্টাইল করেছে৷ যদিও হেলমেট পরলে চুল অগোছালো হবেই৷ আবির সোফায় বসে ফোন চাপতেছিলো৷ তানভিরের পড়নে পাঞ্জাবি আর লুঙ্গি৷ নামাজ থেকে এসে লুঙ্গি পরেছিল এখনও তাই পড়নে। প্যান্ট পড়ার সময়ও পাচ্ছে না ছেলেটা৷ সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে আবিরের থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে বলল,

“ভাইয়া, বনু তো ঘুরতে যাবে না বলছে! ”
সঙ্গে সঙ্গে আবির চোখ রাঙিয়ে তাকিয়েছে। তানভির ঢুক গিলে ছোট করে বলল,
“আচ্ছা আমি রাজি করাচ্ছি। ”
আবার দ্রুত দৌড় দিলো বোনের রুমের দিকে৷ মেঘকে বুঝাচ্ছে কিন্তু মেঘ কোনোকিছুতেই রাজি হচ্ছে না৷ রা*গে চিৎকার করছে,

“বললাম তো যাবো না। তোমরা ঘুরে আসো আমার ইচ্ছে নেই৷ ”
তানভির আবার নিচে আসছে, আবিরকে কিছু বলার আগেই আবিরের তপ্ত দৃষ্টি দেখে ভ-য়ে আবার বোনকে রাজি করাতে গেছে৷ ৪-৫ বার উপর নিচ করতে করতে অবশেষে বোনকে রাজি করাতে সক্ষম হয়েছে৷ মেঘ রাজি হয়েছে শুনে আবির বাসা থেকে বেড়িয়ে বাইকে বসে আছে৷
তানভির সহ সবাই রেডি হয়ে বেড়িয়েছে। তানভির আবির কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে আস্তে করে বলল,

“বনুকে রাজি করিয়ে এনেছি ঠিকই কিন্তু তার শর্ত সে তোমার বাইকে যাবে না। ”
আবির অন্য দিকে মুখ করে কি*ড়মিড় করে বলল,
“তোর বোন আমার সাথে না গেলে তোর খবর আছে। ”
তানভির মনে মনে বলছে,
“আল্লাহ তুমি আমায় উদ্ধার করো। দুই দিকে আ*গ্নে*য়গি*রি মাঝখানে আমি অসহায় এক বালতি পানি। কি করে সামলাবো এই দুই পাগলরে?”

তানভির বাধ্য হয়ে মেঘকে বুঝাতে গেলো৷ মেঘ মাত্রাতিরিক্ত রে*গে আছে৷ আজ তানভিরের কথা শুনা বা মানার কোনো ইচ্ছে তার নেই। আবির ভাইয়ের সাথে যাবে না মানে যাবেই না। তানভির আবিরের দিকে তাকাতেই দেখলো আবির রা*গে ফুঁ*সছে৷
তানভির বিড়বিড় করে বলল,
“কি মসিবতে পড়লাম আমি! ”

কোনোকিছুতেই যখন বোনকে মানাতে পারছিলো না তখন তানভির বলে উঠলো,
“দেখ বনু, ভাইয়ার বাইক এ একজনই বসতে পারবে, দুজন বসলে রিস্ক হয়ে যাবে। আমার বাইকে দুজন বসা গেলেও দুজন মেয়ে বসা যাবে না। মীম জীবনে প্রথম বাইকে উঠবে, তোরা দুজন একসাথে বসলে যদি এ*ক্সিডে*ন্ট করে ফেলি। তাই বলছি তুই ভাইয়ার সাথে যা। ”
মেঘের এপাশ ওপাশ মাথা নাড়িয়ে বলল,

“আমি এসব জানি না। আমি ঐ বাইকে যাব না। তাহলে তোমরা ঘুরে আসো আমি যাব না । ”
তানভির আঁতকে উঠে বলে,
” না, তুই যাবি৷ প্লিজ, এটায় লাস্ট টাইম এরপর থেকে আমিই তোকে নিয়ে যাবো। এবারের মতো ভাইয়ার সাথে চলে যা। ”

এই কথা বলে তো ফেলছে৷ কিন্তু ঘুরে ভাইয়ের দিকে তাকানোর সাহস পাচ্ছে না। কারণ এই কথা শুনে নিশ্চিত ভাবে আবিরের রা*গ দ্বিগুণ বেড়েছে, আর ভাইয়ের র*ক্ত ব*র্ণের চোখে চোখ রাখার ক্ষমতা তানভিরের নেই। সে তো বোনকে বুঝানোর জন্য এই কথা বলছে কিন্তু আবির তো এটা সহ্য করবে না।
মেঘ শক্ত কন্ঠে বলল,

“ঠিক আছে ”
তানভির দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হাসলো। বোনকে মানাতে পারছে এতেই শুকরিয়া। মেঘ আবিরের পেছনে বসেছে ঠিকই কিন্তু মাঝখানে একহাত ফাঁকা রেখে। আবির উচ্চস্বরে বলে উঠলো,
“তানভির তোর বোন রে বল ধরে বসতে, না হয় রাস্তায় আ*ধম*রা হয়ে পরে থাকবে তখন বোনের জন্য কাঁ*দিস না। ”

আবির ভাইয়ের ভারি কন্ঠের হুং*কার শুনে মেঘ সঙ্গে সঙ্গে আবির ভাইয়ের কাঁধ চেপে ধরে আবিরের কাছাকাছি এসে বসলো, আবির হেলমেটের আড়ালেই মৃদু হাসলো। তারপর বাইক স্টার্ট দিলো৷
এদিকে তানভির বিড়বিড় করে বলছে,
“আহারে, আমার বোনের কিছু হলে আমার আগে তো তুমিই মই*রা যাবা। ”

তানভিরও যথারীতি মীম আর আদিকে নিয়ে বাইক স্টার্ট দিলো। ৩ ঘন্টা ঘুরেছে, সবার পছন্দ মতো খাবার খেয়েছে, নাগড় দোলায় উঠেছে, অথচ মেঘের মুখে হাসির ছিটেফোঁটাও নেই। সে জড়বস্তুর ন্যায় আচরণ করছে। মেঘকে এতটা উদাসীন থাকতে দেখে আবিরের ই কষ্ট হচ্ছে৷ আবির তো চেয়েছিলো মেঘের মনোযোগ যেনো আবিরের থেকে কিছুটা সরে পড়াশোনায় যায়। সে তো কখনো চাই না তার অষ্টাদশী এভাবে মুখ গোমড়া করে থাকুক৷ মীম, আদি আর তানভিরকে বাড়ি পাঠিয়ে আবির মেঘকে নিয়ে অনেকটা পথ পেরিয়ে একটা নির্জন রাস্তায় আসছে। রাস্তার পাশে অনেকটা দূরে দূরে ল্যামপোস্টের লাইটের আলো জ্বলছে। আবির বাইক থামিয়ে হেলমেট খুলে রাখলো, তারপর ঠান্ডা কন্ঠে শুধালো,

“কি হয়েছে তোর?”
নির্জন রাস্তায় আচমকা এমন প্রশ্নে, মেঘ কিছুটা কেঁপে উঠেছে। কি বলবে সে, এই প্রশ্নের উত্তর মনের মধ্যে থাকলেও তা বলার মতো সাহস নেই মেঘের । সামান্য এক প্রশ্নে যেই থা*প্প*ড় খেয়েছিলো আজ যদি বিয়ে নিয়ে কথা বলে তাহলে হয়তো এই নির্জন রাস্তায় মে*রে ফেলে রেখে চলে যাবে। এসব ভেবেই মেঘের শরীর কাঁপছে।
আবির পুনরায় প্রশ্ন করলো,
“তোর কি শরীর খারাপ লাগছে?”
মেঘ ঢুক গিলে আস্তে করে বলল,
“না, ঠিক আছি। ”
আবির শক্ত কন্ঠে শুধালো,

“তাহলে বল তুই কি নিয়ে এত আপসেট? পরীক্ষা নিয়ে টেনশনে আছিস?”
মেঘের মনে অন্য চিন্তা থাকা সত্ত্বেও উপর নিচ মাথা নাড়লো।
আবির ভারী কন্ঠে বলা শুরু করলো,

” এডমিশন টেস্ট নিয়ে এত ভাবিস না। তোর কাজ পড়াশোনা করা তুই শুধু তাই কর। আর নামাজ পরে আল্লাহ র কাছে চাইবি। কে কি বললো, কে কি করছে, কোথায় কি হচ্ছে এসব ভেবে মাথা নষ্ট করার প্রয়োজন নেই। তুই যদি কোথাও চান্স নাও পাস তাতেও কেউ তোকে কিছু বলবে না, সেটা আমি দেখবো। কিন্তু নিজেকে যাচাই করার আগেই ভে*ঙে পরবি না। ”

মেঘ মাথা নিচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। আবির মেঘের দিকে তাকিয়ে আছে৷ দূর থেকে আসা ল্যামপোস্টের আলো মেঘের গালে আর কপালের একপাশে পরছে, সেই আলোতে মেঘকে অসম্ভব সুন্দর লাগছে। মেঘের সম্পূর্ণ মুখ দেখতে আবির এক আঙুলে মেঘের চিবুক উঠালো৷ আলোয় জ্বলজ্বল করে উঠলো অষ্টাদশীর চাঁদের ন্যায় মুখবিবর।

আচমকা আবির ভাইয়ের আঙুলের ছোঁয়াতে মেঘের দেহ কম্পিত হলো৷ আবির ভাইয়ের মুখের দিকে তাকালো মেঘ। বুকে জমে থাকা অভিমান রা যেনো অভিযোগ হয়ে বেড়িয়ে আসতে চাইছে, মনের সব কষ্ট উজাড় করে বলতে ইচ্ছে করছে এই মানুষটাকে। কয়েক সেকেন্ডের জন্য মেঘের মনে হচ্ছে এই পৃথিবীর বুকে মেঘের সামনে দাঁড়ানো ব্যক্তিটা মেঘের সবচেয়ে কাছের মানুষ। এই মানুষটা একান্তই মেঘের।
আবির মেঘের চোখে চোখ রেখে তপ্ত স্বরে বলল,
“আমি বিশ্বাস করি, আমার মেঘ এত সহজে হে*রে যাওয়ার মেয়ে নয়৷ ”

এই কথা শুনা মাত্র মেঘের মনে হচ্ছে মস্তি*ষ্কের নিউ*রনেরা দ্বিকবিদিক ছুটছে৷ মনে একটা কথায় বারবার ঘুরছে, “আমার মেঘ”
আবির ভাই, আমার মেঘ বলে সম্মোধন করেছেন এটা ভাবতেই মেঘের সকল মন খারাপ এক মুহুর্তেই পালিয়ে গেছে। সহসা মেঘের মুখে হাসি ফুটে উঠেছে।
মেঘের মুখের অকৃত্রিম, মায়াবী হাসি দেখে আবিরও নিঃশব্দে হাসলো, মেঘের দিকে তাকিয়ে থেকেই পুনরায় ধীর কন্ঠে বলল,

“This is my sparrow.
I always want to see you like this.”
মেঘ নিস্তব্ধ হয়ে চেয়ে আছে আবিরের দিকে। এইযে এই মানুষ টাকে নিয়ে এত অভিমান, এত অভিযোগ সামনে আসলে কেনো এই অভিযোগ আর অভিমানরা পালিয়ে যায়। এত এত রা*গ কেনো দেখাতে পারি না ওনাকে! ওনি যদি সত্যি সত্যি জান্নাত আপুকে পছন্দ করেন আর জান্নাত আপুও যদি ওনাকে পছন্দ করেন তাহলে তো ওনাদের বিয়ে খুব শীঘ্রই হয়ে যাবে। তখন আমি কি করবো? এইযে এই মানুষটার ছোট ছোট কথাতেই আমার সব রা*গ গলে পানি হয়ে যায়, আবার নতুন করে ওনার প্রেমে হাবুডুবু খায়, ওনি জান্নাত আপুকে বিয়ে করলে আমার কি হবে? তখনও কি ওনার প্রতি আমার এরকম ই টান থাকবে? নাকি এখনের অনূভুতি গুলো তখন শুধুই স্মৃতি হয়ে থাকবে? এসব ভাবতে ভাবতে মেঘ ঠোঁট ফুলিয়ে কা*ন্না শুরু করে দিয়েছে৷

হঠাৎ কান্না দেখে আবির কিছুটা অবাক হয়ে গেছে। কিছুই তার মাথায় ঢুকছে না। সে ভেবেছিল শুধু এমপির বাড়ির ঘটনা থেকেই মেঘের মন খারাপ আর বাকিটা পড়াশোনা নিয়ে। কিন্তু এই মন খারাপের সবটা জুড়ে যে জান্নাত এটা আবির বুঝতেও পারছে না।

আবির কিছুক্ষণ সময় নিয়ে চুপচাপ মেঘের দিকে তাকিয়ে আছে৷ একবারের জন্য কা*ন্না থামাতেও বলছে না। অনেকটা সময় কাঁদার পর মেঘ আবিরের মুখের দিকে তাকালো। একটা মেয়ে এভাবে কাঁদছে অথচ এই মানুষটা কিছু বলছেনও না। এতক্ষণে তো অন্ততপক্ষে ৪-৫ টা ধ*মক আর ২-১ টা থা*প্প*ড় খেয়েই ফেলতো৷ তাহলে আজ এত নিশ্চুপ কেনো ওনি। এটা ভেবেই মেঘ তাকিয়েছে, ল্যামপোস্টের আলোতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে আবির মুচকি মুচকি হাসছে । মেঘ তাকাতেই আবিরের হাসির মাত্রা বেড়ে গেছে। মেঘ কপাল কুঁচকে চেয়ে রইলো, গাল বেয়ে অনর্গল নোনাজল গড়িয়ে পরছে ৷ এইযে ম*রার মতো এতক্ষণ যাবৎ কাঁদছে, আর এই ব্যাটায় কি সুন্দর হাসছে৷ মেঘের মে*জাজ আবার খা*রা*প হয়ে যাচ্ছে।
মুখ ফুলিয়ে শ্বাস ছেড়ে আবিরের দিকে চেয়ে গম্ভীর কন্ঠে প্রশ্ন করল,

“হাসছেন কেনো?”
আবির হাসিটা একটু কমিয়ে উত্তর দিল,
“কাঁদলে তোকে অনেক বেশি সুন্দর লাগে তো তাই। ”
মেঘ রা*গী ভাব নিয়ে বলল,
” কাঁদলে আবার কাউকে সুন্দর লাগে নাকি, আর তাই বলে আপনি এভাবে হাসবেন?”
আবির মৃদু হেসে উত্তর দিল,
“আসলে তোর বান্ধবীর থেকেও সুন্দর লাগছিল, তাই হাসি আটকাতে পারছিলাম না৷ ”
মেঘ আঁতকে উঠে প্রশ্ন করল,

“বান্ধবী মানে?”
আবির স্ব শব্দে হেসে উত্তর দিল,
“ঐ যে শেও*ড়াগাছে যে থাকে তোর বান্ধবী টা। ঐ টার থেকেও তোকে সুন্দর লাগছিল৷ ”

মেঘ আশেপাশে তাকাচ্ছে, এমনেই অন্ধকার হয়ে গেছে চারপাশ, ল্যামপোস্টের আলোতে রাস্তা আলোকিত থাকলেও, রাস্তার আশেপাশে বিশাল গাছের কালো ছায়া দেখে ভ*য় পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে দু হাতে আবিরের শার্ট খামচে ধরে আবিরের বুকে মুখ লুকিয়ে ফেলেছে। মেঘকে ভ*য় দেখানোর একমাত্র অস্ত্র হচ্ছে ভূ*ত, পে**ত্নী আর কোনোকিছুতেই ভ*য় পায় না মেয়েটা। আবির এটা খুব ভালো করেই জানে। এজন্য ই ইচ্ছে করে মেঘকে খুঁচা*য়।
আবির মেঘের পিঠে হাত রাখতে গিয়েও হাত সরিয়ে নিয়েছে। মনের বিরুদ্ধে নিজেকে কন্ট্রোল করা কতটা কষ্টের সেটা আবিরের থেকে ভালো কেউ জানে না। আবিরের ও ইচ্ছে করছে মেঘকে দু হাতে ঝাপটে ধরতে কিন্তু সব ইচ্ছে তো পূর্ণতা পায় না।

আবির নিজেকে সংযত করে মুচকি হেসে প্রশ্ন করলো,
“এইযে তুই হুট করে ম*রা কা*ন্না জুড়ে দেস আবার হুট করেই পাগ*লের মতো হাসতে থাকিস তোর এমন আচরণেই মানুষ ভাববে তুই শেও*ড়া পা*ড়ায় থাকিস। ”
মেঘ এখনও ২ হাতে শার্ট খামচে ধরে আছে, ভেজা কন্ঠে বলল,

” এসব কথা বলবেন না প্লিজ। ”
আবির মৃদু হেসে উত্তর দিল,
“তাহলে তুই বল কাঁ*দছিলি কেনো? তোরে কে কি বলে যে তুই এভাবে কাঁ*দিস? এত আবেগ দিয়ে জীবন চলবে না মেঘ, কে কি বলল, কে কি করলো, কে কোথায় চান্স পেলো এসব ভেবে নিজেকে গুটিয়ে নিলে জীবনে কোনোদিন উন্নতি করতে পারবি না। নিজেকে কন্ট্রোল করতে শিখতে হবে। ”
মেঘ আবিরকে ছেড়ে একটু দূরে সরে মাথা নিচু করে দাড়িয়েছে। আবির ছোট করে ধ*মক দিল,

“তাকা এদিকে। ”
মেঘ এক সেকেন্ডের মধ্যে আবিরের চোখের দিকে তাকালো।
আবির ঢুক গিলে শক্ত কন্ঠে বলল,
“তোকে অনেক বেশি শ*ক্ত আর সা*হসী হতে হবে। আশেপাশে তোকে কাঁ*দানোর জন্য হাজারো মানুষ থাকবে। তাদের কথায় তুই কেঁ*দেছিস মানে তারা জিতে গেলো৷ এত সহজে অন্য কে জিতিয়ে দেয়া কি ঠিক হবে?”
একটু থেমে পুনরায় বলল,
“জীবনে যাই হয়ে যাক, তবুও নিজের মনোবল ভাঙতে দেয়া যাবে না। এখনও অনেক সত্যির মুখোমুখি হওয়া বাকি।”

মেঘ কপাল কুঁচকে প্রশ্ন করল,
“কি এমন সত্যি? ”
আবির স্বাভাবিক কন্ঠে উত্তর দিল,
” এখন তোর না জানলেও চলবে। দেরি হয়ে যাচ্ছে, বাসায় যেতে হবে।”

রবিবারে অফিস থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়ে আবির সোফায় বসে আছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই জান্নাত বাসায় ঢুকছে। মেঘ একটা খাতা রেখে আসছিলো সেটা আনতে আবার রুমে গেছে।
জান্নাত কে দেখে আবির হাতে কয়েক প্রশ্ন নিয়ে এগিয়ে গেলো৷ প্রশ্ন গুলো দিয়ে কি যেনো কথা বলছিলো। মেঘ খাতা নিয়ে নামতে গিয়ে সেই দৃশ্য দেখে ফেলছে৷ যার মনে যেটা থাকে সেটায় সবার আগে মাথায় আসে। মেঘ তাড়াতাড়ি করে নামছে। কাছাকাছি আসতেই আবির ঘাড় ঘুরিয়ে মেঘ কে দেখলো, তারপর স্বাভাবিক কন্ঠে জান্নাত কে বলল,

“তুমি ঐসব নিয়ে চিন্তা করো না। আমি দেখছি। আর তুমি ফ্রী হয়ে আমায় একটা কল দিও। ”
জান্নাত চিন্তিত স্বরে উত্তর দিল,
“আচ্ছা, ঠিক আছে। ”
এদিকে মেঘ ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে দুজনের দিকে। মাথার ভেতরে প্রশ্নেরা সব এলোমেলো ছুটছে, জান্নাত আপুকে চিন্তা করতে না করছে? আবির ভাই দেখবে এসবের মানে নি? ওনাদের মধ্যে সম্পর্ক না থাকলে তো এসব বলতো না। আবার কলও দিতে বলছে। মেঘ বিড়বিড় করে বলছে,

“গেলো রে গেলো, তোর আবির ভাই অন্য মেয়ের হয়ে গেলো। ”
আবিরের আনা কোচিং এর কয়েকটা প্রশ্ন দিয়ে জান্নাত পরীক্ষা নিয়েছে। মোটামুটি ৩ ঘন্টার উপরে সময় লাগছে। ড্রাইভার আর তানভির কে পাঠিয়েছে জান্নাতকে বাসা পর্যন্ত দিয়ে আসতে৷ মেঘ খেতে বসেছে, ২ মিনিটের মধ্যে আবিরও খেতে আসছে। বাড়ির সবার খাওয়াদাওয়া অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। আবির ইচ্ছে করেই মেঘের জন্য ওয়েট করছিলো। এইযে সে জান্নাতের সাথে কথা বলেছে, মেঘের মনে কি চলছে তা বুঝার জন্যই ওয়েট করছিলো। ২ জন ই চুপচাপ খাচ্ছে। হঠাৎ মালিহা খান তানভিরের চেয়ার টেনে আবিরের পাশে বসছেন। তারপর শান্ত কন্ঠে বললেন,

“বাবা, তোর সাথে একটু কথা ছিল”
আবির খেতে খেতেই জবাব দিল,
“বলো, শুনছি। ”
মেঘের খাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। সে খুব ভালোই বুঝতে পারছে বড় আম্মু কি বলতে চাচ্ছেন। আজকে জান্নাত আপু যাওয়ার সময় ও মেঘ দেখেছে বড় আম্মু জান্নাতকে দূর থেকে বউ দেখার মতো পরখ করছিলো।
মালিহা খান শীতল কণ্ঠে বলা শুরু করলেন,

“আর কিছুদিন পরেই তোর ২৫ বছর হতে চলল, তুই যেহেতু এখন ব্যবসাও করছিস, তোর আব্বুর মুখে শুনেছি তুই খুব মনোযোগী আর তুই যাওয়াতে নাকি ব্যবসায় অনেক উন্নতি হচ্ছে। তাই বলছিলাম বিয়ে তো করা দরকার, আমি সেদিন মেঘকে জান্নাতের কথা জিজ্ঞেস করছিলাম। মেয়েটাকে আমার ভালো লাগছে। তোর পছন্দ হলে ভাবছি তোর আব্বুকে জানাবো। ”

আবির পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে মায়ের বলা এলোমেলো কথাগুলো শুনলো৷ যতই রা*গ উঠুক আবির মায়ের উপর সহজে চেঁ*চায় না। মেঘের দিকে এক পলক তাকালো আবির। মেঘ অনেকক্ষণ আগে থেকেই খাওয়া বন্ধ করে, মাথা নিচু করে বসে আছে।
আবির মনে মনে ভাবছে,

“মানুষ ঠিক ই বলে, জীবনে হাজার হাজার শ*ত্রুর প্রয়োজন হয় না, ঘরে ২-১ এমন মানুষ থাকলেই যথেষ্ট । হায় আল্লাহ! আমি বিয়ে করার আগেই তো ওরা আমার সংসার ভেঙে দিবে । তারমানে এই কারণেই মেঘ সেদিন এত কা*ন্না করছিলো। আর আমি ওকে পড়াশোনা নিয়ে এত জ্ঞান দিলাম।”
আবিরকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে মেঘের মনটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। আবির ভাই রাজি হলেই সামনে বিয়ে। অবশ্য রাজি হবে না ই বা কেনো। ওনিও তো…

এটুকু ভেবেই মেঘ থেমে গেলো।চোখ টলমল করছে, ঠোঁট কাঁপছে ।
আবির মায়ের দিকে তাকিয়ে ভারী কন্ঠে অকস্মাৎ বলে উঠল,
“একটা মেয়ে এই বাড়িতে পড়াতে আসছে। আর তোমরা কি সব ভাবছো। তাছাড়া আমি এখন বিয়ে করবো না। এই টপিকে আর কথা বলো না। ”

আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ২৮

এটুকু বলেই আবির দাঁড়িয়ে পরলো। মেঘের দিকে তাকিয়ে তপ্ত স্বরে বলল,
“এই মেয়ে খাওয়া শেষ করে পড়তে বস গিয়ে। এসব আজা*ইরা চিন্তা মাথায় ঢুকাবি না। ”

আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ৩০