আসক্তি পর্ব ৪৬

আসক্তি পর্ব ৪৬
লেখায়ঃআফিয়া আজাদ নিঝুম

“মা, মা! “-শান হন্তদন্ত হয়ে চিৎকার করে ওঠে।পুরো বাড়িময় সে আওয়াজ তীরের মতো বিঁধে যায়।শর্মিলা বেগম তখন ড্রয়িং রুমে সবার সাথে গল্পে মশগুল। ছেলের গলার অস্থির ডাকে গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায়।সবাই ছুটে চলে উপরে শানের ঘরে।সুমি দাদিজানকে ধরে ধরে নিয়ে যায় উপরে।
দরজায় দাঁড়িয়ে সবাই অবাক হয়ে যায়।পাখি পেট চেপে ধরে চাপা আর্তনাদ করে ওঠে।দাঁতে দাঁত চেপে অসহনীয় ব্যথাটা সহন করার বৃথা চেষ্টা করছে।ব্যথার চোটে গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পরে বুকে।শান ফোনে কাউকে কিছু বলছে।শর্মিলা বেগম ছুটে এসে পাখির চোখ মুখ মুছে দিয়ে শান্তনা দেয়,”নিজেকে শক্ত করো মা।আল্লাহ্কে ডাকো।”

“মা আমি পারছি না মা।আমার দম বেড়িয়ে আসতে চাচ্ছে মা।”-ব্যথা সহ্য করে বলছে পাখি।
শান সেদিকে চেয়ে বুঝতে পারে অবস্থা খারাপের দিকে।তাই দ্রুত পদে এগিয়ে এসে কোলে নিতে ধরে। দাদিজান বলে ওঠে,”দাদু ভাই নরমালেই হবে মনে হচ্ছে।একটু চেষ্টা করবের দেও আমাদের ”
শান বুঝতে পারে না কি করবে এখন।।পাখি অসহায় মুখে চেয়ে থাকে শানের দিকে।শান পাখির চোখের ভাষা বুঝতে পারে।চাহনীতেই বুকের ভেতর তোলপাড় শুরু হয় শানের।আগপিছে না ভেবে বলে,”আমি আর এক মূহূর্তও দেরি করতে রাজি না দাদিমা”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

শর্মিলা বেগম বলে ওঠেন,”বাবা একটু দেখতে দে আমাদের।নরমালে চেষ্টা করে দেখি না একটু।আচ্ছা এক কাজ কর নার্স পাঠিয়ে দে একজন”
শান চোখ মুখ কুচকে বিরক্ত স্বরে বলে, “মা এসব করে ওর কষ্টটাই বেশি হচ্ছে।তাছাড়া আর কিচ্ছু না।”
” মায়ের কথাটা শুনো”-অস্ফুট স্বরে বলে পাখি।
শান সেদিকে কিছুক্ষন চেয়ে বলে,”ওকে, তবে মা অযথা সময় নষ্ট করবে না।আমি নার্স ডেকে দিচ্ছি”
ইতোমধ্যে পাখির বাবার বাড়িতেও খবর দেয়া হয়েছে।রাশিদা বেগম হন্তদন্ত হয়ে ভাবতে থাকেন কি করবেন! কারণ বাড়িতেও তার ছেলের ঘরে দুমাসের একটি ছোট্ট ছেলে।বীনা এসে পাশে বসে বলে,”মা আপনি আপনার ছেলেসহ পাখির ওখানে যান।আমার মা তো আছেই এখানে।এই সময়ে একটা মেয়ের জন্যে মায়ের হাত টা খুব প্রয়োজন মা”
বীনার কথায় রাশিদা আশ্বস্ত হয়ে ছেলেকে নিয়ে বেড়িয়ে পরেন রংপুরের উদ্দেশ্যে

“পৃথিবীর সমস্ত ব্যথার সম্মিলিত রূপ বুঝি এটাই।এর থেকেও কি মৃত্যু যন্ত্রনা কঠিন!”-ভাবতেই ব্যথাটা যেন মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে।নার্স এসেছে কিছুক্ষন আগে।বাড়ির ছেলেরা ড্রয়িং রুমে বসা।অপেক্ষা শুধু একটা মিষ্টি কান্নার।শান স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারছে না।রুমের সামনে কখনো টুল নিয়ে বসছে তো কখনো ড্রয়িং রুমে গিয়ে পায়চারি করছে।পাখির চাপা কান্নার আওয়াজ শানের বুক ফালাফালা করে ফেলছে।
শরীর বেয়ে দরদর করে ঘাম ঝড়ছে পাখির।চোখ মুখ শুকিয়ে আসছে বার বার।পানির পিপাশায় জিহ্ব যেন বেড়িয়ে আসছে বার বার।

“এতো কষ্ট কেন মাতৃত্বে!আল্লাহ্”-
হঠাৎ নার্সের কথায় ভাবনার সুতো ছেড়ে পাখির।পুরো ঘন্টা খানিক চেষ্টার পর নার্স দরজা খুলে বেড়িয়ে যায়।আশপাশ শানকে খুঁজে। শান এগিয়ে এসে বলে,”রাহি, কি অবস্থা ম্যামের!”
“স্যার, অবস্থা মোটেই ভালো না।আপনি ম্যামকে মেডিকেলে নিন।এমনিওটিক ফ্লুইড রাপচার হচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত, লেবার পেইন উঠে গেছে অথচ ডেলিভারির কোন সিমটম বুঝতে পারছি না।ইমিডিয়েট মেডিকেলে না নিলে কন্ডিশন আরো কমপ্লিকেট হয়ে যাবে স্যার”-আমতা আমতা করে বলে রাহি।তার চোখে মুখে স্পষ্ট দূঃচিন্তার ছাপ শানের ভয়কে আরো দ্বিগুন বাড়িয়ে দেয়।

ইতোমধ্যে পাখির মা ভাই চলে এসেছেন।ড্রয়িং রুমে পৌঁছেছেন তারা।নিজেকে সেখানে স্থির রাখতে পারলেন না রাশিদা। ছুটে চলে আসে উপরে।শান তখনও রাহির সাথে কথা বলছে।দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে মেয়ের করূন অবস্থা দেখে কেঁদে ফেলেন তিনি।চোক দুটো ঝাপসা হয়ে আসে পাখির।কোণা দিয়ে জোনাকিপোকার মতো বের হচ্ছে যেন।পিটপিট করে মাকে একবার দেখে মুচকি হেসে ওঠে পাখি।রাশিদা বেগম মেয়ের হাত চেপে ধরে শান্তনা দেয়।

“মা, মা হতে গেলে এতো কষ্ট কেন মা?তোমার মেয়ে সহ্য করতে পারছে না গো মা।মা এর থেকেও আর কোন কষ্ট বাকি আছে এ ধরায়!”-প্রলাপ বকতে থাকে পাখি।
শান রাহির থেকে সবটা ভালো করে জেনে নিয়ে ঘরে ঢোকে।সবাই তাকায় শানের দিকে।পাখিকে এতো কষ্টের মাঝে দেখে চোখের কোণ ভরে ওঠে শানের।দ্রুত এগিয়ে কোলে তুলে নেয়।পাখি পিটপিট করা চোখে শানের গলা জড়িয়ে ধরে।গায়ে বিন্দু পরিমান শক্তি অবশিষ্ট নেই হাতদুটা জড়িয়ে রাখার।শানের কাঁধ থেকে হাত পরে যায়।শান সেদিকে চেয়ে পাখিকে বলে,”পাখি লিসেন, চোখ দুটো খোলা রাখো জান।আমায় দেখো। তোমার হার্ট সার্জনকে দেখো প্লিজ”

আধখোলা চোখে চেয়ে থাকে শানের দিকে।
“এটাই যদি শেষ দেখা হয় তাহলে , তাহলে মন ভরে দেখবো তোমায়”
পাখির কথায় শানের পা থেমে যায়।কপোট রাগ দেখিয়ে বলে,”এসব কি ধরনের কথাবার্তা?আর কেউ মা হয় না?তুমি প্রথম?”

“থাক, আর মিছে রাগ দেখাতে হবে না।আমিও জানি তুমি ভয় পাচ্ছো।”
“পাখি,আমি আছি তো।আল্লাহ্ কে ডাকো,সব ঠিক হয়ে যাবে”-নরম স্বরে বলে শান।প্রথম মা হওয়ার কষ্ট টা পৃথিবীর অন্য কারোরই অনুভব করা সম্ভব না।
কথা বলতে বলতে এগিয়ে আসে গাড়ির কাছে।রাহি দরজা খুলে পিছনে পাখিকে নিয়ে বসে।শান ড্রাইভিং সিটে বসে রাহিকে বলে,”রাহি ভালো করে ধরো ওকে”

কিছুক্ষনের মধ্যে পৌঁছে যায় মেডিকেলে।পিছনের গাড়িতে বাড়ির বাকিরাও চলে আসে।শানের কথায় অপারেশন থিয়েটার রেডি আগে থেকেই।স্ট্রেচারে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যায় পাখিকে।গলা শুকিয়ে আসে পাখির।এই প্রথম অপারেশন নামোক জিনিসের সাথে পরিচয় হতে চলেছে তার।অটির দরজায় শান থেমে যায়।

পাখি চট করেই শানের হাত ধরে ফেলে,”তুমিও আসো আমার খুব ভয় করছে”-বলতে না বলতেই চোখ দিয়ে অঝোড় ধারা গড়িয়ে পরে গালে।
শান বেশীক্ষন চেয়ে থাকতে পারে না।চোখ ঝাপসা হয়ে আসে তার।
একজন ডাক্তার বলেন,”ডক্টর শান চাইলে আসতে পারেন।আপনার মিসেস মানসিক ভাবে অনেক বেশিই দূর্বল। সি”-ইশারা করে পাখির দিকে।

শান কাউকে ডেকে ওর অটি ড্রেস আনতে বলে পাখির হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকে।এক হাত বাড়িয়ে পাখি শানকে ঝুঁকতে ইশারা করে।শান শুকনো ঢোক গিলে একটু ঝুঁকে যায়।
“বিশ্বাস করো এর থেকে কষ্ট আর হয় না। আমি সয্যই করতেই পারছি না গো।জানি না ঘরটা থেকে বেঁচে ফিরবো কিনা তাই বলছি, আমায় ক্ষমা করে দিও আমার সমস্ত অন্যায়ের জন্যে।যদি আমি মরে যাই, আমায় ক্ষমা করে দিও”

শানের অনুভুতিকে এবার আর কোন শক্তিই আটাকাতে পারলো না।চোখের পানি ছেড়ে পাখির কপালের সাথে কপাল ঠেকিয়ে ঠোঁট কামড়ে চোখ বন্ধ রাখে।কিছুক্ষন ওভাবে থেকে নিজেকে শান্ত করে বলে।
“কিচ্ছু হবে না তোমার। চলো”
বলেই নিজে রেডি হয়ে পাখিকে নিয়ে ঢুকে পরে অটিতে।

কিছুক্ষন পরই নার্স একটি ফুটফুটে বাচ্চাকে দেখিয়ে পাখিকে বলে,”দেখেন তো ম্যাম কে ইনি”
এতো কষ্টের ফল নিজের সন্তানকে দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে যায় পাখি। শব্দ করে কেঁদে ফেলে করূনস্বরে।তবে এ কান্না দূঃখের নয় ;সুখের।
নার্স এবার বাচ্চাকে তুলে দেয় শানের হাতে।
“এই নিন স্যার, আপনার প্রিন্সেস”

শানের পুরো শরীর কাপছে।ঘেমে নেয়ে একাকার।কাপাকাপা হাতে বাচ্চাকে দুহাতে নেয় শান।এ যেন জীবনের সকল সুখানুভূতিকে হার মানাতে সক্ষম।টুকটক করে চেয়ে থাকা সদ্য ফোটা ফুলটি তারই অংশ।ভাবতেই সিনা টানটান হয়ে আসে শানের।
কেবিনে শিফট করা হয় পাখিকে।মা মেয়ে দুজনেই সুস্থ তারা।পাখি বন্ধ হওয়া পাপড়ি দুটো টেনে খুলে বুঝতে পারে বুকের উপর তারই ছোট্ট ছানা।পরম আবেশে দুহাতে জড়িয়ে সারামুখে অজস্র চুমু এঁকে দেয়।ঠোঁটে চুমু দিতেই সদ্য প্রস্ফুটিত ফুলটাও যেন বার বার মায়ের স্পর্শে নেতিয়ে যায়।সবাই দেখে হেসে ফেলে।

সবাইকে দেখানোর জন্যে বাচ্চাকে দরজা অবধি আনা হয়।একে একে সবাই দেখছে নতুন রাজকন্যাকে।সবার চোখেই খুশির ঝলক আজ।
শান কেবিনে ঢুকে পাখির কাছে চলে যায়।সাইডে রাখা টুলটায় বসে পাখির বাঁ হাতটা নিজের দুহাতের মুঠোয় নিয়ে চুমু এঁকে দেয়।পাখি দূর্বল চিত্তে সেদিকে চেয়ে বলে,”কংগ্রাচুলেশন সার্জন সাহেব।মেয়ের বাবা হলেন”

শান উঠে এসে কপালে চুমু এঁকে বলে,”সেইম টু ইউ মিসেস হার্ট সার্জন”
আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেলে পাখি।
“এখন কেমন লাগছে?”
“ভালো”-অস্ফুট স্বরে জবাব দেয় পাখি।
“আই লাভ ইউ পাখি জীবনের শ্রেষ্ঠ এই উপহার টা দেয়ার জন্যে।আর কোন অপূর্ণতা আমার নেই এই জীবনে।”

আসক্তি পর্ব ৪৫

পাখি ঠোঁটে কিঞ্চিত হাসি রেখে জবাব দেয়,”আমারও”
“রেস্ট করো আমি মেডিকেলের কাজগুলো কমপ্লিট করে আসছি, কেমন!”-মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে শান
এরপর একে একে সবাই পাখির সাথে কুশল বিনিময় করে।
“জীবনের প্রথম এই অনুভূতিগুলো সত্যিই বড় অদ্ভুত।একটু আগেও মনে হচ্ছিলো পৃথিবীর আলো বোধহয় নিভে গেলো আমার জন্যে।কতো ব্যথা, কতো কষ্ট সবই গায়েব হলো তোকে দেখে”-মেয়েকে বুকের উপর রেখে ভাবছে পাখি।
নিজের প্রতি নিজেরই ধিক্কার আসছে আজ।
“সেদিন যদি সত্যি সত্যিই মরে যেতাম তাহলে এই সুখটা অজানাই থেকে যেত আমার।”-ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।

তিনদিন পর বাড়িতে আনা হয় পাখিকে।রনি টিনা মিলে বাড়িঘর সাজিয়েছে রঙ্গ বেরঙ্গের কাগজে।গাড়ি থেকে নামতেই চোখ ঝলমল করে ওঠে পাখির।শানকে জড়িয়ে আস্তেধীরে পা ফেলে বাড়ির ভিতর ঢুকতে না ঢুকতেই বাচ্চা নিয়ে কাড়াকাড়ি শুরু হয় হবার।তৃপ্তির হাসি নিয়ে পাখি সেদিকে তাকিয়ে থাকে।শানও হেসে ফেলে সবার এমন বাচ্চামি দেখে।

“তুমি উপরে চলো, রেস্ট করবা”-শান বলতে বলতে পাখিকে নিয়ে খুব সাবধানে উপরে উঠে যায়।
ঘরের দরজায় পা রাখতে চক্ষু চরোকগাছ পাখির।বিছানার পাশে ছোট্ট আরেকটা বিছানা।কতো সুন্দর হরেক রকমের খেলনা দিয়ে সাজানো তার ঘর।নিঃশব্দ হেসে শানকে বলে,”আস্ত পাগল একটা তুমি!”
“তোমার জন্যে “-পাখির কানের কাছে মুখ এনে বলে শান।

আসক্তি শেষ পর্ব