আসক্তি সিজন ২ গল্পের লিংক || আফিয়া আজাদ নিঝুম

আসক্তি সিজন ২ পর্ব ১
লেখায়ঃআফিয়া আজাদ নিঝুম

“ভাইয়া প্লিজ আমায় একটু সাহায্য করুন। আমায় হাইওয়ে অবধি একটু পৌঁছে দিন। আমার ভীষণ বিপদ।আপনার কাছে হাতজোড় অনুরোধ করছি ভাইয়া।দরকার পরলে পায়ে পরছি আমায় সাহায্য করুন”,হকচকিয়ে পিছনে দুইহাত দুরে সিটকে সরে যায় রাফি।দু’টা শুকনো ঢোক গিলে প্রশ্ন ছোড়ে,”আরে করছেন টা কি?কে আপনি?”

“ভাইয়া সব বলব আগে আমায় গাড়িতে উঠতে দিন”
রাফি বুঝতে পারে না এই মূহূর্তে কি করা উচিত তার।একে তো মেয়ে মানুষ তারউপর বিয়ের সাজে আগুন সুন্দরী যাকে বলে।
“রাফি,তোর হলো?পারবি তো নাকি মেকানিক ডাকব?”
রাফি একবার আগন্তুক মেয়েটিকে আগা-গোড়া পরোখ করে এগিয়ে যায় গাড়ির ব্যাক সিটে বসা গাড়ির মালিকের কাছে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

শান,ফয়সাল আহমেদ শান।পেশায় এমবিবিএস ডাক্তার।শহরে বেশ নাম ডাক রয়েছে এই ডাক্তারের।অল্পবয়েসে বেশ নামডাক কুড়িয়েছে যিনি।দেখতে যেমন সুন্দর তেমনই সুন্দর তার বাচনভঙ্গি।শুধুমাত্র তার অমায়িক বাচনভঙ্গির ফাঁদে ফেলে হাজারও কঠিন রোগের রোগীকেও তিনি মানসিকভাবে সুস্থ করতে পারেন।তবে রোগী ব্যতিত তিনি কারোর সাথেই প্রয়োজনের বাহিরে অতিরিক্ত টু শব্দটিও করে না।সবসময় চোয়াল শক্ত রাখে।বাহিরে থেকে দেখেই বুঝা যায় তিনি সবসময় রাগী মুডেই থাকেন। সাহস করে কেউ কখনোই তার কারণ জানতে চায় নি।কারণ তিনি রোগী ব্যাতিত অন্যসবার সাথেই স্বল্পভাষী ।

সিলেটের মৌলভীবাজারে কোন কাজে এসেছিল শান।কাজ সেড়ে বাড়ি পৌঁছাতেই বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে যায়।সাথে মাঝরাস্তায় তাদের গাড়িটাও খারাপ হয়ে যায়।ড্রাইভার রাফি গাড়ির সমস্যা খুঁজতেই বনেট তুলে ইঞ্জিন দেখার চেষ্টা করছে। হঠাৎ কোন মেয়েলি ডাকে চমকে পিছু ফিরে। বৌ এর সাজে একজন সুন্দরী মেয়েকে দেখে চোখ কপালে ওঠে রাফির।তাকে চমকে দিয়েই মেয়েটি হাতজোড় করে বার বার সাহায্যের আবেদন করে।

“ভাইয়া”,একটু ঝুঁকে শানকে সম্বোধন করে রাফি।
শান তখনো ব্লুটুথ কানে, কোলের উপর রাখা ল্যাপটপে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেই গমগমে স্বরে জবাব দেয়, “হুমম।হলো?”
“ভাইয়া একটা মেয়…”,বাকিটা আর বলতে পারে না রাফি।শানের টাইপিং বন্ধ দেখে শুকনো ঢোক গিলে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে।

রাফি পূনারায় গাড়ির সামনে মেয়েটির দিকে দেখে।ড্রাইভিং সিটটার পাশে জানালার কাছে বিপরীত দিকে মুখ করে মাথা উচিয়ে বার বার কিছু একটু দেখছে মেয়েটি।আর হাত মুচরাচ্ছে সমানতালে।
মেয়েটির অনুনয়মাখা মুখটা ভেবে রাফির বড্ডো মায়া হয়।তাই সমস্ত ভয়কে একপাশে রেখে শানকে বলে,”ভাইয়া একজন মেয়ে সাহায্য চাইছে।দেখে মনে হচ্ছে বিয়ে বাড়ির থেকে চলে এসেছে।বার বার বলছে হাইওয়ে অবধি……”

শান এবার ল্যাপটপের পার্ট শব্দ করেই নিচে নামিয়ে রাফির দিকে ঘুরে বলে,”তো?”
“না মানে বলছিলাম যে ভাইয়া….”
“গাড়ির কি সমস্যা?”,রাফির কথা শেষ করতে না দিয়েই শান ফিরতি প্রশ্ন করে।
“পানি ফুরিয়ে গেছে”,বিরসবদনে জবাব দেয় রাফি।

শান আবারও ল্যাপটপ খুলে চোখ গুঁজে বলে,”কাছেপিঠে কোথাও থেকে মিনারেল ওয়াটার নিয়ে আয়।কুলেন্ট ওয়াটার এই গ্রামে তো পাওয়া যাবে না।মিনারেলে কাজ চালাতে হবে।ফাস্ট”
রাফি শুকনো মুখে গাড়ির হুডের কাছে চলে আসে।বোতল টা হাতে নিতে শব্দ হতেই মেয়েটি পিছনে ফিরে বলে,”ভাইয়া কি হলো?আমায় সাহায্য করবেন না?বোঝার চেষ্টা করুন না প্লিজ।বেশি দেরি হলে আমার জীবনটাই শেষ হয়ে যাবে”

বলতে বলতেই এক পর্যায়ে কেঁদে ফেলে মেয়েটি।
রাফির ভীষণ মায়া হলো দেখে।হাত ইশারা করে বললো,”পিছনের সিটে ভাইয়া মানে গাড়ির মালিক বসা আছে।আপনি তাকে গিয়ে বলে দেখতে পারেন”
দূরে একটা এনার্জি বাল্বের ক্ষীন আলোয় বোঝা যায় সেটা হয়ত কোন চা’র দোকান হবে। আলো অনুসরন করে রাফি এগিয়ে যায় সেদিকে।

মৌলভীবাজারের এদিকটা বড্ডো গ্রাম্য;নিশুতি এলাকা।আশেপাশে দূর-দূরান্তেও কোন বাজার বা বাড়ি চোখে পড়ে না।রাস্তায় দু একটা সাইকেল,রিকশা বা মোটরবাইক ছাড়া কিছুই চোখে পড়ে না।
মেয়েটি পা টিপে সন্তর্পণে এগোতে লাগল গাড়ির ব্যাক সিটে বসা মানুষটার কাছে।এই মূহূর্তে কোন গাড়ি চলছে না রাস্তায়।চারিদিকে কেমন থমথমে ভাব।অন্ধকার নেমে এলো খানিক পূর্বেই।গাড়ির ভিতরেও তেমন আলো নেই।ভয়ে বুকের ধুকপুকানি শব্দটা বেড়ে যায়।তবুও যে করেই হোক আজ এই মূহূর্তে তাকে এলাকা ছাড়তে হবে।

আধখোলা জানালার গ্লাসটা চোখে পরলেও ভদ্রতার খাতিরে জানালায় দুটো নক করে মেয়েটি।গাড়ির ভিতর টা অন্ধকার।ল্যাপটপের স্ক্রিনের সাদা আলোতে মানুষটার মুখের ডান পাশটা চোখে পড়ে তার।দুবার নক করার পরেও কোন হেলদোল না পেয়ে আবার নক করে মেয়েটি।
শান আবারও পূর্বের ন্যায় টাইপিং বন্ধ করে কিন্তু মাথা তুলে তাকায় না।
“আমায় কি একটু হেল্প করবেন?বেশি না, হাইওয়ে অবধি”
ভিতর থেকে পুরুষালি গাঢ় মোটাস্বরে ভেসে আসে,”নো”

“কি মানুষ রে বাবা!একেবারেই নো?হুহহ?”,ভ্রুকুচকে যায় মেয়েটির।মুখে ভেঙচি কেটে আনমনে ভাবতে থাকে।
চারিদিকে আবার চোখ বুলিয়ে মেয়েটি গলায় দু’বার হালকা খাকার দিয়ে বলে,”দিন না প্লিইইই….”
“নো মানে না।বাংলা টা বলে দিলাম”,নির্লিপ্ত জবাব শানের।
মুখে বিরক্তিসূচক শব্দ করে মেয়েটি জানলা থেকে সরে আসে।

“কি করব এবার আমি?এতোক্ষনে তো ঐদিকে হৈহুল্লর পরে গেছে।যদি এলাকা না ছাড়তে পারি আমি তো বাঁচতে পারব না।কি করি, কি করি”,হতাশ হয়ে নখ খুঁটতে থাকে সে।কোন কূল কিনারা পায় না।মনে মনে শানের চৌদ্দগুষ্ঠির নামে প্রচুর গালি দিয়ে গাড়ি পাশ কাটিয়ে গাড়ির উল্টোপথে হাঁটা ধরে।
শান এবার মাথা তুলে তাকায়।জানলায় নজর ফেলে কাউকেই দেখতে পায় না।
“কোথায় গেলো মেয়েটা?এখনি তো ছিলো “,আনমনে ভেবে চাপাস্বরে বলে,”হোয়াটএভার”
আবার কিছু একটা টাইপিং এর কাজে লেগে পরে।

কিছুক্ষন পর রাফি এসে যায়। হাতে দুটো বড় বড় মিনারেল ওয়াটারের বোতল সমেত।এগিয়ে দেয় শানের দিকে,”ভাইয়া এই যে পানি”
শান এবার কান থেকে ব্লুটুথ টা খুলে ল্যাপটপ কোল থেকে নিচে রেখে গাড়ি থেকে নেমে পরে।বোতল দুটো নিয়ে এগিয়ে যায় বনেটের দিকে।বনেট খুলে ইঞ্জিনের রেডিয়েটরে পানি ঢালে।
এদিকে রাফি চোখ বুলিয়ে এদিক সেদিক মেয়েটিকে খুঁজতে থাকে।চোখ যতোদূর যায় সদ্য পিচ ঢালাই চকচকে সরকটার উপর ল্যাম্পপোস্টের আলোর প্রতিফলন খুঁজে পায়।

“মেয়েটা গেলো কই?ভাইয়াকে জিজ্ঞেসা করব একবার”
ভাবতেই শানের কথার শব্দে ভাবনায় ছেঁদ পরে রাফির।
“কমপ্লিট,যা স্টার্ট কর দেখি”,গাড়ির স্টেয়ারিং এর দিকে ইশারা করে বলে শান।
রাফির মাথা থেকে মেয়েটার ভাবনা মূহূর্তেই গায়েব হয়ে যায়।এগিয়ে যায় স্টেয়ারিং এর দিকে।
“ভাইয়া, হইছে ”
বিপরীত মুখী হয়ে শান ফোন টিপছিলো। রাফির কথায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে সে গাড়িতে এসে বসে।
গাড়ি ছুটে চলে ঢাকার উদ্দেশ্যে।

সিলেট থেকে ঢাকার দূরত্ব কম নয় ;বেশ খানিকটাই।দীর্ঘ ছয় থেকে সাত ঘন্টার দূরত্ব। জ্যাম থাকলে তো কথাই নেই।পুরো রাস্তায় শান ল্যাপটপে মুখ গুঁজে কিছু একটা করছে।রাফি সামনের রেয়ার মিররে শানকে পরপর দেখে ভাবতে থাকে,”একটা মানুষ কী করে এতোটা নিরস হতে পারে!সারাদিন খালি কাজ আর কাজ”

রাত তখন ১২ টা।সামনে তাকিয়ে গাড়ি চালাতেই হঠাৎই আগন্তুক মেয়েটার কথা মাথায় আসে রাফির।পূনারায় শানকে মিররে দেখে কিছু একটা বলতে চাওয়ার সুযোগ খোঁজে সে।
“কিছু বলবি? “,ল্যাপটপে দৃষ্টি রেখেই সাবলীল ভাবে প্রশ্ন করে শান।
হতভম্ব বনে যায় রাফি।অবাক বিষ্ময়ে ভাবতে থাকে ,”না তাকিয়ে কিভাবে বুঝল!”
“কিছু বলতে চাইলে বল,ওতো কিছু না ভেবে”

শানের স্বগতোক্তিতে রাফি চমকে উঠে বলে,”ভাইয়া তখনকার মেয়েটা….?”
“চলে গেছে”,থমথমে কন্ঠে জবাব দেয় শান।
কৌতূহলী রাফি ইচ্ছেকে দমাতে না পেরে রাস্তার দিকে তাকিয়ে বলে,”কোথায় গেলো ভাইয়া?খুব করে সাহায্য চাইছিলো”
শান এবার মাথা তুলে রাফির দিকে তাকায়। সন্দিহান মনে সরুচোখে সেদিকে চেয়ে থাকে।রাফি কয়েক সেকেন্ডের জন্যে মিররে তাকিয়ে পর পর কয়েকবার চোখের পলক ফেলে অপ্রস্তুত হয়ে বলে,”না মানে মেয়েটাকে দেখে সত্যিই মনে হয়েছিল বিপদে পরেছে তাই আর কি…”
মিলিয়ে যায় রাফির কথা।

“কোথায় গেছে, জানি না।”,বলে শান আবার কাজে মন দেয়।কিছু একটা ভেবে আবারও ল্যাপটপের পার্ট নামিয়ে রাফিকে তেড়ছা ভাবে বলে,”আচ্ছা তোর এতো প্রশ্ন কেন? বাই এ্যানি চাঞ্ছ তোর কি কিছু….”
“না না না, ভাইয়া। বিশ্বাস করো আমি চিনি না মেয়েটাকে”
“গাড়ি হসপিটালে নিবি।কাজ আছে। আমায় ড্রপ করে তুই চলে যাস”,রাফির কথার রেশ কাটিয়ে শান বলে।
সম্মতিসূচক ভঙ্গিতে রাফি জবাব দেয়,”আচ্ছা ভাইয়া”

ত্রিশ মিনিটের পথ অতিক্রম করে গাড়ি এসে পৌঁছায় হসপিটালের সামনে।ঢাকা শহরে এই সময়টাকে দিনের সন্ধ্যেবেলার সাথে তুলনা করা হয়।ঝাঁ চকচকে বিল্ডিং গুলো একের পর এক দাঁড়িয়ে আছে আপন দাম্ভিকতায়।রঙ্গচঙ্গে বাতির ঝলক চারিদিকে।
শান গাড়ি থেকে নেমে চাবি নিয়ে হসপিটালে ঢুকে পরে।রাফি রিকশা করে চলে যায় বাড়িতে।
হসপিটালে এখনো মানুষজনের আনাগোনা বেশ চোখে পরার মতো।শান গায়ের ব্লেজার টা খুলে হাতে ভাঁজ করে নেয়। চশমাটা একহাতে ঠিক করে করিডোর ধরে চলে আসে কেবিনে।উদ্দেশ্য হাতের কাজগুলো সেড়ে তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌঁছানো।আজ বড্ডো ক্লান্ত লাগছে তার।

কেবিনে এসে বসতে বসতেই রিনির আগমন।রিনি, শানের বন্ধু।তবে বন্ধু কম অযাচিত কলিগ বেশি।
শানের টেবিলের উপর দুই হাত টান টান করে হাস্যোজ্বল মুখে জিজ্ঞেসা করে, “কাজ কমপ্লিট হলো ডাক্তার সাহেবের?”
“হু”,গম্ভীরভাবে জবাব দেয় শান।
রিনি এগিয়ে এসে শানের পাশে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই বাজখাঁই গলায় শান বলে ওঠে,”তোমায় কতোবার বলেছি না আমার কেবিনে নক না করে আসবে না।আর আমার থেকে মিনিমাম তিন হাত দূরত্ব মেইনটেইন করবে।হোয়াট ইজ দিস?হোয়াট ইজ দিস?”

শেষের কথাটা বেশ রেগে বলে শান।
শানের মুখের রাগিভাবই বলে দেয় সে কতোটা বিরক্ত রিনির উপর।রিনি থমথমে মুখে বলে,”মেয়েদের প্রতি তোমার এতো ক্ষোভ কিসের বলতে পারো?নাকি নাম, যশ,খ্যাতির অহঙ্কার? নাকি রূপের?”
চোখ বন্ধ রেখে হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে শান নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রনের চেষ্টা করে। মুখ দিয়ে পর পর কয়েকবার নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,”রিনি আ’ম টু মাচ টায়ার্ড।প্লিজ ডোন্ট মেইক মি এ্যাংরি।গেট দ্যাট?”

টলমলে চোখে রিনি চেয়ে থাকে শানের দিকে।আজ প্রথম না এরকম বাজে ব্যবহার হসপিটালের প্রায় মহিলা ডাক্তার, নার্সরা পেয়ে থাকে।যারা কারণে অকারণে শানের কাছে ঘেঁষা চেষ্টা করে।
শান দরজার দেখি হাত ইশারা করে বলে,”হুমম”
রিনি এগিয়ে যায় সেদিকে।
এরপর শান নিজের কাজ সম্পন্ন করে গাড়ি স্টার্ট করে রওনা দেয় বাড়ির পথে।

“ইনায়াহ্ ঘুমিয়েছে?”
“জ্বি, স্যার। তবে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে।আপনাকে ছাড়া ঘুমাতে চায় নি মোটেই।”
শান ঠোঁটে সৌজন্যমূলক হাসি এলিয়ে বলে, “হুমমম।অনেক রাত হয়েছে আপনি রাতটা এখানে থাকুন।কাল ডিউটি শেষে স্যালারি টা সমেত বাড়ি ফিরিয়েন।”
“ওকে স্যার”

আসক্তি সিজন ২ পর্ব ২