আসক্তি সিজন ২ পর্ব ১৫

আসক্তি সিজন ২ পর্ব ১৫
লেখায়ঃআফিয়া আজাদ নিঝুম

পাখি চলে যাবার ত্রিশ মিনিট পার হয়ে গেছে।ঝড়বৃষ্টিও শুরু হয়েছে পরপরই।পুরো বাড়িতে শান একা।কেমন যেন অজানা কারণে চারিদিকে শূন্যতা অনূভব হচ্ছে আজ শানের।কি সে কারণ তা শত চেষ্টার পরেও বুঝতে পারছে না।বিবেকটা বার বার নাড়া দিয়ে উঠছে।
“মেয়েটা কোথায় গেলো?”

পরোক্ষণে ভাবে,”এ শহরের কাউকেই সে চেনে না ঘুরেফিরে এখানেই আসতে হবে”
চট করে মাথায় ভাবনা আসে,”আরে আমি কেন ওকে নিয়ে ভাবছি!ও কোথায় যাক যাক তাতে আমার কিচ্ছু আসে যায় না।এভাবে কোন নারীর প্রতি দূর্বল হওয়া আমার সাথে শোভা দেয় না”,ভাবতেই দাম্ভিকতার গাম্ভীর্য শানের চোখেমুখে স্পষ্ট হয়।তবুও বুকের কোন একটা জায়গায় কি যেন নেই নেই মনে হচ্ছে তার।
ঠোঁটে কটাক্ষের হাসি টেনে শান বিড়বিড় করে, “পরিবার বলতে আমি একা।আমার আমিত্বে আমি বরাবরই একাই রয়ে গেলাম”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ধীরপায়ে শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে যায়।সম্মুখে ইনায়াহ্’র ঘর চোখে পড়ে।এ ঘরে পাখিও থাকত।আনমনে ঘরের ভিতরে একবার নজর ফেলে শান।বেশ পরিপাটি ঘরটা কেমন জনশূন্য হয়ে পরে আছে।একাকিত্বে ইনায়াহ্’র অভাবটা বেশ ঝেঁকে ধরেছে শানকে।দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে চলে আসে।এরপর নিজের ঘরের দিকে হাঁটা ধরে।দরজা খুলে ভিতরে ঢোকে।একে একে গায়ের সব ড্রেস খুলে কাবার্ড থেকে টি-শার্ট আর ট্রাউজার পরে নেয়।গায়ের কাপড় গুলো খুলে রাখে ওয়াশরুমের বালতিতে।এরপর চোখেমুখে পানি ছিটিয়ে ফ্রেশ হয়ে ঘরে ঢোকে।পুরো বাড়িতে শান ব্যতিত কোন মানুষ নেই।কেমন যেন ভুতুরে বাড়ি মনে হয়।

তোয়ালেতে মুখ মুছতে মুছতে বিছানার সাইড টেবিলের উপর চোখ পড়ে শানের। ফুলদানির নিচে একটা সাদা কাগজ বাতাসের বেগে ফরফর করছে।ভ্রকুচকে সেদিকে এগিয়ে যায় শান।নিচ থেকে বের করে খুলে দেখে সেখানে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা,”রাতের ঔষধ রাখা আছে ওয়ারড্রোবের উপরের ঝুড়িটায়।মনে করে খেয়ে নিয়েন।আমি আসতে পারব না এ ঘরে ঔষধ খাওয়াতে”

ওয়ারড্রোবের উপরে চোখ ফেলে শানের কুঞ্চিত ভ্রুজোড়া সোজা হয়ে যায়।সত্যি সত্যি সেখানে তিনটা ঔষধ খুঁজে পায় শান।কেমন যেন পাখিকে এই সময় খুব মনে পড়ছে তার;সাথে গতরাতে তার দেয়া সেবাযত্ন গুলো।এরপর আনমনে রিমাইন্ড করতে থাকে গত কিছুদিন ধরে পাখির ব্যবহার গুলো।
সবটা বুঝতে শানের বেশিক্ষন সময় লাগে না।

“পাখির লজ্জা লজ্জা ভাব,আমারর প্রতি কেয়ারিং, চোখের দিকে না তাকিয়ে কথা বলা এসবই প্রমান করে সে আমার প্রতি দূর্বল।”,চোখেমুখে ভাবনার পরশ এঁকে ভাবে শান।পরোক্ষণে নিজেকে প্রশ্ন করে,”আর আমি!আমিও কি দূর্বল ওর প্রতি?নাহলে কেন ওকে নিয়ে এতো ভাবছি?আর কেন ওকে বের করে দিয়ে এতো গিল্টি ফিল হচ্ছে?”

“না না, এসব কিছু না।ইনায়াহ্ কষ্ট পাবে।সে জন্যে খারাপ লাগছে আমার।অন্য কিছু নয়।”,পরপরই মনকে বৃথা বুঝ বুঝায় শান।
“ওয়েট ওয়েট,শুধু কি ইনায়াহ্’র জন্যে?নাকি সত্যিই আমি পাখিকে ভালো…..
ইম্পসিবল।জাস্ট ইম্পসিবল।”,শানের মন মগজে দুধরনের চিন্তা ঘোড়পাক খাচ্ছে এই মূহূর্তে।সবটাকে ছিটকে ঝেড়ে ফেলে শান কাগজটা ভাঁজ করে ড্রয়ারে ফেলে রাখে।এরপর না খেয়েই ঘুমে বিভোর শ্রান্ত চোখদুটোকে প্রশান্তি দেয়।

পাখি সকাল সকাল ফ্রেশ হয় স্কুলে যাবার উদ্দেশ্যে।মন মস্তিস্ক ভালো নেই আজ।উদ্দেশ্য ইনায়াহ্’র সাথে শেষবার দেখা করে আজকেই সিলেট পৌঁছানো।রাখিদের সাথে তাদের গাড়ি করেই স্কুলে পৌঁছে যায় পাখি।স্কুলে ঢুকতেই গেইটের আড়াল থেকে ইনায়াহ্ দৌড়ে এসে বরাবরের ন্যায় কোমড় জড়িয়ে ধরে।পাখি পর পর কতোগুলো চুমু এঁকে কোলে তুলে নেয় ইনায়াহ্’কে। এরপর ক্লাসের দিকে চলে যায়।
“ম্যাম কিছু কথা ছিলো?”,প্রিন্সিপালের রুমে ঢুকে বলে পাখি।
হাস্যোজ্বল মুখে প্রিন্সিপাল ম্যাম সম্ভাষণ জানিয়ে ভিতরে ঢুকতে বলে। এরপর প্রয়োজনীয় কথা বলতে আশ্বস্ত করে পাখিকে।

“ম্যাম কিভাবে বলব,বুঝতেছি না।আসলে,ম্যাম….”
“আমি জানি তুমি কি বলতে চাও?”,ঠোঁটের হাসি এলিয়ে বলেন প্রিন্সিপাল রেহানা হক।অবাক চোখে পাখি তাকিয়ে থাকে।
রেহানা হক পাখির দিকে চেয়ে বলে,”গতরাতে তোমার ঘুমানোর পর রাখি আমায় সবটা বলে দেয়।ডোন্ট ওয়ারি বাচ্চা তোমার যতোদিন ইচ্ছে তুমি আমার বাড়িতে থাকো।আমার স্কুলে জব কন্টিনিও করো।তবু তোমায় আমি সিলেট যেতে দিবো না”,

“কিন্তু ম্যাম…. ”
“উহু কোন কিন্তু নয়।তোমার মনের অবস্থা ভালো নয়।চাইলে তুমি কিছুদিন বাড়িতে নিজের সাথে একাকিত্বে কিছুটা সময় কাটাও তারপর স্কুলে আসো।তবুও আমি তোমায় ছাড়ছি না”,পাখির কথাকে থামিয়ে দিয়ে বলে রেহানা হক।

প্রিন্সিপালের একরোখা কথায় পাখি বেশ বুঝতে পারে তিনি কখনোই তাকে ছাড়বে না।আর এদিকে এখানে থাকা মানে শানের ঘৃন্য স্মৃতি আঁকড়ে বেঁচে থাকা।খানিকটা দোটানায় পরে যায় পাখি।ভাবনায় পরে যায় সে।পাখির দিকে নজর বুলিয়ে রেহানা হক বলেন,”তুমি আজ বাসায় যাও।ক্লাস নিতে হবে না।ড্রাইভারকে বলছি তোমায় বাসায় দিয়ে আসবে।তুমি একা কিছুটা সময় কাটাও দেখবে ভালো লাগবে”
পাখি তার দিকে চেয়ে একটা স্মিত হাসি উপহার দেয়।
এরপর পাখি পূনরায় ফিরে আসে রাখিদের ফ্ল্যাটে।

এদিকে শান ঘুম থেকে উঠেছে মাত্র কিছুক্ষন আগে।হসপিটালের সময় চলে যাচ্ছে। রাতে কিছু খায় নি; ক্ষিদাও লেগেছে ভীষণ।তাড়াহুড়ো করে ঘর থেকে বের হয়ে নিচে নেমে আসে।গত দিন গুলোর মতো আজও অজান্তেই ডায়নিং এর চেয়ার টেনে বসে পরে শান।ভালো করে খেয়াল করে দেখে টেবিলের উপর জাস্ট প্লেট গুলোই উপর করে রাখা।পরোক্ষনে মনে পড়ে রাহেলা চাচি তো কাজে আসে না গত তিনদিন ধরে।তারপর পাখিও নেই।পাখির কথা মনে হতেই কেমন মূর্ছা যায় শান।পূনরায় শূন্য শূন্য লাগে নিজেকে।
ছটফট করে ওঠে বুকের ভেতর।

মুখে বিরক্তিসূচক শব্দ করে টেবিলে আঘাত করে শান।এরপর কোমড়ে এক হাত রাখে,আরেকটা হাতের দু আঙ্গুলে কপাল স্লাইড করে বিড়বিড় করে, “এরকম তো ছিলাম না আমি।হঠাৎ সবটা কেন এতো এলোমেলো লাগছে।কি নেই আমার কাছে?ইনায়াহ্!আজ একবার স্কুলে যাবো।ইনায়াহ্’কে নিয়ে আসতে হবে”

এরপর তাড়াহুড়ো করে দরজায় তালা মেরে বেরিয়ে আসে শান।রাফি গাড়ির কাছে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।রাফিকে দেখে শানের মনে পড়ে গাড়ির চাবি, ফোন কিছুই তার হাতে নেই।
পরোক্ষনে মনে হয়,”সবটাই তো আমার ঘরে।”

এরপর দৌঁড়ে সদর দরজার দিকে যেতেই বুঝতে পারে দরজায় তালা মেরেছে কিছুক্ষণ আগে।দুহাতের দিকে খেয়াল করে দেখে হাতে চাবি নেই।পকেট হাতরিয়েও চাবি খুঁজে পায় না।তালার দিকে একধ্যানে তাকিয়ে মনে করে চাবিটা সে ডায়নিং এর উপরেই রেখে দরজায় তালা মেরেছে।মেজাজ যেন চরমে উঠে যায় মূহূর্তে।রাগকে কন্ট্রোল করতে না পেরে দরজা বরাবর ডান পা দিয়ে পরপর কয়েকটা লাত্থি মারে শান।দরজার শব্দে দৌঁড়ে ছুটে আসে রাফি।

“ভাইয়া কি হয়েছে”,হন্তদন্ত হয়ে বলে সে।
“গাড়ির চাবি, ফোন সব বেডরুমে।দরজায় তালা মেরেছি চাবি ডায়নিং এ রেখে”,হাফিয়ে গিয়ে বলে শান।
কথার ফাঁকে ফাঁকে বাউন্ডারির চারিদিকে বার বার চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে শান।কোত্থাও পাখি আছে কিনা এই ভেবে।
” কোথাও নেই।তারমানে বাড়িতে ফেরে নি!”
ব্যর্থ চিত্তে ভাবে,”হোয়াটএভার। কোথায় গেছে গেছে”

রাফি অবাক হয়ে যায়।কারণ ইতোপূর্বে শানের এরকম ভুল কোনদিনও হয় নি।পরোক্ষনে ঠোঁটের কোণে বিজ্ঞের ন্যায় মুচকি হেসে আনমনে বলে,”কিছু তো একটা আছে । যা স্বীকার করতে চাইছে না আর না মানতে চাইছে”
“তুই গাধার মতো হাসতেছিস কিসের জন্যে?আমি কি কমেডি করতেছি এখানে”,রাফির দিকে সরু চোখে তাকিয়ে বলে শান।
রাফি হাসি কন্ট্রোল করে বলে,”ভাইয়া এর আগে তো কখনো এমন হয় নি!”
“তো?”
“না মানে, এতো ভুল!তাও একই সময়ে!”

“বেশি কথা না বলে ভারী কিছু নিয়ে আয় তালা ভাঙ্গতে হবে।সময় কম”,ঘড়ি দেখে তড়িঘড়ি করে বলে শান।
রাফি অনেক খোঁজাখুঁজির পর বাগানের একপাশে লোহার ভারী কিছু একটা দেখতে পায়।দৌঁড়ে গিয়ে সেটা নিয়ে এসে শানের হাতে দেয়।ঘড়ির দিকে চেয়ে শান সেটাকে তড়িৎগতিতে নিয়ে তালা বরাবর কয়েকটা বারি দেয়।চট করে খুলে যায় তালাটা।শেষ বারিটা দেয়ার সময় লোহার রডটার হাতে রাখা শেষ মাথাটা হাত ফসকে পরে যায় পায়ের উপর।দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথা সহ্য করার চেষ্টা করে শান।কুচকে যায় চোখমুখ।মুখে একটা স্লাং ইউজ করে বলে,”সব কি একই দিনে হতে হবে!”

এরপর দ্রুত হাঁটতে গিয়ে ব্যথায় টান পরে।খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সোফায় বসে। মোজা খুলে পা টা দেখার চেষ্টা করে।ফর্সা পায়ে গোলাকৃতির জায়গা। লাল রক্তের ছোপছোপ দাগ হয়ে আছে।মনে হচ্ছে চামড়া ফেটে বের হলে শান্তি লাগত।সেদিকে পাত্তা না দিয়ে শান সিঁড়ি বেয়ে নিজের ঘরে চলে যায়।প্রয়োজনীয় জিনিস সমেত নিচে নামে।এরপর বাড়ির চাবি সহ বাদ বকি সবকিছু পূনরায় চেইক করে দরজা লাগিয়ে বাহিরে চলে আসে।

“অলরেডি পনের মিনিট লেইট।ফাস্ট গাড়ি চালাবি।”,রাফিকে আদেশ করে শান ব্যথা পাওয়া জায়গাটা ডান হাতে আস্তে আস্তে বুলাতে থাকে।মোজা জুতা পায়ে রাখা কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে।তাই দ্রুত সেগুলো খুলে পা টা কে রিলিফ দেয়।গাড়ি এসে থামে হসপিটালের গেইটের সামনে।রাফি শানকে নামিয়ে গাড়ি পার্কিং জোনে নিয়ে যায়।গাড়ি থেকে নামতে না নামতেই কারো কল আসে ফোনে।রিসিভারে ক্লিক করে কানে নিয়ে ধীর পায়ে চলে যায় হসপিটালের ভিতরে।দারোয়ান শুরু করে সবাই প্রথম আজ গুড মর্নিং এর পরিবর্তে মজার হাসি উপহার দিচ্ছে শানকে।যেটা গায়ে জ্বালা ধরাচ্ছে তার।একরাশ বিরক্ত আর রাগ নিয়ে নিজের কেবিনে ঢুকে চেয়ারে বসে পরে।পা টা ভালো করে দেখে নেয়।

“আমার লাইফে এরকম একই দিনে এতো দূর্ঘটনার স্বীকার এর আগে কখনোই হয় নি।আজ কি হচ্ছে এসব”,পায়ে মেডিসিন লাগাতে লাগাতে বিরক্তি নিয়ে বিড়বিড় করে শান।

স্কুল থেকে ফ্ল্যাটে ফিরেছে পাখি।রাখির বিছানায় বসে দুহাতে হাঁটু জড়িয়ে নিঃশব্দ কেঁদে চলছে।
“আমার জীবন টা তো এমন ছিলো না।এর থেকে তো ভালো ছিলো রায়ানের সাথে বিয়ে হওয়াটা!আমি কি করে নতুন ভাবে এতোটা জড়িয়ে গেলাম ডাক্তারের সাথে?কখন হলো এসব?নিজের অজান্তেই কবে জায়গা দিলাম তাকে?”,এক ধ্যানে মেঝের টাইলসের দিকে তাকিয়ে ভাবছে পাখি।দুহাতে চোখের পানি মুছে বলে,”ভাগ্যিস সেটা এখন অপ্রকাশ্য।প্রকাশ করলে লজ্জায় মরে যেতাম আমি। আর তার অপমানেরও শেষ থাকত না।”

পায়ের ব্যথাটা টনটন করে উঠছে শানের।কিছুতেই স্থির থাকতে পারছে না শান।বাধ্য হয়ে দুপুরের আগেই ছুটি নিয়ে চলে আসে।রাফি গাড়ি ড্রাইভ করছে স্মুদলি।শান ব্যাকসিটে বসে ব্যথায় আহত পা টা সামনের সিটের ব্যাকসাইডে ঠেস দিয়ে বসে আছে।আর চোখেমুখে ব্যথার স্পষ্ট বলিরেখা বার বার ফুটিয়ে তুলছে।গাড়ি বাড়ির রাস্তা মুখো হতে না হতেই শান তড়িঘড়ি করে বলে,”গাড়ি ডানে নে।ইনায়াহ্’র স্কুলে”
রাফি কথামতো গাড়ি ডানে ঘুড়িয়ে স্কুলের দিকে নিয়ে যায়।
গাড়ি থেকে নেমে শান হাঁটার চেষ্টা করে কিন্তু পারে না।

“কষ্ট করে হলেও আজ ইনায়াহ্’কে একবার দেখে তবেই যাবো।নয়ত শান্তুি হচ্ছে না”,ভাবতে ভাবতে খুঁড়িয়ে এগিয়ে চলে অফিস কক্ষের দিকে।
রাখি সেদিকে একবার দেখে মুখ বাঁকিয়ে অন্য ক্লাসে চলে যায়।এমনি সময়ে শানের উপস্থিতিতে টিচার্সরা অনেক বেশি আগ্রহ দেখায়।আর আজ রাখির ব্যবহার শানকে বড্ডো ভাবাচ্ছে।গা ঝেড়ে এগিয়ে যায় ক্লাসের দিকে।উপস্থিত থাকা টিচারকে বলে বাহিরে আনে ইনায়াহ্’কে। এরপর বাহিরে রাখা বেঞ্চটার উপর ইনায়াহ্’কে কোলে নিয়ে বসে।আড়চোখে বার বার পাখিকে খোঁজে।কিন্তু কোথাও পায় না।এবার না চাইতেও বেশ দূঃচিন্তার রেশ চোখে মুখে দেখা যায় শানের।

“বাড়ির কোথাও নেই।স্কুলেও নেই।তাহলে গেলো কোথায় ও?”
ইনায়াহ্’র চোখে মুখে আদরের স্পর্শ এঁকে বাধ্য হয়ে জিজ্ঞেসা করে, “মাম্মাম তোমার মুন সাইন স্কুলে আসে নি”
সহাস্যে ইনায়াহ্ জবাব দেয়,”হ্যা তো এসেছিলো তো।আমায় অনেক অনেক আদোর করেছিলো তো।”
চারিদিকে চোখ বুলিয়ে ঠোঁট উল্টিয়ে ইনায়াহ্ বলে,”কোথায় যেন গেলো আবার।ও হ্যা একটু আগে ব্যাগ নিয়ে বাহিরে গেছে।আমি ক্লাসে ছিলাম তাই ডাকি নি ”

শান ইনায়াহ্কে কোল থেকে নামিয়ে ভাবে,”রাতে ছিলো কোথায় তবে?রাখিদের ওখানে!”,
“তোমার পায়ে কি হয়েছে সান সাইন”,ব্যথা পাওয়া পা টার দিকে চেয়ে ভয়ার্ত কন্ঠে বলে ইনায়াহ্।
“ও কিছু না মাম।একটু ব্যথা পেয়েছি।এবার বলো তুমি কবে আসবে?আমি তোমায় ছাড়া থাকতে পারছি না মা।কেন বুঝো না বলো তো”,ছোট বাচ্চাদের মতো ন্যাকাস্বরে টেনে টেনে বলে শান।ইনায়াহ্ হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেয়ে বলে,”দিদা যখন বলবে তখন”

শান হতাশ হয়ে ইনায়াহ্’র পেট জড়িয়ে ধরে বলে,”আই মিস ইউ গো মা”
“আই মিস টু “,শানের মাথাটা নিজের পেটের সাথে জড়িয়ে বলে ইনায়াহ্।
“ইনায়াহ্ ক্লাসে চলে আসো,ডায়েরি লিখার সময় হয়েছে”,ক্লাসের ভেতর থেকে ভেসে আসা টিচারের কথায় শান ইনায়াহ্’কে ছেড়ে বলে,”ক্লাসে যাও।আর তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে আসো, কেমন”

“আচ্ছা”,শানের কাপালে চুমু এঁকে বলে ইনায়াহ্।এরপর দৌঁড়ে ছুটে যায় ক্লাসের দিকে।
শান হাঁটতে হাঁটতে ভাবে,”একবার কি রাখিকে জিজ্ঞেসা করব পাখির কথা?ব্যপার টা উচিত হবে তো!”,
“কোন দরকার নাই।যখন স্কুলে আসতে পেরেছে তারমানে নিশ্চই কোন সেইফ জোনেই আছে।আমার কি!আই ডোন্ট কেয়ার ফর এনি উইমেন”,পরোক্ষনে নিজেকে ধাতস্ত করে গাড়ির কাছে চলে আসে।
শান আর ইনায়াহ্’র পিছনে আড়ালে দাঁড়িয়ে তাদের সম্পূর্ণ কথা শুনে ফেলে রাখি।এরপর নিজের ধারনা সত্যি হওয়ার পূর্বাভাসে রাজ্যজয়ের হাসি ফুটিয়ে তোলে ঠোঁটে।

পায়ের ব্যথার প্রয়োজনীয় কিছু মেডিসিন সমেত শান বাড়িতে ঢোকে।ধীরপায়ে এগিয়ে যেতে যেতে ভাবে,”ইনায়াহ্’কে দেখলাম আজ,আদোর করলাম।আর কোন সমস্যা নেই।এখন রিল্যাক্সে সময় কাটাতে পারব”
“আহহহ”,সোফায় বসতে পায়ে আবার টান পরে।রাগ যেন আর ধরেই না শানের।জোড়ে স্লাং একটা শব্দ ইউজ করে বাম পা দিয়ে সোফার কোনায় বারি মারে।নিজেই কিঞ্চিত ব্যথা পেয়ে দুহাত সিটকে আসে।চোখ মুখ কুচকে বলে,”পুরো দিনটাই না ব্যথায় ব্যথায় কাটাতে হয়!”

নিজের রান্না নিজে করা, বার বার সিঁড়ি ডিঙ্গিয়ে ওঠা নামা করা শানের কাছে আজ পাহারসম মনে হচ্ছে।কোন একজন হেল্পিং হ্যান্ডের অভাব বোধ করছে শান।মূহূর্তেই পাখির কথা মনে চলে আসে।পরশু রাতে কিভাবেই না মেয়েটা রাত জেগে সেবা করল তার!অথচ বিকেল হতে হতেই বাড়ি থেকে বের করে দিলো।তাও আবার অতো ঝড়বৃষ্টির রাত।ভাবতেই কেমন নিজের মাঝে অপরাধবোধ জেগে ওঠে শানের।চারিদিকে কেমন ফাঁকা ফাঁকা মনে হয় তার।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়। আজ যেন সময় গুলো কাটতেই চাইছে না শানের।ছন্নছাড়া লাগে নিজেকে।মনে হচ্ছে শরীরের মাঝে গুরুত্বপূর্ণ কিছু একটা নেই।
“ইনায়াহ’কে তো দেখে এলাম আজ।তাহলে আবার কেন এতো খারাপ লাগছে আমার।”,মাথার চুল দুহাতে চেপে ধরে বলে শান।
না চাইতেও বার বার পাখির কথা মনে পড়ছে। পাখির চোখ, মুখ,ঠোঁট,ঐ তিল সবটাই আজ নতুন করে আবিষ্কার করছে শান।কেন জানে না পাখির ভাবনাতে নিজেকে ডুবিয়ে রাখতে ভালো লাগছে তার।

বিছানায় এপাশ ওপাশ করেও কিছুতেই ঘুম চোখে আসছে না শানের।নিজের মনকে প্রশ্ন করে,”তাহলে আমি সত্যিই পাখিকে ভালোবেসে ফেললাম?এটা কি করে সম্ভব।আমি চাইলেও কোন নারীকে আনতে পারব না জীবনে।আর সেখানে পাখির মতো অসহায় কাউকে কী করে আনলাম?আমি কাউকে আগলে রাখতে পারি না আমার জীবনে।আমি কী করে পাখিকে আগলে রাখব?মাকে হারিয়েছি শেষমেশ নিজের ভালোবাসা!আমি কাউকে রাখতে পারি না।সবাই একটা সময় পর চলে যায় আমায় একা করে।”,

আসক্তি সিজন ২ পর্ব ১৪

ভাবতেই চোখের কোনা বেয়ে দুফোটা জল গড়িয়ে পরে শানের চোখ দিয়ে।
“উুহু,আমি পাখিকে জড়াতে চাই না আমার জীবনে।কিন্তু ওকে ছাড়া থাকতেও যে পারছি না।কী করব আমি?”,বিছানা ছেড়ে উঠে বসে দুহাতে মুখ চেপে বলে শান।
জানালার কাছে দাঁড়িয়ে পাখির মতো সড়কের দিকে চেয়ে দেখে শান।এরপর আকাশের দিকে মুখ করে অস্ফুট স্বরে বলে,”পাখি”

ঘুমন্ত মানুষ ধড়ফড়িয়ে ওঠে পাখি।ঘন ঘন শ্বাস নেয়।ওর অবস্থা দেখে রাখি ফোনে কথা বলা রেখে বেলকোনি থেকে দৌঁড়ে ঘরে ঢোকে।
“পাখি, কি হয়েছে?এই পাখি?”,গা ঝাঁকিয়ে ডাকে রাখি।
“পানি,পানি দাও একটু”,শুকনো ঢোক গিলে পানি চায় পাখি।
রাখি পানির গ্লাস এগিয়ে দিতেই পাখি চট করে সেটা কেড়ে নিয়ে দ্রুত পানিটা শেষ করে।মুখ মুছে ঠাঁয় বসে থাকে।
“এবার বলো তো কি হয়েছিলো?স্বপ্ন দেখেছিলে?”
পাখি অসহায় মুখ করে রাখির দিকে তাকায়।রাখি আশ্বস্ত করে বলে,”হুমম বলো?”

“ডাক্তার সাহেব মনে হয় ভালো নেই।একা….”,শেষের শব্দটা বেশ রিনরিনে কন্ঠে বলে পাখি।
রাখি বুঝতে পারে পাখির মনের অবস্থা।মাথা বুলিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,”ভালোবেসে ফেলেছিস।”
পাখি চমকে মাথা তুলে তাকায়।রাখি দুইবার মাথা উপর নিচ করে জবাব দেয়,”হুমম।ইট’স কল্ড লাভ।এবং তুমি ভালোবাসো ডাক্তারকে।আর এটাই মূল ফ্যাক্ট”
রাখির কথাকে নাকোচ করার কোন সুযোগ পায় না পাখি।কেঁদে ফেলে নিঃশব্দে।

আসক্তি সিজন ২ পর্ব ১৬