আসক্তি পর্ব ৪৩

আসক্তি পর্ব ৪৩
লেখায়ঃআফিয়া আজাদ নিঝুম

“এই যে ম্যাম, আপনার বাবার আর শান স্যারের ছবি।রাশেদ যখন আমার ছবিগুলো তুলেছিলো তখন পিছন টেবিলে তাঁদের ছবি গুলোও ওঠে তবে ব্লার হয়ে আসে আর কি।পরে যখন আমি ছবিগুলো দেখি তখন আর ক্রোপ করার ইচ্ছে হয় নি;রেখে দিয়েছিলাম”-ইকরা বলতেই বলতেই নিজের ফোনটা পাখির দিকে বাড়িয়ে দেয়।

পাখি কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনটা নিয়ে ছবি গুলো একের পর এক সুইপ করে দেখতে থাকে।চোখের দুফোটা জল নিকাবের কাপড়েই লুকিয়ে যায়।বাঁ হাতে মুখটা চিপে কান্না সংবরণের বৃথা চেষ্টা করে।
(কিছুক্ষন আগে)

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“পাখি একটু তাড়াতাড়ি করো না। আমার আজ ইম্পোর্ট্যান্ট কাজ আছে তো।”-শান পাখিকে তাড়া দিয়ে নিজে ওয়াশরুমে ঢুকে পরে।পাখি কচ্ছোপের গতিতে বোরখা পরে নিকাব টা বেঁধে নেয়।শান বের হয়ে এসেও দেখে পাখি এখনো ড্রেসিং টেবিলের সামনে।শান যে ওর দিকে বিরক্তি নিয়ে চেয়ে আছে তা আয়না দিয়ে একবার দেখে আবার নিজের কাজে মন দেয়।কাজ শেষে আস্তে করে বলে,”হুমম রেডি”

শান নিজেকে রেডি করে নাস্তা শেষ করে হসপিটালের উদ্দেশ্যে বের হয়।শান পাখিকে নার্স ইকরার কাছে নিয়ে এসে বলে,”ইকরা ম্যামের একবার চেকাপ করিয়ে নিয়ে এসো। আমি কেবিনে আছি”
পাখিকে উদ্দেশ্য করে বলে,”কাজ শেষ হলে আমার কেবিনে চলে এসো কেমন!”
মাথা নাড়িয়ে সায় দেয় পাখি।

“কেমন আছেন ম্যাম?”-জানতে চায় ইকরা।
“ভালো আছি ইকরা, তুমি কেমন আছো?”
“জ্বি ম্যাম অনেক ভালো আছি।আপনার প্রেগন্যান্সির খবর শুনে আরো বেশি ভালো আছি”
পাখি অবাক হয়ে বলে,”কি করে জানলে?”
“সে কি ম্যাম, স্যার কিছু বলে নি আপনাকে?”-
পাখি আমতা আমতা করে জবাব দেয়, “না ততো,কি ব্যপারে!”

“স্যার না বরাবরই এমন একটু গুমোট স্বভাবের।আসলে হয়েছে কি সেদিন হঠাৎ করে স্যার অনেক গুলো মিষ্টি নিয়ে মেডিকেলে ঢুকলো।আমরা সবাই তো অবাক। স্যার একে একে সবাই কে মিষ্টি খাওয়ালো।পরে জানতে চাইলে বলেছিলো আপনি মা হতে চলেছেন।বিশ্বাস করবেন না ম্যাম স্যারের চোখে কি পরিমাণ খুশি দেখেছিলাম।আমি ভাবতেও পারি নি একজন ছেলে মানুষ বাচ্চার কথা শুনে এতো খুশি হতে পারে।”-ইকরা আর পাখি হসপিটালের করিডোরে পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে ইকরা কথা গুলো বলে।পাখি যেন নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছে না শান এতো খুশি হয়েছিলো।

একটু ভাবনার ভঙ্গি করে ইকরা আবার বলে,”সেদিন মেবি স্যার আপনার বাড়ি থেকে এসেছিলো।যতোদূর স্যার বলেছিলো সেদিন আপনার বাবার দোয়া মাহফিল ছিলো’
বলতে বলতে ইকরার গলার স্বর ক্ষীণ হয়ে আসে।ততোক্ষনে তারা পৌঁছে যায় তাদের গন্তব্যে।ইকরা সেই নার্স কে বুঝিয়ে বলে ম্যামের ভালো ভাবে চেকাপ করতে।চেকাপ শেষে তারা পূনারায় হাঁটা ধরে।
ইকরা বিমর্ষ চিত্তে আবার বলে,”সত্যিই বাবা হারানো যে কতোটা কষ্টের এটা যাদের বাবা নেই তারাই বলতে পারবে।”

দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে ইকরা।পাখি শুধু নীরব শ্রোতার ন্যায় শুনে যায়।
পাখি অস্ফুট স্বরে বলে, “তোমার বাবা….”
“নেই ম্যাম, অনেক আগেই গত হয়েছেন”-মুখটা মলিন করে ইকরা জবাব দেয়।
ইকরা আবার বলতে শুরু করে,”তবে কি জানেন ম্যাম, শান স্যারের মতো কেউ একজন জীবনে থাকলে কোন কষ্টকেই আর কষ্ট মনে হয় না।উনি খুব ভালো মানুষ।আপনাকে খুব ভালোবাসেন ম্যাডাম”
“তাই?খুব ভালো মানুষ!”

ইকরা থমকে যায়।হাঁটা থামিয়ে বলে, “এভাবে বলছেন কেন ম্যাডাম?কোন সমস্যা?”
কথা শেষে ঠোঁটে হাসি প্রসস্ত করে ইকরা।
“আচ্ছা ইকরা, আমার জানা মতে তোমার স্যার নামকরা ডাক্তার তবে আমার বাবাকে কেন বাঁচাতে পারলো না ? কারন,কারন তিনি ইচ্ছে করেই আমার বাবাকে পৃথিবী থেকে সরিয়েছেন।”-দাঁতে দাঁত চিপে বলছিলো পাখি।

ইকরা যেন আকাশ থেকে পরার মতো অবস্থা।সে ভাবতেও পারছে না পাখি শানের ব্যপারে এরকম মনোভাব পোষন করে।অবাক হয়ে জিজ্ঞেসা করে, “ম্যাডাম আপনি কিসব বলছেন?”
ইকরার কথায় পাখি মুখ ঘুরিয়ে রাগে হাসফাস করতে থাকে।
“ম্যাম এদিকে আসুন”-বলে ইকরা পাখির হাত টেনে নিয়ে ছাদে চলে যায়।বসার মতো দুটো বেঞ্চ পাতা, সেখানে বসায়।

“আমি নিজেই অপারেশন রুমে ছিলাম ম্যাম। সাথে আরো দুজন নার্স আর দুজন জুনিয়র ডাক্তার ছিলেন।আমরা সবাই দেখেছি কিভাবে স্যার কষ্ট পাচ্ছিলেন।শেষ মূহূর্তে যখন আপনার বাবা চলে যান তখনো স্যার চেষ্টার কোনই ত্রুটি করে নি ম্যাম।আমরা কখনো কোন সার্জারিতে স্যারের ওমন স্তব্ধতা দেখিনি”-এরপর নার্স ইকরা অপারেশন রুমের সেদিনের সমস্ত অভিজ্ঞতা পাখিকে জানায়।
পাখির অস্থিরতা বেড়ে যায়।এক টানে নিকাবটা খুলে লম্বা লম্বা শ্বাস নেয়া শুরু করে।চারিদিকে পাগলের মতো দেখতে থাকে।

“ইকরা, একটু পানি এনে দেবে”
“হ্যা ম্যাডাম এক্ষুনি নিয়ে আসছি।আপনি বসুন”-বলেই এক দৌড়ে নিচে আসে ইকরা।পানির বোতলটা হাতে নিয়ে আবার ছুটে যায় ছাদের দিকে।বোতলটা ছোঁ মেরে নিয়ে পাখি ঢকঢক করে পানি খায়।নিজেকে একটু ধাতস্ত করে কপালের, নাকের ডগার, ঠোঁটের উপরের ঘাম গুলো রুমালে মুছে নেয়।

“স্যারের জন্যে আপনার মনের বিরূপ ধারনা দেখে আমি সত্যিই হতাশ ম্যাডাম।ভাবতেও পারি নি স্যারের। মতো একজন মানুষ আজ তার মিসেসের কাছে অপরাধী।কিছু কথা বলি ম্যাডাম।যদিও আগেই বলা উচিত ছিলো আমার।সময়ের অভাবে আপনার সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয় নি।
একদিন আমি আমার বয়ফ্রেন্ড রাশেদ সহ মেডিকেল মোড়ের জিহা রেস্টুরেন্টে যাই।আমরা আমাদের বিয়ের ব্যপারে কথা বলতেই সেদিন দেখা করি।কিছুক্ষন পর শান স্যার এসে আমাদের সামনের টেবিলটায় বসে।আমি বিপরীত মুখে বসে ছিলাম বলে স্যার আমায় চিনতে পারে নি।আর আমিও রাশেদ ছিলো বলে লজ্জায় স্যারের সাথে আর কথা বলিনি।

রাশেদ আমায় ইশারা করে স্যারকে দেখায়।আমি কাঁধটা হালকা বাঁকিয়ে দেখি একজন মেয়ে আমার পিছনের চেয়ারটায় বসা স্যারের মুখোমুখি।রাশেদ আমায় বলে,”তোমার স্যার।সাথে তার ওয়াইফ নাকি”
আমি স্পষ্টই জানিয়ে দিলাম এটা স্যারের ওয়াইফ নয়।স্যারের ওয়াইফ এভাবে কখনো আসবেন না।দ্বিধা আমার মনেও চলছিলো মেয়েটা কে?,কারণ আমার পিছনে বসায় মেয়েটার মুখ দেখা যাচ্ছিলো না।”
এটুকু বলেই পাখির দিকে তাকালো ইকরা।পাখির অস্থিরতা কমে গেছে, শুষ্ক ঠোঁট দুটো জিহ্বায় ভিজিয়ে বলে, “বাকিটা আমি জানি ইকরা।বাদ দাও ”

ইকরা অবাক হয়ে যায়।অস্ফুট স্বরে বলে,”আপনি জানেন!”
“হুমম”
“কিন্তু ম্যাম স্যার যে আপনার বাবাকে মানা করলো যাতে আপনাকে কিছু না বলে”
“মানে?”
“আমি বলছি ম্যাম।”-বলেই ইকরা আবার বলতে শুরু করে।

“এরপর মেয়েটার ফোনে একটা কল আসে মেয়েটা উঠে যায়।তখন আমি আস্তে করে দেখে নিই মেয়েটাকে।মেয়েটা ছিলো ডাক্তার নীরা।আমিও চুপচাপ বোঝার চেষ্টা করেছিলাম ব্যপারটা কতোদূর!
নীরার সাথে স্যার কিছু দরকারি কথা বলছিলেন।আমি কান পেতে শুনে ফেলি সবটা।আমি আবার কান পাতলা স্বভাবের কিনা!।আমার পায়ের রক্ত মাথায় উঠে যায়।দুনিয়ার সব থেকে খারাপ মানুষ মনে হয় স্যারকে।আমি রাগে উঠে দাঁড়াতেই স্যারের সামনের টেবিল থেকে একজন ভদ্রলোক উঠে স্যারের কলার চিপে ধরে।রাশেদ আমার হাতটা টেবিলে চেপে ধরে ঐদিকে ইশারা করে।এরপর যা দেখলাম ম্যাডাম আমি সবটার জন্যে মোটেও তৈরী ছিলাম না।”

পাখি অবাক বিষ্ময়ে ইকরার একের পর এক সমস্ত কথাগুলো শুনে যাচ্ছিলো।
“ভদ্রলোক স্যারের কলার চিপে সজোড়ে থাপ্পোর বসিয়ে দেয়।দু গালে থাপ্পর এর বুক বরারবর একটা ঘুষি দিতেই আরেকজন ভদ্রলোক এসে তাকে আটকে দেয়।উনি স্যারকে মারছিলেন আর কিছু কথা বলছিলেন। তাতে বুঝতে অসুবিধা হয় নি উনি স্যারের শ্বশুর আই মিন আপনার বাবা।ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে তেড়ে আসা ভদ্রলোক বুক চেপে ঘন ঘন শ্বাস নেয়া শুরু করে।ডাক্তার নীরা তখন আবল তাবল অনেক কিছু বলে ঐ লোককে।ইতোমধ্যে চারদিকে ভীর পরে যায়।আমি রাশেদ সহ সবটাই দেখছিলাম পাশে দাঁড়িয়ে।লোক সমাগম বেশি হওয়ায় স্যার চারিদিকে তাকিয়েও আমায় বুঝতে পারে নি।

ভদ্রলোকের অবস্থা বেগতিক দেখে স্যার নিজের চেয়ারটা এগিয়ে দিয়ে ওয়েটার কে দ্রুত পানি আনতে বলে।ওখানে উপস্থিত সবাই অবাক দৃষ্টে চেয়ে ছিলো স্যারের দিকে।এরপর ডাক্তার নীরার ফোনে আরেকটা কল আসে।নীরা অন্যদিকে চলে যায়।তখন স্যার আপনার বাবাকে যা বললো তা শুনে নিজেই নিজের মাথা ফাটাতে মন চাইছিলো ঐ মূহুর্তে।

নীরা চলে আসার পর স্যার ডক্টর নীরাকে চলে যেতে বলে।আর পরে কথা বলবে বলে জানায়।এরপর আপনার বাবাকে চেয়ারে বসিয়ে স্যার আমার পিছনের চেয়ারটায় বসে।ততোক্ষনে লোক সমাগম কমে গেছে।

এরপর আপনার বাবাকে স্যার ফোনে রেকর্ড হওয়া একটু আগের ঘটনা গুলো শোনায় আর নীরার ব্যপারে সমস্ত কথা বলে।নীরার সব বাজে কাজের প্রমানের জন্যেই সেদিন স্যার নীরার সাথে দেখা করেছে সেটাও বলেছে। ডাক্তার নীরা আপনার ক্ষতি করতে চেয়েছিলো তার প্রমানস্বরূপ রেকর্ড টা জরুরী ছিলো।

আসক্তি পর্ব ৪২

পুরো ঘটনা টা আমি পিছনে বসে নীরবে প্রত্যক্ষ করে গেছি ম্যাম।আর স্যারের মতো মানুষের জন্যে প্রান ভরে দোয়া করেছিলাম।আপনার বাবা অনেক খুশি হয়েছিলো সেদিন।বার বার ক্ষমা চাইছিলো স্যারের থেকে।স্যারের হাত ধরেও ক্ষমা চাইছিলো আর পাশে ঐ ভদ্রলোক সবটা দেখে খুশি হয়ে বলেছিলেন, ভাইজান আপনি সত্যি কপাল করে জামাই পেয়েছেন।মনে হয় আপনার চাচা ছিলো”

পাখি হতভম্বের ন্যায় বসে সামনে তাকিয়ে বলে,”ফুপা”
“হতে পারে ম্যাম।এরপর পরিবেশ পরিস্থিতি শান্ত হলে আমি আর রাশেদ নিজেদের ব্যপারে কথা বলি।উঠে আসার দিকে রাশেদকে বলি কয়টা ছবি উঠিয়ে দিতে।ও দেয়ও, পরে মেসে এসে দেখছিলাম আপনার বাবা আর শান স্যারের ছবিও এসেছে।”
“এই নিন ম্যাডাম”-বলে ফোনটা এগিয়ে দেয়

পাখি অনূভুতিহীন চাহনীতে ইকরার দিকে চেয়ে দূর্বল কন্ঠে বলে,”আগে কেন এসব বলো নি ইকরা”
“আসলে সরি ম্যাম, আমার সুযোগ হয় নি এসব বলার।ভেবেছিলাম হয়ত সমস্যা সমাধান হয়েছে তাই…”-আমতা আমতা করে বলে ইকরা।
এই মূহূর্তে পাখির কি করা উচিত কিছুই বুঝতেছে না ।শরীরটা নেতিয়ে পরছে যেন।নিজের শরীরের ভার টা বড্ডো ভারি লাগছে।টলমলে পায়ে উঠে দাঁড়িয়ে ইকরাকে বলে, “নিচে চলো”

পাখির অবস্থা দেখে ইকরা ভয় পেয়ে যায়।পাখির দুবাহু ধরতে গেলেই পাখি বলে,”লাগবে না।চলো!”
“ম্যাম আপনাকে দূর্বল লাগছে খুব।পারবেন না একা যেতে”
পাখি শুকনো হেসে বলে,”তোমার স্যারের কেবিন পর্যন্ত যেতে যে সময় লাগবে সে সময়টুকুই যেন অন্তত আল্লাহ্ আমায় বাঁচিয়ে রাখে”

আসক্তি পর্ব ৪৪