আসক্তি পর্ব ৪৪

আসক্তি পর্ব ৪৪
লেখায়ঃআফিয়া আজাদ নিঝুম

টলটমলে পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসে পাখি।ছাদ থেকে শানের কেবিনের দূরত্ব যেন আজ যোজন যোজন।মনে হচ্ছে হাজার মাইল দূরে শানের কেবিন।দরজার সামনে আসতেই পাখির পা থেমে যায়।দরজাটা সম্পূর্ণ খোলাও না আবার বন্ধও না;হালকা ভেড়ানো।শানের বাঁ হাত টা সম্পূর্ণ দেখা যাচ্ছে।শ্বাস যেন থেকে থেকে জানান দিচ্ছে।হার্ট জোড়ে জোড়ে বিট করা শুরু করেছে।অনুভুতিহীন চাহনীতে দরজার ফাঁক দিয়েই শানের উপস্থিতি অনুভব করছে পাখি।ইকরা চলে গেছে একটু আগে।কেমন যেন সংকোচ কাজ করছে পাখির মাঝে।

হুট করেই শানের কথায় ধ্যান ফেরে,”ভিতরে আসো।বাহিরে গরম না!”
চমকে পরপর দুবার চোখের পলক ফেলে পাখি।ধীর পায়ে দরজা টা ঠেলে ভিতরে ঢোকে।কেবিনে কেউ নেই এখন।আশপাশে চোখ বুলিয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে স্তম্ভের ন্যায়।নজর আজ শানেতে আবদ্ধ।
“কি হলো দাঁড়াই আছো কেন, বসো?-শান মাথা না তুলেই বলে।মোটা মোটা কিসব রিপোর্ট না কি যেন পড়ছে আর কলমের নিব দিয়ে একটু করে মার্ক করছে।পাখি একদৃষ্টে চেয়ে আছে শানের দিকে।
খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে শানকে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

অফ হোয়াইটের শার্টটা কনুইয়ের কাছে ফোল্ড করা,বুকের কাছের দুটো বোতাম খোলা।লোমগুলো যেন উকি দিচ্ছে শার্টের খোলা জানালা দিয়ে।চোখের চশমা টা বার বার এক হাতে তুলে তুলে দিচ্ছে।আর নাকটা কুচকাচ্ছে বার বার।স্ট্রেইট সিল্কি চুল গুলো ফ্যানের বাতাসে বার বার উড়ে আসছে কপালে।
আনমনে ভাবছে পাখি,”কোন দিকেই কোন খামতি নেই মানুষটার।না রূপের আর না গুনের।শুনেছি কোন মানুষই নাকি পারফেক্ট হয় না।কিন্তু ইনি তো পারফেক্ট। আমার কি আছে?কোনদিক থেকে পারফেক্ট আমি?তিনি আবারও প্রমান করলেন আমি তার যোগ্য মেয়ে নই।”

এসিটা বন্ধ কেন সেটাই বুঝতে পারছে না পাখি।শানকে দেখে মনে হলো ফ্যানের বাতাসেও ঘামছে তাই দ্রুত গিয়ে এসিটা অন করে দিলো।সামনে থেকে পাখির সরে যাওয়াতে শানের দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো পাখিতে।পাখির কাজে মোটামুটি অবাক হয়ে ভ্রু কুচকে ফেললো শান।পাখি মলিন চেহারায় আবারও সামনে এসে দাঁড়ালো।
শান এবার কলম টা রেখে উঠে দাঁড়ালো।এগিয়ে গেলো দরজার দিকে।ভেড়ানো দরজাটা আরো একটু চাপে চৌকাঠের সাথে ঠেকিয়ে দিলো ;লক করল না।পাখি হাতের চেকাপের কাগজ টা দেখছে বার বার।শান হঠাৎ পিছন থেকে এসে জড়িয়ে ধরে পাখিকে।চমকে ওঠে পাখি।

“কি ব্যপারর,এতো ভয় পাচ্ছো মানে?কেবিনে আমি ছাড়া কে আছে?”-শান মুখটা পাখির কানের কাছে এনে বলে আর আস্তেধীরে নিকাবটা খুলে দেয়।
পাখি কিছু বলতে পারে না।ওর কি অনুভূতি হচ্ছে তা সে নিজেও বুঝতে পারছে না।
শান এবার পাখির হাতদুটো স্লাইড করে হাত থেকে কাগজ টা নিয়ে নিলো।থুতনিটা কাঁধে রেখে কাগজ টা দেখতে ব্যস্ত শান।

“আমি ওয়াশরমে যাবো”-পাখির কথায় শান বিরক্ত হয়। বলে,”কোথায় একটু রোম্যান্স করব তাও হলো না”
সরে গিয়ে হাত দিয়ে ইশারা করে বলে,”যান ম্যাডাম”
পাখি কাগজ টা শানের হাতে দিয়েই পাশের রুমে চলে যায়।
কেবিনের পাশেই ছোট্ট ওয়াশরুম আছে।যেটা শানের একান্তই ব্যক্তিগত।পাখি আশ পাশ ভালো করে পরখ করে বোরখা নিকাব টা খুলে চোখে মুখে পানির ঝাপটা দেয়।শুষ্ক ঠোঁট মুখ ভিজিয়ে সামনে রাখা আয়নাটার দিকে চেয়ে নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে।

সিথিবিহীন খোপা করা একগোছা চুল,কালো চামড়া বিশিষ্ঠ একটা মুখঅবয়ব ,প্রসস্ত কপাল,ডাগর ডাগর দুটি চোখ।খুব সাধারন একটা গড়ন।
“কি আছে আমার মাঝে তার সহধর্মিণী হওয়ার?”-ভাবতেই নজর পড়ে গলার নিচে বুকের ঠিক উপরে বিউটিবোনের কাছে কালো লালচে দাগটা।হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেয় পাখি।ঠোঁটের কোণে কিঞ্চিত হাসি ফোটে পাখির।

“পাগল একটা”-মুখ দিয়ে অস্ফুট স্বরে বলে পাখি।সে নিজেও জানে না পরমূহূর্তে সে কী করবে!ভাবনা গুলো কখনো এলোমেলো হচ্ছে কখনো আবার ভোঁতা হয়ে এবড়োখেবড়ো হচ্ছে।
পরপর আরো কয়েকবার চোখে মুখে পানি দিয়ে ড্রেস পরে বের হয় পাখি।
“রেডি?”-শান বলে
পাখি ওয়াশরুমের দরজা লক করতে করতে বলে,”হুমম”

“চলো তোমায় বাড়ি দিয়ে আসি। আমায় আবার মেডিকেলে আসতে হবে”-হন্তদন্ত হয়ে বলে শান।
গাড়ির চাবি ফোন সবটা নিয়ে পাখিকে সাথে করে দ্রুত বের হয় কেবিন থেকে।ফোনে কারো কল আসায় রিসিভ করে কানে ধরে।পাশাপাশি হাঁটছে দুজন।পাখি শুধু চেয়ে দেখছে পাশের শানকে।গাড়ির কাছে পৌঁছাতেই শান লক দরজাটা খুলে দিতে ভোলে না।এরপর বসে পরে নিজের সিটে।
ফোন কানে নিয়েই গাড়ি স্টার্ট করে।পাখি তবুও চেয়ে আছে শানের দিকে।শান ভ্রু নাচিয়ে ইশরা করে, কি?
পাখি তবুও চেয়ে থাকে।শান এবার এগিয়ে এসে পাখির সিট বেল্টটা বেঁধে দেয়।

গাড়ি চলছে আপন গতিতে।শান আড়চোখে পাখিকে দেখেছে কয়েকবার।হঠাৎ করে গাড়ি রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়ে হেসে ফেলে শান।হাসিতে যেন মুক্তা ঝড়ছে।পাখি তবুও অপলকে চেয়ে আছে শানের দিকে।
“এভাবে দেখতে থাকলে গাড়ি চালাব কি করে আমি! বার বার তোমার দিকে নজর পড়ছে।কি সমস্যা বলোতো?চেকাপের পর থেকেই খুব চুপচাপ মনে হচ্ছে তোমাকে।এ্যানি প্রবলেম?”-হেসে হেসে বলে শান।
পাখি মাথা নাড়িয়ে না সূচক জবাব দিয়ে আবারও চেয়ে থাকে শানের দিকে।

শান গাড়ি পূনরায় স্টর্ট দিতে দিতে বলে,”একজন খুনিকে আজ প্রথম দেখলে নাকি?খুনিকে এতো দেখতে নেই।এমনিই আসক্ত হয়ে গেছো পরে না জানি আবার…. ”
শানের কথাটা শেষ হতে না হতে পাখি ডান হাত টা গাড়ির স্টেয়ারিং এর উপর রাখা শানের বাম হাতের উপর রাখে।
“বাড়ি যাবো না ”
শান ভ্রু কুচকে বলে,”তাহলে!”
“ঐ পদ্ম বিলের ধারে!
শান মুচকি হেসে ওঠে পাখির আজ হঠাৎ এমন পরিবর্তন দেখে।
“আমার হসপিটালে যেতে হবে তো!
“ছুটি নিয়ে নিন”

শান পাখির কথাটা আজ ফেলতে পারলো না।কারণ আজই প্রথম পাখি নিজে থেকে ছুটি নিতে বলছে।শানও আর কথা না বাড়িয়ে গাড়ি অন্য রাস্তায় নিয়ে ছুটে চলে সেই পদ্ম বিলের কাছে।দুই ঘন্টার পথ পেড়িয়ে পোঁছে যায় গন্তব্যে।আজ পাখি নিজে নিজেই গাড়ির দরজা খুলে বের হয়ে গুটিগুটি পায়ে। এসে দাঁড়ায় একদম বিলের খুব কাছাকাছি। শানও তাকে অনুসরন করে চলে আসে।

স্বচ্ছ পানিতে পুরো বিলের মাটিটা বোঝা গেলেও একটু দূরের পানিটার গভীরতা বোঝা যাচ্ছে না।পাখি বুঝতে পারে ওটা কোন গভীর পুকুর।নিজের অযোগ্যতা টা যেন মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো।জুতোটা খুলে বিলের ধার ঘেঁষে এগিয়ে চলে সে পুকুরের দিকে।শান পাখির থেকে কয়েক মিটার দূরে।বুঝতে পারে না পাখি কি করতে চলেছে।
পিছন পিছন শানের আগমনের পদধ্বনি বুঝতে পেরে পাখি পুকুরের পাড় ঘেঁষে দাঁড়িয়ে যায়।খুব সাবধানে শানের দিকে ঘুরে দাঁড়ায়।

“স্ট্যাচু”-চিল্লিয়ে বলে পাখি।
শান থমকে গিয়ে ভাবতে থাকে এখন, এই সময় এসব খেলা মানে।তবু ঠাঁয় দাঁড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করে পাখি কি করতে চলেছে!
“সার্জন সাহেব গ্রামের মেয়ে হলেও আমি না সাঁতার জানি না।”
একটু থেমে পাখি আবার বলে,”আমি ছোট বাচ্চা খুব ভালোবাসি।খুব ইচ্ছে ছিলো মা হবো।হলাম, তবে অনাগত সন্তানের।”

পাখি নিজের পেটের উপর হাত রেখে বলে,”আমি আমার পেটের এই অনাগত সন্তানকে খুউব খুউব ভালোবাসি সার্জন সাহেব।কিন্তু কিচ্ছু করার নেই।আমি চলে গেলে তাকেও চলে যেতে হবে।ওর পৃথিবীতে আগমন অবধি অপেক্ষা করা যে আমার কাছে কোন ভাবেই সম্ভব না। ওর আসার আরো পাঁচ ছয় মাস বাকি।এতোগুলো দিন আমি কী করে নিজের বিবেকের সাথে লড়াই করে বাঁচবো।”
শান বুঝতে পারে না কি হতে চলেছে।কি করতে চাইছে পাখি।এক পা আগাতেই পাখি জোড়ে চিল্লিয়ে বলে,”একদম না। একদম কাছে আসবেন না।আমার কথা শেষ হয় নি।আল্লাহ্ র কসম দিলাম কাছে আসবেন না।”

শান এবার বুঝতে পারে পাখি কি করতে চলেছে।চিন্তার ভাঁজ যেন কপালে স্পষ্ট শানের।
“ওটা তো অগভীর বিল একটা।মিনিমাম হাটু পরিমান পানি হবে”-ভেবেই হেসে ফেলে শান।
হাসি থামিয়ে বলে, “গাধী কোথাকার।এসবের মানে কি হ্যা?বলেছি না বাবু দুনিয়াতে আসলে তোমায় ছেড়ে দেবো;তখন আর খুনির সাথে থাকতে হবে না,তাহলে এসব কি?চলে আসো বলছি”
বলতে বলতেই শান আবার হেসে বলে,”ওখানে লাফ দিলে হাইয়েস্ট পায়ে একটু ব্যথা পাবা তাছাড়া আর কিছু না।চলে আসো ”

পাখি এবার ঠোঁটে কিঞ্চিত হাসি এলিয়ে বলে,”আমি কোনদিক থেকেই আপনার যোগ্য নই ডাক্তার সাহেব।আপনাকে অবিশ্বাস করে, ভুল বুঝে যে অন্যায় আমি করেছি তার শাস্তি কি আমার ও আমার অনাগত সন্তানের মৃত্যুর মাধ্যমে পূর্ন হবে না?আমাদের জীবন দিলেও কি তার ক্ষমা হবে না?আমায় মাফ করবেন সার্জন সাহেব।”
বলেই আর এক মূহূর্ত দেড়ি না করে পাখি চোখ মেলে চারপাশটা দেখে লাফ দেয় পুকুরে।পা গিয়ে ঠেকে মাটিতে।নিজের দিকে চেয়ে দেখে,
“তারমানে বুক অবধি পানি!”
ভাবতেই চোখ মুখ কুচকে ফেলে পাখি।

ঘটনার আকষ্মিকতায় স্তব্ধ হয়ে যায় শান।দিগ্বিদিক চিন্তা না এক দৌড়ে চলে আসে বিলের ধারে।পাখির দিকে ভালো করে না দেখেই, কালক্ষেপণ না করে লাফিয়ে পড়ে পানিতে।বলিষ্ঠ দেহে কোলে তুলে নেয় পাখিকে।ভয়ে আতঙ্কে শানের শরীরের প্রত্যেকটা লোম দাঁড়িয়ে যায়।তৎক্ষণাৎ লাফ দেয়ায় পাখির কোন ক্ষতিই হয় নি।বরং শরীরের অর্ধেকটা তখনো শুকনো।শান দ্রুত কোলে তুলে নিয়ে পাড়ে এনে রাখে পাখিকে।দুজনেই চুপ।

কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে কি থেকে কি হলো সেটাই শানের বোধগম্য হচ্ছে না।পা দুটো বিলের পানিতে ভিজিয়ে দুহাত মাটিতে গেড়ে মাথা নিচু করে লম্বা লম্বা শ্বাস নিচ্ছে শান।
এদিকে নিজের ব্যর্থ কাজে নিজের কপাল চাপড়াচ্ছে পাখি।আনমনে ভাবে,”সার্জন সাহেব ঠিকই বলে গাধী আমি। মরতেও পারলাম না।একটু মাঝ বরাবর লাফটা দিলেই হতো!”
শান যে ফিরে ওর দিকে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে আছে তা বোধগম্য হতেই পরপর কতোগুলো শুকনো ঢোক গেলে পাখি

“মরতে না পারলে কি হইছে, এনার হাতে ঠিকই এবার আমার মৃত্যু লেখা আছে।”
ভাবতেই পরপর চোখের পলক ফেলে পাখি অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে নেয়।
রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে আসে শানের।কিছুক্ষন আগে করা পাখির পাগলামির কথা ভেবে থাপ্পোরের জন্যে উদ্যত হয়ে হাতটা উঁচুতে উঠায় শান।পাখি ভয়ে একটু পিছিয়ে চোখ মুখ কুচকে ফেলে।শান থেমে যায়।হাত টা নামিয়ে পাখির দুবাহু ধরে জোড়ে ঝাকিয়ে রাগি স্বরে বল,”কি করতে যাচ্ছিলে তুমি?”

শানের গলার স্বরে পদ্ম বিলে বসে থাকা সাদা বক গুলো ফরফর করে উড়ে গেলো আকাশে।কথাটা যেন প্রতিধ্বনি হয়ে বার বার চারিদিকে আওয়াজ করছে।
নিজেকে এবার আর কন্ট্রোল করতে পারে না পাখি।কেঁদে ফেলে মুখ চেপে।
“আমি আপনার যোগ্য না। আমি আপনার মতো মানুষের ভালোবাসার উপর আঙ্গুল তুলেছি;অবিশ্বাস করেছি। আমায় প্লিজ মরতে দিন”-বলতে বলতে করূনস্বরে কেঁদে ওঠে পাখি।
শান এতোক্ষনে বুঝতে পারে পাখির অস্বাভাবিক আচরনের কারণ কি!দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,”কতোবার বলেছিলাম আমি নির্দোষ।ইভেন আমাদের তোমাদের প্রত্যেকটা মানুষ আমায় সাপোর্ট করেছে এক্সেপ্ট ইউ?হোয়াই পাখি?হোয়াই!”

পাখির কান্নার বেগ বেড়ে যায়।
শান আবার বলে,”কি বলেছিলাম মনে আছে?সত্যিটা জানতে পারলে, পারবে তো নিজেকে ক্ষমা……”
“আমি সত্যিই পারছি না নিজেকে ক্ষমা করতে। বিবেকের কাঠগড়ায় আমি অপরাধী হয়ে সারাজীবন বাঁচতে পারবো না সার্জন সাহেব।তাই তো,তাই তো এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি”
শান আরেকবার তেড়ে এসে বলে,”তাই বলে…..”

মাথা ভনভন করছে পাখির।চোখ ঘোলা হয়ে আসছে।
বন্ধ চোখের পাতা জোড়া খুলে একপলক শানের দিকে চেয়ে অস্ফুট স্বরে বলে,”আমি আপনার যোগ্য না।আমি বাঁচতে চাই না।আমি অবিশ্বাস করেছি, কষ্ট দিয়েছি……”
হারিয়ে যায় পাখির গলার স্বর।শান দ্বিতীয় বারের ভয়ে একেবারে চুপসে যায়।নাম ধরে কয়েকবার ডাকে, গা ঝাকিয়ে কয়েকবার ডেকেও কোন সাড়া না পেয়ে ভেজা শরীরে পাখিকে কোলে নিয়ে গাড়িতে শোয়ায়।ফোন করে কাউকে কেবিন বুক করতে বলে।দ্রুত গাড়ি স্টার্ট করে শান। পাখিকে বসিয়ে সিট বেল্ট বেঁধে দেয় ভালোভাবে।

বিপদের সময় নাকি ফুরাতে চায় না।শানেরও তাই হয়।ড্রাইভ করছে আর বার বার সিটে বসে থাকা পাখিকে দেখছে।
হসপিটালে পোঁছাতে পোঁছাতে দুপুর হয়ে যায়।লাঞ্চ টাইম লোক সমাগম তেমন নেই।এই সুযোগে শান দ্রুত পাখিকে কোলে নিয়ে হসপিটালে ঢোকে।প্রাথমিক চিকিৎসার পর বুঝতে পারে ভিপি লো হয়ে গেছে আর অতিরিক্ত ভয়ের কারণে সেন্সলেস হয় পাখি।শরীর টা বেশ দূর্বল।তার কারণ খাবারে অনিহা।এরপর ইউএসজি রিপোর্ট দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে শান।কারণ তাদের সন্তান এবং পাখি দুজনেই ঠিক আছে।

কিছুক্ষন পর জ্ঞান ফেরে পাখির।চারিদিকে চেয়ে বুঝতে পারে নিজের ঘরে আছে সে।বিছানায় শুয়েই পরে থাকে আর দু চোখের কোণা বেয়ে অঝোড়ে জল ফেলে।কয়েক ঘন্টা আগে ঘটা কাহিনী গুলো নেয়াতই দূঃস্বপ্ন মনে হয় তার কাছে।
“কোন মুখে আমি শানের সামনে দাঁড়াব?কি যোগ্যতায় তার সাথে সংসার করব?”-আনমনে ভাবতেই হঠাৎ খেয়াল হয়,”আমি তো বেঁচে গেলাম আমার বেবি!

ওর কিছু হয় নি তো”-ভেবেই পেটে হাত রেখে কেঁদে ফেলে পাখি।কান্নার শব্দ ক্রমেই বেড়ে চলছে।
কান্নার আওয়াজে ওয়াশরম থেকে হন্তদন্ত হয়ে বের হয় শান।
“এই কি হইছে, পাখি”-বলতে বলতে সারা গায়ে সাবানের ফেনা সমেত এগিয়ে আসে শান।
পাখি হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বলে,”আমার বাচ্চা কই?”
শান সরুচোখে ভ্রুকুচকে তাকিয়ে থাকে।

“মানে?”
“আমি লাফ দিলাম,আপনি তুললেন।তারপর বকলেন।তারপর আমার কিচ্ছু মনে নাই।আমার বাচ্চা কই”-বলতে বলতে পাখি নিজের পেটে হাত বুলায় আর কাঁদে।
শানের মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি খেলে যায়।
“কেন,লাফ দেয়ার আগে খুব না বড় বড় কথা বললে?এখন কি হলো?শোন বাবা মায়ের কর্মফল সন্তানদের দিতে হয়।আজ তোমার গাধামির জন্যে আমার বাচ্চাকে তার খেসারত দিতে হলো”-চোখ মুখ থেকে সাবানের ফেনা সরাতে সরাতে বলে শান।
পাখি কোনকিছু চিন্তা না করে আবারও কেঁদে দেয়।

পাখির কান্নার ধরন টা শানের বুকে গিয়ে লাগে।এগিয়ে গিয়ে পাখিকে ধরে ঝুঁকে গিয়ে বলে,”কিচ্ছু হয় নি তোমার বেবির।আল্লাহ্ র রহমতে দুজনই সুস্থ আছো।তবে আজ যা করলে তার হিসেব কড়ায় গন্ডায় উসুল করবে এই শান।শাস্তি বেঁচে যাচ্ছো তুমি প্রেগন্যান্ট বলে।”
পাখি কান্নাজড়িত কন্ঠে ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলে,”আমি মরেই যেতাম ওর কিছু হলে”
“ড্রামা কুইন একটা”-মুখ কুচকে বলতে বলতে শান ওয়াশরুমের দিকে যায়।
পাখি আস্তে করে পা টিপে টিপে এসে পা উচিয়ে শানের গলা জড়িয়ে ধরে।হঠাৎ এমন হওয়ায় শান ঘাবড়ে তাল সামলাতে না পেরে দু কদম এগিয়ে যায়।

“কি করছো, পরে যাবো তো!”
পাখি কিছু না বলে শানের ভেজা পিঠে মাথা ঠেকিয়ে বলে,”আমি আপনার জীবন থেকে সরে গেলেই ভালো হবে ডাক্তার বাবু”
শান কিছুক্ষন চুপ থেকে বলে,”আমি তো তোমায় ছাড়ছি না সোনা।তোমার হাড় খাবো, হাডি খাবো তারপর চামড়া দিয়ে ঢুগঢুগি বাজাবো।তারপর ভেবে দেখবো আর কি কি করা যায় সে ঢুগঢুগি দিয়ে”
পাখি আচমকাই খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে।শানের কানে অনেকদিন পর পুরোনো সেই হাসির ধ্বনি যেন হার্টের বিটকে কয়েগুন বাড়িয়ে দেয়।পাখির হাত দুটো মুঠো করে ধরে পাখিকে সামনে আনে।চুল গুলো ঠিক ঠাক করে বলে।

আসক্তি পর্ব ৪৩

“আমি জানতাম এই দিনটা আসবে।যেদিন তুমি আমায় আবারও আগের মতো ভালোবাসবে। তবে ভাবিনি তুমি বোকার মতো সুইসাইড এটেম্পট করবে।জানো কতোটা ভয়টা পেয়ে গেছিলাম আমি?”-থমথমে মুখে বলে শান।
“সরি! আমি আর কোনদিন আপনাকে অবিশ্বাস করব না।তখন আসলে মাথা ঠিক ছিলো না।সামিহা ভাবি যা যা বলেছিলো আপনিও তাই তাই বলেছিলেন।আর নীরার সাথে দেখা করার কথাও তো সত্যি ছিলো।তাই আমি বোকার মতো…..

আমার অনেক বড় ভুল হয়েছে।আর কোনদিন এমন ভুল করব না প্রমিস”-কানে ধরে বলে পাখি।
একটু দম নিয়ে আবার বলে,”আসলে আজ যখন ইকরার কাছ থেকে সবটা জানলাম,বুঝতে পারি নি কি করব!শুধু মনে হয়েছে মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে হয়ত এই অন্যায়ের ক্ষমা পাবো আমি।”
“ইকরা মানে?”-সন্দিহান চোখে বলে শান।
এরপর পাখি ইকরার বলা সমস্ত কথা শানকে বলে দেয়।

শান ওকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে মনে মনে বলে,”যতো যাইই বলো আগে সুস্থ হও, বুঝাব শান কি!আর আজকের টা তো আরো বড় অন্যায় করে ফেললে।প্রেগন্যান্সির সময়ে তোমায় কোন কষ্টে রাখব না আমি”
“এই,শুনছেন!”-পাখির ডাকে ভাবনা ভাঙ্গে শানের।
শুকনো জবাব দেয়,”কি?”
“ভিজে গিয়েছি একদম। আপনি তাড়াতাড়ি গোসল সেড়ে নিন।আমিও ওয়াশরুমে যাবো”
শান ওকে কোলে করে নিয়ে বলে,”চলো আজ একসাথে গোসল করব”

আসক্তি পর্ব ৪৫